এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -৪৩+৪৪+৪৫

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৩

গাড়ি থেকে নেমে মুখার্জীবাড়ির বাইরে দাড়াতেই থমকে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আগেরবার দেখা ‌বেরঙ চিলেকোঠাটা আজ যেনো রাজ্যাভিষেকে মেতে থাকা রাজবাড়ির মতো দেখাচ্ছে। রঙ চটে যাওয়া দেওয়ালগুলোতে উজ্জল রঙের স্পর্শ,বড়বড় গাদা ফুলের ঝালড় ঝুলানো বারান্দাতে,দেয়ালে দেয়ালে ফুলের সাজসজ্জা,মরিচবাতি,উঠোনের একপাশে ফুলে ফুলে সাজানো বর বসানোর স্টেজ। সাজ দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না তৌফিক ওয়াহিদ। গাড়ির ভেতর থেকে ফাইলটা নিয়ে ভেতরে এসে আরো বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন চারপাশ। আজ দোয়া আরাবের গায়ে হলুদ। সেই সাজে সেজেছে পুরো মুখার্জীবাড়ি। বলা বাহুল্য,মুখার্জীবাড়ির এই সাজ,দোয়ার হলুদে এতোএতো খরচ,সবটাই কল্পনাতীত ছিলো তৌফিক ওয়াহিদের।

বাড়িতে উপস্থিত সবার পরনে হলুদ পোশাক। সবাই কথা বলছে নিজেদের মতো,ছেলেরা কাজে ব্যস্ত,তবুও হাসি আড্ডায় মেতেছে,বাচ্চারা সারি বেধে রেলগাড়ির মতো ছুটোছুটি করছে। রংধনুর কথা মনে পরে গেলো তৌফিক ওয়াহিদের। ইভেন্ট ম্যানেজারকে দায়িত্ব দিয়ে সকালেই অফিসে চলে গিয়েছিলেন উনি। পরে আরাব জানালো ওর গায়ে ছোয়ানো হলুদ আর দোয়ার বিয়ের যাবতীয় জিনিস এখানে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব নাকি ছেলের বাবার। এমনটাই নিয়ম দোয়াদের। প্রথমে দ্বিমত রেখেছিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। পরে ফর্মুলার অনুমতি নেওয়ার দিকটা বিবেচনা করে ফাইল নিয়ে চলে এসেছেন চিলেকোঠায়। তৌফিকা হলুদের ডালা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-এইটা তোমার হাতে নাও বাবা?

-আরে আরে বেয়াইসাহেব? এসে গেছেন আপনারা? কেমন আছো তৌফিকা? এই সবাই এদিকে আয়! ছেলেপক্ষ হলুদ নিয়ে এসেছে যে!

অরুনাভ মুখার্জীর কথায় চার পাঁচজন মিলে ব্যস্ত হয়ে পরলো তৌফিকা,টুইঙ্কেল,তৌফিক ওয়াহিদসহ বাকিদের নিয়ে। দোয়া বাদে বাকি সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো ওরা। জোরপুর্বক হাসিতে কিছুক্ষন আতিথেয়তা স্বীকার করে তৌফিক ওয়াহিদ অরুনাভ মুখার্জীকে বললেন,

-বলছিলাম দাদা,দোয়া কোথায়?

অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-ও দোয়া? ও তো ওর ঘরে। আসুন আপনাকে আমি…

-না না। আমিই চলে যাবো।

-চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে নানুভাই!

টুইঙ্কেল নানুভাইয়ের আঙুল ধরে হাটা লাগালো। ওর সাথেই ভীড় থেকে বেরিয়ে আসলেন তৌফিক ওয়াহিদ। যেনো হাফ ছেড়ে বাচলেন উনি। দোয়ার ঘরে এসেই টুইঙ্কেল চেচিয়ে বললো,

-উইশমাম দেখো কে এসেছে!

বিছানায় বসে কুচি গোছাচ্ছিলো দোয়া। তৌফিক ওয়াহিদকে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে মাথায় আচল তুলে দিলো ও। এগিয়ে এসে সালাম দিলো। সালামের উত্তর নিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। টুইঙ্কেল নানুভাইয়ের হাতে থাকা ডালাটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-তুমি এই শাড়ি পরেছো উইশমাম? এই দেখো,নানুভাইও শাড়ি এনেছে তোমার জন্য!

দোয়া হাসিমুখে মাথা নিচু করে নিতে যাচ্ছিলো ডালাটা। তৌফিক ওয়াহিদ ডালার উপর স্বচ্ছ মোড়ক থেকে দেখলেন,ওনাদের কেনা শাড়িটার চেয়ে দোয়ার গায়ের শাড়িটা বেশি ভালো,বেশি দামি দেখাচ্ছে। কিন্তু তৌফিকাও যথেষ্ট ভালোভালো ব্রান্ডেড জিনিসই কিনেছে দোয়ার জন্য। তবুও দোয়ার শাড়ি,সর্বপরি এখানকার ব্যবস্থাপনায় এক আলাদাই জাকজমকতা। আরেকবার মনে পরে গেলো তৌফিক ওয়াহিদের,দোয়া সাফাত রওশনের মেয়ে। ডালাটা দোয়ার হাতে না দিয়ে পাশের টেবিলে রাখলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ফাইলটা তুলে ধরে বললেন,

-এখানে তোমার একটা সাইন চাই দোয়া।

কিঞ্চিত বিস্ময়ে তাকালো দোয়া। পরপরই ওর তৌফিকার বলা কথাটা মনে পরে গেলো। বিজনেস ছাড়া কিছুই বোঝেন না তৌফিক ওয়াহিদ। টুইঙ্কেলের দিকে তাকালো একবার। ও বিছানার উপর রাখা উপহার,শাড়ি,গয়নার বক্সগুলো আঙুল ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে গুনছে। নিজেকে সামলে ফাইলটা হাতে নিয়ে দোয়া পড়লো ওটা। মুচকি হেসে বললো,

-আমাকে হলুদ ছোয়াতে না,ফর্মুলা রংধনুর নামে করবেন বলে আজ এখানে এসেছেন স্যার?

-দেখো দোয়া….

-দেখুন স্যার,ফর্মুলা এখনো পুরোপুরি স্বীকৃত না। রিচেইকের এক্সপেরিমেন্ট এখনো চলছে। তাই এ বিষয়ে এই মুহুর্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

বিস্ময়ে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়ার মতো সাদামাটা মেয়েটার মুখে এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না উনি। বললেন,

-দেখো দোয়া,তুমি রংধনুতে বউ হয়ে আসছো। আরাবের বউ হতে চলেছো। আর রংধনু গ্রুপসের উত্তরাধীকার তো আরাব,এটাও জানো তুমি। তাই রংধনু গ্রুপসের জন্য এটুকো তো করতেই পারো তাইনা?

দোয়া মৃদ্যু হাসলো। বললো,

-রংধনুর জন্য আমার শুভকামনা সবসময় আছে আর থাকবে। আমি রংধনুর ভালোর জন্যই মানা করছি স্যার। যদি এখানে মত দেওয়ার পর কোনোমতে ফর্মুলায় কোনো ভুল ধরা পরে,দিনশেষে বদনামটা এন্টিডোড লন্চ করা সেই রংধনু গ্রুপসেরই হবে তাইনা?

তৌফিক ওয়াহিদ নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলেন দোয়ার দিকে। যুক্তিতে একবর্নও ভুল নেই ওর। দোয়া ফাইলটা ওনার হাতে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

-আপনার বিজনেস ওমেন পছন্দ তাইনা স্যার? কথা দিচ্ছি,একদম মনের মতো বউমা হবো আপনার। যেমনটা আপনি চান!

-আপুনি?

দরজা থেকে বললো দিয়ান। দোয়া ইশারায় ভেতরে আসতে বললো ওকে। তন্নি তৃষা আর কয়েকটি মেয়ে ভেতরে ঢুকলো। ফাইলটা নিয়ে আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ।
দোয়াকে আরাবদের বাড়ি থেকে দেওয়া হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়নায় সাজিয়ে স্টেজে বসানো হলো। টুইঙ্কেল এসে কোলে বসেছে ওর। চোখ মেলে চারপাশ দেখে নিলো দোয়া। ভরে উঠলো ওর চোখ। কে বলবে ওর কেউ নেই? ওর মনে হচ্ছে,পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবারের আদরের মেয়ে ও। উঠোন কোনায় কোনায় ভর্তি মানুষজনে। আশেপাশের সব বাসার আন্টিরা এসেছে হলুদ শাড়ি পরে। মেসের ছেলেগুলো হলুদ পান্জাবি পরে এ কাজ ও কাজে ছোটাছুটি করছে। অরুনাভ মুখার্জী,দিয়ান,স্বস্তিক,নিরব চেনা মুখগুলোও আছে। এককোনে মাকে ধরে দাড়িয়ে তাজীন। তন্নি তৃষা আর তৌফিকা মিলে তৌফিক ওয়াহিদের আনা হলুদের ডালা এনে ওর সামনে রাখলো। সবার আগে ডাকা হলো দোয়ার মাকে। উনি এসে দোয়ার দুগালে হলুদ ছোয়ালেন। ওনার মুখে হাসি,চোখে জল। দোয়ার ছড়িয়ে রাখা আঁচলে একটা চাবি দিয়ে বললেন,

-এতে আমার আর তোর বাবার তরফ থেকে তোর জন্য রেখে যাওয়া কিছু উপহার আছে মা।

দোয়া কেদেই দিলো। নিজেকে সামলে চলে গেলেন সালমা বেগম। দোয়াকে থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো তন্নি,তৃষা। তৌফিকা দোয়াকে হলুদ ছুইয়ে ওর আঁচলে একটা গয়নার বাক্স রেখে ওর গালে হাত রেখে বললো,

-দোয়ার জন্য দোয়া আর ভালোবাসা। এটা তো শুধু দেখানোর জন্য।

তৌফিকার হাতে হাত রেখে মুখে হাসি ফুটালো দোয়া। তৌফিকা বাবাকে ডাক লাগিয়ে বললো,

-বাবা? এখন তুমি হলুদ ছোয়াও। তারপর আমরা ফিরে যাই রংধনুতে। ওদিকের হলুদপর্বও তো বাকি। এদিকে বউয়ের গোসল দেরি না হয়,জ্বর না হয়,এজন্য আরাব শুধু একটু ছুইয়ে পাঠিয়েছে হলুদ। ওকেও তো হলুদ দিতে হবে!

দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। এককোনে দাড়িয়ে তৌফিক ওয়াহিদ ফোন স্ক্রল করছিলেন। তৌফিকার ডাক শুনে ইশারায় বোঝালেন ব্যস্ত আছি। সালমা বেগম বললেন,

-যান না মিস্টার ওয়াহিদ? ছেলের বিয়ের চেয়ে বড় ব্যস্ততা কিসের?

বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলেন না তৌফিক ওয়াহিদ। এগিয়ে এসে হলুদ হাতে নিলেন। দোয়া চুপচাপ চেয়ে রইলো তার দিকে। সবে হলুদ ছোয়াবেন, ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো তৌফিক ওয়াহিদের। টুইঙ্কেল তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে দোয়ার আচলে দিয়ে বললো,

-এই নাও উইশমাম! এইটা নানুভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস! এইটা গিফট করলাম তোমাকে!

উপস্থিত সবাই ঠোট টিপে হাসছে। তৌফিক ওয়াহিদ ব্যস্তভাবে ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

-না টুইঙ্কেল। এটা….

দোয়া এবার ফোনটা হাতে নিলো। সৌজন্য হাসি রেখে বললো,

-হলুদ আঁচলে দেওয়া জিনিস ফেরত নিতে নেই‌ স্যার। অমঙ্গলজনক ধরা হয় এটাকে। আর আমি থাকতে আপনার বা আপনার ছেলের কোনোরকম অমঙ্গল কি করে হতে দেই বলুন?

-বাট মাই ফোন….

-এখানে সবার চাওনির চেয়ে আপনার ফোনটাই কি বেশি দামি?

আস্তেধীরে বললো দোয়া। আশপাশ দেখে ওকে হলুদ ছুইয়ে সরে আসলেন তৌফিক ওয়াহিদ। রংধনুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো তৌফিকারা। ছেলেগুলো বাদে অরুনাভ মুখার্জী আর একে একে চিলেকোঠার প্রায় মেয়েরা হলুৃদ ছোয়ালো দোয়াকে। তারপর ছেলেগুলোকে বের করে দেওয়া হলো। পাশের বাসার সব মহিলারা মিলে দোয়াকে উঠোনের কলতলায় বসাবে বলে এগোচ্ছিলো। হঠাৎই তন্নি বলে উঠলো,

-রাতে মেহেদী আর সঙ্গীত হবে। তখন তো মেহেদি আমরাও পরবো। তো এখন হলুদ শুধু দোয়াপু কেনো মাখবে?

কথা শেষ করেই তৃষার মুখ ভর্তি করে হলুদ মাখিয়ে দিলো ও। তাজীনসহ বাকি সবাইও নিজেদের মাঝে হলুদ ছোয়ানো শুরু করে দেয়। দোয়াকে ছেড়ে মেয়েরা সবাই যে যার মতো হলুদ মাখামাখি করছে। ভীরে ধাক্কাধাক্কিতে একটু সরে দাড়াতে যাচ্ছিলো দোয়া। হঠাৎই এক অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে জমে গেলো ও। শ্বাস আটকে কম্পিত হাত ছোয়ালো শাড়ির নিচে কোমড়ের দিকটাতে। হলুদ লেগে আছে সেখানে। আশপাশে তাকালো দোয়া। হলুদ শাড়ির মেয়ের দল ছাড়া কোনো পুরুষের ছায়াও নেই। একচুলও নড়লো না ও আর। বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো শুধু। কোনো ছেলে নেই এখানে,কোনো মেয়ে কেনো ওভাবে হলুদ লাগাতে যাবে ওকে? নাকি সবটাই কাকতলীয়?

কিছুক্ষন পর ওকে ধরে কল তলায় বসালো সবাই মিলে। কয়েক কলসি জল মাথায় ঢেলে ওকে উপরে পাঠিয়ে দিলো চেন্জ করার জন্য।শাড়ি পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো দোয়া। ভেজা চুল থেকে গামছাটা খুলে ফেললো। নিজের দিকে তাকালো একপলক। ভেতরটায় অজানা কষ্ট জেকে বসেছে। ওই অচেনা তিন আঙুলের স্পর্শ ভুলতে পারছে না কোনোমতেই। কোনো পুরুষের স্পর্শ নয় ওটা। তবুও এভাবে কোনো মেয়ে ছুয়েছে ওকে,মানতে পারছে না ও। চোখ ভরে উঠলো ওর। দরজায় নক পরায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে গলা স্বাভাবিক করে বললো,

-ক্ কে?

-আমি স্বস্তিক।

দোয়া মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। স্বস্তিক বাইরে থেকেই ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আরাব দাদা ফোন করেছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায় দিভাই।

অস্বস্তিতে পরে গেলো দোয়া। ইতস্তত করে ফোনটা হাতে নিলো ও। স্বস্তিক হেসে চলে গেলো। আস্তেধীরে ফোনটা কানে নিলো দোয়া। আরাব বললো,

-কল রেকর্ড অফ করো দোয়া।

কথাটা শুনে তৎক্ষনাৎ কান থেকে ফোন নামিয়ে নিলো দোয়া। স্ক্রিন অন হতেই কল রেকর্ড অন দেখে হতবিহ্বল হয়ে ওটার দিকেই তাকিয়ে রইলো ও। আরাব বলে উঠলো,

-দোয়া? আছো?

কল রের্কড অফ করে ফোন কানে নিলো দোয়া। বিস্ময়েই বললো,

-আপনি কি করে জানলেন কল রেকর্ড অন করা?

-বর বউয়ের কথার কাবাবে হাড্ডি হওয়া,স্বস্তিকের ওই ক্লাসের টপার ছিলাম আমি। তৌফিকা আপু আর মুফতাহির ভাইয়া জানে।

দোয়া মৃদ্যু হাসলো। পরপরই মন খারাপ হয়ে গেলো ওর আবারো। যা থেকে যাই হয়ে যাক,বারবার কেউ ওর কোমড়ে হলুদ ছুইয়েছে ভাবতেই মন বিষিয়ে উঠছে ওর। আরাব বললো,

-কি হলো? চাঁদমুখের হাসিটা গায়েব কেনো?

বড়বড় চোখে আশপাশে তাকালো দোয়া। ওপাশ থেকে আরাব বললো,

-এইতো! এইদিক! জানালা দিয়ে ঠিক বাইরে,সেলুনের সামনে!

ছুটে এসে জানালার গ্রিল ধরে দোয়া বাইরে উকিঝুকি দিলো। চোখে পরলো সেলুনের পাশে বাইকে হেলান দিয়ে সত্যিই কেউ দাড়িয়ে। বাইকের সিটে হলুদ শাড়ি এলোমেলোভাবে রাখা। মানুষটার পরনে হলুদ বর্ডারের সাদা পান্জাবী। একহাতে কানে ফোন ধরে আরেকহাতে দুরবীন ধরে ঠিক ওর জানালার দিকেই তাকিয়ে আছে কেউ। দোয়া তৎক্ষনাৎ ঘুরে উঠে পর্দার আড়ালে দাড়ালো। শ্বাস আটকে আরাবের পাগলামীগুলো মাথায় ঠিকঠাকমতো বসাতে লাগলো। কানে ধরা ফোনে আরাব বললো,

-ওইযে তোমার কোকড়া চুলের ডগায় পানিকনা দেখা যায়।

চোখ বন্ধ করে ঠোট টিপে নিশব্দে হাসলো দোয়া। আরাব বললো,

-আমার গায়ে ছোয়ানো হলুদ তোমার গায়ে ছোয়ানোর পর তোমাকে ঠিক কেমন দেখায়,তা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি দোয়া। চলে এসেছি।

-একে চলে আসা বলে না। পাগলামি বলে।

-তবে আরেকটা পাগলামি শোনো?

-ম্ মানে?

-এসেছি যখন,তোমাকে হলুদ ছোয়াবো না,তা কি করে হয় বলো? আপু জানে এটা। তাই বারবার করে বলে দিয়েছে,দোয়ার গায়ে তোর লাগানো হলুদ যেনো কেউ না দেখে আরাব! বাধ্য হয়ে শাড়ির আড়ালেই তিন আঙুলের হলুদ স্পর্শ একে দিয়ে এসেছি তোমার গায়ে।

লজ্জায় লালাভ হয়ে উঠলো দোয়া। যে স্পর্শকে ঘিরে ওর এতোক্ষন খারাপ লাগা ছিলো,তা নিমিষেই শিহরনে পরিনত হয়েছে। নিমিষেই ভালোলাগার বহর জুড়ে বসেছে মনেপ্রানে। চোখ বন্ধ করেই তা অনুভব করতে লাগলো ও। আরাব বললো,

-বলেছি না তোমাকে? কোনো কষ্টকে ছুতে দেবো না তোমায়। আমার ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে রাখবো তোমাকে। এভাবেই! না না! এরচেয়েও বেশি ভালোবাসায়! আদরে!

দোয়া ওড়না খামচে ধরে দেয়ালে মিশে রইলো। আরাব আবারো বললো,

-হেই মেয়ে? আড়ালে দাড়িয়ে লজ্জা পাও ঠিকাছে। তবে কালকের বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর এই লজ্জা….

আর সহ্য হচ্ছিলো না দোয়ার। জানালায় এসে দাড়ালো সাথেসাথে। আরাব আটকে গেলো। লজ্জা ভুলে দোয়া এভাবে জানালায় এসে দাড়াবে,আকাঙ্ক্ষিত ছিলো না এর। দোয়া চেহারায় গম্ভীর ভাব আনার ভঙিমা করে বললো,

-আমাকে তো খুব লজ্জা নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন মহাশয়! আমার না হয় ওটা একটু বেশিই। তা বলে আপনি এতোটা নির্লজ্জ কেনো বলুনতো?

-অপোজিট এট্রাক্টস্! সিম্পল!

-হুম। জানি! তবে ভাবিনি আপনি এতোটা বেপরোয়া যে,আমাকে হলুদ লাগাবেন বলে,শাড়ি পেচিয়ে,আন্টিবেশে চিলেকোঠায় চলে আসবেন! সাইকো সাইন্টিস্ট কোথাকার!

দুরবীন চোখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষন বিমুর্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাব। পেছনে বাইকের উপরে রাখা এলোমেলো শাড়িটা হাতে নিয়ে হেসে দিলো ও। ফোনের এপাশ থেকে ওর হাসির শব্দ শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো দোয়াও।#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৪

কুয়াশাঘেরা সন্ধ্যায় কনকনে শীতের মধ্যে শুধুমাত্র শ্যাডো গেন্জি আর পায়জামা পরে বাগানের স্টেজে বসে আরাব। রীতিমতো কাপছে ও। বসে আছে কখন ওকে হলুদ ছোয়াবে সবাই। আর সবাই যারযার মতো খাওয়া,ড্রিক হাতে দাড়িয়ে আড্ডায় ব্যস্ত। দোয়াকে দেখতে যাওয়া নিয়ে এতোটাই উৎসাহ ছিলো যে,বাবার দাওয়াত করা উচ্চবিত্ত আন্টিসকল যে ওকে হলুদ ছোয়াতে না,নামেমাত্র হলুদসন্ধ্যা এটেন্ড করতে আসবে,সেটা মাথায়ই ছিলো না আরাবের। ওখান থেকে ফিরে তৌফিকাকে পাঠিয়ে দিয়েছে পাশের মধ্যবিত্ত পরিবারের আঙ্কেল আন্টিদের নিয়ে আসতে। টুইঙ্কেল সামনে রাখা হাজার রকমের সাজানো খাবারগুলোর ছবি তুলছে,কখনো টুথপিকে আটকানো আঙুর টেনে তুলছে আবার সাজিয়ে রাখছে। তৌফিক ওয়াহিদ স্টেজের সামনেই বসে ছিলেন। ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে একপলক আরাবের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-ঠান্ডায় বসে আছো কেনো? জ্যাকেট পরে নিলেই তো হয়!

আরাব হাতের তালু ঘষতে ঘষতে মুচকি হেসে বললো,

-বিয়ের আমেজ গায়ে লাগতে দাও বাবা! আনাদার লেভেল অফ স্যাটিসফেকশন! পয়ত্রিশ বছর আগে সেই কবে একবার বিয়ে করেছিলে তো,মনে নেই তোমার! তাই তুমি বুঝবেও না!

মাথা নাড়িয়ে আবারো ল্যাপটপে মনোযোগ দিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। ইভেন্ট ম্যানেজার এসে বললো,

-স্যার সবকিছু গোছানো শেষ।

-মুফতাহির কোথায়?

-মুফতাহির স্যার বাসার ভেতরের কিছু ডেকোরেশন দেখছেন। ওখানে কিছু গেস্টও এটেন্ড করছেন উনি।

-ওকে। আরকিছু?

-ন্ না মানে স্যার আসলে….

ইভেন্ট ম্যানেজারের দিকে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। উনি ইতস্তত করে বললেন,

-আসলে স্যার,ফটোশুটের জন্যে যদি সবাইকে একটু….

আশেপাশে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। সবাই হলুদ অনুষ্ঠান বাদে বাকিসব বিষয়ে আড্ডা কথাবার্তায় ব্যস্ত। আনন্দের কোনো আভাসই নেই এদের মাঝে। জোর করে ছবি তোলানোর জন্য বলতে হবে নাকি এখন? তৌফিকা ক্যামেরাম্যানকে ডেকে কয়েকজন মহিলাকে সাথে নিয়ে এগোলো স্টেজের দিকে। তৌফিক ওয়াহিদ ওনাদের দেখে কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। ওদের নিয়ে ফটোশুট শুরু হয়ে গেছে। মিসেস ওয়াহিদ এসে বললেন,

-ছেলের গায়ে হলুদ দেবে না?

-এসবে আমাকে কেনো জড়াচ্ছো বলোতো?

-দেখো….

-ওই বাসায় দোয়াকে হলুদ দিয়ে মোবাইলটা দিয়ে আসলাম। এখানে তোমার ছেলেকে রংধনু গ্রুপস্ দিয়ে দেবো। জিজ্ঞাসা করো নেবে কিনা ও?

-না নিলে?

-দেবো না হলুদ। ভালো লাগে না এসব আমার।

একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ছাড়লেন মিসেস ওয়াহিদ। এরইমাঝে দশ পনেরোজন ছেলেমেয়ে হুরমুড় করে ভেতরে ঢুকে পরলো। সবাই মিলে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো একদম। কাউকে না চিনে শুধু তাকিয়ে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। তৌফিকা পাশ থেকে বললো,

-আরাবের ফ্রেন্ডস্ আর কলিগস্।

ওদের প্রত্যেকের মাঝে উৎসবের আমেজ লক্ষ্যনীয়। যেমনটা চিলেকোঠার সবার মাঝে ছিলো। অজান্তেই শান্তি অনুভব হলো তৌফিক ওয়াহিদের। ওরা সবাই কুশল বিনিময় শেষে বাকা হেসে হলুদ হাতে মাখিয়ে আরাবের দিকে এগোচ্ছিলো। আরাব লাফিয়ে উঠে দাড়ালো। দুপা পিছিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,

-গাইস গাইস! ওয়েট! আগে বাবা আমাকে হলুদ লাগাবে! তারপর মা! তারপর সব! ওয়েট কর!

থমকে দাড়িয়ে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। আরাব স্টেজ থেকে নেমে হলুদের বাটিটা নিয়ে ওনার দিকে এগোলো। বাবার সামনে ধরে ইশারায় বুঝালো ওকে হলুদ মাখাতে। রোবটের মতো কোনোদিক না তাকিয়ে ছেলের গালে হলুদ ছোয়ালেন তৌফিক ওয়াহিদ। আর খুশিতে আরাব জরিয়ে ধরলো বাবাকে। আনন্দঅশ্রু ঢাকতে বারবার চোখের পলক ফেলে বললো,

-তোমাকে জরিয়ে আর শীত করছে না বাবা। এই সন্ধ্যার সার্থকতা তো তোমার এই হলুদ ছোয়ানোতেই ছিলো। অন্য কোনো কিছুতে নয়!

এতোক্ষনে শ্বাস ছাড়লেন তৌফিক ওয়াহিদ। একহাতে আলতোভাবে জরিয়ে ধরলেন উনি আরাবকে। আরাব আরো শক্ত করে বাবাকে জরিয়ে ধরলো। ওদের একসাথে দেখে চোখ মুছলেন মিসেস ওয়াহিদ। তৌফিকা মায়ের কাধ জরিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলো বাবা-ভালয়ের দিকে।

মরিচবাতি,আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে মুখার্জীবাড়ি। দোয়াকে মেহেদী পরানো হবে এখন। হালকা কারুকাজ করা কফি কালারের কুর্তা-স্কার্ট পড়ানো হয়েছে ওকে। কোকড়া চুলগুলো উচুতে খোপা কর। তবে কিছু কপালের সামনে ছেড়ে দেওয়া। মাথায় বড় টায়রা,কানে ঝুমকো,গলায় আটকানো একমাত্র গয়না। এতেই যেনো রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছে ওকে। তাজীন,তন্নি,তৃষা দোতালা থেকে সিড়ি দিয়ে ওকে দিয়ে নামছিলো। নিরব গিয়ে সাউন্ডবক্সে কিউটিপাই গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউসিক চালু করে দিলো। দোয়াকে এনে স্টেজে বসিয়ে ওর চারপাশে বসে গেলো মেয়েরা। তাজীন সবে মোবাইলটা বের করেছে ছবি তুলবে বলে,নিরব এগিয়ে ওর ফোনটা কেড়ে নিয়ে গাইতে লাগলো,

Banno tahsan tera ati fantastic
Social media pe hukum chalay,
Phone pe baate kare apni left hand se
Right hand pe mehendi lagay…

তাজীন নিজের মোবাইলটা নিয়ে নিলো। আবারো নিজের মতো করে মোবাইল নিয়ে সেলফি তুলতে লাগলো দোয়াসহ সবার সাথে। নিরব স্বস্তিকের গলা ধরে গাল ফুলিয়ে গাইলো,

Boyfriend ki tujhe koi fikar nehi
Pehli date pe Kahe ok byeee,
Debdas ki tarha hi afsos woh kare
To tu haske innocent si shakal banay…
Cutipie….!
Ay haaay……cuty,cuty,cuty cutipie…!

তাজীন স্টেজ থেকে উঠে দাড়ালো। মেয়েরা সবাই একসাথে আওয়াজ করে উঠলো। দোয়া সামনের নাচগান কয়েকপলক দেখে হাতে মেহেদীতে লেখা আরাব নামটায় চোখ আটকালো। তাজীনের পাশে ঘুরে ঘুরে নিরব গাইলো,

Scent lagake tera party o me jana
Ashik fasaneka tarika he purana
Tan badanke tu suur sabe cher de
Mu se lagake bina basuri bajay…
Neend churana nojawano ko to thik hay
Buddho ka kahe blood pressure baray?
Boyfriend……cutipie…!

নিরব তাজীন একসাথে নাচা শেষ করলো। হাততালি দিলো সকলে মিলে। দোয়ার একহাতে মেহেদি পড়ানো শেষ। তাজীন এসে জরিয়ে ধরলো ওকে। নিরব হাপাতে হাপাতে এসে বললো,

-বুঝলেন দোয়া ভাবি,আপনার বান্ধুবী এভাবেই নাচিয়ে চলেছে বিয়ের পর থেকে। এভাবে নাচাতে থাকলে ভবিষ্যতে এই আনারকলি,সংসারধর্ম ছেড়ে কিন্তু বনবাস চালী হু!

দোয়া হেসে দিলো ওর কথায়। নিরবের কাছে ম্যামের পরিবর্তে ভাবি ডাক শুনে আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করছে ওর ভেতরে। তাজীন সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

-যাকনা আনাড়কলি বনবাস! আনাড়কলিকে ওই বনেরই আনারস আর ব্যাঘ্রদুদ্ধ পান করিয়ে বনবাসের স্বাদ ঘুচিয়ে দেবো একেবারে!

মাথা চুলকে সরে আসলো নিরব। হাসির রোল পরে গেছে জায়গাটায়। সবাই মিলে তন্নি তৃষাকে জোর করে তুলে দিলো নাচার জন্য। দিয়ানকে নিয়ে ওরা দুজনে আগেই রিহার্সেল করেছিলো নাচবে বলে। পরিকল্পনামতো দিয়ান,তৃষা একটু সাইডে দাড়ালো। তন্নি ওড়না গিট দিয়ে মাঝখানে দাড়িয়ে নাচতে নাচতে গাইলো,

-ওহে শ্যাম তোমারে আমি নয়নে রাখিবো
অন্য কেউরে না আমি চাইতে দেবো(ii)

-বাগিচার ফুল তুমি,তুলিয়া আইনাছি আমি
মালা গেথে গলায় পরিবো
অন্য কেউরে না আমি চাইতে দেবো…

স্বস্তিককে পাশে নাচতে দেখে বড়বড় চোখে তাকালো তন্নি। ওর গাওয়া শেষের কলিটা স্বস্তিক শুরু করেছে। কিন্তু ওখানে দিয়ানের গাওয়ার কথা। পাশে তাকিয়ে দিয়ানকে না দেখে রাগে চলে আসতে চাইছিলো তন্নি। কিন্তু সবাই খুশি ছিলো,হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলো ওদের। এভাবে মুহুর্তটা নষ্ট করাটা উচিত হবে না। তাই কিছু না বলে গানে তাল মেলালো তন্নি। স্বস্তিক নিজেও বিরক্তি নিয়ে নাচছে। নাচ শেষে বিখ্যাত সেই পা ছোড়া ভুললো না তন্নি। স্বস্তিক পাত্তা না দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। তন্নি খুজেখুজে বারান্দার এককোনে পেলো তৃষাকে। ওএসে সোজা কান ধরলো তৃষার। খিচে উঠে বললো,

-দিয়ান কই?

তৃষা ব্যথাতুর কন্ঠে কান ধরে বললো,

-আরে,দিয়ান একটু ঘরে গেছে। কি দরকার আছে বললো। আর ফিরলোই তো না! কান ছাড় তন্নি। লাগছে!

তন্নি আরো শক্তিতে ওর কান চেপে ধরলো। বললো,

-তো দিয়ান নেই বলে ওই বিলেতি কদুকে নাচতে বলেছে কে? কে বলেছে?

-আমি বলিনি তন্নি। বিশ্বাস কর!

-তুই জানিস তৃষা? নাচ শেষ করে যখন আসছিলাম,ওসাকা ভিলার স্বপ্না আন্টি বলছিলো,এই অনাথ মেয়েটার সাথে অরুনাভ দাদার ছেলে কেনো নাচলো? এই অনাথ মেয়েটার সাথে অরুনাভ দাদার ছেলের এতো কথা কিসের? হোক তা ঝগড়া! ওই লোকটার জন্য আমি কেনো কথা শুনবো বলতো? কেনো? তুই বলিস নি! তো তাকে কে বলেছিলো গিয়ে নাচতে? কে?

-কেউ বলেনি। আমি যেচে নাচতে গিয়েছিলাম।

স্বস্তিকের গলা শুনে তৃষার কান ছেড়ে পেছন ফিরলো তন্নি। উঠোনে গান বাজছে,বাচ্চারা নাচছে। কানে ওদিকের শব্দটা বেশি জোরে আঘাত করলেও,স্বস্তিকের গলা চিনতে ভুল হয়নি ওর। এগিয়ে এসে ঝারা গলায় বললো,

-কেনো? কেনো নাচতে যাবেন আপনি? লজ্জা করলো না একটা অচেনা মেয়ের সাথে এভাবে নাচতে? হুম? লজ্জা করলো না?

-আমার এতোটুকোও লজ্জা করলো না তন্নি! ট্রাস্ট মি! কিন্তু এটা বলো,তোমার লজ্জা করছিলো তো? একটা অনাথ মেয়ে হয়ে হিন্দু বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে নাচতে। তাইনা? তাহলে তুমি কেনো নাচছিলে আমার সাথে? বলো? আন্সার মি?

স্বস্তিক রাগী চোখমুখ করে একপা এগি‌য়ে বললো কথাগুলো। ধরফরিয়ে পিছিয়ে তৃষার হাত জরিয়ে দাড়ালো তন্নি। মনেমনে ইয়া নফসি পরতে লাগলো। স্বস্তিক ওকে আপনিই ডাকে। আর ঝগড়া করলেও রাগ দেখায় না। হুট করে লোকটা এমন রাগ দেখাচ্ছে,করনীয় কি তা বুঝতে পারছে না ও। তৃষা কাপাকাপা গলায় বললো,

-র্ রিল্যাক্স স্ স্বস্তিকদা। এ্ এমন কেনো…

চোখ বন্ধ করে অন্যদিক তাকালো স্বস্তিক। মন মস্তিষ্কে এতোটা রাগ কেনো জমলো হুট করে,বুঝে উঠতে পারলো না। একটা জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,

-আ্ আ’ম সরি। এভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত হয়নি আমার। সরি ওয়ান্স এগেইন।

স্বস্তিক চলে আসলো ওখান থেকে। তৃষার হাত ছেড়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কয়েকপা এগোলো তন্নি। শান্ত দৃষ্টিতে শুধু আড়াল হতে দেখলো সোনালীরঙা পান্জাবী পরিহিত ভিনদেশী লোকটাকে। এক মুহুর্তের জন্য ওর মনে হলো,ভিনদেশী নয়,মানুষটা হয়তো আপনজনের জায়গাটার দাবীদার হতে চেয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবে স্বাভাবিক হবে তন্নি,কিন্তু হঠাৎই দোয়ার আর্তনাতে চমকে উঠলো ও। একপলক তৃষার দিকে তাকিয়ে বুঝলো,ওউ শুনেছে সে আর্তনাত। ছুট লাগালো দুজন স্টেজের দিকে।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৫

-বিয়েটা আমি করবো না কাকাবাবু।

মলিন চোখে দোয়ার দিকে তাকালেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়ার বিদ্ধস্ত চেহারা,লেপ্টে যাওয়া মেহেদী শুকানো হাত,কান্নায় কান্নায় চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। গয়নাগুলো গোছানোর পরিবর্তে বিক্ষিপ্তভাবে গায়ে পরে আছে কোনোমতে। সহ্য হলো না আর তার। চোখ সরিয়ে চোখ মুছলেন অরুনাভ মুখার্জী। নিচে উঠোনে সবাই আনন্দ করছে,আর এখানে বারান্দায় দাড়িয়ে মা ভাইয়ের দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে কথাটা বললো দোয়া। বিয়ে নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে,নতুন সম্পর্কে জড়াতে গিয়ে কি কি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় একটা মেয়েকে,তা শুধু ওই মেয়েই জানে। আর দোয়া? ওর যে মা ভাইই সব! মায়ের শরীরটা ভালো না,ভাইয়ের এতোবড় অসুখ। এসবের ভীড়ে আরাবের ভালোবাসায় যতোটুকো আশ্বস্ত ও হয়েছিলো,কিছুক্ষন আগে দিয়ানের অসুস্থ্য হয়ে পরায়,তা পুরোপুরিই ভেঙে পরতে বসেছে।

নাচগানের মধ্যে বুক চেপে ধরে হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে যায় দিয়ান। এমন এর আগেও দুবার হয়েছে দিয়ানের। দোয়া এতোটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যে কান্নাকাটি করে,সাজ নষ্ট করে ওই সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। ওর ভয়েরও কারন আছে। মা ভাইয়ের থেকে দুরে সরে যেতে হবে বিয়ের পর,ওর বাড়তি চিন্তা যথার্থ। দিয়ানের হার্টে ফুটো আছে,এটা একমাত্র অরুনাভ মুখার্জীই‌ জানেন। খুব কষ্টে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। দিয়ানের জ্ঞান ফেরার পর ও তো স্বাভাবিক হয়েছে,কিন্তু দোয়া কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। ওর মনে সেই ভয় আবারো জেকে বসেছে। ও চলে গেলেই ওর মা ভাই একা পরে যাবে। ওদের দেখার কেউই থাকবে না। তাই এই মুহুর্তে বিয়েটা করবে না ও। আরাবকে প্রয়োজন পরলে সবটা বলবে। যা হবার হবে! মা ভাইকে ছেড়ে যাবে না ও। অন্তত দিয়ানের অপারেশনের আগে তো নয়ই! অরুনাভ মুখার্জী ওর কাধে আলতো করে হাত রেখে বললেন,

-এমন কেনো করছিস দোয়া? দিয়ান ঠিক আছে তো! কিছুই হয়নি ওর!

দোয়া তাকালো তার দিকে। হঠাৎই ডুকরে কেদে দিলো ও অরুনাভ মুখার্জীকে জরিয়ে ধরে। কাদতে কাদতে বললো,

-ও ঠিক নেই কাকাবাবু! ও ঠিক নেই! যতোক্ষন না ওর অপারেশনটা হচ্ছে,ও ঠিক নেই! কি করে ভুলে গেলাম আমি এটা? কি করে?

বিস্ময়ে তাকালেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়াকে ছাড়িয়ে বললেন,

-এভাবে কেনো বলছিস দোয়া? দিয়ানের অপারেশন তো আরাব….

-দিভাই!

স্বস্তিকের গলা শুনে থেমে গেলেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়া চোখমুখ মুছে সরে দাড়ালো কিছুটা। স্বস্তিক বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে আসলো দোয়ার দিকে। কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দিয়ে বললো,

-এক লোক এসে দিয়ে গেলো।

অরুনাভ মুখার্জী,দোয়া দুজনেই কিঞ্চিত অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

-কার জন্য?

-বললো তো দিভাইয়ের নামে।

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কাগজগুলো নিলো দোয়া। ওগুলো দেখে টপটপ করে জল গরাতে লাগলো ওর চোখ থেকে। অরুনাভ মুখার্জী বললেন,

– কি হলো দোয়া? কাদছিস কেনো?

যন্ত্রমানবীর মতো তার দিকে তাকালো দোয়া। অস্ফুটস্বরে বললো,

-বাবার ফর্মুলার ভিত্তিতে করা এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়েছে। বায়োমেডিসহ ন্যাশনাল মেডিসিন রিসার্চ সেন্টার স্বীকৃতি দিয়েছে ফর্মুলাকে। আ্ আমাদের রওশন প্লাজার সিল তুলে নেওয়া হয়েছে। কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে,বাবার সবরকম ব্যাংক ব্যালেন্স,প্রোপার্টি সব…স্ সব নাকি সরকারিভাবে আমাদের নামে…

দোয়া আর বলতে পারলো না। থেমে রইলো। অরুনাভ মুখার্জী হেসে বললেন,

-কাল তোর বিয়ে। আর তারপরেই দিয়ানের অপারেশন। এর বাইরে আর কোনো কথা নেই দোয়া। চিলেকোঠায় তাকওয়াতুল দোয়া নামে আরেকটা রাত ঘুমিয়ে নে গিয়ে। কারন এরপর আমার চিলেকোঠায় আসবে,মিসেস তাহসানুল আরাব! রংধনুতে গিয়ে এই কাকাবাবুকে ভুলিস না কিন্তু!

দোয়ার গালে হাত রেখে কথাগুলো বলে চলে আসলেন অরুনাভ মুখার্জী। দোয়ার কাছে সবটা এখনো ধোয়াশা। আরাব বলেছিলো এক্সপেরিমেন্ট শেষ হতে দেরি হবে। সাথে বাকিসবও। আজই এসব হয়ে যাবে,ভাবতে পারে নি ও। স্বস্তিক গলা ঝেরে বললো,

-আরাব দাদা কল করেছে।

ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। ওর হাতে ফোন গুজে দিয়ে চলে গেলো স্বস্তিক। ফোন কানে ধরে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে আরাব বললো,

-ওই চিলেকোঠা থেকে তোমাকে আমার করে নিয়ে আসবো ঠিকই,কিন্তু তোমার দায়িত্বকে ছেড়ে আসতাম না আমি দোয়া। তুমি সে সব দায়িত্ব পালন করবে,যেগুলোকে ঘিরে এতোদিন এতোশত স্বপ্ন বুনে এসেছো তুমি। ভরসা রাখতে পারো।

আনন্দঅশ্রুতে গাল সিক্ত হলো দোয়ার। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন পর সে খুশির কান্না সংবরন করে বলে উঠলো,

-ভালোবাসি।

একশব্দে দুনিয়ার সমস্ত সুখ যেনো খুজে পেলো আরাব। ফোনটা বুকের সাথে আকড়ে ধরে ভুলে গেলো ওই ফর্মুলার পেছনে দেওয়া এতোদিনের রাতজাগা সব মেধা,সময় আর পরিশ্রম।

মুখার্জীবাড়িতে আজ বিয়ে। দোয়ার বিয়ে। সকাল থেকেই সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। দোয়া বিছানায় বসে দিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,দিয়ান ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মুলত ওকে জোর করে ধরে রেখেছে দোয়া। দৌড়াদৌড়ি করতে দেবে না বলে। দিয়ান বললো,

-তোর ডানহাতের মেহেদি কাল আমাকে ধরতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে আপুনি।

দোয়া চুপ। দিয়ান আবারো বললো,

-মেহেদি লেগে তোর ওই জামাটাও নষ্ট হয়ে গেছে আপুনি।

দোয়া তখনও চুপ। দিয়ান এবার বললো,

-আমাকে জরিয়ে কাদছিলি,আমার পান্জাবিটাও নষ্ট হয়ে গেছে আপুনি।

-ওরকম আরো কয়েকটা কিনে দেবো। মন খারাপ করিস না।

দিয়ান চাইছিলো একটু বিরক্ত হয়ে দোয়া ওকে ছেড়ে দিক। কিন্তু কোনোটাই না ঘটায় উল্টো ওই বিরক্তি নিয়ে বললো,

-আপুনি? আমাকে যেতে দে না! স্বস্তিকদা একা কয়দিক সামলাবে বলতো?

-সবাই মিলে সবদিক সামলে নেবে। তুই আমার কাছে থাক!

বোনের কথায় আর কিছু বললো না দিয়ান। একবারের জন্যও ওর কেনো যেনো মনে হচ্ছে না,বোনটা বিয়ের পর ওদের ছেড়ে চলে যাবে। বরং ও এতেই খুশি,আরাবের মতো কাউকে ওর আপুর বর হিসেবে পেয়েছে। সালমা বেগম ব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকে বললেন,

-দোয়া? তোকে গয়নাগুলো দিয়ে দিচ্ছি,তৃষা আর তাজীনের সাথে তুই এখনি সাজতে চলে যা। তন্নি এখানে আমার কাজে হাত লাগাবে।

সালমা বেগম গয়নার বাক্স নিয়ে রাখলেন দোয়ার সামনে। গয়নাগুলোর দিকে একপলক তাকালো দোয়া। ওগুলো সব স্বর্নের। ওর বাবার লকার থেকে আজই অরুনাভ মুখার্জী নিয়ে এসেছে এসব। সালমা বেগম ব্যস্তভাবে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। দোয়া মায়ের হাত ধরে আটকে দিলো। দিয়ান উঠে বসলো ওর কোল থেকে। দোয়া উঠে দাড়িয়ে মায়ের গাল ধরে বললো,

-মা তুমি সত্যিই যেতে চাওনা রওশন প্লাজায়?

মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন সালমা বেগম। ধীর গলায় বললেন,

-এ বিষয়ে তোর সাথে তো আগেই কথা হয়ে গেছে আমার দোয়া। আবারো একই কথা কেনো জিজ্ঞাসা করছিস বলতো?

-কিন্তু মা….

-কোনো কিন্তু না দোয়া। ওই বিশাল অট্টলিকা আমাকে কিছুই দেয়নি রে! উল্টো ওই টাকাপয়সার প্রতি কিছু মানুষের লোভ তোর থেকে,দিয়ানের থেকে তোদের বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ,এই চিলেকোঠায় আমি সব পেয়েছি। পরিবার,সুখ সব! ওখানে গিয়ে কাকে নিয়ে থাকবো আমি বলতো? ওই আভিজাত্যের অভ্যেস তো কবেই ভুলে গেছি। তোর থেকেই তো এসব শিখেছি দোয়া। জানিস তো তুই সব।

দোয়া চুপ করে রইলো। সালমা বেগম হাসিমুখে মেয়ের দিকে এগিয়ে বললেন,

-তুই শশুড়বাড়ি চলে যাচ্ছিস। দুদিন পর বাবার কথামতো ভাইকেও বিকেএসপিতে দিয়ে আসবি। আমি কি নিয়ে থাকবো বলতো? ওই রওশন প্লাজায় একাকী দম বন্ধ হয়ে মরার চেয়ে…

-মা!

দোয়া মুখ চেপে ধরলো মায়ের। সালমা বেগম হাসলেন। মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে বললেন,

-আমাদের নিয়ে আর এতো ভাবিস না তুই দোয়া। কোর্ট যেসব প্রোপার্টি,ব্যাংক একাউন্ট আমাদের গ্রান্ট করেছে,আমরা ভালোই থাকবো। এতো বেশি চিন্তা করে তুই তোর বর্তমানকে নষ্ট করিস না।

দোয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তন্নি,তৃষা আর তাজীন ভেতরে ঢুকে শাড়ি,গয়না হাতে তুলতে লাগলো। তাজীন দোয়াকে তাড়া দিয়ে বললো,

-কিরে? চল জলদি! সময় লাগবে তো!

-আব্ তাজ….

-হুম। ওকে নিয়ে যাও তো তাজীন! কখন থেকে বলছি যেতে,একচুলও নড়ছে না মেয়ে!

সালমা বেগমের কথায় দোয়াকে নিয়ে জোরাজুরি করতে করতে বেরিয়ে এলো তাজীন,তন্নি,তৃষা। ওকে সাজানো হলো লাল বেনারসি আর গয়নায়। নিজের কাছে নিজেকেই ভারি লাগছিলো দোয়ার। সাজ শেষে একা একা গুটিগুটি পায়ে আবারো নিজের ঘরে আসলো ও। ঘরের প্রতিটা কোনা জলভরা চোখে দেখে নিলো। সব আসবাব,নিত্য ব্যবহার্য সবকিছু। দেয়ালের ছোট আয়নাটা,ওতে আজকের দোয়াকে দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো নিরবে। আজকের পর ও শুধু এ ঘরের মেয়ে না,আরেকটা বাড়ির বউ। আরাবের কথামতো ওর পরিচয় তো বদলাবে না,তবে নতুন পরিচয় যুক্ত ঠিকই হবে। হঠাৎই ‘ বর এসেছে’ উল্লাসী আওয়াজ ঝংকার তুললো পুরো মুখার্জীবাড়ি জুড়ে। বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দন নিয়ে আস্তেধীরে বারান্দায় এসে রেলিং ধরে দাড়ালো দোয়া। সদর দরজার বাইরে কয়েকটা গাড়ির সারি। সামনের গাড়িটা থেকে কোটসুট পরা এক ভদ্রলোক নামলো। মুফতাহির। টুইঙ্কেল লাফিয়ে নেমে আগে অরুনাভ মুখার্জীর পেটে গুতো দিয়ে চেচিয়ে বললো,

-এইত্তো গোপাল ভাড়! আমি এসে গেছি উইশমামের বর নিয়ে!

প্রথমে হেসে দিয়েছিলো দোয়া। কিন্তু টুইঙ্কেলের উইশমামের বর নিয়ে এসে গেছি কথাটা শুনে মাথা নামিয়ে নিলো ও।
নির্বিঘ্নে শেষ হয় দোয়ারাবের বিয়ে। বিদায়ের সময় চিলেকোঠার সবাইকে জরিয়ে কেদেছে দোয়া। আরাব ওকে সামলাতে এগোতে যাচ্ছিলো,কিন্তু তৌফিকা থামিয়ে দেয় ওকে। মাকে জরিয়ে যেনো বাকিসব ভুলে গেছিলো ও। কাদছিলোই। তবে শান্ত ছিলেন সালমা বেগম। আরাবের আর সহ্য হলো না। এগিয়ে গিয়ে একহাতে দোয়াকে জরিয়ে ধরে আরেকহাত দিয়ে সালমা বেগমের হাত দোয়ার মাথায় রাখলো। বললো,

-দোয়াকে দোয়া করবেন মা। কোনোদিনও যেনো ওকে আর কাদতে না হয়।

চুপ হয়ে গেছে চারপাশ। সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছে আরাবকে। মাথা নিচু করে সে হাত নিজের মাথায় নিলো আরাব। বললো,

-আমাকেও দোয়া করবেন মা। ওর কান্নার সবরকম কারন ওর কাছে আসার আগে যেনো আমাকে অতিক্রম করে।

কান্না কমিয়ে আরাবের দিকে মুগ্ধভাবে চেয়ে দোয়া। সালমা বেগম খুশিতে কাদতে লাগলেন এবার। আরাব ওনার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-অনুমতি দিন মা। দোয়ার আরেক মা ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

মাথা উপরনিচ করলেন সালমা বেগম। দোয়াকে শক্তভাবে জরিয়ে ওকে নিয়ে মুখার্জীবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আরাব।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
স্পেশাল পর্ব❤

গাড়িতে ওঠার পরও আরাবের চোখ লুকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাদছিলো দোয়া। একটু পরই হাতের উপর কোনো হাতের স্পর্শ অনুভব হলো ওর। চোখ বন্ধ করে রইলো দোয়া। ও বেশ বুঝতে পারছে,ওর কান্না আরাব না পারছে সইতে,না এই মুহুর্তে বলতে পারছে থামতে। হাতের উপর আরেকটি ক্ষুদ্র হাতের স্পর্শে চোখ মেললো দোয়া। টুইঙ্কেল এই গাড়িতেই বসেছে। ও দোয়ার থুতনি ধরে ওর দিক ফেরালো। দোয়াকে ফিরতে দেখেই ওর চোখের জল দেখে দাতে দাত চেপে গেলো আরাব। টুইঙ্কেল দোয়ার চোখ মুছে দিয়ে বললো,

-কাদছো উইশমাম? কেউ বকেছে?

দোয়া ডানেবামে মাথা নেড়ে না বুঝালো। টুইঙ্কেল আবারো বললো,

-কেউ চকলেট নিয়ে নিয়েছে তোমার?

দোয়া আবারো না বুঝালো। টুইঙ্কেল এবার হেসে দিয়ে বললো,

-ওওও। তাহলে তুমি আদর নেবে বলে কাদছো? জানোতো উইশমাম? যখন আমারও এমন আদর পেতে ইচ্ছে করে,আমি একটুখানি কান্না করলেই আম্মু,আব্বু,মামা সবাই মিলে আদর করে দেয় আমাকে!

একটু প্রসারিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো দোয়া। ওপাশ থেকে আরাব কোলে নিলো টুইঙ্কেলকে। মুচকি হেসে বললো,

-হ্যাঁ টুইঙ্কেল। উইশমাম আদরের জন্যই কাদছে।

হচকিয়ে গেলো দোয়া। চোখমুখ মুছে আরো গুটিয়ে বসলো ও। এরা মামা ভাগ্নি মিলে ঠিক কি করতে চলেছে,মনে মনে হাজারটা উদ্ভট চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো ওর। টুইঙ্কেল উৎসাহ নিয়ে বললো,

-হুউউউম! কিন্তু আম্মু আব্বু তো এখানে নেই মামা! তাহলে তুমিই আদর করে দাও উইশমামকে?

ঠোট কামড়ে হেসে মাথা নাড়লো আরাব। টুইঙ্কেলকে উচু করে সামনের সিটের দিকে এগিয়ে দিয়ে গাড়ির ড্রাইভারের সামনের দিকের আয়নাটা ঘুরিয়ে দিতে বললো ও। টুইঙ্কেল করলোও তাই। আরাব ওকে পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো,

-দেখো টুইঙ্কেল! তারা খসেছে।

উৎফুল্লভাবে বাইরে তাকালো টুইঙ্কেল। তারা খসেছে শুনে দোয়াও পাশ ফিরেছে। তৎক্ষনাৎ ওর দুচোখ মুছে দুগাল ধরলো আরাব। চোখজোড়ায় চুমো একে দিয়ে বললো,

-আর কেদো না দোয়া। প্লিজ!

ঠোট কামড়ে ধরে মাথা নামিয়ে নিলো দোয়া। আর যাই হোক,আরাবের এ আকুতি ফিরিয়ে দেবে না ও। যত কষ্টই হোক না কেনো,নিজের চোখের অশ্রুতে আরাবকে আর আঘাত করবে না ও। কখনোই না।

গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নেমে রংধনুর দিকে মাথা উচু করে তাকালো দোয়া। ওর শশুড়বাড়ি। আরাব ওর হাত ধরে হাটা লাগালো। সাদরে আপন করে নিলো ওকে তৌফিকা,মিসেস ওয়াহিদ,আরাবের বন্ধুবান্ধবেরা। টুকিটাকি কথা শেষে মিসেস ওয়াহিদ বললেন,

-অনেক হয়েছে। এবার দোয়াকে একটু একা ছাড়ো সবাই। সারাদিন অনেক ধকল গেছে এর। একটু কিছু মুখে দিক।

সবাই দোয়াকে ছেড়ে আরাবকে নিয়ে চললো এবার। দোয়ার মানা সত্ত্বেও মিসেস ওয়াহিদ নিজহাতে খাইয়ে দিলেন দোয়াকে। খুশির কান্না অতিকষ্টে আটকে দিয়েছে দোয়া। তৌফিকা জরিয়ে রেখেছে ওকে। এককোনে থেকে আরাব মুচকি হাসি ঝুলিয়ে শুধু মা বোনের কান্ডকারখানা দেখেছে। খাওয়ানো শেষে তৌফিকা আর আরাবের কিছু বান্ধবী মিলে দোয়াকে নিয়ে আরাবের রুমের দিকে চললো। টুইঙ্কের দোয়ার শাড়ির আঁচল ধরে লাফাতে লাফাতে চললো ওদের সাথেই। ঘরে ঢুকে দোয়াকে বিছানায় বসিয়ে দিলো তৌফিকা। বললো,

-এই নাও দোয়া! আমার এলোমেলো ভাইটাসহ ওর অগোছালো ঘরও এখন তোমার দায়িত্ব!

দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। প্রচন্ড ইতস্তত লাগছে ওর। বাকিসবাই হাসছে। হঠাৎই দরজায় নক করলো কেউ। সবার সাথে দোয়াও দরজায় তাকালো। দরজায় নক করা বৃদ্ধাঙ্গুলিই নাড়িয়ে শীতল চাওনিতে ঘাড় নাড়িয়ে আরাব সবাইকে বুঝালো বেরিয়ে যেতে। চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো দোয়া। এভাবে বলার কি আছে? আরাবের এক কলিগ বলে উঠলো,

-এইট কেমন হলো? ভাবলাম ভাবির সাথে বসে আড্ডা দেবো। আর আরাব তুমি এসেই ইশারা করছো বেরিয়ে যেতে?

আরাব বুকে হাত গুজে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বললো,

-ওকে। ইউ মে ক্যারি অন! পইপই করে হিসাব নিচ্ছি প্রতিটা সেকেন্ডের!

সবাই শব্দ করে হেসে দিলো। আরাবের এক বান্ধবী দোয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-আসছি দোয়া! তোমার বরটা সাইন্টিস্ট ঠিকই। তবে হিসাবে বেশ পাকা। আমাদের উপর দিয়ে ওর বাসর বিলম্বের ফলটা নিউটনের আপেল পরার মতোই হবে দেখো। এক্সট্রা প্যারা!

দোয়া অবুঝের মতো তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা হেসে বললো,

-বোঝোনি? ওকে। আরাবের এই বাসর বিলম্বের শাস্তি কি হলো আমাদের,সময় করে জানাবো তোমাকে। আসছি হুম? হ্যাপি ম্যারেড লাইফ!

একে একে সবাই বেরিয়ে যেতে লাগলো ঘর থেকে। দোয়া একেবারে জরোসরো হয়ে বসলো। কিন্তু বসে থাকতেই পারলো না ও। হুট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো। একটু থেমে বাকা হেসে আরাব এগোতে লাগলো। নিচদিক তাকিয়েও সেটা টের পেলো দোয়া। একপা দুপা করে পেছোতে পেছোতে পেছনের কিছুর সাথে থেমে গেলো ও। আরাব এগিয়ে এসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। দোয়ার ঠিক পেছনেই বারান্দা দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখা যায়। দোয়ার থুতনিতে হাত রেখে ওর মুখ উচু করে ধরলো আরাব। একপলক চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওই চাঁদকে তাচ্ছিল্য করে মাথা নাড়িয়ে খানিকটা শব্দ করলো আরাব। দোয়ার দিকে তাকিয়েই বললো,

-মাশাল্লাহ্!

-আরাব মামা? তুমি না বলেছিলে উইশমামকে যেদিন ডলের মতো সাজিয়ে রংধনুতে আনবে,একসাথে আমরা উইশমামের কার্লি হেয়ার দেখবো!

দোয়া চোখ বন্ধ করেই ছিলো। টুইঙ্কেলের কথায় চোখ মেললো ও সাথেসাথে। বিছানায় কোমড়ে দুহাত দিয়ে দাড়িয়ে টুইঙ্কেল। আরাব চেহারায় চাপা কষ্ট পুরোপুরি প্রকাশ করে দোয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-স্মৃতিশক্তিটা তোমার স্টুডেন্টের একটু বেশিই!

দোয়া হাসবে না কাদবে,বুঝে উঠতে পারছে না। সবে ও টুইঙ্কেলের দিকে এগিয়ে যাবে,তৌফিকা টুইঙ্কেলকে ডাকতে ডাকতে রুমে ঢুকলো। মেয়েকে বিছানায় ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কয়েকবার জিভ কাটলো তৌফিকা। ছুটে এসে টুইঙ্কেলকে কোলে নিয়ে সরি আরাব বলে ছুটলো ও। দোয়া এগোচ্ছিলোই। আরাব ওর হাত ধরে আবারো সামনে দাড় করালো ওকে। মুড তো টুইঙ্কেল নিয়ে গেলো,তবে দোয়ার দিকে তাকাতেই হাসি ফুটলো ওর মুখে। উকিঝুকি দিয়ে কিছু একটা পরখ করে বললো,

-আজকে একটু বেশিই সেজেছো।

একবার বিস্ময়ে আরাবের দিকে তাকিয়ে দোয়া নিজের দিকে তাকালো। গাল ফুলিয়ে বললো,

-বেশিই হয়ে গেছে তাইনা? আমি বারবার করে বারন করছিলাম ওদের। এতো না সাজাতে! এতো গয়না না পরাতে! শুনলোই না কোনো কথা আমার!

ঠোট টিপে হাসি আটকালো আরাব। দোয়ার ওর দিকে তাকিয়ে আবারো বললো,

-খুব বেশিবেশি হয়ে গেছে?

-হুম।

দোয়া মুখ কালো করে গয়নাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাব কিছুক্ষন বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে দেখলো ওর চাওনি। তারপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,

-তোমার ঠিক কেমন লাগছে বলতে পারবো না। তবে আমার অনেকবড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এসবে!

ভ্রুকুচকে তাকালো দোয়া। হুট করেই আরাব ওর কানে হাত দিলো। খানিকটা চমকে উঠলো দোয়া। ওর কানের দুল খুলতে খুলতে আরাব ফিসফিসিয়ে বললো,

-ঠিক কি কি ক্ষতি,জিজ্ঞাসা করো না! আমি যেটুকো বলবো,শুধু মন্জুর করো হুম?

দোয়া যেনো জমে গেছে। আরাব নিজের মতো করে ব্যস্ত থেকে বললো,

-এইযে! তোমার এই ঝুমকো নড়াচড়া করছে বলে তোমাকে ছেড়ে ওর দিকে চোখ চলে যাচ্ছে! এটা আমার কতোবড় ক্ষতি জানো?

ওর ঘোমটা খুলে মাথার মুকুট খুলে দিলো আরাব। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বললো,

-এই মুকুট তোমার চুলের উচ্ছ্বলতাকে এতোক্ষন আটকে রেখেছিলো,তা আমার কতোবড় ক্ষতি করেছে জানো?

-আ্ আরাব….

দোয়াকে বলতে দেয়নি আরাব। ওর নথ খুলে দিয়ে বললো,

-এর উপর পরা আলো তোমার দৃষ্টির কম্পন থেকে আমাকে দৃষ্টিচ্যুত করতে বাধ্য করেছে দোয়া। অনেকবড় ক্ষতি করে দিয়েছে আমার। বিশ্বাস করো!

দোয়ার হাত তুলে ধরলো আরাব। চুড়িগুলো খুলতে খুলতে বললো,

-এতো শব্দ কেনো করতে হবে এদের? একসময় তো এটুকোর জন্যই তৃষ্ণার্ত ছিলাম। কোথায় ছিলো তখন এরা? আজ যখন তোমার হৃদস্পন্দন শুনবো বলে স্থির করেছি,এরা কন্টিনিউয়াসলি ডিস্টার্ব করে চলেছে! তোলপাড় শুরু করে দিচ্ছে আমার ভেতরটায়। এ ক্ষতি কি উপেক্ষা করার মতো? বলো দোয়া?

দোয়া দুহাতে মুঠো করে ধরলো শাড়ি। ওর ঘাড়ের সবগুলো চুল একপাশে দিয়ে দিতেই কেপে উঠলো দোয়া। একে একে ওর গলার সমস্ত গয়না খুলে দিয়ে আরাব বললো,

-এরা তোমার কাছে থেকে তোমার সৌন্দর্যে নিজেদের সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যস্ত। আমার প্রেয়সীর সৌন্দর্য শুধু আমার নামে,আমার তরে। এদেরকে কেনো বিলিয়ে দেবো? তাতে যে আমার বড্ড ক্ষতি দোয়া! বড্ড ক্ষতি!

দোয়া কিঞ্চিত ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। আরাবের উষ্ণ নিশ্বাস চোখে মুখে লাগছে ওর। পাগলপাগল লাগছে নিজেকে ওর। একহাতে ওর কোমড় জরিয়ে ধরলো আরাব। কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললো,

-তুমি তো জানো দোয়া,তোমার নিত্যরুপ আমার দুর্বলতা। আমার মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে তোমার পাশ কাটানোতে বারবার তোমার প্রেমে পরেছি আমি। সাহসী চাওনির চেয়ে লজ্জায় তুমি একটু নুইয়ে গেলে আমি খুন হয়ে যাই। আজ বুঝি সবরকমভাবেই আরাবকে এলোমেলো করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছো?

দোয়া নিশ্চুপ। আজ ও শুনবে। আরাবের কথাগুলো শুনবে। সেদিন তো ও বলেছিলো। আর আরাব অনুমতি নিয়েছিলো,আজকে বলার। আজ তবে আরাবই বলুক! নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা আর করলো না দোয়া। আরাব ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

-তবে সত্যিই যদি আমি আজ বেসামাল হই,তার দায় নেবে তুমি দোয়া?

একপলক চোখ তুলে তাকালো দোয়া। আরাবের সেই তৃপ্ত হাসি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তেধীরে মাথা উপরনিচ করলো দোয়া। মুচকি হেসে ওর একগালে হাত রেখে আরাব এগোচ্ছিলো। সুযোগটুকো না দিয়ে ওর শেরওয়ানি খামচে ধরে ওরই বুকে মুখ লুকালো দোয়া। কিছুক্ষন থেমে থেকে ওকে কোলে তুলে নিলো আরাব। ঘটনার আকস্মিকতায় দোয়া বড়বড় চোখে তাকালো। আরাব বললো,

-মুখ লুকানোর জন্য একেবারে পার্ফেক্ট জায়গাটাই চুজ করেছো! আমার থেকে আড়াল হয়ে আমার মাঝেই বিন্যস্ত হতে চাইছো! লাজুকলতার সকল চাওয়া শিরধার্য!

দোয়া পুরোই বোকাবনে গেছে। আরাব যে সব বিষয়কে ওর দিকে তাক করে কেনো এতো বেশি মজা পায়,বুঝেও ওঠে না ও। ওর চাওয়া মানে কি? ওকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাব সামনে তাকিয়েই হাটতে হাটতে বললো,

-ভালোবাসি।

শব্দটা শুনেই লজ্জায় আবারো নুইয়ে গেলো দোয়া। আরো শক্তকরে ওর গলা জরিয়ে বুকে মুখ লুকালো। মিশে যেতে লাগলো ওর বুকের মাঝে। এ রাত লজ্জার,এ রাত….ভালোবাসার!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here