এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩৩

আরাবকে অফিসে দেখে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো মুফতাহির। সরাসরি তৌফিক ওয়াহিদের কেবিনে এসে বসেছে ও। এটা আরো বেশি আশ্চর্যের। আরাব ফাইল দেখতে ব্যস্ত। মুফতাহির এগিয়ে গিয়ে বললো,

-তুমি অফিসে?

ফাইল ছেড়ে চোখ তুলে তাকালো আরাব। মুফতাহিরকে দেখে উঠে দাড়িয়ে একদম ওর সামনে এসে দাড়ালো। পকেটে দুহাত গুজে চোয়াল শক্ত করে বললো,

-প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত ডক্টর সজল মুফতাহির। তুমি? অফিসে?

ভ্রুকুচকে তাকালো মুফতাহির। আরাব হেসে দিয়ে বললো,

-গট নার্ভাস?

মুফতাহির প্রতিক্রিয়া দেখালো না। অন্যদিক ফিরে বললো,

-বাবা কোথায়?

-বাবার ছেলে,তোমারই ভাষ্যমতে তার উত্তরাধিকার আছে তোমার সামনে দাড়িয়ে। বাবাকে কেনো খুজছো তবে?

মুফতাহির স্পষ্ট গলায় বললো,

-কারন সেই উত্তরাধিকার তার কাজে একবারও বাবার কথা ভাবেনি।

আরাব শব্দ করে হেসে দিয়ে বললো,

-ও রিয়েলি? তা কি এমন করলাম আমি মুফতাহির ভাইয়া?

-তুমি জানো তুমি কি করেছো আর করছো!

-বাট তুমি জানো না তোমার অগোচরে আমি আরো কি করেছি,করছি আর করবো।

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মুফতাহির। আরাব আবারো হেসে বললো,

-ও কাম অন মুফতাহির ভাইয়া! ডোন্ট গিভ মি দ্যাট লুক! তোমাকে না বললে আমার চলে না তুমি জানো না? তাই তোমাকে তো বলবোই! নাও লিসেন,বাবা আমার কথা মেনে দোয়ার ভার্সিটিতে স্কলারশিপ আর বাস গ্রান্ট করেছে। তার বিনিময়ে অনওয়ার্ডস্,আমি অফিসে রেগুলার। এন্ড ট্রাস্ট মি,সবরকম হিসাবের হিসাব নেবো আমি!

শেষের কথাটা একটু বেশিই জোর দিয়ে বলেছে আরাব। মুফতাহির শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। আরাব হেসে দিয়ে বললো,

-ডোন্ট ওয়ারি ব্রো! শ্যালক তোমার সাইন্সের স্টুডেন্ট তো কি? হিসাবে একেবারে কাচা না! সুদ,আসল,মুনাফা,মুলধন,লাভ,ক্ষতি এসবের সঙ্গা,উদাহরন এই চারদিনে বেশ ভালোমতো স্টাডি করে নিয়েছি।

-অল দ্যা বেস্ট।

মুফতাহির বেরিয়ে আসছিলো। ওর চেহারায় ক্ষোভ স্পষ্ট। আরাব পেছন থেকে ডাক লাগিয়ে বললো,

-এসেছিলে এতো কষ্ট করে,তোমার লাভের জন্য কিছুতো শুনে যাও?

মুফতাহির থামলো। কিন্তু পেছন ফেরেনি। আরাব শক্ত গলায় বললো,

-আরাব সব সহ্য করতে পারে। কিন্তু ওর বোনের চোখের জল না! আমার বোনের চোখের জলের কারন যে হবে,তাকে নিজের এক অন্যরুপই দেখাবো আমি মুফতাহির!

মুফতাহির পেছন ফিরলো। আরাব হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে। ওর ফর্সা চেহারা রক্তিম হয়ে আছে। রগগুলো ফুটে উঠেছে রাগে। মুফতাহিরকে পেছন ফিরতে দেখে আরাব শান্ত গলায় বললো,

-ভাইয়া।

মুফতাহির পাথর হয়ে দাড়িয়ে রইলো। একজন স্টাফ দরজায় নক করে বলে গেলো,

-আরাব স্যার? তৌফিক স্যার আপনাকে মিটিংয়ে ডাকছেন।

মুফতাহিরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আরাব। হাতের পাশে থাকা ছোট কেবিনেটের উপরের গ্লাসটা চেপে ধরলো মুফতাহির। গ্লাস ভেঙে রক্ত ঝরতে লাগলো ওর হাত থেকে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো দেয়ালে আটকানো তৌফিক ওয়াহিদের ছবির পাশে থাকা আরাবের ছবির দিকে।

দোয়া বই খুলে পেন্সিল কামড়াচ্ছে। ক্লাস এখনো শুরু হয়নি। অনেক দেরি আছে। বাস আগে ছিলো বলে আগে আগেই আসতে হয়েছে ওকে। অন্যান্যদিন লাইব্রেরিতে থাকে,আজ ইচ্ছে করেই একাকী ক্লাসে বসেছে। “আনরোমান্টিক এক্টা!” বলতে বলতে বিরক্তি নিয়ে ক্লাসে আসছিলো তাজীন। নিরবের কাজকর্মে আজও সকালসকাল একদফা ঝগড়া সেরে ভার্সিটি চলে এসেছে। দরজায় থেকে দোয়াকে পেন্সিল কামড়াতে দেখেই আটকে গেলো ও। যে মেয়েটা অন্যদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকে,আজ মুখে পেন্সিল গুজে আছে,বিষয়টাই আজব লাগলো ওর। পরপরই আরাবের কথা মনে পরতেই মুচকি হেসে ভেতরে আসলো ও।
এগিয়ে এসে দোয়ার পাশে বসলো তাজীন। দোয়া পেন্সিলে বইয়ের ভাজে সুন্দর ভাবে আকাআকি করছে। স্কেচটা খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে। তাজীন বললো,

-সুন্দর। তবে বেরঙ। রঙ কর?

দোয়া কিছুটা চমকে উঠলো। তাজীনকে পাশে দেখে তৎক্ষনাৎ বই বন্ধ করে নিয়ে বললো,

-ত্ তুমি? কখন এসেছো তাজ?

তাজীন আবারো ওর বই খুলে দিলো। পেন্সিলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

-সেটা বড় কথা নয়! বড় কথা হলো,ছবিটা শেষ কর!

-তাজ…

তাজীন চোখ রাঙালো। দোয়া মুচকি হেসে তাই করলো। আকানো শেষে তাজীন বিস্ময়ে বললো,

-ওয়াও দোয়া? তুই এতো সুন্দর ড্রয়িং জানিস,জানতাম না তো!

মৃদ্যু হাসলো দোয়া। রংতুলি ওর জীবনের ঠিক কতোবড় অংশ জুড়ে ছিলো,সেটা কেবল ওর পরিবারই জানে। বললো,

-কোথায় সুন্দর? এটা তো সাদাকালো স্কেচ! সাদাকালো,বেরঙ স্কেচে সৌন্দর্য কিভাবে খুজে পাও?

-তোর সবটা জুড়েই সৌন্দর্য দোয়া।

-ঢপ দিচ্ছো?

-ওকে ফাইন। বেরঙ বলে ভালো লাগছে না। তো রঙিন করে নে?

-এমনই থাক!

-না থাকবে না! রঙ কর তুই!

দোয়া একপ্রকার তাচ্ছিল্যে বললো,

-আমার জীবনে এতো রঙ নেই তাজ। এতো রঙ আমাকে মানায়ও না।

বলতে বলতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেলো দোয়া। ব্যাগ থেকে দুটো রঙিন কলম বের করে ওর বইয়ের উপর রাখলো তাজীন। দোয়া ধ্যান ছেড়ে কলমদুটো দেখে তাজীনের দিকে তাকালো। তাজীন শক্তভাবে বললো,

-রঙ কর!

দোয়া আবারো সেই মৃদ্যু হাসিটা দিয়েই অন্যদিক ফিরলো। তাজীন ওর হাতে এবার কলমদুটো গুজে দিয়ে বললো,

-তুই সে সবকিছু ডিসার্ভ করিস,যেগুলোকে অবহেলা করে দুরে ঠেলে দিচ্ছিস! তারা যে তোকে তাদের রঙে রাঙাতে উতলা হয়ে আছে দোয়া! তবে তুই কেনো সাড়া দিচ্ছিস না? তুই কেনো নিজের অনুভূতিকে সীমাবদ্ধ করে রাখছিস? নিজেকে একটু সাজাতে দে? একটু সুযোগ দে চারপাশকে?

একটা জোরে শ্বাস নিলো দোয়া। শক্তহাতে কলমদুটো আকড়ে ধরলো ও। নিজের মনের মতো করে দুটো রঙে ছবিটা ছেয়ে দিলো। আকানো শেষে নিজেই‌ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে। কতোকাল পর রঙ পেয়েছে ওর হাত! কতোকাল পর রঙ পেয়েছে ওর হাতের অঙ্কন! কতোকাল পর! তবুও কতো ভালো লাগছে ছবিটা দেখতে!

মুগ্ধভাবে দোয়াকে দেখছে তাজীন। সকালে নিরবের সাথে ঝগড়ার কারন এই কলমদুটো। কলম নেবে বলে নিরবের টেবিলের কলমদানি নাড়াচাড়া করছিলো ও। তখনই চোখ পরে সামনে অতিযত্নে সাজিয়ে রাখা এই কলমদুটোর দিকে। ধরতে যাবে,নিরব একপ্রকার ধমকেছে ওকে। কলমদুটো আরাবের। কোনো একসময় কোনো জয়েন্ট থেসিস করতে গিয়ে নাকি কলমদুটো আরাব রেখে গিয়েছিলো। সে তাই ওগুলো অতো যত্নে রেখেছে। “বউকে ছেড়ে স্যারের জিনিসের প্রতি দরদ উতলানো দেখতে পারবো না” কথাটা বলে এগুলো ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ও। ঘটনাচক্রে এগুলো এখানে দোয়ার হাতে ছোয়া পেয়ে গেলো। দোয়ার বেরঙ চিত্রপটে রঙ এটে দিয়ে গেলো। ভেতর থেকে এক তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো তাজীন। সত্যিই দোয়াকে রাঙাতে এসেছে আরাব। মুখে বললো,

-দেখেছিস কতো সুন্দর লাগছে এই রঙে?

দোয়া কিছুই বললো না। তাজীন আবারো বললো,

-আমাকে নিরব নিয়ে যাওয়ার পর তুই‌ কি একাই বাড়ি ফিরেছিলি?

আগেরদিনের কথা মনে পরতেই ইতস্তত করতে লাগলো দোয়া। তাজীন ঠোট টিপে হেসে বললো,

-কিরে? কিছু বলছিস না যে? অবশ্যই আরাব ভাইয়ার বাইকে লিফট নিসনি তুই তাইনা?

-আব্…আমি রিকশায় চলে গিয়েছিলাম।

বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানালো তাজীন। ভাবখানা এমন,এদিকে দোয়া নিজের কেস এগোতে দিচ্ছে না,ওদিকে ও যে কেস এগোতে চায়,সেটা নিরব বুঝতে চাইছে না। দোয়া ওকে চুপ দেখে ভ্রুকুচকে বললো,

-কি হলো? চুপ করে গেলে যে?

-আমারটা একটা চিজ ইয়ার! ভয় পায়!

কথাটা বলেই দোয়ার দিকে তাকালো তাজীন। দোয়া ফিক করে হেসে দিলো। তাজীন বললো,

-হাসছিস কেনো?

-তোমারটা মানে?

এতোক্ষনে কি বলেছে সেই হুশে ফিরলো তাজীন। লজ্জায় পরে যাওয়ার আগেই দোয়াকে বলে বসলো,

-আমারটা ছাড় নিজেরটা বল!

দোয়ার হাসি থেমে গেছে। নিজেরটা বলতে কি বুঝালো তাজীন? তাজীন আবারো কিছু বলবে,তখনই স্যার ক্লাসে ঢুকলো। দাড়িয়ে গেলো সবাই। স্যার বই বের করতে বললো। দোয়া এতোটাই অন্যমনস্ক ছিলো যে,বাইরে থাকা বইটা ব্যাগে ঢুকাতে যাচ্ছিলো ও। তাজীন ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-স্যার বই বের করতে বলেছে,তুই ব্যাগে কেনো ঢুকাচ্ছিস? কার কথা মাথায় ঘুরছে তোর দোয়া?

চোখ বন্ধ করে জিভ কামড়ালো দোয়া। কপালে হাত রেখে কোনোমতে মুখ লুকালো নিজের। এই চেহারা তাজীনকে দেখানোর মতো না। দু সেকেন্ডও লাগবে না ওর আরাবের নাম নিতে। আর লজ্জায় পরতে চায় না ও। গলা ঝেরে‌ ঠিকঠাক মতো হয়ে বসে ক্লাসে মনোযোগ দিলো। মুচকি হেসে তাজীনও সামনে তাকালো। আর কিছুই বললো না।

ভার্সিটি থেকে মুখার্জীবাড়ি ফিরে প্রতিদিনের মতো নিজের কাজগুলো গুছিয়ে টিউশনির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো দোয়া। মাহিমকে পড়ানো শেষে এগোলো টুইঙ্কেলদের বাসার দিকে। বড়বড় দালানের মাঝখান দিয়ে চেনা রাস্তাটায় হাটা লাগালো। একজায়গায় এসে দাড়িয়ে গেলো ও। এটা সেই জায়গা যেখানে আরাব জরিয়ে রেখেছিলো ওকে সেদিন। জ্যাকেটটাও দিয়ে দিয়েছিলো নিজের। ওর জন্য সে ছেলেটার গালে চড়ও মেরেছিলো। গাল ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠলো দোয়ার। ওর কাছে থাকা জ্যাকেটটাই সেই একমাত্র বস্তু,যা এ অবদি মা ভাই দেখেনি। একেবারেই লুকিয়ে,চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছে ও। প্রথমদিকে ভাবতো,ওটা ফেরতের কথায় আরাবের সাথে দেখা করার কোনো মানেই হয়না। এখন মনে হয়,দেখা হওয়াটা যতোটা অস্বস্তির,ওটা ফেরত দেওয়াটা ততোটাই খারাপ লাগা হবে ওর কাছে। কানের পিঠে থাকা ছোট চুলগুলো আরো ভালোমতো গুজে দিয়ে মাথা নিচু করে এগোলো। কিন্তু দোয়ার সামনে হঠাৎই এসে দাড়িয়ে গেলো কেউ। মাথা তুলে সেদিনের ওই ছেলেটাকেই দেখতে পেলো ও। ছেলেটা বললো,

-তোমার জন্য ওই ভাইয়াটা আমাকে চড় মেরেছিলো ম্যাডাম!

দোয়া শক্তভাবেই বললো,

-ওটা তোমার প্রাপ্য ছিলো। আমি বয়সে বড় তোমার। বেয়াদবি করেছিলে তুমি সেদিন!

-ঠিকাছে। আমি না হয় বেয়াদবিই করলাম। কিন্তু ওই ভাইয়া যে সেদিন জরিয়ে ধরলো তোমাকে? তারবেলায়?

-মানে?

-সেদিন ওই ভাইয়ার বুকে গিয়ে পরেছিলে,সে জরিয়ে ধরলো তোমাকে। তাকে কিছুই বললে না কেনো?

-ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো!

-ছিলো তো? কিছুই‌ বললে না তাই বলে? কি হয় সে তোমার?

দোয়া আটকে গেলো। কি বলবে ও? সেদিন যদিও এক্সিডেন্টলি আরাবের বুকে গিয়ে পরেছিলো,কিন্তু ছেলেটাকে আরাবের মারা চড়টা তো ইচ্ছাকৃত ছিলো। কি বলার আছে ওর এখন? কে হয় আরাব ওর? তখনই বাইক থামানোর শব্দ কানে আসলো দোয়ার। পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,

-আমি বলছি আমি কে হই ওর!

চকচকে চোখে সামনের ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটার চেহারায় শংকা। দোয়া মুচকি হেসে বললো,

-আর কিছু?

-আ্ আপু আমি…

দোয়া একদম পিছন না ফিরে খানিকটা ঘাড় ঘুরিয়ে ধীর গলায় বললো,

-ও ওর জবাব পেয়ে গেছে।

কথাটা বলেই ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো ও। দোয়ার লাজুক উত্তরে পেছন থেকে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো আরাব। ” দ্যাটস্ লাইক মাই লেডি!” কথাটা বলার এরচেয়ে বড় কারন লাগতো না ওর। দোয়া একদৌড়ে পাশের গলিটা দিয়ে ঘুরে এসে আরাবের বেশ অনেকটা পিছনে এসে দাড়ালো। সামনে আরাব ডানহাতে বা হাতের শার্টের গুটানো হাতাটা টান মেরে এগোচ্ছে। দেখাদেখি দোয়াও ওর বড়হাতা জামার বা হাতা টেনে গুটালো। আরাব এবার নিজের ডানহাতা টান মারলো। একইভাবে দোয়াও নিজের ডানহাতা টেনে তুললো খানিকটা। আরাবের অনুরুপ ভঙিমাতেই এগোতে লাগলো ও। ছেলেটা একবার পেছনে দোয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে,তো একবার আরাবের দিকে। ঠোট কামড়ে হেসে ছেলেটার কাছে গিয়ে সোজা ওর কলার দুহাতের মুঠোতে ধরলো। আস্তেধীরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-ওইযে দেখছো আমার পেছনে আমাকেই নকল করতে করতে একজন এগোচ্ছে,আমার ভবিষ্যত বউ হয় সে! আমি ওই তাকওয়াতুল দোয়ার ভবিষ্যত বর,তাহসানুল আরাব। হরলিক্স খেয়ে হলেও কথাটা মনে রাখবে ওকে? এরপর থেকে যেনো আর ভুল না হয়! বাই!

কথাগুলো বলেই কলার ছেড়ে দিলো আরাব। আদরের ভাবে ছেলেটার কলার ঠিকঠাক করে দিয়ে সরে গেলো। আরাবকে ছেলেটার কলার ধরতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলো দোয়া। ও শেষ কথাটা বলার পরও আরাব ছেলেটাকে কিছু করবে,এমনটা আশা করেনি ও। এরপর যখন আরাবকে সরতে দেখলো,শ্বাস বেরোলো ওর। ছেলেটা তাড়াতাড়ি স্থানত্যাগ করলো,কিন্তু আরাব তখনো দোয়ার সামনেই পকেটে হাত গুজে হাটছে। পেছনদিক থেকে মুগ্ধভাবে দেখতে লাগলো ওকে দোয়া। কিন্তু হুট করেই চোখ গেলো সামনের সেই গাড়ির আয়নায়। আর তাতে সামনে দাড়ানো আরাবের বিম্ব স্পষ্ট। হেলতে দুলতে যেতে যেতে আয়নাতেই দোয়াকে চোখ মেরে বাকা হেসে চলে গেলো আরাব। বড়বড় চোখে তাকালো দোয়া। গাড়ির আয়নায় ওর এতোক্ষন করা সব ভঙিমাই যে চোখে পরেছে আরাবের,তাতে আর একবিন্দুও সন্দেহ নেই। ব্যাগটা শক্তভাবে ধরে লজ্জারাঙা চেহারা নিয়ে ছুট লাগালো ও। এই লোকের আশেপাশে আর এক মুহুর্তও না! কোনোভাবেই না!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩৪

কালো পাড়ের সাদা শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুজে সদর দরজায় গাদা ফুলের ঝালরটা ঠিক করছে দোয়া। আজ অরুনাভ মুখার্জীর স্ত্রীর জন্মদিন। মুখার্জীবাড়ির কেউই বেরোয় নি আজ। এলাকার ধনী,গরিব,হিন্দু,মুসলমান সবার জন্য একবেলা খাবারের আয়োজন করবেন বলে অরুনাভ মুখার্জী চিলেকোঠার সবাইকে টুকটাক কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। প্রতিবছর এমনটাই হয়। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। মেসের ছেলেরা বাড়ির বাইরে মুসলিমদের জন্য করা রান্নায় এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে,তদারকি করছে,আর মেয়েরা বাটনা বাটা,বাসন গোছানো নিয়ে আছে। কয়েকঘর হিন্দু আছে এ এলাকায়। তাদের জন্য বাড়ির ভেতরে যে রান্নাটা হচ্ছে,তার সবটা দোয়া সামলাচ্ছে। এ কাজে একমাত্র দোয়াই সাচ্ছন্দ বোধ করবে। অন্য কেউ নয়। এটা জানেন অরুনাভ মুখার্জী। তাই এ কয়েকবছর হলো দোয়াকেই ঠিক করে আসছেন তিনি।

নতুন জামা কেনা হয়নি এর মাঝে দোয়ার। কিন্তু আজকে নতুন জামাই পরতে হবে সবাইকে। এটা অরুনাভ মুখার্জীর আদেশ ছিলো। গোসল সেরে পুরোনো জামাটা ইস্ত্রি করে পরেছিলো দোয়া। কিন্তু তা চোখে পরে যায় অরুনাভ মুখার্জীর। তৎক্ষনাৎ সবকাজ ফেলে দোয়ার জন্য শাড়ি কিনে এনেছেন তিনি। তন্নি তৃষাকেও দিয়েছেন একই শাড়ি। শুধু পাড় আলাদা। তন্নিরটা লাল,তৃষারটা খয়েরি। ওরাও শাড়ি পরেছে। তাই মানা করতে পারেনি দোয়াও। শাড়ি পরেই কাজে নেমে পরেছে ও। দিয়ান দুটো লবনের প্যাকেট নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বললো,

-আপুনি? এই দু প্যাকেটে হবে এদিকের রান্না?

টুলের উপর থেকে দোয়া নিচে তাকালো দোয়া। বললো,

-আরেকটা নিয়ে আয় না হয়! যদি লাগে?

-তাহলে এ দুটো কোথায় রাখবো?

দোয়া বিরক্তি নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমার মাথায় রাখ?

-তো একটু নিচু হ?

টুলের উপর থেকেই ঝুকে দিয়ানের চুল টেনে দিলো দোয়া। মাথায় হাত দিয়ে দিয়ান চিৎকার করে উঠলো,

-মা? তোমার মেয়ে আবারো চুল টেনেছে আমার! এবার যদি চুল বড় হয়ে যায়,তারপর কোনো মেয়ের বাবা বড় চুল বলে আমার সাথে মেয়ে বিয়ে না দেয়,তার দায় কে নেবে?

মুখ কিঞ্চিত হা করে তাকিয়ে রইলো দোয়া। দৃষ্টি সরু করে তাকাতেই ছুটে চলে গেলো দিয়ান। ফিক করে হেসে দিয়ে দোয়াও ছুটলো ওর পিছনে। তন্নি এসে দোয়াকে ছুটতে দেখে হাসলো। খুব কম সময় দোয়া এভাবে হাসে। তাই ওকে ডাক না লাগিয়ে নিজের মতো করে ফুল লাগাতে লাগলো দরজায়। এরমধ্যেই আওয়াজ এলো,

-টগর ফুল হলে বেশি ভালো হতো।

তন্নি নিচে তাকালো। হালকা খয়েরি রঙের শার্ট,ধূসর প্যান্ট,বেশ গোছানো পরিধান,হাতে ট্রলিব্যাগ নিয়ে এক ভদ্রলোক দরজায় দাড়িয়ে। চিনতে না পেরে চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। কোমড়ে গোজা আচলটা ছেড়ে দিয়ে কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে আপদমস্তক আরেকবার দেখে নিলো লোকটাকে। আজকে অনেকেই আসবে এ বাড়িতে। কিন্তু কেউই ওদের অচেনা না। এমনকি দাওয়াতের বিষয়টাও অরুনাভ মুখার্জী দোয়া,ওর আর তৃষার দায়িত্বেই ছেড়েছিলো। ওরা তিনজনে মিলে দাওয়াত করেছে এলাকার সবাইকে। সেখানে এই অচেনা লোক,তারউপর ট্রলি নিয়ে! তন্নি বললো,

-টগর কেনো? গাদাই ভালো লাগছে!

লোকটা শব্দ করে হেসে বললো,

-স্বস্তিকা মুখার্জীর টগর বেশি পছন্দের ছিলো। তাই বললাম।

তন্নি এবার কিছুটা বিস্মিত হলো। ধীর গলায় বললো,

-আপনাকে তো ঠিক…

-আমাকে আপনি চিনবেন না। এটা বলুন আপনি কে?

-আমি এ বাসার ভাড়াটিয়া।

-ও। অরুনাভ মুখার্জী আছেন ভেতরে?

তন্নির হুশ ফিরলো লোকটা তখনো বাসার বাইরেই দাড়িয়ে। তাড়াতাড়ি সরে দাড়িয়ে বললো,

-হ্ হ্যাঁ হ্যাঁ। আসুন না! ভেতর আসুন?

মুচকি হেসে ভেতরে ঢুকলো লোকটা। এদিকওদিক তাকিয়ে জোরে‌ শ্বাস ফেললো একটা। দিয়ান দোয়া তখনও‌ দৌড়াচ্ছিলো। অচেনা লোকটাকে দেখে এককোনে থেমে গেলো দুজনেই। বোনের কাছে এগিয়ে দিয়ান ফিসফিসিয়ে বললো,

-এটা কে রে আপুনি?

দোয়া ঠোট উল্টে আমি কি জানি একটা লুক দিলো। অরুনাভ মুখার্জী ফতুয়ার উপর পরা কোটটার বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘর থেকে বেরোলেন। লোকটা তৎক্ষনাৎ ট্রলি ছেড়ে একদম তার পায়ের নিচে বসে গেলো। চমকে উঠলেন অরুনাভ মুখার্জী। লোকটাকে তুলে দাড় করালেন তারপর। তার চেহারা দেখেই চোখ ভরে উঠলো অরুনাভ মুখার্জীর। দুগালে হাত রেখে কাপাকাপা কন্ঠে বললেন,

-স্ স্বস্তিক?

কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো দোয়া,দিয়ান,তন্নি। নামটা চেনাচেনা লাগছে ওদের। কিন্তু মনে করতে পারছে না কোনোভাবেই। লোকটা অরুনাভ মুখার্জীর হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,

-কেমন আছো বাবা?

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তিনজন। বাবা? তারমানে এটা অরুনাভ মুখার্জীর ছেলে! হ্যাঁ! কাকাবাবু একবার বলেছিলো তো ওদেরকে। কাকীমার নাম স্বস্তিকা,কাকাবাবু অরুনিমা বলে ডাকতেন। আর কাকীমার নাম অনুসারে তাদের ছেলের নাম রাখা হয় স্বস্তিক মুখার্জী! কিন্তু ইনি তো বিদেশে ছিলেন। হঠাৎ এখানে? স্বস্তিক জরিয়ে ধরলো বাবাকে। কেদেও দিলো। অরুনাভ মুখার্জী নিজেও কাদছেন। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ চোখে বাবা ছেলের মিলন দেখছে। অনেকক্ষন পর ছেলেকে ছেড়ে অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-এতোদিন পর মনে পরলো বাবাকে? কবে এসেছিস দেশে? আমাকে কিছু জানাস নি কেনো?

-হ্যাঁ বাবা,এতোদিন পরই নিজের দায়িত্বের কথা মনে পরলো।আজই এসেছি। মায়ের জন্মদিনে তোমাকে উপহার দেবো বলে ভেবেছিলাম। তাই জানাইনি কিছু।

ছেলেকে আবারো জরিয়ে ধরলেন অরুনাভ মুখার্জী। আবেগের সবটাই বেরিয়ে আসছে তার। স্বস্তিক তন্নি,দোয়া,দিয়ান,রাধুনীগুলোর দিকে তাকালো একবার। তারপর বাবাকে ছেড়ে বললো,

-কি সবার সামনে আদর করে আমাকে লজ্জায় ফেলছো বাবা? ঘরে তো নিয়ে চলো?

অরুনাভ মুখার্জী হেসে দিলেন। ছেলের কাধ ধরে হাক ছেড়ে বললেন,

-তোমরা সবাই দেখো! আমার ছেলে ফিরেছে বিদেশ থেকে! মায়ের জন্মদিনে বাবার কাছে ফিরেছে আজ ও। স্বস্তিকার ছেলে,স্বস্তিক ফিরে এসেছে ওর বাবার কাছে!

একশ্বাসে কথাগুলো বলে ছেলের দিকে তাকালেন অরুনাভ মুখার্জী। তার মুখে হাসি,চোখে জল। একই অবস্থা বাকি সবারও। কাকাবাবুকে এর আগে ঠিক কবে এতো খুশি দেখেছে ও,ঠিক মনে পরে না ওদের। সবার অগোচরে চোখের জলটা মুছে নিলো দোয়া। স্বস্তিক সেটা দেখেছে। ওর দিকে এগিয়ে খানিকটা ঝুকে,কপাল কুচকে বললো,

-এক্সকিউজ মি? আপনি কাদলেন কেনো? আমার আসাতে খুশি হননি আপনি?

দোয়া হতভম্বের মতো ওর কুচকানো ভ্রুর দিকে তাকিয়ে রইলো। দিয়ান বলে উঠলো,

-কেনো? আপুনি খুশি হবে না কেনো?

স্বস্তিক দিয়ানের গাল টেনে দিয়ে বললো,

-আরেহ্ বাহ্! ছোটা প্যাকেট,বাড়া ধামাকা রাইট?

হা করে তাকিয়ে থেকে গালে হাত বুলাতে লাগলো দিয়ান। তন্নি এগিয়ে এসে বললো,

-কথাটা গাল না টেনে বলা যেতো না?

তন্নির দিকে আরো বেশি বিরক্তিতে তাকালো স্বস্তিক। তারপর বাকা হেসে বললো,

-তারমানে আমি আসায় আপনিই খুশি নন!

তন্নি রাগী চোখে তাকালো। অরুনাভ মুখার্জী হেসে দিয়ে তন্নি,দোয়া দিয়ানকে দেখিয়ে বললেন,

-ওরা এখানেই থাকে। দোতালায়। ও তন্নি,ও দোয়া,এটা দোয়ার ভাই দিয়ান।

স্বস্তিক তন্নির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-মুসলিম।

অরুনাভ মুখার্জী জবাব দিলেন,

-হ্যাঁ,এখানে বর্তমানে আমি আর আরেকটা ফ্যামিলি শুধু ব্রাক্ষ্মন। বাকিরা মুসলিম।

স্বস্তিক মুচকি হাসলো। এর মধ্যে তৃষা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,

-তন্নিপু? আমার সুতোকাটা শাড়িটা তুমি কেনো পরেছো? ওইটা আমিই পরতাম! সমস্যা হতো না তো!

আঁচলের সুতোকাটা দিকটা মুঠো করে ধরলো তন্নি। ছেড়া জায়গাটা যাতে কারো চোখে না পরে। স্বস্তিক তন্নির দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষন। তৃষার কথায় একপলক ওর দিকে তাকালো,তারপর তন্নির পেছনে মুঠো করা হাতের দিকে উকি দিলো। চোখ রাঙানোর মতো করে তাকালো তন্নি ওর দিকে। নতুন মানুষকে দেখে থেমে গেলো তৃষা। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-কি বলিস তৃষা? শাড়ি সুতোকাটা ছিলো?ইশ্! তিনটা একজায়গা থেকেই কিনেছি। খুলে দেখা হয়নি তো!

তন্নি স্বস্তিকের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-সমস্যা নেই কাকাবাবু। অল্প একটু কাটা।

স্বস্তিক একটা ছোট শ্বাস ফেলে আরামে দাড়ালো। মেয়েটা উল্টো কথা বলতে ভালোবাসে,বোঝাই যাচ্ছে। দোয়ার দিক ফিরে বললো,

-নাইস টু মিট ইউ মিস দোয়া।

দোয়া জোরপুর্বক হেসে বললো,

-জ্বী পরিচিত হয়ে আমারো ভালো লাগলো।

-চল চল,ঘরে চল! আগে ফ্রেশ হয়ে নে,তারপর সব দিক তো তোকেই সামলাতে হবে! চল ঘরে!

ছেলেকে নিয়ে হাটা লাগালেন অরুনাভ মুখার্জী। পেছনে তন্নির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বাবার সাথে পা বাড়ালো স্বস্তিক। গাঢ় খয়েরি পাড়,সাদা শাড়িতে বাঙালী মেয়েদের বুঝি এক আলাদাই সৌন্দর্য! কথাটা ভেবে মুচকি হেসে সামনে তাকিয়ে ঘরে ঢুকলো ও।

দোয়া ছাদে এসে দাড়িয়েছে। রাত নেমেছে অনেক আগেই। নিচের সবকাজ গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে ছাদে চলে এসেছে ও। বাড়িতে লোকজনের অভাব নেই। অরুনাভ মুখার্জী সবাইকে স্বস্তিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বলে রয়ে গেছে অনেকেই। আধভেজা চুলগুলো কাজের জন্য খোপা করে রেখেছিলো দোয়া। আস্তেকরে খুলে দিলো চুলগুলো। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস নিতে লাগলো। মোটামুটি গোল চাঁদ,শীতল বাতাস,নিচতলা আর আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর আলোতে আবছা অন্ধকারে ডুবে থাকা ছাদ,এখানে থাকার অনুভবটা মন্দ না। তবুও আসেনি কোনোদিন ও এই ছাদে। সেদিন আরাবের ভালোবাসি বলার পরই শুধু ছুটে এসেছিলো ও ছাদে। আবারো সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো দোয়ার। চোখ‌ খুলে ফেললো ও। কানে বাজলো,

-যার লাজুকতার প্রকাশ আমার চারপাশকে ভুলিয়ে দেয়,কালো পাড় সাদা শাড়ির যার সাধারন সাজ আমার চারপাশকে রাঙিয়ে দেয়,যার উপস্থিতি আধারে ডোবা ছাদকেও উজ্জলতায় ভরিয়ে দেয়,যার ঢেউখেলানো কৃষ্ণবর্ন চুল রাতের আকাশের কালো মেঘকেও হার মানায়,তার বন্ধ চোখ হঠাৎই‌ শিহরনে খুলে ফেলার কারন আমি। এ যে অনেক বড় প্রাপ্তি আমার! অনেকবড় প্রাপ্তি!

শ্বাস আটকে সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। হঠাৎই ঝড় শুরু হয়ে গেছে ওর ভেতরটায়। চোখ বন্ধ করে মাথা নামিয়ে নিলো ও। মনেমনে প্রার্থনা করতে লাগলো,এ যেনো ওর ভ্রম হয়! যার আওয়াজে হৃদয়ের কোনো এককোনে শতসহস্র তান্ডব বয়ে যায়,সে মানুষটা কোনোভাবেই যেনো এখানে না আসে! আরাব আরেকপা এগিয়ে বললো,

-কাকাবাবু আমাকেও দাওয়াত করেছিলো দোয়া। একবার মুসলিমদের ওদিকে খাওয়াতে গেলেও পারতে!

মাথা নিচু করে আস্তেধীরে পেছন ফিরলো দোয়া। ঘাড় বাকিয়ে পা থেকে মাথা অবদি ওকে দেখে নিলো আরাব। প্রথমবার দেখা সেই রাতের মতোই আজ শাড়িতে দোয়া। সেই কখন থেকে অস্থির হয়ে আছে এতোটা,বা এরচেয়ে বেশি কাছ থেকে ওকে দেখবে বলে। অরুনাভ মুখার্জীর একটা ফোনকলে বায়োমেডি থেকে ছুটে চলে এসেছে ও। সকালের অফিস,বিকেলের ল্যাব সবকিছুর ক্লান্তি মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গিয়েছিলো ওর যখন শাড়িতে দোয়াকে দেখেছে ও। মেয়েটা কাজের ব্যস্ততায় একবারও এগোয়নি ওর দিকে। দেখেইনি। অবশ্য দেখলে যে লজ্জায় আরো নুইয়ে থেকে কাজ করতো সেটা বুঝেই চুপচাপ রইলো আরাব। আজকে দোয়ার চুলগুলো ছাড়া,ঘাড়ের একপাশ দিয়ে সামনে দেওয়া।

বেশ অনেকক্ষনের নিরবতা দেখে চোখ মেললো দোয়া। এভাবে থাকা উচিত নয়। বাড়িতে অনেকেই আছে এখন। অতিকষ্টে চোখ তুলে তাকালো আরাবের দিকে। নিষ্পকলভাবে তাকিয়ে আরাব। লজ্জায় দোয়ার ইচ্ছে করছিলো দুহাতে ওই চাওনিকে ঢেকে দিতে। পারেনি। পাশ কাটিয়ে আসছিলো ও। আরাব আটকে দেয় ওর হাত। একটানে আবার সামনে দাড় করিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-ছুয়েছি বলে রাগ দেখিয়ে দুটো চড় মেরে যাও,সয়ে নেবো। কিন্তু ওই হাসিতে খুন করে চলে যাবে,তা কি করে হতে দেই?

দোয়া একেবারে নামিয়ে নিলো মাথা। বুঝলো ওর লাজুক হাসিটা আরাবের দৃষ্টি এড়োয়নি। কাপছে মৃদ্যু ও। কাপাকাপা গলাতেই বললো,

-আ্ আমাকে যেতে দিন মিস্টার আরাব।

-এভাবে আর কতোদিন?

শান্ত,সোজা প্রশ্ন আরাবের। ধক করে উঠলো দোয়ার ভেতরটা। মাথা তুলে তাকালো ও আবারো। একটা ছোট হতাশার শ্বাস ফেললো আরাব। দোয়ার ভেতরটা যেনো এবার মুচড়ে ধরছে। একটা শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলতে যাবে,আরাব রেলিংয়ের উপর রাখা ব্যাগ থেকে কাচের চুড়ি বের করেছে আরাব। দোয়ার দুহাতে নিজ হাতে চুড়ি পরিয়েছে ও। রিনরিন শব্দে প্রতিবার এমনভাবে চোখ খিচে বন্ধ করে নিচ্ছিলো,যেনো ওই শব্দ একেবারে ভেতরটায় আঘাত করছে ওর। দুহাতে চুড়িগুলোর রঙও দেখেনি দোয়া। ওর দৃষ্টি আরাবের বারবার বন্ধ করে নেওয়া চোখজোড়াতেই ছিলো। মাথা নিচু করে দোয়ার দুহাত ধরে চুড়িগুলো দেখতে লাগলো আরাব। হঠাৎই দোয়ার হাতদুটো ওর নিজের চোখে নিয়ে চোখ আটকে দিয়ে বললো,

-আমার দৃষ্টিকে থামিয়ে দাও দোয়া। ওরা যে দিনের পর দিন আরো বেশি বেসামাল হয়ে উঠছে। সামনে যখন তুমি,ওদের সামলানো যে আমার আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। ওদের চাওনিতে তোমাকে অস্বস্তিতে পরতে হচ্ছে। তোমাকে নিয়ে ওদের দৃষ্টিসীমা আমার হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছে। সবকাজের ভীড়ে,প্রতিটা মুহুর্তে ওরা শুধু তোমাকেই আমার সামনে তুলে ধরছে। পারছি না! তোমার অবর্তমানে ওদের উপর সবটা ছাড়তে পারছি না! এতে যে আরো অস্থিরতা বাড়ে দোয়া! মনপ্রান শুধু বারবার এটাই চায়,তোমাকে একেবারে আপন করে সবসময় নিজের কাছে রাখি। এই অবাধ্য দৃষ্টিসীমার বাইরে আর নয়! আর নয়!

কথাগুলো শেষে হাতে আরাবের ঠোটের স্পর্শ পেতেই ধরফরিয়ে কয়েকপা পিছিয়ে গেলো দোয়া। আরাব প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মুচকি হেসে বললো,

-টেক ইউর টাইম।

কথাটা বলেই আরাব চলে আসলো ছাদ থেকে। পেছন পেছন দৌড় লাগালো দোয়াও। ওর হাতের চুড়ির শব্দে হাসতে হাসতেই আরাব নিচে নামছিলো সিড়ি বেয়ে। নিচতলায় আসতেই স্বস্তিক সামনে পরে ওর। দোয়া থেমে যায়। একপলক উপরে দোয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তিক আরাবকে বললো,

-চলে যাচ্ছেন?

আরাব কিঞ্চিত ঘাড় ঘুরালো। পকেটে দুহাত গুনে পুরোপুরিভাবে পিছন না ফিরে আবারো সামনে তাকিয়ে বললো,

-হ্যাঁ।

-ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না দাদা। তবে আমাকে আমার দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চিরঋণী থাকবো আপনার কাছে।

-বাবার যত্ন নিও স্বস্তিক। তোমাকে অনেক ভালোবাসেন কাকাবাবু।

আরাব,স্বস্তিক দুজন দুজনকে জরিয়ে ধরলো। বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো শুধু দোয়া। স্বস্তিকের আগমনে কোথাও না কোথাও আরাবের ভুমিকা আছে,তা বুঝতে বাকি রইলো না দোয়ার। স্বস্তিককে ছেড়ে একপলক পেছন ফিরে দোয়ার দিকে তাকিয়ে,চলে গেলো আরাব। আবারো একরাশ মুগ্ধতার বহর চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো দোয়াকে। আবেশে দুচোখ বন্ধ করে শাড়ির আঁচলে ডেকে নিলো চুড়িগুলো।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৩৫

-আজ তাকে আমি বলবো তাজ,তাকে ভালোবাসি।

দোয়ার মুখে কথাগুলো শুনে আটকে রইলো তাজীন। চোখের পলক ফেলা ভুলে গেছে ও। বড়বড় চোখে দোয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। দোয়া লজ্জানত হয়ে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে নিচদিক তাকিয়ে। তাজীন আস্তেধীরে ওর ফোনটা নিয়ে নিরবের নাম্বার ডায়াল করলো। কল রিসিভ করেই নিরব বললো,

-তোমার ক্লাস শেষ তাজ? আমি বেরিয়েছি কিন্তু!

-হু ক্লাস শেষ। আচ্ছা নিরব? তোমার সকালের চায়ে আমি চিনি দেইনি। কেমন ছিলো ওটা?

-ভ্ ভালো ছিলো তাজ। তুমি বানাবে আর সেটা খারাপ হবে,তা কি করে সম্ভব বলো? খুবই ইয়ামি ছিলো চা টা! খুব টেস্টি ছিলো!

নিরবের উত্তর শুনে নিরবে ফোন কেটে দোয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো তাজীন। ফোনের ওপাশ থেকে নিরব ভয় পেয়ে মিথ্যে বললো। তারমানে এটা বাস্তব। দোয়া ওর পাশেই বসে। দোয়াই বলছে,ও কাউকে ভালোবাসি বলবে। নাহ্!কোনো ভুল নেই এতে। কোনো সন্দেহ নেই আর। মিনমিনে গলায় বললো,

-সত্যি বলছিস দোয়া?

দোয়া মাথা নিচু রেখেই আঙুলে ওড়না পেচাতে লাগলো। তাজীন খুশিতে জরিয়ে ধরলো ওকে। অনেকটা সময় পর ছেড়ে দিয়ে বললো,

-আমি এক্ষুনি আরাব ভাইয়াকে কল করছি!

আরাবের নাম শুনেই চোখ তুলে তাজীনের দিকে তাকালো দোয়া। আস্তেধীরে বললো,

-কল করতে হবে না। আমি জানি তার সাথে আজ দেখা হবে আমার।

ফোন কানে নিয়েও তাজীন থেমে গেলো। কলটা কেটে কৌতুহল নিয়ে বললো,

-মানে? কোথায় দেখা হবে? ভাইয়াকে আসতে বলেছিস কোথাও?

মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো দোয়া। কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললো,

-জানিনা তাজ। কোথায়,কিভাবে দেখা হবে,জানিনা। শুধু এটুকো জানি,আজ তাকে আসতেই হবে। আজ তার সাথে আমার দেখা হওয়া,অনিবার্য। নিয়তি ঠিক তাকে আজ আমার সামনে এনে দাড় করাবে।

তাজীন মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই তো!নিয়তি! এই নিয়তিই কতো সুন্দরভাবে জুড়ে দিয়েছে দোয়া আরাবকে। কতো সুন্দর দুজনের কাছে আসা! কতো সুন্দর,কতো পবিত্র ওদের অনুভূতি। দোয়া হাতে থাকা বইটা বুকে শক্তভাবে আকড়ে ধরলো। শত আধারের ভীড়েও আরাব আলোকিত করে দিয়ে গেছে ওর চারপাশ। ওর বেরঙ জীবনে হঠাৎই রঙের বর্ষনের জন্য দায়ী সে। হঠাৎই নানা বেসামাল অনুভূতি সৃষ্টির জন্য দায়ী সে। কতোভাবে তো আটকালো নিজেকে,সামলালো নিজেকে। পারেনি।

মাঝে আরো দুটো দিন আরাবের দেখা মেলেনি। সে রাতে চিলেকোঠার ছাদে আরাবের বলা কথাগুলো একমুহুর্তও স্থির থাকতে দেয়নি দোয়াকে। অতি ক্ষুদ্র স্বরে আরাব বলে তো গিয়েছিলো,টেক ইওর টাইম। কিন্তু সে সময় ওকেই কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। আরাবের অনুপস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে ওর কাছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে,পরিনতি যাই হোক,আর নিজের অনুভূতি লুকোতে পারবে না ও। আর দমিয়ে রাখা সম্ভব নয় এদের। যার কাছে আসায় শিহরন,দুরে যাওয়ায় যন্ত্রনা,যার ভালোবাসি বলায় এক অন্য দুনিয়াতেই হারিয়েছে দোয়া,যাতে কঠোরতাও লাজুকতায় পরিনত হয়,তাকে ভালোবাসে ও। হ্যাঁ,আরাবকে ভালোবাসে দোয়া। ও স্বীকার করবে,সে মানুষটার কাছে ও স্বীকার করবে আজ সবটা। তার ভালোবাসায় গা ভাসাবে। যা হবে,হবে। কোনো কিছুর পরোয়া নেই আজ দোয়ার। কোনো কিছুর না!তাজীন বললো,

-যদি আজ আরাব ভাইয়া না আসে?

-সে আসবে!

তাজীন হাসলো। গাড়ির হর্ন শুনেই রাস্তায় তাকালো ও। নিরব এসেছে। দোয়া আরেকবার চারপাশে চোখ বুলালো। গাড়ি থেকে নেমে এসে নিরব দোয়াদের সামনে দাড়ালো। দোয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

-কেমন আছেন ম্যাম?

-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

-জ্বী ভালো। আপনি এখনো যাননি? আপনার বাস তো…

নিরব কথা শেষ করার আগেই তাজীন বলে উঠলো,

-আরাব ভাইয়া কোথায়?

দোয়া মাথা নিচু করে রইলো। নিরব একপলক তাজীনের দিকে তাকিয়ে একবার দোয়ার দিকে উকি‌ দিলো। তারপর বাকা হেসে বললো,

-স্যার নতুন এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে অনেক ব্যস্ত আছেন। দুদিন হলো ল্যাব থেকেই বেরোননি! হয়তো আরো কয়েকদিনও বেরোবেন না ল্যাব থেকে।

তাজীনের মন নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। আর দোয়ার চেহারায় থাকা হাসিটা আরো প্রসারিত হলো। নিরব উকিঝুকি দিয়েই ওর হাসিটা পরখ করলো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

-ম্যাম হাসছেন?

দোয়া মাথা তুললো। হাসি খানিকটা কমিয়ে বললো,

-জ্বী না। আপনারা আসুন। আমিও এগোই। ভালো থাকবেন।

খানিকটা হা হয়ে গেলো নিরবের মুখ। দোয়া তাজীনকে ইশারায় আসছি বুঝিয়ে দু পা এগোলো। তাজীন পেছন থেকে ওর হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,

-আরাব ভাইয়া আসবে না,তুই খুশি হয়ে চলে যাচ্ছিস?

দোয়া তাজীনের পেছনে তাকালো। ওখানে ওদের কথা শোনার জন্য নিরব কান উচিয়ে আছে একপ্রকার। মুচকি হেসে ও এগিয়ে তাজীনের কানেকানে বললো,

-যদি এতো ব্যস্ততার মাঝে আমার সাথে দেখা করতে নাই পারে,কেমন প্রেমিকপুরুষ সে? তোমার বরকে বলে দিও তাজ,তার বলা নতুন এক্সপেরিমেন্টের ব্যস্ততাও আজ তাকে আমার সাথে দেখা করা থেকে আটকাতে পারবে না।

তাজীন হেসে দিলো। নিরব হতভম্বের মতো দুজনের ভাব বোঝার চেষ্টা করছে,তবুও কিছুই বুঝলো না। গলা ঝেরে বললো,

-চলো তাজ? বাসায় যাই?

দোয়াকে বাই বলে নিরবের সাথে চলে গেলো তাজীন। ফুটপাত দিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে পা বাড়ালো দোয়া। নিচদিক তাকিয়ে হাটলো অনেকক্ষন। বাস চলে গেছে আগেই। আরাব ল্যাবে ব্যস্ত। কেনো এভাবে হাটছে,নিজেও জানে না দোয়া। তবে উদ্দেশ্যহীন হয়ে হাটতে ভালো লাগছে ওর। কাধের ব্যাগটা আকড়ে ধরে নিচদিক তাকিয়ে আরেকপা হাটতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে দুপা পিছিয়ে গেলো দোয়া। মাথা তুলে তাকালো ও। মোবাইল কানে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ফুটপাতের উপর দাড়িয়ে কথা বলছে আরাব। মুচকি হেসে ঘাড় বাকিয়ে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো ও আরাবের দিকে।

আরাব ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। ভাবখানা এমন,কারো সাথে ওর ধাক্কা লেগেছে,সেটা টেরই পায়নি ও। অন্যদিন হলে দোয়া ওর চাওনিতে লজ্জায় পরে যেতো। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো। আজ না আরাব তাকাচ্ছে,না দোয়ার লজ্জা করছে,নাইবা ওর চলে যেতে ইচ্ছে করছে। আরাব সামনে তাকিয়ে। আর সে সুযোগে দোয়া খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে ওকে। ব্যস্ত রাস্তার পাশের ফুটপাত,পথচারী কিছুই মনে পরছে না যেনো দোয়ার। আরাবের পরনে আকাশী রঙের শার্ট,হাতা কনুই অবদি গুটানো,হাতে বড় আকারের ঘড়ি,চুলগুলো বেশ এলোমেলো। হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় দোয়ার ওড়না উড়ে একদম আরাবের গায়ে গিয়ে লাগলো। বুকে এসে পড়া আকাশী ওড়নাটার দিকে তাকিয়ে হুট করেই দোয়ার দিকে ফিরলো আরাব।

এসময় দোয়াকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না আরাব। ব্যস্ততায় দেখা করতে পারে নি দু দিন। কিন্তু তাতে দোয়ার চাওনির পরিবর্তন লক্ষনীয়। আজকে সেই চিরচেনা লাজুকতা নেই। আরাব বুঝেই পায় না,ওর অনুপস্থিতে দোয়া যেনো আরো বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। ওই বা নিজেকে দুর্বল দেখাবে কেনো? সুন্দরভাবে ঘাড় বাকিয়ে একটা বাকা হাসি দিয়ে ভ্রু নাচালো ও। হচকিয়ে গেলো দোয়া। আরাবের বাকা হাসি দেখে এতোক্ষনে হুশ ফিরলো ওর। বড়বড় চোখ করে ডানহাত উচিয়ে পাশে ইশারা করে বললো,

-তারা খসেছে মিস্টার আরাব!

ঠোট টিপে হেসে একপা এগোলো আরাব। দোয়া চোখ বন্ধ করে জিভ কাটলো। বিকেলের এ সময় তারা খসা ঘটনা বলার চরম মতো বোকামি আর কি হতে পারে? আবারো চোখ মেললো ও। আরাব সেভাবেই বাকা হাসছে। এবার বা হাত উচিয়ে পাশে দেখিয়ে ফট করে বলে ফেললো,

-কতোসুন্দর পদ্মপুকুর দেখুন মিস্টার আরাব!

আরাব হেসে আরো একপা এগোলো ওর দিকে। দোয়া কাচুমাচু হয়ে আরো একপা পিছোলো। পাশের পদ্মচত্বরটা দেখাতে গিয়ে পদ্মপুকুর বলে ফেলেছে ও। আরাব খানিকটা ঝুকে বললো,

-তুমি জানো আমার চারপাশে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো এনে দিলেও সেদিকে তাকাবো না আমি। কারন তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে। তবুও উদ্ভট কথাবার্তা বলে চলেছো কেনো,জানতে পারি?

দোয়া মাথা নিচু করে রইলো। ধীর গলায় বললো,

-আপনি এখানে?

-একজনের সাথে বেরোবো। সে এখানেই দাড়াতে বলেছে। তা তুমি বাস ছেড়ে এখানে কেনো?

মাথা তুলে আরাবের দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। কারন যাই হোক,দেখাটা হলোই। আবারো মাথা নামিয়ে নিয়ে বললো,

-আপনাকে কিছু বলার ছিলো।

চকচকে চোখে তাকালো আরাব। দোয়ার লাজুকতায় ওর বুঝতে বাকি নেই,দোয়া কি বলতে চায়। তখনই একটা গাড়ি এসে দাড়ালো ওদের সামনেই। দোয়া শুকনো মুখ করে তাকালো গাড়িটার দিকে। আরাব দুষ্টু হেসে বললো,

-তোমার কিছু বলার আছে? আর আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে দোয়া। তবে তা এখানে,এই কোলাহলে নয়! কাল কৃষ্ণচূড়াতলায় অপেক্ষা করবো। বলবো বলে,শুনবো বলে! দেখা হচ্ছে তবে? আমার জীবনের সবচেয়ে রাঙা গোধুলীতে,যার সাথে আমার জীবন রাঙাতে চাই,তার সাথে!

এটুকো বলে থামলো আরাব। আরো এগিয়ে দোয়ার দিকে ঝুকলো অনেকটাই। দোয়া আড়চোখে আশেপাসে তাকলো। কোনোরুপ ভ্রুক্ষেপ না করে আরাব একদম ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

-তোমার সাথে!

দোয়া অতি ধীরে মাথা উপরেনিচে নাড়ালো। মুচকি হেসে সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো আরাব। দোয়া নিজেও হাসলো। আরাবের বলা ওই রাঙা গোধুলীতে এক অন্যরকম পাগলামি অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ও জানে। ঠোটের কোনের লাজুক হাসিটা লুকিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে।

কোমড়ে দুহাত দিয়ে সরু চোখে স্বস্তিকের দিকে তাকিয়ে তন্নি। স্বস্তিক ক্যামেরা হাতে ভাষাহীনভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে। তৃষা একবার তন্নির দিকে তাকাচ্ছে,তো একবার স্বস্তিকের দিকে। বেশ ভালোমতোই দুজন একসাথে হেটে ফিরছিলো বাসস্টপ থেকে। হুট করেই দৌড় লাগিয়ে স্বস্তিকের পথ আগলে দাড়িয়েছে তন্নি। তন্নি কড়া গলায় বললো,

-আপনার ক্যামেরা চেইক করবো আমি!

-আমার পার্সোনাল জিনিস আপনাকে কেনো চেইক করতে দেবো?

-আপনার পার্সোনাল জিনিসে আমি নামক পার্সোনটার ছবি আছে তাই!

স্বস্তিক হতাশার শ্বাস ফেললো। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো এক মেয়ে লাফিয়ে কোনো এক গাছ থেকে ফুল তুলছে। দেখতে ভালো লাগছিলো বলে পেছনদিক থেকে মুখ না দেখে ছবিটা তুলে ফেলেছে ও। সেটা যে তন্নি ছিলো না তা বুঝেছিলো,আর তন্নি ওর ছবি তোলাটা দেখে নেবে,না তা বুঝেছিলো। চুপচাপ ক্যামেরাটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-না জানিয়ে ছবি তোলার জন্য সরি। আমি জানতাম না ওটা আপনি ছিলেন।

ভ্রুকুচকে তাকালো তন্নি। বিলেতি বাবুর এতো নম্র ব্যবহার,ধারনায় ছিলো না ওর। বললো,

-তো আমি ছিলাম না ঠিকাছে,অন্য মেয়েরই বা কেনো ছবি তুলবেন আপনি?

-সবার তো আপনার মতো সমস্যা নাও থাকতে পারে!

-সব বাঙালী মেয়েরই সমস্যা হবে! এটা আপনার বিলেত না,যে যার তার,যেমন খুশি ছবি তুলে ফেলবেন আর সে কিছু মনে করবে না!

স্বস্তিক ক্যামেরাটা নাড়িয়ে বললো,

-আপনার একটাই ছবি ছিলো। বাকিসব অন্যসবার। ভেবেছিলাম আপনার হাতে ক্যামেরাটা দেবো,শুধু আপনার নিজের ছবিটা ডিলিট করবেন। কিন্তু এখন আর ভরসা পাচ্ছি না! আপনি নিজের সাথে পুরো নারীজাতির সমস্যার দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন। সবগুলো ছবিই হয়তো ডিলিট করে দেবেন। বিশ্বাস নেই আপনাকে। তাই ক্যামেরাটা আপনি পাচ্ছেন না!

বড়বড় চোখে তাকালো তন্নি। এই লোককে ভদ্র ভাবাই ওর ভুল হয়েছে। তৃষার দিকে তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে বললো,

-তুই কিছু বলবি না?

তৃষা মোচড়াতে মোচড়াতে বললো,

-স্ স্বস্তিকদা? ব্ বলছি যে…

-তোমাকে ভদ্র,সভ্য বলে মনে হচ্ছে। তুমি নাও ক্যামেরাটা।

স্বস্তিক ক্যামেরাটা তৃষার দিকে এগিয়ে দিলো। তন্নি যেইনা এগোতে যাবে,দুজনের মাঝখানে এসে দাড়ালো স্বস্তিক। তৃষা ক্যামেরাটা নিয়ে তন্নির ছবিটা বের করলো। মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছবিটায় তন্নি লাফিয়ে ফুল পারার চেষ্টা করছে গাছ থেকে। ছবিটা এতো সুন্দর এসেছে,ও বলেই উঠলো,

-তন্নিপু! ছবিটা অনেক সুন্দর গো!

-হতেই হতো। স্বস্তিক মুখার্জী তুলেছে বলে কথা!

ভাব নিয়ে বললো স্বস্তিক। তন্নি চেচিয়ে বললো,

-ডিলিট কর তৃষা!

আতকে উঠে ছবিটা ডিলিট করে দিলো তৃষা। তন্নি ফুসতে ফুসতে বললো,

-ভালো হয়েছিলো কারন ছবিটা আমার ছিলো!

-নিজেকে এতো সুন্দরী ভাবার কারন?

-নিজেকে এতো ভালো ফটোগ্রাফার ভাবার কারন?

বুকপকেট থেকে একট কার্ড বের করে তন্নির সামনে ধরলো স্বস্তিক। কার্ডে স্বস্তিকের নাম লেখা। আর পেশার জায়গায় লেখা,ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। ওটা দেখে তন্নি দমে গেলো অনেকটাই। একটু ধীরস্থিরভাবে বললো,

-ও্ ও হতে পারেন আপনি পশুপাখির ফটোগ্রাফার,তা বলে মানুষের ছবি ভালো করে তুলতে পারেন না। আমার ছবি ভালো হওয়ার কারন,ওটা আমার ছবি!

-হ্যাঁ,মানুষের ছবি ভালো করে তুলতে না পারলেও আপনার মতো উল্টো কথা বলা জীবটার ছবি ভালো আসা আবশ্যক ছিলো।

তৃষার হাত থেকে ক্যামেরাটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলো স্বস্তিক। ওর কথা শুনে রাগ নিয়ে পা ছুড়লো তন্নি। তৃষা এতোক্ষনভর ওদের অকারন ঝগড়া শুনে আহম্মকের মতো বলে উঠলো,

-এসব কি ছিলো? কেনো ছিলো?

টুইঙ্কেলদের বাসায় পৌছাতেই দোয়াকে জরিয়ে ধরলো টুইঙ্কেল। খুশি আজ উপচে পরছে ওর চোখেমুখে। দোয়া ওর গাল টিপে দিয়ে বললো,

-আজ টুইঙ্কেল এতো হ্যাপি কেনো?

-আজ আমার রেজাল্ট দিয়েছে উইশমাম! আমি তো টপ করেছি ক্লাসে!

অসম্ভব খুশিতে দোয়া জরিয়ে ধরলো টুইঙ্কেলকে। চোখেমুখে চুমো দিয়ে ওর দুগাল ধরে বললো,

-আমি জানতাম তো! আমার লিটল স্টার টপ করবে ক্লাসে! এতো কষ্ট করেছে কি না সে!

-উহুম। কষ্ট তো করেছে টুইঙ্কেলের উইশমাম! তাইতো টুইঙ্কেল এতো ভালো রেজাল্ট করেছে!

তৌফিকা মিষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসলো। দোয়াকে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর গালে হাত রেখে বললো,

-তুমি জানো দোয়া,তুমি আসার পর সবকিছু অনেক সুন্দর ভাবে বদলাচ্ছে।

দোয়া মৃদ্যু হেসে ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,

-এভাবে কেনো বলছেন আপু? আপনারাও তো কম কষ্ট করেন নি!

-তবুও তোমার ভুমিকা অস্বীকার করবো কি করে?

দোয়াকে মিষ্টি নিজহাতে খাইয়ে‌ দিলো তৌফিকা। অল্প কিছুক্ষন টুইঙ্কেলের সাথে কথাবার্তা বলে উঠে আসছিলো ও। আসার পথে ওর‌ হাতে সুন্দর একটা খাম গুজে দিলো ও। দোয়া বুঝলো ওতে ওর বেতন। সুন্দরমতো হেসে‌ বেরিয়ে আসলো ও।
বাসার নিচে নেমে পাশের দোকানে থাকা চকলেটের বক্সগুলোতে চোখ গেলো দোয়ার। টুইঙ্কেলের এতো ভালো রেজাল্ট,ওর উচিত ওকে কিছু উপহার দেওয়া। ব্যাগ থেকে তৌফিকার দেওয়া বেতনের খামটা বের করলো ও। খাম খুলতেই কিছু বাড়তি টাকা দেখলো ওতে দোয়া। মেয়ের ভালো রেজাল্টের জন্য খুশি হয়ে হয়তো তৌফিকা সেগুলো দিয়েছে ওকে। কিন্তু তা নেওয়াটা সমাচীন মনে হলো না ওর। গুটিগুটি পায়ে আবারো সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো টাকাটা ফেরত দেবে বলে। কয়েকসিড়ি উঠতেই শুনতে পেলো,

-তুমি জানো না তৌফিকা! তোমার ভাই আরাব এই দোয়া নামের মেয়েটার জন্য ঠিক কি ধরনের পাগলামি শুরু করেছে! টুইঙ্কেলকে পড়ানোর জন্য ওকে আনা,সবসময় সবরকমভাবে ওকে হেল্প করা অবদি ঠিক ছিলো। কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি আরাব! তোমার ভাই ওর জন্য,শুধুমাত্র ওর জন্য ভার্সিটিতে তোমার বাবাকে দিয়ে স্কলারশিপ এমনকি বাস অবদি গ্রান্ট করিয়েছে! একজনের হাতে বেইস ঢেলে তার হাত ঝলসে দিয়েছে! একজনের এগেইনিস্টে হাত ধুয়ে পরে আছে! তাকে পুলিশে দেবে বলে! এই মেয়েটাকে নিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে তোমার ভাই! নিজের ‌মা,বাবা,বোন,বোনজামাইয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করছে এই রেপড্ মেয়েটার জন্য!

দোয়ার পা থেমে গেলো। সিড়ি আকড়ে ধরে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। স্টপ ইট মুফতাহির!- বলে দরজা ধরাম শব্দে লাগিয়ে দিলো তৌফিকা। টপটপ করে পানি পরতে লাগলো দোয়ার চোখ দিয়ে। আস্তেআস্তে অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো ওর চারপাশ।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here