পুরো জনমানবশূন্য একটা এলাকার ঘন জঙ্গলের রাস্তার মধ্য দিয়ে হাঁটছিল একটি মেয়ে। বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টি ছিল, সেইখান থেকে আসতে আসতে লেট হয়ে গেছে। সবাই মিলে জোড়াজুড়ি করেছিল থেকে যাওয়ার জন্য কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে আর থাকা হলো না। তাই দ্রুত পা চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে। মেইন রোড দিয়ে যেতে গেলে সময় বেশি লাগবে, তাই জঙ্গলের পথ দিয়ে শর্টকাটে বাড়ি ফেরার জন্য পাড়ি জমালো।
রাত ১১ টা বেজে ৩৫ মিনিট। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘ জমেছে। মাঝে মাঝে মেঘের ভয়ানক গর্জন শোনা যাচ্ছে, হালকা বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে চারপাশটা আলোকিত হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের করুণ আর্তনাদ। জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করার পর মনে হচ্ছিল পিছনে কেউ তাকে ফলো করছে, তাই সে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। তবে অন্যদিনের তুলনায় আজ কেমন জানি একটু সময় লাগছে, এটা তো মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ।
এভাবে বেশ কিছু সময় যাবার পর হঠাৎই পরিবেশটা ভারী হয়ে এলো। চারপাশে বাতাস বইতে শুরু করল। ঝড়ো হাওয়া যেন আছড়ে পড়তে লাগল মেয়েটির উপরে। এরপর পরই মনে হলো পেছনের বট গাছটা উপরে পড়েছে বাতাসের তাণ্ডবে। তখনই পেছন থেকে কেউ মেয়েটির নাম ধরে জোরে একবার ডাক দিল। মেয়েটি সাথে সাথে পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু কাওকেই দেখতে পেল। শুধু দেখতে পেল পাশে থাকা বট গাছের মগডালে একটা কালো কুচকুচে বেড়াল বসে আছে। বেড়ালটি অস্বাভাবিক রকমের বড় আর লম্বা। এই বিড়ালটিকে স্বাভাবিক বিড়াল বলা যায় না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, চোখটা জলজল করছে, যেন গোটা একটা আগ্নেয়গিরি। মুখ দিয়ে তার রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। হিংস্র সরু দাঁত দুটি বেরিয়ে এসেছে তার। এতো রাতে এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে মেয়েটির অন্তরাত্মা কেপে উঠল। শিরদারা বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল মেয়েটির। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়াতে আরম্ভ করল, কিন্তু পথ যে শেষই হচ্ছে না।
সমানে দৌড়ে চলেছে মেয়েটি, যে করেই হোক তাকে জীবন বাঁচাতেই হবে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই কোনো কিছুর সাথে হোচট খেয়ে পড়ে গেল মেয়েটি। পড়ে গিয়ে তার পা মোচকে গেল। তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বরাবরের মতোই সে ব্যর্থ। হঠাৎই শুনতে পেল পাশ থেকে কিছু হাড় চিবানোর আওয়াজ, আর ফিসফিসালো কিছু অদ্ভুত ভাষার কথা। আজকে মেয়েটির নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় মনে হচ্ছে কেন ওদের কথায় বাড়িতে থেকে গেল না। কিন্তু সে তো থাকতেই চেয়েছিল তবে অজানা আকর্ষণে এসেছে যেন কোনো দৈব শক্তি তাকে এখান অবধি টেনে হিচড়ে নিয়ে এসেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই মাথাটা তুলে সামনের দিকে যেই যাবে তখন কোনো কিছু একটা দেখে থমকে গেল সে।
ভয়াবহ রকমের দেখতে একটি কালো কুচকুচে রঙের অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখের মণির জায়গায় অগ্নি শিখা জলজল করছে। মেয়েটি চোখ তুলে তাকাতেই ওকে দেখে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। এটা দেখে মেয়েটির হ্রদপিণ্ডটা যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভয়ে চিৎকার করে পেছনে পিছাতে লাগল মেয়েটি। এটা দেখে সামনে থাকা অবয়বটি তার দিকে তাকিয়ে গগন কাপানো একটা হাসি দিল। মেয়েটি এবার থরথর করে কাপতে লাগল। এবার মেয়েটি অনুনয়ের সুরে আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল
-‘ ক কে আ আপনি? ছ ছেড়ে দ দিন আ আমায় প প্লি প্লিজ।
ওর কথা শুনে অবয়বটি আরও বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। এবার ওর কাছে এগোতে লাগল। মেয়েটি পেছাতে লাগল পেছাতে পেছতে একটি বাবলা গাছের সাথে ওর পিঠ ঠেকে গেল। কাটাযুক্ত বাবলা হওয়ায় সবগুলো কাটা মেয়েটির পিঠে ফুটে গেল। ফলে উক্তস্থান থেকে অনবরত রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি চিৎকার করে আর্তনাদ করতে লাগল। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস কে শুনবে মেয়েটির এমন করুণ আর্তনাদ, আর কেই বা বাঁচাবে ওকে। ওর চিৎকার কারও কান অবধিও পৌছাবে না। উক্ত অবয়বটি ওর কাছে এসে ওর গলা চিপে ধরল, মেয়েটি গঙাতে লাগল। এরপর বড়বড় নখের আচড় বসিয়ে দিল মেয়েটির গালে, মুখে, গলাতে। বেশ ধারাল নখের আচড় হওয়ায় রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়তে লাগল। প্রচন্ড ব্যথার কারণে মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। এইবার মেয়েটির ঘাড়টি মটকিয়ে একটানে ছিড়ে ফেলল ওর গলা। মৃত্যুর আগে মেয়েটি গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওর মাথাটা। গলা দিয়ে ছুয়ে ছুয়ে রক্ত পড়তে লাগল। আর পড়ে রইল মেয়েটির নিথর নিষ্প্রাণ দেহটি। এই দৃশ্য দেখে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল অবয়বটি।
—————————-
সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কাল রাতের ঘটনাটি। সকল টিভি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে নিউজটি। জঙ্গলের পথ দিয়ে কিছু সংখ্যক লোক যাওয়ার সময় গলাকাটা একটা মেয়ের লাশ জঙ্গলের ধারের পচা ডোবাতে পড়ে আছে। তার মাথাটা দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মাথাটা পড়ে আছে ডোবার পাশেই পচা নোংড়া মাটিতে। কি বিভৎস্য দেখতে লাশটি! কিছু লোক তো এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। আর কিছু লোক সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ইনফর্ম করেছে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই উক্ত স্থানে পুলিশ এসে হাজির হয়। ইতোমধ্যে তারা লাশটার ময়না তদন্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্যই। তারা কোনো ধরনের কোনো ক্লু পেল না। তবে কে মারলো মেয়েটাকে এমন নৃশংস ভাবে। এটা কি আদৌ কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব?
.
.
.
ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িং রুমে এসে এমন নিউজ দেখে থমকে গেল আনায়শা। ঘুমে ঢলতে ঢলতে এলেও এমন বিশ্রী নৃশংস ভাবে খুনের নিউজ দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল আনায়শা। ও বিশ্বাসই করতে পারছেনা, তাই হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ যাবত। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই জোরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল সে। আনায়শা একটু দূর্বল হওয়াতে ছোটবেলা থেকেই এসব সহ্য হয়না ওর তাই ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে।
আনায়শার এসময় চিৎকার শুনে দ্রুত সোফা থেকে উঠে আনায়শার কাছে গেলেন আশরাফ চৌধুরী। তার প্রতিদিনের অভ্যাস সকালে উঠে নিউজ দেখা, আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তিনি বসে বসে নিউজ দেখছিলেন এমন সময় মেয়ের চিৎকার শুনে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে রান্নাঘর থেকে ছুটে চলে এলেন লাবিবা রহমান ওরফে আনায়শার মা। মেয়েকে এভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়তে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে বললেন
-‘ কি হয়েছে আমার মেয়ের? ও এমন চিৎকার করে সেন্সলেস হয়ে গেল কেন?
-‘ আমি টিভিতে নিউজ দেখছিলাম, একটা মেয়ের নৃশংস মৃত্যুর, তাই হয়তো দেখে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।
-‘ দ্রুত ডক্টরকে ফোন করো। এটা তো ওর ফোবিয়া, এর কারণে ওর মৃ….
বাকিটা আর বলতে পারলেন না তিনি বলতে গিয়েও নিজের মুখ চেপে ধরলেন। তিনি বেঁচে থাকতে তার একমাত্র মেয়ের কিছু হতে দিবেননা তিনি। লাবিবা রহমানের কথা মতোই তাদের ফ্যামিলি ডক্টরকে কল দিলেন আশরাফ চৌধুরী।
এখন বিছানায় শুয়ে আছে আনায়শা। ডক্টর এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন। অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার কারণে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে, জ্ঞান ফিরতে বেশ সময় লাগবে। হয়তো রাতও হয়ে যেতে পারে। চৌধুরী পরিবারের একমাত্র মেয়ে আনায়শা। এমনিতেই তাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তারউপর এখন তাদের মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড় জমেছে।
.
.
.
কানের কাছে হঠাৎ কোনো পুরুষালি কণ্ঠে কারও ফিসফিসালো আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আনায়শার। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে কাওকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল সে। হঠাৎই সামনে তাকাতেই চমকে উঠল আনায়শা….
#চলবে ~
#এক_বর্ষণমুখর_সন্ধ্যায়
#Nushaiba_Jannat_Arha
#পর্ব : ১