এক প্রহরের খেলা, পর্ব:১৫+১৬

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৫||

নামাজের পাটিতে মাথা রেখে ডুকরে কাঁদায় মনটা অনেকটাই হালকা হয়ে এলো। অনেক কিছুই পরিস্কার করে ভাবতে পারছে এখন। গতরাতে আতঙ্ক এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে, মনে হচ্ছিল কিডন্যাপাররা এই বাড়ীর ভেতরেই যেন চলে আসবে ওকে নিতে। এক ঘন্টা শুধু কেঁদেই কাটিয়েছে সে। তারপর শায়লার বারংবারের সান্ত্বনা আর গরম চায়ের সাথে কুকিজ খেয়ে পেটের সাথে মনকেও শান্ত করেছে। তারপর শেষ রাতের দিকে জায়নামাজে বসে বাকি সময় পার করেছে। এখন অনেকটাই ফুরফুরে হয়ে আসছে মনটা।

জায়নামাজ ভাঁজ করে শায়লার দিকে তাকালো রুমকি । এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা । অবিবাহিত মেয়েরা সাধারণত এভাবে ঘুমায় না। কেবল বিবাহিতদের মধ্যেই এই ভঙ্গিটা দেখা যায়। শায়লা অবিবাহিত হলেও ওর ঘুমানোর ভঙ্গিটা একদম বিবাহিতদের মত । ওর এই অভ্যাসের কারণে রুমকির কিছুটা অসুবিধাই হয়েছে শুতে। অবশ্য রুমকি শুয়েছেই বা কতক্ষণ। চারটার দিকে বিছানায় পিঠটা লাগিয়েছিল কোনমতে। তাতেই শায়লার হাত আর পায়ের ধাক্কায় ওর পড়ে যাবার যোগাড় হয়েছে। ফলে খানিক গড়াগড়ি দিয়ে উঠেই পড়েছে রুমকি। এমনিতেও ওর গায়ে কেউ হাত পা তুলে দিলে ওর ঘুম হয়না। ঋভূর সাথে যে কয়দিন ছিলো তখন ওকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এর কারণটা প্রথমতঃ ঋভূদের খাটটা ছিলো বেশ বড়। দ্বিতীয়তঃ মাঝখানে কোলবালিশ আর কুশনের ব্যারিকেড থাকায় ঋভূর সাথে ধাক্কাধাক্কিতে যেতে হয়নি। তবে ঋভূ শোবার অভ্যাসও অনেকটা শায়লার মতোই। আর এটা সে টের পেয়েছে শেষের দিন। যেদিন ঋভূ আর ওর মাঝে নতুন এক প্রহরের জন্ম হয়েছিল। সেদিন ঋভূ নিজের জায়গা ফেলে রুমকির সাইডে চলে এসেছিল। শুধু চলে এসেই ক্ষান্ত দেয়নি রীতিমত পেটের ভেতর মুখ গুঁজে সমানে নাক ডাকছিল গন্ডারটা। রুমকি ঘুম ভেঙ্গে যতটা না চমকেছিল তারচে বেশী ভাবাবেগে ভেসে গিয়েছিল। ঋভূর অধিকারবোধের কাছে স্বেচ্ছা পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল রুমকির পোড়া মন।
সেদিনের ঐ এক প্রহরের খেলার ছোট্ট পরিসরে ঋভূ আর ওর মাঝে রচিত হয়েছিল এক অটুট সেতু বন্ধন। চোখে চোখে অনেক কথা বলে ফেলেছিল দুজন। তখনও জানত না ঠিক পরদিনই জীবন ওদের দুজনকে ছিটকে ফেলবে দু প্রান্তে। আজ ঋভূ ঢাকা আর সে ঝিনাইদহে। উপরন্তু গৃহহারা। ঋভূ জানতে পেলে কী করবে কে জানে। একছুটে হয়ত ঝিনাইদহ চলে আসবে। আর নয়ত ফোন করে করে পাগল করে দেবে। কে জানে, এ পর্যন্ত কতবার ফোন দিয়ে বসে আছে সে।

জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে ভাবনার রাজ্য ডুবে গিয়ে কাটিয়ে দিল সকালটা । আচমকা শায়লাদের পুরোনো দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে ঘোর কেটে গেল রুমকির। ঘড়ির দিকে তাকাল। ভোর ছয়টা বাজে। চোখ নামিয়ে আরেকবার শায়লাকে দেখল সে। বেঘোরে ঘুমুচ্ছে মেয়েটা। সম্ভবত ওর দেরী করে ওঠার অভ্যাস। অবশ্য গতরাতে দুজনে একরকম জেগেই কাটিয়েছে। রুমকিও তার এ যাবৎকালের সকল কথা বলে ফেলেছে পুরোনো বান্ধবীকে। শেষ রাতের দিকে শায়লা আর থাকতে পারেনি। শুয়ে পড়েছে। কিন্তু রুমকির চোখে এক ফোঁটা ঘুম ছিলো না। এক পর্যায়ে রাতটাকে দারুণ বিভীষিকাময় মনে হয়েছে রুমকির কাছে । ভয়ে আতঙ্কে কেঁদেই কাটিয়েছে অর্ধেক রাত। রাত তিনটার দিকে গা কাঁপাকাঁপি থামলেও বাবাকে ফোন করার কথা মনে হয়নি একবারও। তাছাড়া নিজের মোবাইল ফোনটা যে আগেই খুঁইয়ে বসেছিল। শায়লার ফোন নিয়ে যে খবরটা জানাবে সেই বুদ্ধিও তখন মাথায় আসেনি, এতোটাই উত্তেজিত ছিল তখন। এখন হঠাৎ মনে পড়লো, একটা ফোন করে অন্তত আব্বাকে ওর খবরটা জানিয়ে দেয়া দরকার। আর কাজটা অনায়াসেই শায়লার মোবাইল থেকেই করা যেতে পারে। আব্বা আম্মার কী অবস্থা কে জানে। হয়ত এতক্ষণে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে গেছেন দুজনে।

ভাবতে ভাবতেই শায়লার ফোনটা হাতে তুলে নিল রুমকি। খারাপ লাগলে কিছু করার নেই। এমনিতে অনুমতি ছাড়া কোনদিন কারো ফোন ব্যবহার করা তো দুরে থাক, ছুঁয়েও দেখেনি রুমকি । কিন্তু আজ শায়লার অনুমতি ছাড়াই ওর ফোনটা ব্যবহার করতে হবে ওকে। আর কারো নম্বর মুখস্ত না থাকলেও আব্বার নম্বরটা মুখস্ত আছে রুমকির। কারণ আব্বার অনেক পুরোনো সিম এটা।

দুরুদুরু বুকে ফোন করল রুমকি।
আব্বার নম্বরে ফোন করার সময় মনে হলো বুকের ভেতরে হার্ট এত জোরে বিট করছে যেন বাইরে থেকেই তার শব্দ শোনা যাবে।
দুটো রিংও হয়নি। তার আগেই ফোন রিসিভ করল কেউ। রুমকি তার মায়ের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ শুনতে পেল । আবেগে নিজেও কেঁদে ফেলল ।
-” আম্মা…। আমি রুমকি। ”

-” রুমকিই….? আমার রুমু….? তুই কোথায় আছিস রে মা। সারাটা রাত আমরা চিন্তায় শেষ। তোর আব্বা তো…..আচ্ছা, তোর কথা বল। তুই এখন আছিস কোথায় ? ”

-” আম্মা আমি ভালো আছি। নিরাপদে আছি আলহামদুলিল্লাহ। ”

-” আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর লাখ শোকর। আমার মনটা বলছিল যে আল্লাহ আমারে এত বড় বিপদে ফেলবেন না। নিশ্চয়ই একটা উপায় হবে। আল্লাহ সত্যি বড় মেহেরবান।”

-” আম্মা শোনো, আমি আমার বান্ধবী শায়লাদের বাড়িতে আছি। তুমি আব্বাকে চিন্তা করতে মানা করে দিয়ো। আর আম্মা, হ্যালো…! শোনো, ঢাকা থেকে আমার শ্বশুরবাড়ীর কেউ যদি ফোন করে, মানে তোমাদের জামাই যদি….!”

-” আরে জামাই তো ঝিনেদাতে…!” বলেই চুপ মেরে গেলেন রুমকির আম্মা। শব্দ তিনটা বোম ফাটাল যেন ফোনের ভেতর। রুমকি সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড কোন কথাই বলতে পারল না সে। ঋভূ ঝিনাইদহতে , তাও এই সাতসকালে ? এমন অবিশ্বাস্য কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সে। তারমানে ঋভূ রাতেই ঝিনাইদহ পৌঁছেছে এবং সেটা রুমকির ডাক্তারখানার উদ্দেশ্যে বেরোবার পর। কিন্তু কেন !!
তাহলে কী ঋভূ ওকে সারপ্রাইজড করতে চেয়েছিল ? আর উল্টো নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছে ? হায় আল্লাহ, তারমানে ঋভূ কী সব জানে ?

-” কীহ্…?” রুমকি কোনমতে উচ্চারণ করল।

-” হ্যা রে মা। সে গতরাতেই সব জাইনে গেসে।”

-” তাই নাকি ? শুনে কী বলল ও ? আচ্ছা, তার আগে তুমি ওকে কী বলেছ সেটা বলো তো ।”

-” আমার কী আর বলা লাগে ? সে তো সরাসরি এখানে আইসে ঐ আজাদের সামনেই পইড়েসে। আজাদ তোর বাপেরে ধরাধরি করে বাড়ী আইনি দিতে আইসেছিল। সে তো এমন দেখাচ্ছিল যেন সে এসবের কিছুই জানেনা। ও রূপম বাবাজির সাথে কী কথা বলছে তা তো আমি জানিনা তবে তোর জামাই বড় ভালো মানুষ মাশাআল্লাহ। সে ভেতরে আইসে আমার সাথেও কথা বইলে গেছে। চিন্তা করতি মানা করি গেসে। এরপর আর সারারাতে আর সে আসেনি। কোনো
ফোনও করেনি। তবে তোর দাদী আর চাচি শ্বাশুরী আইসেছিল। দেখা কইরে গেছে। তাের চাচী শ্বাশুরির কথার ছাঁচ আমার কাছে ভাল লাগেনি। একটু কেমন জানি বাঁকা ঠেকল। তোর কিডনাপের বিষয়টা তারা হয়ত ভালোভাবে নেয়নি। আল্লাহই জানে, তারা কী ভাবতিসে ! রূপমরেও তো আর সকালে দেখলাম না। চাচী আর দাদীর কথায় ছেলে ঘুরে গেল কি না কে জানে।”

-” না, মা। ঋভূ এমন ছেলে না। অন্তত আমি ওকে এই অল্প কয়েকদিনে যতটুকু জেনেছি, সে সব না জেনে আমাকে অবিশ্বাস করবে না। তাছাড়া ও যখন শুনবে আমি কিডন্যাপড হইনি তখন তো সে নিশ্চয়ই খুশি হবে।”

-” হ, তা তো আছেই। তবে আজাদ আমাগের বড় একটা ক্ষতি করি দিল। আল্লাহয় যেন ওরে এর জন্য উচিত শিক্ষা দেয়। সে আমার মেইয়ের ঘরে আগুন লাগাইসে। ওর ঘরেও যেন একদিন আগুন লাগে।”

-” থাক্, মা। বদদোয়া না দিয়ে হেদায়েতের দোয়াই করো। আল্লাহ তো তার রহমত দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েই দিয়েছেন । নইলে কী যে হতো। তবে এবার আমি আজাদ ভাইকে ছাড়বো না। সরাসরি ফুপির বাসায় যাব আর জিজ্ঞেস করব ওরা কী চায়। ওরা কী আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না কী দেবে না। দরকার হলে এবার লিখে দিয়ে আসব আমার নামের জমিটুকু। এই জমি নিয়ে ওরা মা ছেলে কবরে যাক। ওদের নিত্য এ অশান্তি আর নিতে পারছি না মা।”

-” আচ্ছা, ওসব পরে ভাবা যাবে। এখন শোন্, কাউরে কিছু বলার দরকার নাই। আর তুই একা আসিসনে খবরদার । আমি জামাইরে খবর দিচ্ছি। তোর বাবারে দিয়ে ফোন করায়ে তারে ডাইকে আনব। ওরে সাথে নিয়েই তোর বাবা তোরে আনতে যাবে। তুই একদম একা আসিস নে মা। ওরা গেলি পরে ওগের সাথেই ফিরবি। বুইজেছিস ? আর জামাইরে বলব, সে যেন আজই তোরে নিয়ে ঢাকা রওনা দেয়। এখানে আর একটা দিনও থাকার দরকার নাই।”

-” আচ্ছা, সে দেখা যাবে। এখন শোনো, তোমাদের জামাই যদি আমার সাথে ফোনে কথা বলতে চায় তাহলে ওকে এই নাম্বারে কল করতে বলে দিও। আমার মোবাইলটা তো গতরাতে হাত থেকে পরে গিয়ে হারিয়ে গেছে। আর চারিদিকের এত এত পেরেশানি যে, তোমাদের ফোন দিতেও ভুলে গিয়েছি। মাথা কাজ করছিল না একদম।”

-“থাক্, না দিয়ে ভালই করেছিস। আল্লাহ যা করে ভালর জন্যিই করে। রাত্রে তো আজাদ এখানে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। তোর বাবা যখন মাথা ঘুরায়ে পইরে গেছিল, তখন সে তারে ডাক্তার আইনে দেখাইসে। তুই ফোন দিলে সে শুনি ফেলাইত। আল্লাহর দয়া সবদিকেই বাঁচাইসে আমাদের। তবে আজাদের কথা কী আর বলব রে মা। মানুষের যে কত রূপ। কত দয়া দেখালো সে গতরাত্রে।”

-” থাক্, ওর কথা বাদ দাও। আমি এখন রাখি । শায়লার ফোনে এমনিতেই ব্যালান্স ছিল না। ওকে না জানিয়েই লোন নিয়েছি। লোন নিয়ে ফোন করেছি। আচ্ছা, আব্বা কোথায় মা ? ”

-” সে তো এখনও ঘুমে। ডাক্তার তারে ঘুমের সুঁই দিয়ে ঘুম পাড়ায়া গিইসে। বলসে আটটার দিকে ভাঙ্গবে। তাই তারে ডাকিনি।”

-” তাহলে থাক। আগেভাগেই ডাকার দরকার নেই। তুমি বরং আব্বাকে পাঠানোর আগে আমাকে একটা ফোন দিও এই নাম্বারে। তখন কথা বলে নেব আব্বার সাথে। ”

-” আচ্ছা, মা। সাবধানে থাকিস। রাখি।”

ফোন রেখে আরেক দফা লোনাজলে ভাসল রুমকি। অচেনা আনন্দ ঢেউ আছড়ে পড়ল হৃদয়ের বেলাভূমিতে। আহা, তার ঋভূ ঝিনাইদহে ? আজ ওর দেখা পাবে রুমকি ? কেমন হবে সেই পুনর্মিলন ? ঋভূ কী ওকে ফিরে পেয়ে অনেক খুশি হবে ? নাকি অভিমানে মুখ ভার করবে ? আম্মা বলছিল, ওর বড়চাচি নাকি রুমকির অন্তর্ধানকে ভালো চোখে দেখেন নি। এটা মেয়েলী প্রেজুডিস থেকেও হতে পারে। কিন্তু ঋভূও কী তাই ? সেও কী ধরে নিয়েছে রূমকি অপবিত্র হয়ে গেছে ? অপবিত্রতা কী আসলেই শুধু শরীরে ? যেসব নারী স্বামী ছত্রছায়ায় থেকে পরকীয়া করে বেড়ায়, তারা কী অযু গোসল করেও আদৌ পবিত্র ? রুমকি তো শরীরে মনে কেবল ঋভূকেই নিজের দাবিদার মেনে বসে আছে। আজাদ সে জায়গায় কোনদিনই পৌঁছুতে পারেনি। আর না কোনদিন পারবে। ঋভূ যদি সত্যিই ওকে ভুল বোঝে তাহলে যে রুমকি মরেই যাবে।
ভাবনাটা ওর চোখের পানি বাড়িয়ে দিল। খুব ইচ্ছে করছে সরাসরি ঋভূকে ফোন দিতে। কিন্তু প্রানপন চেষ্টা করেও ওর ফোন নম্বরটা স্মৃতিতে আনতে পারল না। এখন ঋভুর দিক থেকে ফোন আসার অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই রুমকির।

======

শহরের শেষ প্রান্তে এই পেট্রল পাম্পটাতে জটলা সবসময়ই কম। আজ তো আরো নিরব হয়ে আছে জায়গাটা। কারণ আজ পেট্রল পাম্পে তেল সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও আজ কোন হরতাল বা ধর্মঘট কিছুই নেই। আবার পেট্রোল বা অকটেনও ফুরিয়ে যায়নি। তারপরেও পাম্পের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। সম্ভবত আগত অতিথিদের জন্যেই এই ব্যবস্থা।

পাম্পের বাইরে বেশ কিছু মোটর বাইকের জটলা। তবে একে জটলা না বলাই ভাল কারণ প্রত্যেকেই বেশ দুরে দুরে অবস্থান নিয়েছে। ঢোকার মুখে একটা খোলা জিপের সাথে রয়েছে তিনটা বাইক। এক্সিটের সামনে আরো দুজন। বলা বাহুল্য এরা সবাই একই দলের লোক নয় । কারণ কারো সাথে কারো কথা নেই। সৌজন্য সাক্ষাতও না। তবে দুই দলই তটস্থ হয়ে আছে। কারল পাম্পের অফিস রুমের ভেতর তাদের দুই দলের নেতা মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের দুজনের সাথে নিজেদের একজন করে সঙ্গী রয়েছেন। আজাদের সাথে রয়েছে বেলাল। রাজনকে বাইরে দাঁড় করানো হয়েছে পরিস্থিতি নজরে রাখার জন্য। কে জানে, সমাদ্দারপুত্র আবার কোন ফাঁদ পেতে রেখেছে। তাই কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি আজাদ। সে আসার আগেই রাজন আর সায়মন বাইক নিয়ে টহল দিয়ে এখানকার আবহাওয়া দেখে গেছে। তারপরেই আজাদ স্বয়ং এসেছে। এর মিনিট পাঁচেক বাদেই এসেছে সমাদ্দার পুত্র। দুজনে এখন মুখোমুখি টেবিলে বসে আছে।
আজাদ এক নজরেই সমাদ্দার পুত্রকে যা দেখার দেখে নিল। ঈর্ষায় জ্বলে উঠল ওর সর্বাঙ্গ। এই কুলাঙ্গার অদিতির স্বামী হতে যাচ্ছে ? ছ্যাহ্…! না চেহারায় না স্বভাবে। আস্ত শিম্পাঞ্জী একটা। অদিতি কী মনে করে একে বিয়ে করতে রাজী হল। নাকি না দেখিয়েই রাজী করানো হয়েছে, কে জানে। এই ছেলের কোন গুণের কারণে সে এমন মেয়ের স্বামী হবার যোগ্যতা অর্জন করল তা আজাদের বুঝে আসছে না ।

সমাদ্দার পুত্রই প্রথম মুখ খুলল, ” আপনিই তাহলে আজাদ।? ”

-” সেরকমই তো জানি।”

-” হম। যাক, সরাসরি বলি। কত হলে কোন চুক্তিতে আসেন আপনি সেটা পরিস্কার করে বলুন ! এখানে কোন বার্গেনিং হবে না।”

-” কিসের চুক্তি ? ”

-” আহ্ ! যে কোন চুক্তি। আপনার রেট কত ? ”

আজাদের মেজাজটা স্বভাবতই হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।
রেগেমেগে বলে বসল, ” শুধু ভিজিটই নেই লাখ টাকা। এরপরে কাজ প্রসঙ্গ। আপনি তো আর ভিজিট দেবেন না। নাকি দেবেন ?”

-” দেব ! প্রয়োজনে ফি ও দেব।” ঠান্ডা আর স্থির শোনাল লোকটার কণ্ঠ। আজাদ বিস্মিত।

-” কী কারণে জানতে পারি ? আমাকে কী দরকার আপনার ? ”

-” বলছি তার আগে বলুন ইনি কে ? ” বেলালকে দেখিয়ে বলল সমাদ্দারপুত্র।

-” কাছের লোক। বলতে পারেন যা বলার।”

-” ওকে। তাহলে ভিজিট আর কাজ বাবদ পাঁচ লাখ দিচ্ছি।”

-” আপনার কেন মনে হল আমি গুন্ডামী করে পয়সা নেই ?

-” তাহলে কী ভাল কাজ করে পয়সা নেন ? “সমাদ্দার পুত্র পকেট হাতড়াতে গিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললে আজাদ থেমে গেল। সে বলল,

-” কাজটা কী জানতে পারি ? আমি কিন্তু এমনিতেই আপনার হবুবধূকে সরাসরি আপনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম । অযথাই….!”

-” লিসেন, সে আমার হবুবধু নয়। সে আমার বড় ভাইয়ের ফিয়ন্সে। আর তাকে আপনার গায়েব করে ফেলতে হবে। একদম গায়েব। খুঁজলেও লাশ পাওয়া যাবেনা এমন।” শান্ত স্বরে কথাগুলো বলল লোকটা।

আজাদ সামান্য ঝাঁকি খেয়েই স্থির হয়ে গেল। নিরবে তাকিয়ে রইল সামনে বসা নরপিশাচটার দিকে। বলছে কী এই হারামিটা ? গায়েব করে ফেলতে হবে কথাটার মানে কী ? সে কী অদিতিকে মেরে ফেলতে চায় ? কিন্তু কেন ? ”

চলবে….

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১৬|

আজ সকাল থেকেই মাথাটা ব্যথা অদিতির। আজাদের কথামত রুমের ভেতর থেকে লক করে দিয়ে টেবিলের ওপরেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে গত রাত আর পুরো সকালটা। ভাল করে হাত পা মেলে আরাম করে ঘুমাতে পারেনি বলেই কিনা কে জানে সমস্ত শরীরে খিঁচ ধরে আছে। এক অদ্ভুত জড়তা। নড়াচড়া করতে গেলেই যেন হাড় মটমট করে। তাই ঘুম ভাঙার পরেও টেবিলের উপরই পড়ে রইল কিছুক্ষণ। মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে আছে ওর। কে জানে আর কতদিন এই বন্দীত্ব মেনে নিতে হবে। যদিও এখন পর্যন্ত আজাদ নামের লোকটা ওর সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেনি কিন্তু তাই বলে যে পরেও করবেনা তার নিশ্চয়তা কী।
হঠাৎই ভীষণ কান্না পেল ওর। সবসময় জেনে এসেছে যা হয় ভালর জন্যই হয়। আল্লাহই জানে কোন ভালো আছে এতে। ভাবনাটা মনে আসতেই হিজাবটা টেনে তাতে মুখ গুঁজল অদিতি। ছিঁড়ে যাওয়ায় এটা আর ব্যবহার উপোযোগী নেই। তবু পরে থাকা। উপায়ও তো নেই। আজ সকালে এই ছেঁড়া হিজাবটা পড়েই ফজরের নামাজ আদায় করেছে অদিতি।সেদিনের টানাটানিতেই এটা ছিঁড়েছে। আজাদের সাথে এটা নিয়ে রাগারাগি করায় সে ক্ষমা চেয়ে আরেকটা এনে দিতে চেয়েছিল কিন্তু অদিতি রাজী হয়নি। সে কেন নেবে আরেক জনেরটা। আজাদের এসব আলগা খাতিরের মানে খুব ভালোই বোঝে অদিতি। পুরুষ মানুষ যখন উদারতা দেখায় তখন ধরে নিতে হবে মতলব খারাপ। জীবনে এই অভিজ্ঞতাটা বারবার হয় বলে অবচেতন মন থেকেই সতর্কতা এসে যায়। আজাদ তো সেই পুরুষ জাতিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সে আবার আলাদা হবে কেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের হাতের ভাঁজে মুখ গুঁজল। আর তখনই দরজায় উপর্যুপরি টোকার আওয়াজ পড়ল। আজাদ নামের লোকটার ডাকও শুনল একসাথেই। দ্রুত টেবিল ছেড়ে নামল অদিতি।
একটু আগেও দরোজায় নক করেছিল কেউ। তাতেই ঘুম ভেঙ্গেছিল অদিতির। পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে গড়িয়ে নামতেও যাচ্ছিল আরেকটু হলেই। তখনই মনে পড়েছিল যে এটা একটা টেবিল। এখন আর সেই ভুল হলো না।
সন্তর্পনে টেবিল থেকে নেমে হিজাবটা ঠিকঠাক করে নিল। আস্তে করে ডোর আনলক করেই দ্রুত পেছনে সরে গেল অদিতি। আজাদকে দেখা গেল। সে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই তাড়া দিল অদিতিকে।
-” এই যে, তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নিন। কুইক…! আমাদের দ্রুত এখান থেকে সরে পড়তে হবে। ওরা সবাই এখানকার ঠিকানা জেনে গেছে এতক্ষণে। কই আপনার ব্যাগ কই। সব গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলুন।” বলে আজাদ নিজেই টেবিলের ওপর নিচ খুঁজতে লাগল কিছু আছে কিনা দেখার জন্য। অদিতি এবার মহা ক্ষেপে গেল।
-” এসেই কী শুরু করেছেন আপনি ? কোথায় যাব আমি ? কেনই বা যাবো ? কারা সব জেনে ফেলেছে ? আর আমি আপনার সাথে কেন পালাব ? পালাবেন তো আপনি। হুঁহ্…এবার বুঝবেন কত ধানে কত চাল। আপনার জারি জুরি এবার খতম হবে। আমার সাথে চালাকি করে লাভ নেই। এখান থেকে একপাও নড়ছিনা আমি।” গড়গড় করে একটানে কথাগুলো বরে থামল অদিতি।

আজাদ রূঢ় স্বরে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” সুন্দর মেয়েদের মাথায় যে গোবর থাকে কথাটা এতদিন শুধু শুনেছি । আজ হাতেনাতে প্রমান পেলাম। আপনার সঙ্গে ইতরামি করার ইচ্ছে থাকলে এই রুমটাই যথেষ্ট ছিল। বাইরে যারা আছে সব আমার লোক আপনার স্বামীর পাঠানো লোক না। বুদ্ধু একটা। শুনুন, বিপদটা আমার না আপনার। আমি তো অলরেডী পাঁচলাখ টাকাও পেয়ে গেছি আপনাকে হাপিস করার জন্য। আপনার স্নেহের দেবর আপনাকে দুনিয়া থেকে হাওয়া করার প্ল্যান কষেছে। আগামী এক ঘন্টার মধ্যে তাকে ফোন করে জানাতে হবে যে আপনি খরচ হয়ে গেছেন। কাজেই এখুনি বের না হলে আপনি তো আপনি, আমি নিজেও বিপদে পড়ে যাব। এবার দয়া করে, তাড়াতাড়ি করুন। যা কথা বলার গাড়িতে গিয়ে বলবেন।”

অদিতি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর আপনমনেই ফিসফিস করে বলল, ” লিটন এতটা নিচে নামতে পারল ? শুধু কিছু সম্পত্তির জন্য ? ”
– ” কী বলছেন একা একা ? ”
-” নাহ্, কিছু না! ”
-” এখনই তো বললেন সম্পত্তির জন্য।”
বলেই আজাদের মনে হল দেরী হয়ে যাচ্ছে। সে তাড়া দিল অদিতিকে।
-” আচ্ছা, সব শুনব। আগে এখান থেকে সরে পড়া দরকার। বুঝতেই পারছেন। আপনাকে খতম করলে আমাকে আমার ডেরা ছেড়ে পালাতে হতো না। কিন্তু আপনার দেবর মহা ঘাগু বদমাশ। সে এরই মধ্যে লোক লাগিয়ে রেখেছে। এখানে আসার সময়ও তাদের ফলো করতে দেখেছি আমি। কিচ্ছু বলিনি। না দেখার ভান করে সোজা হেঁটে ঢুকে পড়েছি। লিটন হয়ত আর আধাঘন্টা অপেক্ষা করবে তারপরেই আপডেট জানতে চাইবে। কাজেই আমাদের যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। প্লিজ, আসুন।”
-” আমরা যে বেরুব ওরা দেখবেনা ? ”
আজাদ কাষ্ঠ হাসল। অদিতির ফাইল হাতে নিয়ে বলল, ” এতক্ষণে কথায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ দেখলাম। জি, ঠিকই বলেছেন। ওদের শ্যেন দৃষ্টি আছে আমাদের ওপর। তাই সামনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের জন্য। আমরা ছাদ টপকে পেছনের বাড়ীর গেট দিয়ে বেরুব। আমার লোকজনকেও কিছু জানাই নি। ওদের তিনজনকে তিন জায়গায় পাঠিয়েছি। একজনকে আপনার হিজাব কিনতে মার্কেটে, আরেকজনকে দুপুরের খাবার আনতে আর একজনকে আমার বাসায় বক্সগুলো ফেরত পাঠাতে। কাজেই ময়দান খালি। তাড়াতাড়ি চলুন।”
-” কিন্তু আপনি আমাকে বাঁচাতে চাইছেন কেন বুঝলাম না ? আর আমাকে পালাতেই বা হবে কেন ? আপনার সদিচ্ছা থাকলে আমার হবু স্বামীর কাছেই তো আমাকে তুলে দিতে পারেন। পালাব কেন আমি ? ” কিছুটা একরোখামির সুর অদিতির গলায়।
হাতের ফাইলটা এবার টেবিলে আছড়ে ফেলে দুহাত কোমড়ে রাখল আজাদ। খিস্তি আওড়াতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। পকেট থেকে ফোন বের করে অদিতির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
-” নিন, ফোন করেন আপনার জানের জান স্বামীকে। তাকে বলুন যে তার ভাই আপনাকে মারার জন্য লোক ভাড়া করেছে। তারপর দেখুন উনি কী বলে ?” অদিতি মোটেও ঘাবড়ালো না আজাদের কথায়। বরং সমান তেজেই জবাব দিয়ে বলল, ” সেটা করার জন্য আপনার ফোন দরকার হবে কেন। আমার ফোন থেকেই তো করতে পারি। আমার ফোন আমাকে ফেরত দিন।”
-” আপনার ফোন কোথায় তা আমি কী করে বলব? ” আজাদকে বোকা দেখাল।
-” এই গুন নিয়ে হয়েছেন গ্যাং লিডার ? আমার ফোন যদি আমার কাছে থাকত তাহলে কবেই আপনার খবর করে ফেলতাম। এটা তো আপনার ঐ অসভ্য চ্যালা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। থাকলে কী আমি রাতে শাহানকে ফোন করতাম না?”
-” শাহান কে ? ”
-” আমার ফিয়ন্সে। শাহান সমাদ্দার।”
-” ওহ্, আচ্ছা। তাহলে তো মুশকিল হলো। আমার লোকগুলোকে তো আমিই বাইরে পাঠিয়েছি কারণ আমি চাইনা ওরা জানুক আপনাকে নিয়ে আমি কোথায় যাচ্ছি। সেকারণেই ওদের সরিয়ে দিয়েছি। আপনি আমার সাথে চলুন, পরে ফোন নিয়ে নেয়া যাবে। শাহানের ফোন নম্বর মুখস্ত নেই আপনার? ”
-” আছে।”
-” গুড। চলুন। গাড়ীতে বসে ফোন দেবেন ওকে। এখন তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ। ”
-” আমি এখান থেকে এক পা’ও নড়বো না। আমি বুঝতে পারছি আপনার এই ডেরা শাহান বা আমার শ্বশুর জেনে ফেলেছে বলে আপনি চালাকি করে আমাকে এখান থেকে সরাতে চাচ্ছেন।”
রাগে আজাদের মুখ লাল হলো এবার। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আপনি অযথা দেরী করছেন। আপনি এভাবে যেতে না চাইলে আপনার মুখ আর হাত পা বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে হবে আমার। আর ওভাবে যদি বেরোই তাহলে আপনার দেবরের লোকেরাও আর সন্দেহ করবেনা। ভাববে আপনার গতি করতে নিয়ে যাচ্ছি। ঘটে বুদ্ধি থাকলে একবার হলেও ভাবতেন আপনার সাথে আমি পালাচ্ছি কেন। যাই হোক, যথেষ্ট হয়েছে। আপনাকে আর বোঝাতে পারবো না। এমনি যাবেন কী না বলুন। না কী কাঁধে তুলে নিতে হবে ?”
অদিতি ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল।
~`~`~`~`~

ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে রুমকি। প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ওটা বেজে উঠল। শায়লা দু’বার এসে তাগাদা দিয়ে গেছে ওকে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হবার জন্য কিন্তু রুমকির সেসব ইচ্ছে নেই। সে বাড়ী যেতে পারলে বাঁচে। ঋভূকে একনজর দেখার জন্য মনটা আকুলিবিকুলি করছে।
অমনিই ফোন বাজল। প্রথম রিঙেই ছোঁ মেরে ফোনটা তু্লে নিল রুমকি। বাবার কণ্ঠ শুনে কেঁদে ফেলল সে। তার একটু পরেই ঋভূর কণ্ঠে নিজের নাম শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। ওপাশে ঋভূ নিজেও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে। রুমকি বাবাকে শায়লাদের বাড়ীর লোকেশন বলে ফোন রেখে দিয়ে দ্রুত তৈরী হতে লাগল। শায়লা ঘরে ঢুকে অবাকই হলো,
-” কী রে, তুই কোথায় চললি ? ভাত খাবিনা ? ”
-” না রে, ও ঝিনাইদহ চলে এসেছে। আমাকে নিতে আসছে এখানে । এখন আমার গলা দিয়ে কিছুই নামবে না। ” বলেই শায়লার হাত ধরল রুমকি। ” তোর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই শায়লা। গতরাতে আমাকে আশ্রয় না দিলে কী যে হত।”
-” বাজে বকিস না। আমার জায়গায় তুই হলেও এটাই করতি।”
-” তোর ফোনের ব্যালেন্স ছিল না বলে লোন নিয়েছি। সেই লোনও শেষের দিকে। ইয়ে, তুই যদি কিছু মনে না করিস তবে আমার ব্যাগে টাকা আছে। মানে আম্মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলাম তো….!”
-” এবার কিন্তু তুই আমাকে অপমান করছিস।”

বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল রুমকি। ঋভূ ভেতরে আসেনি। সে নাকি বাইরে ক্যাবেই বসে আছে। রুমকি দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল। আব্দুল্লাহ মেয়েকে পেছনের সিটে জামাই এর সাথে বসিয়ে দিয়ে নিজে সামনে বসলেন। এদিকে রুমকির অবস্থা ধরা পড়া হরিনীর মত ! ঋভূর স্থির দৃষ্টির সামনে সংকুচিত হয়ে পড়ল বেচারী । সামনের সিটে বাবা আর চালক না থাকলে হয়ত এতক্ষণে ঋভুর বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু এখন শক্ত হয়ে বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই। হঠাৎই খেয়াল করল ঋভু ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে। প্রত্যুত্তরে রুমকি নিজের দু হাত দিয়ে ঋভুর হাতটা চেপে ধরল। ট্যাক্সি সবেগে ছুটে চলছে কাঞ্চন নগরের দিকে।
রুমকি কোনরকমে বলতে পারল, ” আগে আপানের সাথে দেখা করব, ঠিকআছে ? ”
-” কোন দরকার নেই।” ঋভূর মুখ শক্ত দেখালো।
=====

মুখ ভার করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অদিতি। একটু আগের কথা ভেবে গা কাঁপছে ওর। আজাদের বেপরোয়া আচরন ওকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ছাদ বেয়ে নামার ব্যপারটা। অদিতি কোনোদিন কল্পনাও করেনি যে ওকে কোনদিন কারো বাড়ীর ছাদ টপকে কার্ণিশ বেয়ে নিচে নামতে হবে আর চোরের মত কারো গেট খুলে রাস্তায় বেরোতে হবে । সেই বাড়ীটা থেকে বেরিয়ে ওরা মোড়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড়ানো দেখতে পেয়েছিল। অদিতিকে নিয়ে দ্রুত সেটাতে উঠে পড়েছিল আজাদ। গাড়ীটা কার বা ওখানে কে রেখে গেল সেসব তখনও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি অদিতির। আজাদ গাড়ীর নাক ঘুরিয়ে সোজা টান দিয়ে একেবারে মেইনরোডে বেরিয়ে পড়লে তবেই স্বাভাবিক হল। তার আগ পর্যন্ত ওকে বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছিল।

-” আপনার ফাদারের ঠিকানাটা বলুন ! তাঁর সাথে কথা বলব আমি।” হঠাৎ মুখ খুলল আজাদ।অদিতি হালকা নাক টানল, ” আমার বাবা- মা বেঁচে নেই। ”
-” অহ্..!” ঘাড় ফিরিয়ে একবার অদিতিকে দেখে বলল । ” তাহলে আপনার অভিভাবক কে ? অভিভাবক তো নিশ্চয়ই একজন আছে ? ”
-” অভিভাবক বলতে ঐ বড়মামাই। আমি তাঁর কাছেই মানুষ। ”
-” ও আচ্ছা, তার ঠিকানাই বলুন।”
-” তাঁকে তো আপনি চেনেন বলছেন। বাদল সমাদ্দার আমার বড়মামা । লিটন আর শাহান আমার আপন মামাত ভাই।”

আজাদ বিস্মিত চোখে কয়েকবার তাকাল অদিতির দিকে কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবে কোন মন্তব্য করলো না। কিছুক্ষণ পর মুখ দিয়ে হালকা শব্দ করে বলল, ” মাই গড। এ তো দেখি জিলাপির প্যাঁচ।”
-” মাই গড বলছেন কেন। গডের তো ফিমেল ভার্সন আছে, প্লুরালও আছে। যেটা আল্লাহ শব্দের নেই। আর আমরা জানি স্রষ্টা একজনই। কাজেই বলুন, মাই আল্লাহ।”
আজাদ পুনরায় সবিস্ময়ে মেয়েটাকে আরেকবার দেখল। মেয়েটাকে ঠিক বোঝা যায় না। এতবড় বিপদেও সে কেমন মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলছে সেটাই বিস্ময়। তবে এর কারণ এক হতে পারে সে আজাদের কথা সবটা বিশ্বাস করেনি, আর নয়ত সে জানতো যে এমনটা হবে। নইলে এত শান্ত কী করে।
-” শাহানের সাথে কী আপনার প্রেমের বিয়ে? স্যরি, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি।”
-” প্রেম কিনা জানি না। শাহান ভাইকে আমি বিশ্বাস করি।”
-” বাকিদের করেন না ? ”
-” মানে বড়মামা মামী আর লিটন ভাইকে?”
-” হম…?”
-” নাহ্। ” ছোট্ট করে উত্তর দিল অদিতি। আজাদ অপেক্ষা করছে। ওর মনে হল অদিতি আরো কিছু বলবে। আজাদের ধারণাকে সত্যি করে দিয়ে অদিতি বলতে লাগল, ” আমার নানাভাই আমার নামে কিছু প্রপার্টি ওসিয়ত করেছিলেন। মানে আমার আম্মার অংশটা তিনি পুরোটাই আমার নামে অসিয়ত করে দিয়ে গেছেন আর লিটনের তাতে মহা আপত্তি। আমাদের পারিবারিক একটা মজলিসে সে বলেই ফেলেছিল, আমাকে ঐ সম্পত্তি সে নিতে দেবেনা। এতদিন তার বাবা আমার যে ভরণ পোষণ করেছে ওতেই নাকি সব শোধ হয়ে গেছে। এই সম্পত্তি নাকি আমি কোনমতেই পাইনা। ”
আজাদ কোনো মন্তব্য করলো না।
অদিতি হালকা গলায় বলল, ” যেদিন রাতে আমি কিডন্যাপড হই সেদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল। আজ তার কারণ বুঝতে পারছি।”
-” কীরকম? “আজাদের কৌতুহলী হলো।
-” সেদিন আমার এন্ডোসকপি করার কথা ছিল বলে আমি আট ঘন্টা না খেয়ে অপেক্ষা করছিলাম। লিটন সেদিন বাসাতেই ছিল। সে আমাকে ডাক্তারখানা নিয়ে যাবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছিল কিন্তু মামী কৌশলে ব্যপারটা কাটিয়ে আমাকে লুকিয়ে একাই পাঠিয়ে দেন আর বলেন, ‘তুই যা, আমি শাহানকে বলব যেন তোকে গিয়ে নিয়ে আসে। তখনও ব্যপারটা বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মামী আমাকে লিটনের সাথে একা ছাড়তে ভয় পাচ্ছিলেন। তারমানে মামী ছোটছেলের উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারছিলেন না।”
-” হম। তারমানে আপনার মামী আপনাকে স্নেহই করেন দেখা যায়।”
-” তা জানিনা।” ঠোঁট ওল্টালো অদিতি। ” হয়ত ছেলেকে কোন ঝামেলায় পড়তে দিতে চান না। কারন মামী জানেন লিটন আমার প্রপার্টির জন্য কীরকম ক্ষেপে উঠেছে। ঐদিন সবার সামনে সে কথাটা বললে মামা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। কিন্তু লিটনের রাগ অন্যখানে। সে আমার সম্পত্তি সবটা শাহানের হাতে যেতে দিতে রাজী না তাই বিয়ের আগেই সে সম্পত্তির ঝামেলা শেষ করতে চায়। আর মামা মামী চান পুরো ব্যপারটা সিস্টেমেটিক ওয়েতে হোক। সমাজে মামার একটা রেপুটেশন আছে। তাছাড়া বউ হয়ে যাবার পর কোন মেয়েটাই বা নিজের স্বামীকে উপেক্ষা করে সম্পত্তি অন্যত্র খরচ করে। আমার সবকিছু এমনিতেও শাহানকে দিয়ে দিতে হত তাই মামা মামী শান্ত ছিলেন। কিন্তু লিটন তা মানতে রাজী না। সে সবসময় মুখের ওপরেই বলতো, আমার যেহেতু কোন ভাই নেই। তাই তারা দুই ভাই এর অংশীদার। শাহান একা কেন নেবে! এসব বলতো।”
-” শাহান কী বলে ? ”
-” ও এসব নিয়ে বেশী কথা বলতো না।”
-” হম, মিচকা শয়তান।” বিড়বিড় করল আজাদ। অদিতি ঘাড় ফেরাল, ” কী বললেন? ”
-” নাহ্ কিছু না। আচ্ছা, আপনি কী শতভাগ নিশ্চিত যে আপনার স্বামী লিটনকে বা আপনার শ্বশুরকে মনে মনে সাপোর্ট করে না? আমার তো আপনার হবুবরকেও সন্দেহ হয়।”
-” ন্….না, শাহান ভাল ছেলে। ওর মধ্যে এসব লোভ নেই।”
-” আর ইউ শিওর ? ”
-” হম, শিওর।”
-” তাহলে ছোটভাইকে সেদিন ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়নি কেন। মৌনতাও কিন্তু একরকম সম্মতি।”
-” না না…শাহানকে যতটুকু জানি তার মাঝে সম্পত্তির লোভ নেই।”
-” হম, জানাজানিটা তাহলে বেশ ভালোই হয়েছিল দেখছি। আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয়না যে আপনি প্রেম করেন। শুনেছি ইসলামে বিবাহপূর্ব প্রেম হারাম। ”
-” একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি প্রেম করেছি কে বলল আপনাকে। শাহানকে আমি অনেকদিন যাবৎ দেখে আসছি বলেই ওর সম্পর্কে এভাবে বলতে পারছি।”
-” তাই? আচ্ছা, মানলাম আপনার আইকিউ খুব শার্প। তা আমাকে দেখে কী মনে হয় আপনার ? বলুন তো।”
অদিতি তাকাল। এক ঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিয়ে স্বগোতক্তির সুরে বলল,
-” ভাল না। মাকাল ফল। বখাটে না হলে কেউ কাউকে কিডন্যাপ করে কেউ ?”
-” অন্য ফলও বলতে পারতেন। মাকালই কেন ? ‘
-” কারণ মাকাল দেখতে সুন্দর।” বলে রুমকি দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে বলল, ” ভাল কথা, আমার জায়গায় কাকে কিডন্যাপ করতে যাচ্ছিলেন আপনি ? ” বলে অদিতি তাকিয়ে রইল আজাদের দিকে। আজাদ জবাব দিলো না একথার।
অদিতি আপন মনেই মাথা নাড়ল, ” হম বুঝেছি। প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।”
-” এসব কথা ছাড়ুন আর আপনার ভালমানুষ হবুবরকে ফোন দিন। জিজ্ঞেস করুন, সে এখন কোথায় ? আরেকটা কথা, নিশ্চিত না হয়ে আমাদের অবস্থান বলবেন না। বলা যায়না, কথা লিটনের কানেও পৌঁছে যেতে পারে।”
– ” ফোনটা দেব কিভাবে শুনি ? আপনার লোকেরা তো প্রথমেই আমার মোবাইল ছিনতাই করেছে। এখনও সেটা ফেরত দেয়নি। ফোন থাকলে কী আর আপনারা এতক্ষণ আস্ত থাকতেন ? ”
-” ওহ্, আচ্ছা স্যরি। ” বলে আজাদ এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখেই বাম হাতে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল।
অদিতি ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিণ ওপেন করেই নিজেকে দেখে দারুণ চমকে গেল। আজাদ তখনও গভীর মনোযোগে পথের দু’ ধারে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। অদিতি সন্তর্পণে ছবিটা সরিয়ে দিয়ে কল অপারেটর অন করল। শাহানের নম্বর টিপে অপেক্ষা করল কয়েক সেকেন্ড। গাড়ী চালানোর ফাঁকে ফাঁকেই আজাদ অদিতির দিকে তাকাচ্ছে। অদিতি হঠাৎই সোজা হয়ে বসল, ” হ্যালো শাহান ? ”
-” কে অদিতি ? হ্যাঁ, কোথায় তুমি ? বাপ্পীর লোকজন তো তোমাকে ঐ হারামজাদার ডেরায় গিয়েও পায়নি। তাড়াতাড়ি বলো তুমি কোথায় ? আর এই ফোন নম্বর কার ?”
-” বলছি তার আগে বলো লিটন কোথায় ? তুমি কী জানো ও আমাকে মারার জন্য লোক লাগিয়েছে ? ”
-” অদিতি শোনো। ফোনে এসব কথার কোনো মানে নেই। লিটনকে আমরা সবাই জানি। তাছাড়া তোমার বা আমার দুজনের কারোই ঐ সম্পত্তির উপর লোভ নেই কাজেই সম্পত্তি টম্পত্তি বাদ। আমি লিটনকে ম্যানেজ করব। তুমি চলে আসো। তোমার সাথে কে আছে তাকে ফোন দাও।”
অদিতি আজাদের দিকে তাকাল। আজাদ তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলের ইশারায় বোঝাতে চাইল ওর নাম যেন না বলে। অদিতি কী বুঝল কে জানে। শান্ত গলায় বলল, ” লিটনকে কী বোঝাবে তুমি ? যে লোক শুধু সম্পত্তির জন্য আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করতে পারে তাকে কী দিয়ে বোঝাবে তুমি ? ”
-” দেখো অদিতি। একই পরিবারের মানুষ আমরা। দাঙ্গা হাঙ্গামা করে লাভ কী। তারচেয়ে আমি বলি কী। ও যা চায় ওকে দিয়ে দাও। মিটে যাক। তুমি আর আমি শান্তিতে থাকি।”
-” মানে ? ওর অন্যায় আব্দার মেনে নেবে তুমি ? ”
-” না নিয়ে উপায় কী বলো ? ও কীরকম ক্রেজী তা তো তুমি জানো। তবে ও তোমাকে মারতে চায় এটা মানতে পারছি না। তুমি বাড়ী এসো আগে। এখন কোথায় আছ তুমি ? ”
জবাব না দিয়ে কট করে ফোন কেটে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে মুখ ফিরিয়ে নিল অদিতি। আজাদও আর কোন কথা না বলে নিরবে ড্রাইভিং করতে লাগল। ফোনালাপের পুরোটা না শুনলেও অদিতির আচরণ তাকে বলে দিচ্ছে শাহানের ভূমিকা কী। হঠাৎ অদিতির নাক টানার শব্দে ঘাড় ফেরাল আজাদ। মৃদু শব্দে বলল, ” কাঁদছেন কেন? ”
-” শখে।”
-” শাহান কী বললো ? কমপ্রোমাইজ? ”
অদিতি জবাব দিতে পারলো না। কান্না এসে ওর গলা আটকে দিয়েছে। কেবল ওপর নিচ মাথা নাড়ল। তারপর ভেজা কণ্ঠে বলল, ” আমার যাবার কোন জায়গা নেই। নয়ত সোজা সেখানেই চলে যেতাম।”
-” আপনার বাকি রিলেটিভস ?”
-” তেমন কেউ নেই। এক চাচা দেশের বাইরে থাকেন। খালারা যার যার মত সংসারী। আমার হয়ে কথা বলার মত কেউ নেই। তাছাড়া বড়মামা প্রভাবশালী মানুষ। তাকে সবাই ভয় পায়। এমনিতে এক দুরসম্পর্কের আন্টি আছেন যিনি আমার মায়ের খুব ঘনিষ্ট বান্ধবী। আমার আম্মু বেঁচে থাকতে উনি প্রায়ই আমাদের বাড়ী আসতেন। শুনেছি উনি রাঙামাটি থাকেন কিন্তু কোথায় থাকেন তা জানি না।”
-” তার কাছে যেতে চান ? কোনো ফোন নম্বর আছে ? ”
-” আছে, আমার মোবাইলে। কিন্তু মোবাইল তো আপনার চ্যালাদের কাছে। ”
-” ওহ্ হো। আচ্ছা কার কাছে আছে, সাইমন না রাজন ? ”
-” নাম তো জানি না। প্রথম দিন যে আমার রুমের বাইরে পাহারায় ছিল তাদেরই একজন। যাকে কামড়েছি সে না। ”
-” ওহ্, আচ্ছা। রাজন ? কিন্তু রাজনকে পেতে হলে আবার গাড়ী ঘোরাতে হবে। আর কেউ নেই ? ”
-” না। রাজনকে বলুন না এখানে কোথাও এসে ফোনটা দিয়ে যেতে। তাহলে আমি সোজা আন্টির কাছে চলে যেতাম। আন্টির ছেলেমেয়ে কেউ নেই । আমাকে ভীষণ আদর করেন। মাঝেমধ্যে ফোন করে আমার খোঁজখবর নেন। আমাকে বরং রাঙামাটির বাসে তুলে দিন না প্লিজ ? ”
-” দাঁড়ান, দেখছি কী করা যায়। আজাদ গাড়ী ফুটপাথের একপাশে দাঁড় করালো। ফোনটা বের করে রাজনকে ফোন দিলে সে’ই ধরল।
-” হ্যালো রাজন।?
-” হ্যাঁ, বস, কোথায় আপনি ? আপনাকে তো ফোনে পাচ্ছিলাম না। এটা কার নাম্বার ? ”
-” যারই হোক আমার কথা শোন্। অদিতির ফোনটা তো তোর কাছে তাই না ? ওটা নিয়ে দেখা কর আমার সাথে।”
-” কী বলেন বস? এই ঝামেলার মধ্যে দেখা করবেন ? এদিকে লিটন হারামজাদা আমাদের নাকে দম করে ফেলেছে। আপনার খবর পাবার জন্য সে সায়মনকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাকে ধরার আগেই আমি আউট হয়ে গেছি। বেলালকেও জিজ্ঞেস করেছে সে সাফ বলে দিয়েছে সে এসবের কিছুই জানেনা। কিন্তু লিটনের মাথায় ভুত চেপেছে। সে অদিতিকে না পেলে শান্ত হবে না। বস্, এক কাজ করেন। যেখানেই থাকেন অন্তত ব্যাক কইরেন না। এদিকের পরিস্থিতিটা ঠান্ডা হতে দেন। আপাতত আপনি অদিতিকে ঝেড়ে ফেলে গা ঢাকা দেন। লিটন আপনার উপর মহা ক্ষ্যাপা।”
-” -“ওর ক্ষ্যাপামি টাকার জন্য। ওর টাকা ও পেয়ে গেলে আর ক্ষ্যাপা থাকবেনা। কিন্তু ফোনটা যে আমার খুবই দরকার রাজন।”
-” খুব দরকার ? উমমম, তাহলে এক কাজ করেন বস। পেট্রল পাম্পের কথা মনে আছে? সোজা পাম্পে চলে আসেন। ”
-” দেখিস, কোনো ঝামেলা যেন না হয়, সাবধানে আসিস।”
-” ওকে বাই বস্।”
ফোন কেটে দিয়ে সেটা ড্যাশবোর্ডে ছুঁড়ে মেরে দু হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান দিকে টার্ণ করে ফিরতি পথ ধরল আজাদ। অদিতি কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল, ” রাজনকে কতটুকু বিশ্বাস করেন আপনি? ”
আজাদ ফিরে তাকাল অদিতির দিকে। মৃদু শব্দে বলল, ” পরিমানটা এক ফোঁটার সামান্য বেশী। এই লাইনে বিশ্বাস বলে কিছু নেই। ”
-” তাহলে ওর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন যে ? ” অদিতি বিস্মিত।
-” ফোনটা তো দরকার।
-” শুধু ফোনের জন্য এতবড় ঝুঁকি নেবেন?”
-” উঁহু, আপনার জন্য।”
অদিতি বিস্ময়াহত চোখে চেয়ে রইল। আজাদ তাকাল না। বলে চলল,” আমার ভুলেই আজ আপনি ঘরছাড়া। আপনাকে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়া এখন আমার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। আপনার একটা গতি করতে পারলেই আমার মুক্তি। তারপর আরেকটা বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে চাই।”
-” কী সেটা জানতে পারি ? ”
-” হম, পারেন। সে হলো আমার মামাত বোন রুমকি। যাকে আমি সম্পত্তির জন্য কিডন্যাপ করতে যাচ্ছিলাম।”
অদিতি স্তম্ভিত। আজাদও নিরব। গাড়ীর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অদিতি হঠাৎ বলল, ” আপনি রুমকিকে ভালোবাসতেন নাকি শুধুই সম্পত্তি ? ”
আজাদ জবাব দিলো না। অদিতির নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা বাড়ল। রেগে গিয়ে বলল,
-” তারমানে আপনি নিজেই আরেকটা লিটন। আর আপনি বাঁচানোর ভান ধরেছেন আমাকে ? আপনাকে তো গুলি করে মারা উচিত।”
আজাদ কোন কথা না বলে বাম পকেট থেকে রিভলবার বের করে ড্যাশবোর্ডের উপর রাখল। গাড়ীটা পেট্রল পাম্পের কাছাকাছি চলে এসেছে। আজাদ স্টিয়ারিং মুচড়ে বলল, ” যে কোন সময় এটা ব্যবহার করতে পারেন। একটাই গুলি আছে। এতোকিছুর পর আমার নিজেরও বেঁচে থাকার ইচ্ছে ফুরিয়ে আসছে। তবে মৃত্যুটা মায়ের সামনে হলে ভালো হতো। তাকে দেখাতে পারতাম যে, দেখো, কী কুলাঙ্গার তৈরী করেছ। যে আজ একজন সামান্য নারীর ভালবাসাও দাবী করার যোগ্যতা রাখেনা। ”
গাড়ী পেট্রল পাম্প থেকে একটু দুরেই থামল। আজাদ গাড়ী থেকে নামার আগে অদিতিকে সতর্ক করল, ” বসুন আমি আসছি।’
-” যাবেন না প্লিজ।”
-” আবার কী হলো?”
-” যদি আপনার কিছু হয়?’
-” কিচ্ছু হবেনা। আর যাই ঘটুক না কেন আপনি গাড়ী ছেড়ে নামবেন না। বেচাল দেখলে পেছনের রোড ধরে সোজা বাসস্ট্যান্ড চলে যাবেন। এখান থেকে চট্টগ্রামের বাস পাবেন, তবে রাঙামাটির পাবেন না। কাজেই সোজা চট্টগ্রাম চলে যাবেন। সেখান থেকে রাঙামাটি। আর একটা অনুরোধ। নিজেকে নিকাবে ভাল করে ঢেকে নেবেন। যেন আর কেউ ঐ মুখ দেখে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা না ভাবে।”
আজাদ বেরিয়ে যেতে ধরলে অদিতি ফের পেছন থেকে ডাকল,” শুনুন। আমার ফোনের দরকার নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে এখানে কোন একটা ঝামেলা হবে। প্লিজ, ফিরে চলুন। যে পথে যাচ্ছিলাম সেদিকেই যাই।”
-” সেদিকের গন্তব্য যে অনির্দিষ্ট।”
-” হোক, তবু যথার্থ সঙ্গী পেলে সমস্ত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করা যায়। আপনার দায়িত্ব আমাকে রাঙামাটি পৌঁছে দেয়া।”
আজাদ গাড়ীর দরজা খুলে একপা বের করে রেখেছে। ভাবছে কিছু। তার কিছু বলার আগেই আচমকা “বিইং” করে ধাতব একটা শব্দ হলো। আজাদ ভীষণভাবে চমকে উঠে দ্রুত গাড়ীর দরজা বন্ধ করল। প্রায় সাথে সাথেই আরো দুটো গুলি। যার একটা সরাসরি ভেদ করে গেল আজাদের বাহুতে ।

পরের পর্বে সমাপ্য….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here