এক জীবনে অনেক জীবন পর্ব ২০

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২০)
*********************************

ঘুমের ওষুধ খেয়ে শোয়ার পরেও কিছুক্ষণ পরে তাবাসসুমের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল । তিনি উঠে বসেই অস্থির হয়ে জানতে চাইলেন –

জারা এসেছে ?

কায়সার মাত্রই জহির সাহেবের সাথে কথা শেষ করে রুমে ঢুকেছিলেন । তাবাসসুমকে উঠে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি কাছে এসে হাত ধরে বললেন –

জারা আসবে, জহির বলেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই খোঁজ পাওয়া যাবে । তুমি উঠে গেলে কেন ? মাত্র তো ভোর হলো, আরেকটু ঘুমাও ।

খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো ! একটা পুরো রাত পার হয়ে গেল তবুও তোমরা সবাই মিলে আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ করতে পারলে না ? এই ঢাকা শহরে চারিদিকে খারাপ লোক গিজগিজ করছে । আমার মেয়েটা এতো চালাক চতুরও তো না । কার পাল্লায় পড়বে আল্লাহ ই জানেন । তুমি ঘরে বসে আছো কেন এখনো ? জারা’র মোবাইলে ফোন দিয়েছিলে ?

কায়সার বুঝতে পারলেন তাবাসসুম হয়তো হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠার জন্য আর অতিরক্ত টেনশনের কারণে কিছুক্ষণ আগের বিষয়গুলো মনে করতে পারছেন না । তিনি বললেন –

জহির আমাকে এখনই ফোন করেছিল । জারা’র কিচ্ছু হয়নি । ও ভালো আছে । তুমি শোও তো, আরো কিছুক্ষণ ঘুমাও তাহলে একটু ভালো লাগবে । কথাগুলো বলে এক রকম জোর করেই তাবাসসুমকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলেন কায়সার ।

তাবাসসুম তাঁর পাশে ঘুমন্ত রোজাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন –

সিয়াম চলে গেছে ?

হুম চলে গেছে । ওর কাজ আছে সকালে ।

আর সবাই কোথায় ?

সবাই আছে, ঘুমিয়ে আছে তো এখন । তোমার চোখে কিন্তু ঘুম আছে এখনো, ঘুমটাকে নষ্ট কোরো না । তুমি ঘুম থেকে উঠলে আমরা কথা বলবো ।

তাবাসসুমের চোখ ভরা ঘুম ছিল তাই স্বামীর কথা শুনে শুয়ে চোখ বুঁজলেন আর অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেন আবারো ।

তাবাসসুম ঘুমিয়ে গেলে কায়সার রুমের দরজা টেনে বাইরে চলে এলেন । জহির সাহেবের পাঠানো ছবি আর এড্রেসটা বের করে দেখলেন তিনি । সাদাতকে ডাকতে গিয়েও ফিরে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে । ওর চেহারাটা দেখে এতো ক্লান্ত মনে হচ্ছিল যে ডাকতে গিয়েও আর ডাকতে ইচ্ছে করেনি । কায়সার আবার জারা’র রুমে আসলেন । তিনি আসলে এতটুকুও স্বস্তি পাচ্ছেন না । যদিও জহিরের কাছ থেকে পুরোটুকুই শুনেছেন কিন্তু নিজে যেয়ে সচক্ষে না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না কায়সার । এতক্ষণ ভাবছিলেন আদিত্যের খোঁজ পাওয়া গেলেই জারাকেও পাওয়া যাবে কিন্তু এখনো জারা’র কোনো খবর না পাওয়ায় খুব হতাশ হয়েছেন তিনি । বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে । তাঁর শুধু মনে হচ্ছে জারা যদি ও বাড়িতে না-ও থাকে, ও বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই জানেন তাঁদের ছেলে জারাকে নিয়ে কোথায় আছে । তিনি তাঁদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করবেন, জারা যদি আদিত্যের সাথে থেকে থাকে তাহলে তাঁরা যেন জারা কোথায় আছে এটুকু অন্তত জানায় ।

কায়সার এসে আলতো করে সাদাতের কাঁধে হাত রাখলেন । দু’বার ডাকার পর সাদাত চোখ মেলল । কায়সার বললেন –

তোমাকে বললাম বিছানায় যেয়ে ঘুমাতে অথচ তুমি এভাবেই কষ্ট করে ঘুমালে ।

অসুবিধা নেই খালু । আপনি ঘুমিয়েছিলেন ?

আমি ঘুমাবো, জারা ফিরুক । এতো অস্থিরতা নিয়ে ঘুম আসে বলো ? আমার বাচ্চাটা কোথায় কীভাবে আছে আমি এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না । আচ্ছা এই ছবিটা দেখো তো, এটা কী আদিত্য ?

সাদাত কায়সারের হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছবিটা দেখলো । রফিকের ইদানীংকার ছবি । স্কুলের সময় একেবারে শুকনো লিকলিকে ছিল । সে বললো –

জ্বি খালু, এটাই রফিক ।

হুম রফিক । তুমি তো বলেছিলে ওরা শেওড়াপাড়ায় থাকে কিন্তু জহির পাঠিয়েছে শ্যামলীর এড্রেস ।

ওহ তাহলে বোধহয় পরে শ্যামলী চলে এসেছে । স্কুলে থাকতে শেওড়াপাড়াতেই থাকতো ।

জহির গিয়েছিল ঐ ছেলের বাসায় । ওর বাবা-মা বলেছে কয়েকদিন ধরে সে না-কি বাসায় আসে না । আমার কী মনে হচ্ছে জানো ? তারা হয়তো জানে জারা কোথায় আছে । চলো না এখনই একবার যাই । আমি গিয়ে রিকোয়েস্ট করে ঠিক জেনে নেবো জারা’র কথা ।

খালু জহির আংকেল যখন বাড়ির ঠিকানা পেয়ে গেছেন তখন তিনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেন ।

না না আমি নিজে যেয়ে তাঁদের সাথে একবার কথা বলতে চাই ।

খালু এক কাজ করি, আমি যেয়ে দেখে আসি । আপনার যাওয়ার দরকার নেই । আপনি যেয়ে একটু রেস্ট নেন ।

সাদাত তুমি বুঝতে পারছো না……

খালু আপনার মতো করে আমি বুঝতে পারছি না । জারা না ফিরে আসা পর্যন্ত আপনার এই অস্থিরতা কমবে না কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না খালু । সব কাজই চালিয়ে নিতে হয় অল্প বেশি করে । আমিই বরং যাই । আমি রফিকের বাসায় যেয়ে কথা বলে আপনাকে ফোন করবো । এখন আর আসবো না খালু । ওখান থেকে বাসায় যেয়ে চেঞ্জ করে অফিসে যাবো ।

আজকে আর অফিসে যেও না সাদাত ।

কিন্তু ক্রিয়েটিভ প্রপার্টিসের কাগজগুলো আজকে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল । ওগুলো আমার ড্রয়ারে রয়ে গেছে ।

অসুবিধা নেই, আমি ফেরদৌসকে বলে দেবো ।

খালু চাবি তো আমার কাছে ।

অফিসে সব ড্রয়ারের ডুপ্লিকেট চাবি থাকে । ফেরদৌস কাজটা করে রাখবে । তুমি আজকে থাকো সাদাত । মনে একটু সাহস পাই তোমরা কাছে থাকলে ।

জ্বি খালু ঠিক আছে । আমি তাহলে যাই, গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি ।

যদি কোনোভাবে জারা’র খোঁজ পাও তাহলে সাথে সাথে আমাকে কল দিও সাদাত । আমি চলে আসবো ।

আচ্ছা খালু ।

.
.

রফিক তানভীরকে জিজ্ঞেস করলো –

আপা বলেছে এই কথা ? আর কী বলেছে ?

বেশি কিছু বলেনি, শুধু বললো যে পুলিশ ভদ্র ভাষায় ভয় দেখিয়ে গেছে । খুব টেনশন করছে সবাই কারণ তুই কী করেছিস, পুলিশ খোলাসা করে কিছুই বলেনি ওনাদের । শুধু এটুকু বলেছে যে তুই তোর সাধ্যের অনেক বাইরে হাত বাড়িয়েছিস ।

তুই আপাকে কিছু বলে দিসনি তো ?

আমি কী বলবো বল ? আপা তো জানেই তুই বাড়ি ছেড়ে আমার ওখানে উঠেছিস । সে জন্যই তো আমাকে ফোন দিলো । ভাগ্যিস আপা পুলিশের কাছে আমার নাম্বারটা দেয়নি তাহলে বিরাট বিপদ হয়ে যেতো । অবশ্য আপা না দিলেও পুলিশ ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে দেখিস ।

কী করে খুঁজবে বল ?

যখন খুঁজে পাবে তখন দেখিস । পুলিশ যেমন করে খড়ের গাদা থেকে সুঁই বের করে তেমন করেই খুঁজে বের করবে তোদের । ভাই রে ভাই কিসের মধ্যে যে পড়লাম ! আমার বাসায় যদি শুনে এই কাহিনি, আমার আম্মা নির্ঘাত মেরে ফেলবে আমাকে ।

তুই যে এতো ভিতু এটা আমি আগে বুঝিনি ।

আর তুই যে এতো বড় বাটপার আর ধুরন্ধর এটাও আমি আগে বুঝিনি ।

এই ব্যাটা তোর সাথে কী বাটপারি করলাম আমি ?

আমার সাথে করলে তো তোর খবর ছিল । এই যে মেয়েটার সাথে যে কাজটা করলি, এটা কোনো ভালো মানুষের কাজ ? আমি যেয়ে এখন জারা’র কাছে সব বলে দেই তারপর দেখবি ও কী করে তোর সাথে ?

ভয় দেখাচ্ছিস কেন রে ভাই ? এখন কিছু বুদ্ধি দে । কী করবো বল ।

শোন তুই যেয়ে মেয়েটাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয় । বিরাট অন্যায় তো এর মধ্যে করেই ফেলেছিস, এখন যদি বাঁচতে চাস তো মেয়েটাকে ভালোয় ভালোয় ওর বাসায় দিয়ে আয় ।

তুই কী পাগল না-কি রে ব্যাটা ? এখন আমি বাসায় দিতে যাই আর ধরা খেয়ে জেলে গিয়ে বসে থাকি ।

জেলে তুই এমনিতেও যাবি । জারা যখন তোর সত্যিটা জানতে পারবে, তোর কী মনে হয় ও সুবোধ বালিকার মতো তোর পিছে পিছে ঘুরবে ? তারচেয়ে এটা কর, ওকে বাসায় দিয়ে আয়, পরেরটা পরে দেখা যাবে ।

রফিক সোফায় বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো । তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো –

একটা উপকার করবি দোস্ত ?

কী ?

আমি এখান থেকে এখনই বেরিয়ে যাবো । তোর কাছে রিকোয়েস্ট, জারাকে একটা কথাও বলবি না আর আপা বা অন্য কেউও যদি ফোন করে তো বলবি যে তুই জানিস না আমি কোথায় ।

তুই কী জারাকে ওর বাসায় রেখে আসবি না রফিক?

সম্ভব না দোস্ত । এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে আর বাসায় রেখে আসার জন্য তো বিয়ে করিনি । দু-একদিন যাক, আমি ঠিকই ম্যানেজ করে নেবো আর তোরাও কোনো বিপদে পড়বি না , প্রমিস ।

তুই আমার কথাটা শুনবি ই না তাহলে ?

এখন আর সময় নাই রে । আমাদের বের হতে হবে । তুই কাফি আর রুদ্রকে কিছু বলিস না । কিছু টাকা হবে?

কতো ?

দে না যা দিবি । পরে দিয়ে দেবো ।

তানভীর মানিব্যাগ বের করে দেখলো অনেক টাকা আছে । এতো টাকা ওকে দেয়ার কোনো মানেই হয় না । দু’টো নোট বের জরে বললো –

দুই হাজারের বেশি হচ্ছে না এখন ।

টাকাটা হাতে নিয়ে রফিক তানভীরের হাত ধরে বললো –

প্লিজ দোস্ত তুই কাউকে কিছু বলিস না । একটু ম্যানেজ করে নিস ।

আবারো ভেবে দেখ রফিক । যেটা বললাম সেটা করলে তুই বেঁচে যেতিস আর মেয়েটাও বাঁচতো ।

আমি ফোনে তোর সাথে কথা বলবো তানভীর । দেরি হয়ে যাচ্ছে খুব ।

রফিক হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে দেখলো জারা শুয়ে আছে । জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো সে তারপর বললো –

জারা তোমার কী এখন একটু ভালো লাগছে ?

হুম, আগের চেয়ে বেটার ।

আচ্ছা শোনো এখানে একটু প্রবলেম হয়ে গেছে । একটু পরেই তো ওরা সবাই কাজে বেরিয়ে যাবে, তার ওপরে আবার কাফির আব্বা আসবেন আজকে ।

তো ?

তো খালু এসে আমাদের যদি এখানে দেখেন, না মানে আমরা এখানে থাকলে ওনার থাকার একটু সমস্যা হয়ে যাবে ।

তাহলে আমরা তোমাদের বাসায় চলে যাই ।

হ্যাঁ সেটাই বলছিলাম আমাদের এখন চলে যেতে হবে ।

আদি আমরা কী এখন তোমাদের বাসায় যাবো ?

সেটা আমি যেতে যেতে বলি জারা ।

আদি আমাদের বাসায় আব্বু মা দু’জনেই নিশ্চয়ই খুব টেনশনে আছেন । আমি একটা ফোন করে জানিয়ে দেই ?

কাকে ফোন করবে !

আপুকে অন্তত ফোন করতে দাও । আব্বু বা মা কারো সাথে কথা বলার সাহস আমার নেই । আপুকে ফোন করি প্লিজ ।

একটু পরে জারা, একটু পরে । আমরা আগে একটা জায়গায় পৌঁছে নেই তারপর ফোন দিয়ে তাঁদের জানিয়ে দিও ।

একটা জায়গা মানে ! আমরা এখন তোমাদের বাসায় যাবো না আদি ?

সেটাই বলবো, যেতে যেতে বলি । তুমি তোমার জিনিসপত্রগুলো সব গুছিয়ে নাও । আমি সিএনজি নিয়ে আসি ।

আদিত্য বেরিয়ে গেলে জারা ওর জিনিসপত্র সব ব্যাগে ভরে নিলো । পাঁচ মিনিটের মধ্যে আদি সিএনজি নিয়ে ফিরে এলো । ওরা রুম থেকে বের হতেই দেখলো তানভীর ড্রইংরুমে বসে আছে ।

তানভীর উঠে এসে আদির সাথে কোনো কথা না বলে জারাকে জিজ্ঞেস করলো –

এখন ঠিক আছো ?

জ্বি এখন ভালো লাগছে ।

ওষুধগুলো নিয়েছো ?

না নেইনি তো । টেবিলের ওপর রাখা আছে ।

ওগুলো নিয়ে যাও । আবার যদি জ্বর আসে তো কাজে লাগবে ।

জারা আদিত্যর দিকে তাকাতেই ও গিয়ে ওষুধগুলো নিয়ে এলো । তানভীর বললো –

তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না জারা ।

কোথায় ভাইয়া ! আপনারাই তো সব করলেন ।

আদি বললো –

যেতে হবে দোস্ত, সিএনজিওয়ালা হাউকাউ শুরু করে দেবে এখনই ।

তানভীর জারা’র মাথায় হাত রেখে বললো –

ভালো থেকো জারা । হয়তো আবার কখনো দেখা হবে ।

জারা মিষ্টি করে হেসে বললো –

নিশ্চয়ই দেখা হবে, আসি ভাইয়া ।

ওরা বেরিয়ে গেলে তানভীর মোবাইলটা হাতে নিয়ে মিনা আপাকে ফোন করেও কলটা কেটে দিলো । তার মন বলছে রফিকের কথাটা ওর বাসায় জানিয়ে দেয়া দরকার কিন্তু পরবর্তী জটিলতার কথা চিন্তা করে পিছিয়ে গেল সে । থানা-পুলিশ হলে যে বিপদটা আসবে সেটা ভেবে এখনই তার জ্বর চলে আসছে । দু’দিন পর যখন সবাই জানতে পারবে তখনই হবে যা হবার ।

.
.

ঠিকানা মিলিয়ে শ্যামলীর যে বাড়িটার সামনে দাঁড়ালো সাদাত সেই দোতলা বাড়িটার সদর দরজাটা খোলা । কাল রাতের নাম্বারটায় আবারো ফোন করলো সে । সেই নারী কন্ঠ ই আবার কথা বললেন । নিজেকে রফিকের বন্ধু পরিচয় দেয়ার পর একটু দোনোমোনো করলেও সেই নারী কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে এলেন । সাদাতের সামনে এসে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন –

তুমি রফিকের বন্ধু, ওর সাথে পড়তে ?

জ্বি আপা ।

কোথায়, কলেজের ?

না আপা , আমরা স্কুলে পড়তাম একসাথে ।

সাদাতের সাথে আরো দু’একটা কথা বলার পর মিনা তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল ।

বাসায় ঢুকেই সাদাত দেখলো রফিকের বাবা-মা ড্রইংরুমে বসে আছেন । রফিকের বাবাকে সে কোচিং-এ দেখেছিল কয়েকবার । চেহারাটা খুব একটা পাল্টায়নি শুধু বয়সটা বেড়েছে । সাদাতকে দেখে রফিকের মা উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন –

বাবা তুমি রফিকের খোঁজ জানো ?

না খালাম্মা, ও কী বাসায় নেই ?

না ওর আব্বার সাথে রাগ করে আজ কয়দিন হলো বাসায় আসে না ।

রফিকের আব্বার চেহারা দেখে সাদাত স্পষ্ট বুঝতে পারলো, অচেনা কারো কাছে নিজেদের বাড়ির কথা বলে দেয়ায় তিনি বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু রফিকের মা’র উতলা ভাব দেখে মনে হচ্ছে , মহিলা খুব টেনশনে আছেন ।

সে বললো –

রফিকের সাথে আমার কিছুদিন আগে হাসপাতালে দেখা হয়েছিল । ওর ছোট বোনকে….

হ্যাঁ আমার ছোট মেয়ে লীনাকে নিয়ে গিয়েছিল ।

জ্বি লীনা । আচ্ছা খালাম্মা রফিকের মোবাইল নাম্বারটা কী দেয়া যাবে ?

এবার রফিকের আব্বা কথা বললেন –

তুমি না ওর বন্ধু তাহলে তোমার কাছে ওর নাম্বার নেই কেন ?

নাম্বার তো ছিল খালু, ঐ নাম্বারে কাল রাতে আপার সাথে কথাও হয়েছে । সেদিন ওর নতুন নাম্বারটা আমাকে দিয়েছিল কিন্তু যে কাগজে লিখে রেখেছিলাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি ।

রফিকের মা এবার কেঁদে ফেললেন । ওনাকে কাঁদতে দেখে সাদাত খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল । উনি কাঁদতে কাঁদতেই বললেন –

খুব টেনশনে থাকি রে বাবা সবসময় । বাপ-ছেলের ঝগড়া লেগেই থাকে সারা বছর । আজকে আবার বাসায় পুলিশ আসলো, রফিক না-কি কোথায় কী করেছে । আমার তো বাবা ভয়ে জানটা শেষ হয়ে যাচ্ছে । কী এমন করলো আমার ছেলে যে বাসায় পুলিশ চলে আসলো ?

সাদাত বুঝতে পারছে না জারা’র বিষয়টা এখন বলা উচিত হবে কি-না । জারা’র কথা বললে তাঁরা যদি আর কোনো কথা না বলেন তাহলে তো কিছুই জানা হবে না ।

সে বললো –

আমাকে ফোন নাম্বারটা দেয়া যাবে ? আমাদের অন্য বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে দেখি ওরা কেউ রফিকের খবর জানে কি-না ।

এখনই ফোন করো বাবা । আমার ছেলেটা কোথায় আছে আমি জানতে চাই ।

বাধ্য হয়ে সাদাত নাফিজকেই ফোন দিলো । এক মিনিটে কথা শেষ করে বললো –

খালাম্মা নাফিজের সাথে তো ওর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল , ও হয়তো নাফিজের সাথে যোগাযোগ করবে । আমি কিছু জানতে পারলে আপনাদের ফোন করে জানিয়ে দেবো ।

রফিকের বোন এসে বললেন –

তুমি তানভীরকে চেনো না, ও তোমার বন্ধু না ? রফিক তো ইদানীং তানভীরের সাথেই থাকে সারাক্ষণ । ওর সাথে কী যেন বিজনেস শুরু করছে ।

জ্বি আপা তানভীরকে চিনি তো । স্কুলে থাকতে সবসময় রফিকের সাথেই থাকতো ।

কিন্তু তানভীর তো ওর সাথে কলেজে পড়েছে, স্কুলে তো পড়েনি । আচ্ছা রফিকের সাথে তোমার দরকারটা কী বলো তো ?

সাদাত নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বললো –

ও আচ্ছা কলেজের তানভীর , হ্যাঁ ওকেও তো চিনি তবে রফিকের বন্ধু হিসেবে । আপা স্কুলেও একজন তানভীর ছিল । আপনাদের শেওড়াপাড়ার বাড়ির কাছেই ওর বাসা ছিল । রফিককে লেখাপড়ায় খুব হেল্প করতো ।

ও আচ্ছা, আমার ঠিক খেয়াল নেই ওই তানভীরের কথা ।

রফিক আমাকে বলেছিল তানভীরের সাথে বিজনেস শুরু করবে, ঐ বিষয়েই আমার অফিসে আসার কথা ছিল ওর তানভীরকে সাথে নিয়ে । আপা রফিক আর তানভীর দু’জনের নাম্বারটা যদি দেন তাহলে আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করে ইনফরমেশনগুলো জানিয়ে দিতাম ।

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে কথার পিঠে কথা চালাচালির পর সাদাত রফিক আর তানভীরের নাম্বার নিয়ে বের হয়ে আসলো ঐ বাড়ি থেকে । বাইরে এসে সে কায়সারকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো খালু এর মধ্যেই পাঁচ বার ফোন করেছে তাকে । সাদাত তাঁকে ফোন দিয়ে বললো যে সে রফিকের ওখান থেকে সরাসরি ধানমন্ডির বাসাতেই চলে আসছে ৷

.

.

সিএনজি চলতে শুরু করলে জারা জিজ্ঞেস করলো –

আদি এদিকে আমরা কোথায় যাচ্ছি ? তোমাদের বাসা তো নিকুঞ্জে ।

হুম কিন্তু আমরা এখন বাসায় যাবো না জারা । একটু সমস্যা আছে ।

কেন তোমার বাসায় আবার কী সমস্যা ? তুমি তো বলেছিলে তোমাদের বাসায় কোনো প্রবলেম হবে না তাহলে আমরা তোমাদের বাসায় কেন যাচ্ছি না ?

আমার বাসায়ও হঠাৎ করে গেস্ট চলে এসেছে । গ্রামের বাড়ি থেকে আমার দাদা আর ছোট চাচা এসেছেন । এখন হুট করে যদি আমরা যেয়ে হাজির হই তখন তো দাদা জিজ্ঞেস করবেন তোমার কী পরিচয় । আমি তখন কী বলবো বলো ? আমার বাবা-মাকে ম্যানেজ করা কোনো বিষয়ই না কিন্তু দাদা তো আগের দিনের মানুষ, একমাত্র নাতির এভাবে বিয়ে হয়েছে শুনলে তিনি ভীষণ কষ্ট পাবেন । তাঁকে কষ্ট দেয়াটা কী ঠিক হবে বলো ?

আদি আমরা কী কাজটা ঠিক করলাম ? আমার এখন খুব ভয় লাগছে । মা যা রাগী, মা যখন জানতে পারবেন আমি বিয়ে করে ফেলেছি উনি যে কী করবেন ভাবতেই আমার শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠছে ।

এইসব টেনশন করে করে তুমি জ্বরটা এনেছো । আমি আছি তো তোমার সাথে জারা । আমি তোমার কিচ্ছু হতে দেবো না । ভরসা রেখো আমার ওপর, আমার ভালোবাসার ওপর ।

সিএনজি যেখান দিয়ে যাচ্ছে সে সব রাস্তাঘাটের সবকিছুই জারা’র অচেনা মনে হচ্ছে । এই জায়গায় সে আগে কখনো আসেনি । মহাসড়ক ছেড়ে সিএনজি একসময় ভেতরের সড়কে চলে এলো । জারা আদিকে জিজ্ঞেস করলো –

এটা কোন জায়গা আদি , আর কতক্ষণ সময় লাগবে ? আমরা কোথায় যাচ্ছি ?

গেলেই দেখতে পারবে, এই তো চলে এসেছি কাছাকাছি ।

অবশেষে সিএনজি এক সময় থামলো । জারা নেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো । সামনেই বড় একটা হোটেল, হোটেল আল মদিনা । যেটার গায়ে আরো লেখা আছে লেখা মির্জাপুর, টাঙ্গাইল ।………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here