এক ফাগুনের গল্প পর্ব ১৩

#এক_ফাগুনের_গল্প
#পর্বঃ-১৩

বাগানের মধ্যে অনেক মানুষের ভিড়, সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে আমরাই মনে হয় সবার শেষে দেখতে এসেছি। রাতে মনে হয় বৃষ্টি পরেছে ভিজে মাটি দেখে সেটাই মনে হয়, আর তাছাড়া যায়গা যায়গা পানি জমা হয়ে গেছে।

লাশের অবস্থা খারাপ, পিছন থেকে কেউ একজন ছুরি মেরেছে, বাঁচার জন্য সামিহা চেষ্টা করেছে তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে। যেখানে বসে ছুরি মারা হয়েছে তার খানিকটা দুরে লাশ পরে আছে। রক্ত দুজায়গা পরেছে, নিজের হাত দিয়ে সে ছুরি বের করার চেষ্টা করেছে মনে হয়। কারণ ডান হাত দিয়ে পিছনে ছুরি ধরতে গিয়ে হাতের কব্জি ও কনুই উভয় স্থানে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। মনে হয় যেভাবে পরে ছিল ঠিক সেভাবেই পরে আছে, কেউ ধরতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনার মধ্যে নেই। আজকাল শহরের মতো গ্রামের মানুষও চালাক হয়ে গেছে, তারা প্রায় টিভিতে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডি, আদালত ইত্যাদি দেখতে দেখতে অনেক সচেতন হয়ে গেছে। কেউ খুন হলে তাকে স্পর্শ করা যে ঠিক হবে না সেটা এখন বেশিরভাগ মানুষ জানেন।

বাগানের মধ্যে অনেক গাছপালার সমাহার, একটা গাছে অনেক গুলো আম দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে তিনটা আম পেকে হলুদ রঙের হয়ে গেছে কিন্তু সেই আমের দিকে কেউ দেখছে না। সবার কাছে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে খুনের রহস্য।

এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম মোহনা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ডান হাত ধরে আছে, আমার হাত এতটা শক্ত করে ধরেছে এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। মরিয়ম এর চোখে পানি টলমল করছে, তার সমবয়সী মেয়ে তাই তার সাথে হয়তো ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। মোহনার খালু একটা চেয়ার পেতে বসে আছে, একটা মেয়ে খুন হয়ে গেছে তবুও সে তার চেয়ারম্যানি ভুলে না গিয়ে বরং সবার মধ্যে চেয়ার পেতে বসেছেন। গ্রামের চেয়ারম্যান চেয়ার পেতে বসে আছে আহ এর চেয়ে বাস্তবতা আর কি আছে?

|
|

পুলিশের মধ্যে যিনি সবার কাছে খুটিনাটি জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন তার বয়স বেশি নয়। আমার চেয়ে খুব বেশি বড় হবে না ৬/৭ বছর হতে পারে তার বেশি হবার সম্ভবনা নেই। পুলিশ যখন চেয়ারম্যান আঙ্কেল এর কাছে জিজ্ঞেস করছিলেন তখন সামিহার সম্পুর্ন পরিচয় জানতে পারলাম। গতকাল যদিও সামিহা বলেছিল যে সে এ বাড়িতে আশ্রিতা তবে সম্পুর্ন পরিচয় জানলাম মাত্র।

সামিহার মা-বাবার বাড়ি পাশের গ্রামে, তার বাবা দীর্ঘদিন যাবত চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন তারা পরিবারসহ সদর উপজেলা থেকে ফেরার পথে এক্সিডেন্ট ঘটে। তখন মা-বাবা মারা যায়, চেয়ারম্যান আঙ্কেল তাকে এ বাড়ি নিয়ে আসে। নিজের মেয়েদের সাথে সবসময় মিশতে দিতেন, মরিয়ম ও তার বড় আপু (যার বিয়ে) সাজেদা সামিহাকে খুব পছন্দ করতেন। কাজেই নিজের পরিবার হারিয়ে সে আরেকটা নতুন পরিবার পেয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা রাতের আধারে নিস্তব্ধ বাগানের মধ্যে এভাবে তাকে বিদায় করে দিল সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। সামিহা ডিগ্রিতে পড়াশোনা করতো, মা-বাবার মৃত্যুর জন্য এক বছর পিছনে পরে গেছিল। তার সাথে তাদের গ্রামের তেমন কেউ দেখা করতে আসতো না বা কোন মেয়ে বান্ধবী তার বেশি ক্লোজ ছিল না। তবে কলেজের এক বান্ধবী ছিল যার সাথে ওর ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, সে নাকি মাঝে মাঝে সামিহার সাথে এ বাড়িতে আসতো।

লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য নিয়ে গেছে, গ্রামের অনেকেই আলোচনা ও আফসোস করতে করতে নিজের কাজে চলে গেল। কিছু কিছু মানুষ থেকে গেল তাদের মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই।
সকলের সামনে দাঁড়িয়ে সেই অল্পবয়সী পুলিশ বলে গেল যে যেভাবেই হোক তিনি এ খুনের রহস্য বের করবেন। উপস্থিত গ্রামবাসীরা তার সেই কথা গুলো বিশ্বাস করেছে কিনা জানিনা।

আমরা বেলা এগারোটার দিকে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম, সকালের নাস্তা এখনো করা হয় নাই। একটা মেয়ে খুন হয়েছে আবার আরেকটা মেয়ের বিয়ে বন্ধ হবার উপক্রম সৃষ্টি করে গেছে। চেয়ারম্যান আঙ্কেল হয়তো নিজের বড় মেয়ের কি হবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তবে আমার বিশ্বাস সেটা কোন সমস্যা হবে না কারণ চেয়ারম্যান আঙ্কেল সম্মানিত ব্যক্তি তাই তাদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য নয়। যদি গরীব ঘরের কারো মধ্যে এমন হতো তাহলে এতক্ষণে চেয়ারম্যান সাহেব নিজে ৪/৫ বার বক্তৃতা দিতেন।

কোনরকমে হালকা নাস্তা করে দোতলায় রুমের মধ্যে আসলাম তখনই ঢাকা থেকে স্যার কল দিল। আমি রিসিভ করে মনমালিন্য রূপে কথা বললামঃ-

– স্যার আসসালামু আলাইকুম।

– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, কি খবর সজীব? তোমরা যেতে না যেতেই নাকি ও বাড়িতে একটা মেয়ে খুন হয়েছে?

– জ্বি স্যার অবস্থা বেশি ভালো না।

– কেন যে তোমাদের এতদিন আগে পাঠালাম সেটা বুঝতে পারছি না, এখন কি যে হবে?

– স্যার চিন্তা করবেন না সবকিছু স্বাভাবিক হবে তবে কিছু সময় দরকার। আশা করি আমরা সবাই সুস্থ আর বিপদ মুক্ত থাকবো।

– তুমি একটু সাবধানে থেকো, যেহেতু তুমি সেখানে নতুন আর তুমি একজন পুরুষ। পুলিশের সামনে বেশি যাবে না, আর যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তবে যতটুকু জিজ্ঞেস করবে ততটুকু জবাব দেবে।

– ঠিক আছে স্যার।

– মোহনার সাথে আগের মতো কথা হয়?

– না স্যার, যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছি শুধু ভাবছি দিনগুলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাক।

– ওখানকার খবরাখবর আপডেট জানিও, আমি কিন্তু টেনশনে থাকবো।

– ঠিক আছে স্যার তাই হবে।

★★

দুপুরের পরে দুটো লোক এসে বাড়ির সামনে প্রথমে চিৎকার চেচামেচি করলেন তারপর চেয়ারম্যান আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন। খবর নিয়ে জানলাম লোকগুলো সামিহার চাচা, তাদের একমাত্র ভাতিজির মৃত্যুতে তারা গভীর শোকাহত।

মোহনার খালুর সাথে আসার পরে এখন পর্যন্ত কোন বিশেষ আলাপ হলো না। আসরের নামাজের পরে তিনি আমাকে ডাকলেন, আমি তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে রাস্তায় গেলাম।

– তোমার বাসা কোথায় বাবা?

– জ্বি আমার বাসা চট্টগ্রামে।

– কিছু মনে করো না বাবা, বিগত পনের বছর ধরে আমি অত্র এলাকার চেয়ারম্যান। এই পনের বছরের মধ্যে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে নাই, কিন্তু তুমি অন্য শহর থেকে আসা নতুন মেহমান আসার সাথে সাথে একটা কেলেঙ্কারির হয়ে গেল। মেহমান হয়ে তুমি আমাকে কতটা তিরস্কার করছো জানিনা তবে আমি সত্যি সত্যি লজ্জিত।

– ছি ছি, আমি তেমন কিছু মনে করিনি তাই সরি বলে লজ্জা দিবেন না। আসলে এখানে আপনার কি দোষ বলেন? বরং আপনার নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে সমস্যা হয়ে গেল।

– তা আর বলতে, ভেবেছিলাম অনেক ধুমধামে বিয়ে দেবো কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেল।

– আঙ্কেল আমার মনে হয় এখন আপনি তাদের সাথে নতুন করে কথা বলুন। তারপর তারা কীভাবে বিয়ে সম্পন্ন করতে চায় সেভাবেই করার চেষ্টা করুন।

– তাই করতে হবে, আচ্ছা তুমি তো গতকাল এলে এবং সামিহার সাথে কথা বলেছো। তাহলে বলো তো তাকে কেন কেউ খুন করতে পারে? কোন উপযুক্ত কারণ খুঁজে বের করো তো।

– আমি সেভাবে কিছু বলতে চাই না আঙ্কেল, তবে একটা কথা জানার খুব ইচ্ছে করছে।

– কি কথা?

– সামিহা কাউকে পছন্দ করতো? মানে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কারো সাথে?

– তা তো জানিনা কিন্তু থাকলে থাকতেও পারে তেমন অসম্ভব কিছু না।

– যদি সত্যি সত্যি কেউ থেকে থাকে তাহলে আমি সেই প্রেমিকের খোঁজ বের করতে চাই।

– কেন কেন?

– আঙ্কেল একটা বিষয় ভেবে দেখুন, সামিহা খুন হয়েছে বাগানের মধ্যে। সেখানে তাকে জোর করে নিয়ে গেছে সেটা মনে হয় না কারণ তার হাত পা কিছু বাধা ছিল না।

– হুম তারপর?

– কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে সামিহা নিজের ইচ্ছেতে বাগানে কারো সাথে দেখা করতে গেছে। আর সেই ব্যক্তি তার একান্ত আপনজন হবে কারণ ভালবাসার মানুষ ছাড়া নিজের আত্মীয়স্বজন কারো সাথে কেউ রাত বারোটার পরে দেখা করে না। আমরা যেহেতু বারোটা পর্যন্ত আড্ডা দিছি তাই সামিহা তারপর হয়তো বাগানে কারো সাথে দেখা করতে গেছে। আর সেই ব্যক্তি আগে থেকে হয়তো তাকে খুন করার পরিকল্পনা করে রেখেছে।

– বাহহ তোমার কথার যথেষ্ট যুক্তি আছে।

– আপনার কাছে একটা কথা বলতে চাই, আমি খুব গোপনে এই খুনের রহস্য সমাধানের চেষ্টা করবো। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেবো না, এবং যা কিছু করার সবকিছু আমি এখানে থাকতেই করবো।

– অনেক খুশি হলাম তোমার কথা শুনে, তোমার যদি কোন ধরনের সাহায্যের দরকার হয় সাথে সাথে আমাকে বলবে। আমি তোমার সবকিছু যোগাড় করে দেবার ব্যবস্থা করে দিবো, তবুও আমি চাই রহস্যের সমাধান হোক।

– ধন্যবাদ আঙ্কেল।

|
|

গতকাল আর আজকের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, গতকাল এমন সময় সবাই উল্লাসিত ছিল। কিন্তু আজ একটা খুনের জন্য সবকিছু নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে রেখেছে। সন্ধ্যা পরে রুমের মধ্যেই ছিলাম, মোহনার সাথে কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না। ডিনার করার পরে যখন রুমে যাচ্ছি তখন মোহনা ফাহিমকে ডাক দিল। আস্তে আস্তে কি যেন জিজ্ঞেস করলো, মিনিট দুই পরেই আমরা রুমের মধ্যে আসলাম।

জানাল খোলা ছিল, আমি নিজের হাতে খুলে রেখে গেছিলাম। রুমে ঢুকেই দেখি ফ্লোরে একটা ভাজ করা কাগজ পরে আছে। হাতে নিয়ে দেখি সেখানে ছোটখাটো একটা চিঠি লেখা আছে, ভেবেছিলাম পড়বো না কিন্তু কৌতূহলবশত পড়তে লাগলাম।

আসসালামু আলাইকুম।
আমি কে? সেই অনুসন্ধান করে বৃথা সময় নষ্ট করার মতো ভুল করবেন না। আমার পরিচয় আপনার না জানলেও চলবে কিন্তু আমি যেটা বলবো সেটা জানা আপনার জন্য জরুরি। আপনি ইতিপূর্বে অবগত আছেন যে এ বাড়িতে একটা মেয়ে খুন হয়েছে। সেই খুন কে এবং কি কারণে করিয়াছে সেটা আমি জানি কিন্তু আপনার জানার দরকার নেই।

আপনার যেটা দরকার সেটাই বলছি, আপনি এখান থেকে অতিশীঘ্রই চলে যান। এই খুন পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে দুটো কাজ করার জন্য। প্রথমটা আমি বলবো না কারণ সেটা আপনার জানা দরকার নেই তবে দ্বিতীয়টা বলবো। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এই খুনের মাধ্যমে আপনাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আপনি আপনার পিছনের কিছু দিনের ঘটনা স্মরণ করলেই বুঝতে পারবেন, কে করতে পারে এমন কাজ? আমি জানি আপনি খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি তাই আপনার কাছে সবকিছু খুলে বলতে হবে না।

কথায় আছে,
জ্ঞানী যারা বোঝে তারা শুধু ইশারায়।
মূর্খকে বোঝাতে পারে, কে আছে কোথায়?

আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা ঠান্ডা প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা সর্বদা ভেবে চিন্তে কাজ করতে পছন্দ করে তাই সবকিছু পরিকল্পনার মাধ্যমে করেন। আপনার একজন প্রিয় শুভাকাঙ্খী হয়ে বলছি, সামনে আপনার খুব বিপদ অপেক্ষা করে আছে। আপনি তাড়াতাড়ি গ্রাম ত্যাগ করুন, আর শহরে গিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকরির ব্যবস্থা করুন। একটা চাকরি গেলে আবার আরেকটা চাকরি হবে সমস্যা নেই, কিন্তু একবার বিনাদোষে জেলে গিয়ে যদি সাজা হয়ে যায় সেটা কিন্তু মানা যায় না।

যদি বুঝতে না পারেন তাহলে চিঠিটা বারবার পড়ুন, আর কে আপনাকে ফাঁসাতে চাচ্ছে সেটা বের করে তার থেকে এড়িয়ে চলুন।

ভালো থাকবেন সবসময়।
আর
সাবধানে থাকবেন সবসময়।

★★

চিঠি পড়ে সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে, কি হচ্ছে এ-সব? ভাবতে লাগলাম চিঠির লেখা নিয়ে।

রুমের মধ্যে ফাহিম এসে বললোঃ- স্যার আপু হঠাৎ একটা কথা জিজ্ঞেস করলাে কিন্তু কারণ বুঝতে পারছি না।

– কি জিজ্ঞেস করেছে তোমার আপু?

– আপু বলে, গতকাল রাতে আড্ডা দিয়ে সবাই চলে
যাবার পর আপনি কি রুমে ছিলে নাকি কিছু সময়ের জন্য বা অনেক সময়ের জন্য বাইরে গেছিলেন?

– এ কথা জিজ্ঞেস করেছে?

– হ্যাঁ স্যার।

খোলা জানালার কাছে খটাখট শব্দ হলো, আমার বুকটা ধুকধুক করতে লাগলো। হঠাৎ করে কেন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো, কে এসেছে জানালার পাশে? নাকি আবারও চিঠি আসবে?

চলবে…..

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here