এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় পর্ব -১০ ও শেষ

#এক_বর্ষণমুখর_সন্ধ্যায়
#Nushaiba_Jannat_Arha
#পর্ব ১০

রাত ৩ টা বেজে ৩৪ মিনিট…

জানালা দিয়ে সোঁ সোঁ করে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বাতাস যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাতাসের তাণ্ডবে আশপাশের গাছপালা সব উপরে ফেলবে। বাতাসের কারণে একটা জানালার সাথে আরেকটি জানালা বারি খেতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আনায়শার। ধরফরিয়ে উঠে বসল আনায়শা। এমন অবস্থা দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে মেহরাবকে ডাকতে গেলে, দেখে আনায়শার পাশে মেহরাব নেই। আশেপাশে কোথাও মেহরাবকে দেখতে না পেয়ে আনায়শার মনে যেন আরও ভয়ের বাসা বাধল। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল সে। হাত বাড়িয়ে যে জানালাটা বন্ধ করবে সেই শক্তিটুকুও নেই তার।

– আনু, আমাকে বাচাও, আনু।

মেহরাব উক্ত কথাটা বলল আনায়শাকে, কথাটার উৎস জানালার বাহির থেকে ভেসে এলো আনায়শার কানে।

আনায়শার মেহরাবের কণ্ঠস্বর পেয়েই যেন কলিজায় পানি চলে এলো। সাত পাচ না ভেবেই এক দৌড়ে চলে যেতে নিলেই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বাধা দেয় তাকে। আনায়শা থেমে যায়। আশপাশ ঘুরে দেখে আবার জানালার দিকে অগ্রসর হতেই মেহরাবের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

– আনায়শা, ভুলক্রমেও জানালার ধারে কাছেও যাবে না তুমি। গেলেই বিপদ হবে তোমার। এই মুহূর্তে ওয়াশরুমেও যাবে না কারণ ওখানে গেলে সবচেয়ে বেশি বিপদ, ওরা সহজেই তোমার ক্ষতি করতে সক্ষম হবে তাহলে। আমার কণ্ঠ বা তোমার পরিচিত কণ্ঠে নানাভাবে তোমাকে ডাকবে, কিন্তু তুমি কোনো সাড়া দিবে না। এই রুমের বাইরেও বের হবে না। মনে রেখো, জানালার বাইরে দিয়ে শব্দ আসবে তোমাকে জানালার কাছে নেওয়ার জন্য, তুমি জানালার কাছে গেলেই তোমার ক্ষতি করতে পারবে। যদি না যাও তাহলে, তাদের সেই ক্ষমতা নেই যে রুমের ভেতরে এসে তোমার ক্ষতি করবে। আর আমি তোমার সাথে আছি সবসময়। আমি না বলা পর্যন্ত, আমি না আসা পর্যন্ত এই রুমের বাইরে প্রবেশ করবে না তুমি। মনে সাহস রাখো, আল্লাহর নাম নাও, কুরআন তিলাওয়াত করো।

মেহরাবের বলা প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিল এতোক্ষণ আনায়শা। আশেপাশে মেহরাবকে খুজেও পেল না আনায়শা। মেহরাব এমন কেন বলল, ও কোথায় গেছে এতরাতে, তাহলে জানালার কাছে তখন মেহরাবের কণ্ঠে কে ডেকেছিল তাকে এসব ভাবতে থাকল আনায়শা। মেহরাবের কথা মতো আনায়শা আর জানালার কাছে গেল না, বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।

ভাবতে লাগল কে জানালার বাইরে থেকে ডাকতে লাগল তাকে। তখনের কথা মনে হতেই কিছুটা থমকে গেল আনায়শা। মেহরাব তো আনায়শাকে আনায়শা বলেই ডাকে। আনু বলে তো শুধু নিশিতা আর মাইশা ডাকত। তাহলে তাকে এই নামে ডাকল টা কে? ওটা মেহরাব হতেই পারেনা কারণ মেহরাব ডাকলে পরের বার মেহরাবই কেন নিষেধ করবে জানালার কাছে যেতে আনায়শাকে।

আনায়শা এসব নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত তখনই জানালার বাইরে থেকে জোরে জোরে কান্না করে আনায়শার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল নিশিতা।

– আনু, আমাকে বাচা, আনু। আমাকে মেরে ফেলল ওরা। আমাকে বাচা প্লিজ। আমি বাচতে চাই, আনুুুু।

নিশিতার কণ্ঠস্বর পেয়ে বুকটা ধক করে উঠল আনায়শার। মনে পড়ে গেল তখনের কথা। নিশিতার হাত ধরেই তো ওরা যাচ্ছিল মাইশাদের বাসায়। কিন্তু তারপর ও জ্ঞান হারানোর পর তো নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে, আর নিশিতার কি হলো। নিশিতার ব্যাপারটা তো ভুলেই গেছে আনায়শা। দৌড়ে যখনই জানালার কাছে যেতে যাবে তখনই মনে পড়ে গেল মেহরাবের বলা কথাটা। আনায়শা আর সামনে এগলো না, যেখানে ছিল সেখানেই বসে পড়ে।
নিশিতার সাথে পরেও কথা বলা যাবে। এখন মেহরাবের কথা মতো চলতে হবে তা না হলে ওরই বিপদ।

আনায়শা ভয়ে জোড়োসড়ো হয়ে বসে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকে। কুরআন তিলাওয়াত করতে হলে তো ওযু করতে হবে, কিন্তু ওয়াশরুমে তো যেতে পারবে না, তাই উপায় না পেয়ে বসে বসে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকল আনায়শা। এখন সব কিছু শান্ত হয়ে গেছে। বাহিরে আর কোনো ঝড়ো বাতাসও বইছে না। সব একেবারে শান্ত। আনায়শা তাও ভয়ে চোখ বুজে দোয়া দুরুদ পড়তে থাকল।

এমন সময় হঠাৎ জানালায় জোড়ে জোরে নক করতে লাগল কেউ। আনায়শা আরও শক্ত হয়ে গিয়ে দোয়া পড়তে থাকল। আবার সব শান্ত হয়ে গেল মুহূর্তেই। বিপদের আশঙ্কা আর নেই ভেবে আনায়শা যেন হাফ ছেড়ে বাচল। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু ঘুম আসছে না কিছুতেই। এদিকে মেহরাবেরও দেখা নেই।

হঠাৎ আনায়শার মা লাবিবা রহমান আনায়শাকে ডাকতে লাগল আর ওর রুমের দরজায় নক করতে লাগল। আনায়শা আর কোনো কিছু চিন্তা না করে দৌড়ে রুমের দরজার কাছে চলে গেল। ও বেমালুম ভুলেই গেল মেহরাব এই রুমের বাইরে যেতেও নিষেধ করেছিল। কিন্তু ওর আর মনে নেই মেহরাবের বলা বারণ। মায়ের ডাক শুনে যেন আনায়শার কলিজায় পানি চলে এলো। সাত পাচ না ভেবেই দরজা খুলে দিল। যদিও মন বারবার বলছিল দরজা যেন না খুলে, কিন্তু অনেকটা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে দরজাটা খুলেই ফেলল আনায়শা।

দরজা খুলে কোথাও লাবিবা রহমানকে দেখতে পেল না আনায়শা। পুরো বাসাটাই অন্ধকার। কোথাও কারও ছায়াটাও দেখতে পেল না আনায়শা। আনায়শা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে দোয়া পড়তে পড়তে মা বাবার রুমে উকি দিল, কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে বেশ ভয় পেল আনায়শা। আনায়শা ওদিক থেকে সরে এসে ভয়ে ভয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

নিচে এসেই যে দৃশ্য দেখল তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না আনায়শা। জোড়ে চিৎকার দিতে নিলে গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয়না আনায়শার। আনায়শার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে অনবরত।

মৃদু আলোর কারণে অবয়বগুলো ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। এগুলো মানুষের মতোই দেখতে, তবে চেহারার হিংস্রতার ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে এরা কোনো সাধারণ মানুষ নয়। এরা হলো অদৃশ্য শক্তি অর্থাৎ জ্বীন। তাদের একার সাথেই ফাইট করছে মেহরাব। তবে কি মেহরাবও ওদের মতোই…, মনে মনে এমন প্রশ্ন জাগে আনায়শার।

আনায়শা লুকিয়ে লুকিয়ে এসব কিছুই দেখছিল আর হাত দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে, সাথে চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। এইবার মেহরাবকে রেখে লাবিবা রহমানকে আঘাত করল ওদের মধ্যে একজন। সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন লাবিবা রহমান। আনায়শা এতোক্ষণ সহ্য করতে পারলেও এবার আর সহ্য করতে পারল না। ছুটে গেল তার মায়ের কাছে আনায়শা।

মায়ের মাথাটাকে নিজের কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আনায়শা বলল

– কিচ্ছু হবেনা তোমার মাম্মি। এই দেখো আমি চলে এসেছি।

আনায়শাকে দেখে মলিন হাসলেন লাবিবা রহমান। কাপা কাপা কণ্ঠে বললেন

– নিজের খেয়াল রাখিস মা। আমার হাতে বেশি সময় নেই। দোয়া করি মা, তুই অনেক সুখি হবি মেহরাবের সাথে। ভালো থাকিস মা আমার।

কথাটা বলেই তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

আনায়শা তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে লাগল। আনায়শার চিৎকার শুনে সবগুলো অবয়ব ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। একজন ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে ধরতে গেলেই মেহরাব নিজের সব শক্তি দিয়ে ভস্ম করে দেয় সেই অবয়বটাকে। এটা দেখে আনায়শা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহরাবের দিকে। মেহরাব করুণভাবে তাকায় আনায়শার দিকে।

এভাবে বেশ অনেক সময় ধরে সবার সাথে ফাইট করতে করতে মেহরাবও বেশ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে একা পেরে উঠছে না তাদের সাথে।

আশরাফ চৌধুরীও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

– মা, আমি জানি তুই আমার রেগে আছিস, তোর অমতে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু যা করেছি তা আমি তোর ভালোর জন্যই করেছি।মেহরাবকে কখনো ভুল বুঝিসনা। ও যা করেছে তা তোর ভালোর জন্যই করেছে। আজকে যদি ও না থাকতো তাহলে আমরা তোকে পেতাম না। ছোটবেলা থেকেই তোর একটা সমস্যা ছিল। তোর আগেই আমি আমার ২ সন্তানকে হারিয়েছি। আমাদের পরিবারের উপর বদনজর পড়েছিল। তাই যেকোনো ভাবে কেউ চাইতো না আমার সন্তান বাচুক। এভাবে ওরা মারা গেল।এরপর তুই হলে আমরা আরও চিন্তিত হয়ে পড়ি। হুজুরের পরামর্শে আমরা বাড়ি বন্দক দেই। আর তোর দাদার পরামর্শে মেহরাবকে তোর উপর নজর রাখার জন্য আনি। মেহরাব কোনো সাধারণ মানুষ নয়। আমরা চেয়েছিলাম মেহরাবের সাথে তোর বিয়েটা দিতে। আর আমরা পেরেছি। বিয়েটা দেখে যেতে পারলাম। এখন মরেও শান্তি পাব। ভালো থাকিস মা। তুই খুব সুখি হবি। কিন্তু আপসোস তোর সুখটা দেখে যেতে পারলাম না।

– এসব কি বলছো পাপা? তোমার কিছু হবেনা আমি থাকতে। কিন্তু পাপা, আমাদের ভালো কে চায়না? কে আমাদের ক্ষতি করছে? কে আছে এর পিছনে?

আশরাফ চৌধুরী কিছু বলতে যাবেন তখনই আক্রমণ করে বসে অবয়বটা। আশরাফ চৌধুরী লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে, আনায়শা চিৎকার করে উঠল। চোখের সামনে প্রথমে তার মাকে মারা যেতে দেখল, এখন তার বাবাকেও। আর সহ্য করতে পারল না আনায়শা। চারিদিক অন্ধকার দেখতে লাগল সে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু মেহরাবের চিৎকার শুনতে পেল আনায়শা। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল আনায়শা।

#চলবে#এক_বর্ষণমুখর_সন্ধ্যায়
#Nushaiba_Jannat_Arha
#অন্তিম_পর্ব

কাধে কারো শীতল স্পর্শ পেতেই ধরফড়িয়ে ওঠে আনায়শা। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল এতোক্ষণ, জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল মেহরাব করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনায়শার দিকে। আনায়শা কোনো কথা না বলে আবারও ঐ দূর অন্তরীক্ষের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। মেহরাব আনায়শার কাধে মুখ রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

আজ মেঘেরাও বড্ড মন খারাপ করে আছে তাদের মতো। বিষণ্ণ সন্ধ্যায় মেঘাবৃত আকাশ। মেঘের গুরু-গর্জন ও আকাশের বিদ্যুৎ-ঝলকানির মধ্যে লজ্জায় লাল হয় অস্তায়মান সূর্যটা— বর্ষণমুখর সন্ধ্যার এ এক দুর্লভ রূপ।

প্রকৃতির সন্ধ্যা যেন আজ আগেই হাজির হয়েছে। প্রকৃতি যেন অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশি নিস্তব্ধ, নিথর। শ্রাবণের বর্ষণমুখর দিবাবসানে এক সময় আধার ঘনীভূত হয়ে আসে।

দুর্যোগপূর্ণ শ্রাবণ সন্ধ্যা, চারপাশ নিরব, নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে, প্রকৃতির কোল জুড়ে যেন আজ শুধুই বিষণ্ণতা। সর্বত্র যেন প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ। বেদনায় অন্তর্নীল বাদল বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যেন তার চোখের জল ঝড়ছে।

এতোক্ষণ চুপচাপ প্রকৃতির এ লীলাখেলা দেখছিল আনায়শা এবং মেহরাব। আজ আনায়শার মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে, বর্ষণের সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে ঝড়ছে নোনা জল। মেহরাব এসবই দেখছে, এবার সে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল।

” খোলা জানালায় মন পালায়
অন্ধকারে ফেরার হয়ে
বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়
কোথাও যদি চুপটি করে আকাশ
ফেলে রাখে বর্ষার ফুল
অন্ধকারেও চিনতে এবং
শুকতে হবে না ভুল।”

মেহরাবের কবিতা শুনে অবাক হয়ে মেহরাবের দিকে তাকায় আনায়শা। আনায়শাকে অবাক হতে দেখে মেহরাব মুচকি হাসে।

– আপনি কবিতা- আবৃত্তিও করতে পারেন?

– হুম সব পারি আমি। কি চাও তুমি?

– কিছুই চাইনা আমার। সব তো শেষ হয়ে গেল আমার কাল রাতেই। এখন তো আমার বেচে থাকাটাই বৃথা।

– কেন বেচে থাকা বৃথা তোমার? তুমি আমার জন্য বাচবে। আর কে বলেছে তোমার কেউ নেই। আমি আছি তো। সবসময় আছি আমি তোমার পাশে।

আনায়শা করুণ দৃষ্টিতে তাকায় মেহরাবের দিকে। চোখে পানি টলমল করছে। মেহরাব আনায়শার দিকে তাকাতে পারেনা আর। নিজের ভেতরেই কেমন অপরাধবোধ কাজ করছে।

– আনায়শা, আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোমার মা বাবাকে বাচানোর, কিন্তু কোনোভাবেই পারিনি।

আনায়শা মলিন হাসল মেহরাবের কথা শুনে। খেয়াল করল মেহরাবের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন, সাথে মেহরাব কিছুটা দুর্বলও।
অজান্তেই আনায়শার বুকটা ধক করে উঠল। বিচলিত হয়ে বলল

– আপনিও তো কম চেষ্টা করেননি। ওরা আপনাকে খুব মেরেছে, তাইনা?

– তা তো একটু মেরেছেই। আমার একার পক্ষে তো আর সম্ভব ছিলনা ওদের ঘায়েল করা। তারপরও আমি ওদের সবাইকে মারতে সক্ষম হয়েছি।

– ওরা কেন-ইবা আমাদের মারতে চাচ্ছিল? আর আমাদের এতো বড়ো ক্ষতি কেন করল ওরা?

– আজ তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। আজকে আমি তোমাকে সব বলবো। কিন্তু, আমি এখন যা বলবো তা তোমাকে শুনতে হবে।

– কি বলুন?

– চোখ বন্ধ করো, আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। চোখ খুলবেনা একদমই।

মেহরাবের কথামতো আনায়শা চোখ বন্ধ করলেই মেহরাব আনায়শাকে কোলে তুলে নেয়। আনায়শা চোখ খুলতে নিলেও চোখ খুলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর অনভব করল সে যেন হাওয়ায় ভাসছে। একটু পর চোখ মেলতেই নিজেকে এক অন্য জগতে আবিষ্কার করতে পেরে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেল আনায়শা। মেহরাব আনায়শার অবস্থা দেখে হাসতে লাগল। আনায়শা বলল

– এটা কোথায়? আমি এখানে এলাম কি করে এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে?

– তোমার বাবা হয়তো বলেছিলেন আমি কোনো সাধারণ মানুষ নই। আমি আসলে একজন জ্বীন। আর এটা জ্বীনদের রাজ্য।

আনায়শা অবাক হওয়ার সাথে সাথে ভয়ও পেল কিছুটা। ভয়ে মেহরাব হতে কয়েক হাত দূরে সরে গেল আনায়শা।

– ভয় পেও না, আনায়শা। আমি এতোদিন যেমন তোমায় আগলে রেখেছি, ঠিক তেমনি এখনও আগলে রাখব। তোমার যাতে আর কখনও কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য চিরদিনের জন্য এইখানে আমার সাথে নিয়ে এসেছি। তুমি আমার সাথে এখানেই থাকবে।

এতে আনায়শার ভয় কিছুটা হলেও কমলো, তাও একটা ভয় থেকেই যায়। আনায়শার ভয় দূর করার জন্য মেহরাব বলল

– চলো তোমাকে পুরো রাজ্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।

মেহরাবের কথামতো আনায়শা মেহরাবের সাথে চলতে শুরু করল। পুরো রাজ্যটা অনেক সুন্দর। আনায়শা নিজের দিকে খেয়াল করলেই দেখতে পায় সে একটা গোল্ডেন রংয়ের গাউন পরা, যা অসম্ভব সুন্দর। মেহরাবের দিকে নজর দিতেই দেখল মেহরাবও গোল্ডেন রংয়ের পাঞ্জাবি পরা। এসব দেখতে দেখতে ওরা একটা লেকের কাছে চলে এলো। এই লেকটা সাধারণ লেকের মতো নয়। এখানে এসেই মেহরাব থেকে গেল।

– আনায়শা, আমরা এখানে বসি।

– হুম। কিন্তু আমি এই পোশাকে কেন?

– এখানে আসার সাথে সাথেই চেঞ্জ করে দিলাম আমি। এটা জ্বীনদের রাজ্য, এখানে চোখের পলকে যা খুশি করা যায়।

আনায়শা কোনো কথা না বলে চুপচাপ মেহরাবের পাশে বসল।

– আমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর পাইনি মেহরাব।

মেহরাব একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে সব বলতে শুরু করে।

– তোমাদের ফ্যামিলির সাথে মাইশাদের ফ্যামিলির একটা পূর্ব শত্রুতা ছিল। তোমার দাদু এবং মাইশার দাদু ছিল দুই ভাই। কিন্তু তাদের মাঝে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। একদিন এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করার এক পর্যায়ে মাইশার দাদু হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। ওদের ধারণা তোমার দাদুর কারণেইমাইশার দাদু মারা গিয়েছে। সেই থেকেই শত্রুতার সূত্রপাত। মাইশার বাবা এটা সইতে না পেরে সুইসাইড করে। মাইশার মা তখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। তুমি আর মাইশা তখন অনেক ছোট। মাইশারা চলে যায় অন্যত্র। তাদের দেখা আর কেউ পায়না। সবাই ভাবে তারাও মারা গেছে। কিন্তু তারা মনে মনে ঘৃন্য পরিকল্পনা কষে। আদোতে, তোমার দাদুর কোনো দোষ ছিল না, দোষটা মাইশার দাদুরই ছিল। কারণ জমিটা ছিল তোমার দাদুর। মাইশা বড় হওয়ার সাথে সাথে সে-ও সব জানতে পারে যে কারণে তোমার সাথে বেস্টফ্রেণ্ড হওয়ার নাটক করে তোমাকে সহ তোমার পুরো পরিবারকে মেরে ফেলার ঘৃন্য পরিকল্পনা করে। আর তোমাদের মারার জন্য বলি হয় মোহনা, মিলি আর নিশিতা।

– নিশিতা কি মারা গেছে? কিন্তু কিভাবে? আর মিলি, মোহনা আপু ওদেরই বা কেন মারল? কালও তো আমার নাম ধরেই ডাকল নিশিতা।

– নিশিতা তো ঐদিনই মারা গেছে, যেদিন তোমরা মাইশার বাড়িতে গিয়েছিলে। ওকে খুব নৃশংসভাবে হত্যা করেছে মাইশা। সাথে মিলি আর মোহনাকেও। আমি সবসময়মতো না গেলে হয়তো তোমাকেও হারিয়ে ফেলতাম।

– আপনি আমাকে বাঁচালেন কিভাবে?

– তুমি জ্ঞান হারাবার আগেই আমি তোমাকে ধরে ফেলি, অদৃশ্য হওয়ার কারণে আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। আমি তোমাকে নিরাপদ স্থানে রেখে যখনই নিশিতাকে আনতে যাব তখন মাইশা পিছন ফিরে নিশিতার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। আমি হাজার চেষ্টা করেও নিশিতাকে বাচাতে পারিনি। তবে আমি তখন মাইশার স্মৃতি হতে তোমার কথা সরিয়ে দেই ফলে ওর আর মনে ছিল না যে সাথে তুমিও ছিলে।

– কিন্তু মাইশা সাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এতোগুলো মানুষকে খুন করল কিভাবে?

– মাইশার দাদু ছিল খুবই খারাপ লোক, সে লুকিয়ে জ্বীন পুষতো, তোমাদের ক্ষতির জন্য। কালের পরিক্রমায় সেই জ্বীনগুলোই মাইশার সহচারী হয়ে যায়। আর ওর হুকুম পালন করেই সবাইকে মারে। মোহনা, মিলি আর নিশিতা ছিল ওর পথের কাটা, ওদের জন্যই তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারছিলনা মাইশা। তাই ওদেরকে মেরে ফেলে মাইশা। তোমাকে মারতে পারলেই ওদের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যেত। আর কাল রাতে ঐ জ্বীনগুলো তোমার পরিচিত মানুষের ভয়েসে তোমায় ডাকছিল, তুমি জানালার কাছে গেলেই তোমাকে মেরে ফেলতো ওরা। আর সেইদিন গলায় যে দাগটা ঐটা ঐ জ্বীনের কাজ ছিল। আমি তোমাকে বাচিয়েছি, প্রতি মুহূর্তে তোমার আর তোমার পরিবারের খেয়াল রেখেছি। আমি না থাকলে হয়তো ঐদিন তোমায় বাচাতেই পারতাম না।

– আপনি এতো কিছু কিভাবে জানলেন?

– তোমার দাদুরও জ্বীনদের সাথে কানেকশন ছিল, তবে সেটা ভালো জ্বীন। দাদু বিচক্ষণ ছিলেন, তাই আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরে আমায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন তোমার আর তোমার পরিবারের খেয়াল রাখার জন্য।

– কিন্তু, আপনি মাইশাদের কি করেছেন?

– মাইশা আর ওর মাকে আমি টুকরো টুকরো করেছি, ওদের কারণেই তুমি তোমার মা বাবা, সব হারিয়েছো। আর তোমার মা বাবাকে আমি দাফন করে এসেছি।

আনায়শা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল

– আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেলাম, কিন্তু সেইদিনের ঐ অবয়বটাকে কে ছিল যে আমায় ভালোবাসি বলেছিল?

– ইয়ে মানে ঐটা আমিই ছিলাম। ঐদিন আমি আমার মনের কথা তোমায় বলেই দিতাম কিন্তু তুমি তো ভয়েই জ্ঞান হারালে।

– কবে থেকে ভালোবাসেন আমায়?

– প্রথমদিকে তোমার খেয়ালই রাখতাম আমি। তবে যখন তোমার বয়স ১২, তখন একদিন তুমি বৃষ্টিতে ভিজছিলে, তখন ছিল শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। তোমার ঐ ভেজা চুল, মিষ্টি হাসি আমার ভালো লেগেছিল। আর সেদিন থেকেই আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলি।
আচ্ছা, আনায়শা আমি তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি কি আমায় ভালোবাসো?

মেহরাবের এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিলনা আনায়শা। লজ্জামাখা এক হাসি দিয়ে মেহবারের কাধে তার মাথা রেখে আকাশের চাদ দেখতে লাগল। মেহরাব মুচকি হেসে আনায়শার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এভাবেই শেষ হলো তাদের জীবনের গল্প। হয়তো আবারও কারো জীবনের সূচনার মাধ্যম হবে #এক_বর্ষণমুখর_সন্ধ্যায়

#সমাপ্ত

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here