#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৬
আরাব উপুর হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে,আর দোয়া ওর উন্মুক্ত পিঠের ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। কিঞ্চিত নড়েচড়ে উঠলো আরাব। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলো,ভোরের আলো ফোটেনি এখনো। ঠিকঠাকমতো শুতে যাবে,টের পেলো ওকে কেউ দুহাতে জরিয়ে আরামে ওর পিঠের ওপর মাথা রেখে শুয়ে। নড়াচড়া না করে মুচকি হাসলো আরাব। একহাতে দোয়ার মাথাটা একটুখানি উচিয়ে ধরে সোজা হয়ে শুয়ে পরবে ভাবলো। কিন্তু ও সোজা হওয়ার আগেই চোখ মেললো দোয়া। হুট করেই আরাবকে খালি গায়ে এতো কাছে দেখে ভরকে গিয়ে মোটামুটি লাফিয়ে সরে যাচ্ছিলো ও। আরাব একটানে ওকে নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো। একহাতে চাদর দিয়ে দোয়াকে ঠিকঠাকমতো জরিয়ে আরেকহাতে ওর ঘাড়ের চুলগুলো মুঠো করে নিলো ও। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর গলায় বললো,
-নিজেকে নতুন করে দেখুন,চিনুন মিসেস তাহসানুল আরাব? এখনো এভাবে চমকালে চলবে? দুরে সরে যেতে চাইলে চলবে? আমি যেতে দেবো?
চোখ খিচে বন্ধ করে রইলো দোয়া। সকাল সকাল ওকে এভাবে লজ্জায় না ফেললে চলছিলো না লোকটার? দোয়ার চুলে চুমো দিলো আরাব। তারপর ওকে শুইয়ে দিয়ে চাদরটা ছেড়ে দিলো। শক্তহাতে ওটা ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো দোয়া। আরাব দোয়ার দিকে খানিকটা ঝুকে ওর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললো,
-জানো দোয়া? বারান্দা দিয়ে ভোরের আকাশে শুকতারা দেখা যাচ্ছে।
দোয়া চোখ মেললো। মুচকি হেসে ওর কপালে ঠোট ছোয়ালো আরাব। কপালে ভাজ ফেলে সরু চোখে তাকালো দোয়া। আরাব মাথার নিচে একহাত রেখে কিছুটা উচু হয়ে শুয়ে বললো,
-আজ অনেকদিন পর এতো সকালে ঘুম ভেঙেছে আমার।
-ত্ তো আবার ঘুমিয়ে পরুন।
অন্যদিক তাকিয়ে কোনোমতে কথাটা মুখ দিয়ে বের করলো দোয়া। চোখ তুলে আরাবের দুষ্টু হাসি দেখেই গালে রক্তিমতা ফুটে উঠলো ওর। ধাক্কা মেরে আরাবকে সরিয়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আরাব মুচকি হেসে আবারো শুয়ে পরলো উপুর হয়ে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দোয়া দেখলো আরাব ঘুমিয়ে। ঠোট টিপে নিরবে হাসলো শুধু। এইতো,তৌফিকার বলা ওর এলোমেলো বর! মাথায় তোয়ালে পেচাতে পেচাতে পুরো ঘরটায় আরেকদফা চোখ বুলালো ও। সবকিছু বেশ ভালোভাবেই গোছানো। তাহলে তৌফিকা ওকে কেনো বললো,এলোমেলো ঘর? বিছানায় থাকা গোলাপের পাপড়িগুলো মেঝেতে পরে আছে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে দুহাতের আজলায় কিছু পাপড়ি তুলে নিলো দোয়া। ঘ্রান এখনো যায়নি ওগুলোর। যেমনটা ওর গায়ে এখনো আরাবের ঘ্রান লেগে আছে,তেমনটাই।
চোখ বন্ধ করে আরেকবার নিজের মাঝে আরাবকে অনুভব করতে যাচ্ছিলো ও। পরপরই মনে পরলো,আরাব ওর কাছেই,ওর সামনেই। আর এ মানুষটা তো পুরোপুরিই ওর। আরাবের দিকে কিছুটা ঝুকে আস্তেকরে ওর কপালে ঠোট ছুইয়ে পাপড়িগুলো বেডসাইড টেবিলে রাখলো দোয়া। ওখানেই চোখে পরলো স্বচ্ছ কাচের একটা গোলাকৃতির পাত্রবিশেষ। ভেতরে কালচে,বড়বড় পাতার মতো কিছু। কি সেটা বুঝতে পারছিলো না দোয়া। কপালে ভাজ পরলো ওর। তখনই শুনতে পেলো,
-ওগুলো তোমার তোলা পদ্ম। ওই ফুলকুড়োনির কাছ থেকে আমিই কিনেছিলাম।
আরাবের কথায় ওর দিকে তাকালো দোয়া। আরাব ততক্ষনে উঠে বসেছে। দোয়াকে তাকাতে দেখেই চোখ মেরে বললো,
-কি ম্যাডাম? আপনি নিজে থেকে আমাকে আদর করবেন,আর আমি ঘুমোবো এটা কোনোদিন সম্ভব বলে মনে হয় আপনার?
মাথা নেড়ে দোয়া টেবিলে তোলা পাপড়িগুলো সরিয়ে দিতে যাচ্ছিলো। আরাব ব্যস্তভাবে বললো,
-ওয়েট!
দোয়া থেমে গেলো। আরাব নেমে এসে পাপড়িগুলো ওই কাচের বোলটায় রেখে দোয়ার সামনে দাড়ালো। বললো,
-তোমার ভালোলাগা দিয়ে এই ঘর ভরিয়ে তোলো দোয়া। আমি তোমায় হারাতে চাই,তোমার ভালোলাগায় হারাতে চাই।
দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। শাড়ির আচল আঙুলে পেচাতে লাগলো ও। আরাব আপদমস্তক দেখে নিলো ওকে। মিষ্টি রঙের শাড়িটায় একেবারে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো দেখাচ্ছে দোয়াকে। ওর মাথার তোয়ালে খুলে দিলো আরাব। দোয়া মাথা তুললো। আরাব ওর ভেজা চুল কানে গুজে দিয়ে বললো,
-কোনো এক উপন্যাসে পড়েছিলাম,বরের স্পর্শে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। আজ দেখেও নিলাম।
লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো দোয়ার। তবুও নিজেকে সামলে নিলো ও। বরাবরই এই লজ্জাতেই আরাব বারবার লজ্জায় ফেলেছে ওকে। গলা ঝেড়ে আরাবের হাতের তোয়ালে কেড়ে নিলো ও। চোখে চোখ রেখে বললো,
-ও! তারমানে সাইন্টিস্ট মশাই এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে এইসব উপন্যাসও অধ্যায়ন করেন?
একটু প্রসারিত চোখে তাকালো আরাব। দোয়া একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। আরাব নিজেও বাকা হাসি দিলো একটা। হচকিয়ে গেলো দোয়া। আরাবের এই বাকা হাসির পরবর্তি কাজগুলো ওর জন্য ভয়ানক লজ্জাজনক হয় মনে পরে গেছে ওর। আমতা আমতা করতে করতে বললো,
-আ্ আসলে আরাব….
বলার সুযোগ না দিয়ে দোয়াকে ঘুরিয়ে দাড় করালো আরাব। একহাতে পেছন থেকে জরিয়ে রেখে আরেকহাতে ওর চুলগুলো ঘাড়ের সামনে দিয়ে দিলো। কেপে উঠলো দোয়া। দুহাতে আরাবের একহাত ছাড়ানোর জন্য দুবার নড়চড়া করলো। ওর ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়েছে আরাব। দোয়া অস্ফুটস্বরে বললো,
-আ্ আরাব…
আরাব নেশালো কন্ঠে বললো,
-হুম। পড়েছি। তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো বলে প্রেমের সব উপন্যাস পড়েছি,সব সঙ্গা জেনেছি,ভালোবাসা নামক বিস্তৃত অধ্যায়ের সকল পরিচ্ছদ অধ্যায়ন শেষ আমার। আরো কি কি স্টাডি করেছি,প্র্যাকটিকালি প্রমান দেই?
দোয়ার চোখ যেনো বেরিয়েই আসবে। ওর দেহের কম্পন অনুভব করে আরাব মুখ তুললো। হাফ ছাড়লো দোয়া। ওর গলায় একটা সরু চেইন পরিয়ে দিলো আরাব। ওকে সামনে ঘুরিয়ে দুগাল ধরে বললো,
-আরাবের পাগলামিগুলোতে গা ভাসাতে অভ্যস্ত হয়ে যাও দোয়া। তোমাকে হুটহাট লজ্জায় পরে যেতে দেখলে আমি আরো বেসামাল হয়ে যাই।
-ও আম্মু! আরাব মামার রুমের দরজা নষ্ট হয়ে গেছে!
বাইরে থেকে টুইঙ্কেলের চিৎকার শুনে বড়বড় চোখে দরজায় থাকালো দোয়া। আরাব গুরুত্ব না দিয়ে ওভাবেই জরিয়ে রইলো দোয়াকে।বললো,
-আমার রুমের দরজা কখনো লক পায়নি। তাই ওভাবে বলছে।
লজ্জায় চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লো দোয়া। সকাল সকাল এই লোক এমন করছে,আর ওই বাচ্চা মেয়েটা বাড়িভর জানান দিচ্ছে ওদের রুমের দরজা লক। আরাব দোয়ার কপালে চুমো দিয়ে ওকে ছেড়ে গিয়ে দরজা খুললো। টুইঙ্কেল ভেতরে ঢুকে আরাবকে শাষনের স্বরে বললো,
-এই পচা ছেলে! খুব ভালো লাগে না মাকে জ্বালাতে? খুব মজা পাও না মাকে ভয় দেখিয়ে? খুব আনন্দ লাগে তাইনা?
আরাব ঘাড় বাকিয়ে হেসে বললো,
-বাহ্! সকাল সকাল নানুমনির লেকচার মুখস্ত করে এসেছো টুইঙ্কেল?
টুইঙ্কেল হেসে দিলো। ওকে কোলে তুলে কাতুকুতু দিতে লাগলো আরাব। খিলখিলিয়ে আরো জোরে জোরে হাসতে লাগলো টুইঙ্কেল। দোয়া মুগ্ধ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটুপর দোয়াকে দেখে টুইঙ্কেল বললো,
-গুড মর্নিং উইশমাম।
-ভেরি গুড মর্নিং লিটলস্টার।
টুইঙ্কেল আরাবের মুখ ধরে দোয়ার দিকে ফেরালো। তারপর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-মামা? উইশমামও কি আমার আর তোমার মতো চুল মুছতে পারে না?
আরাব দোয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। ও নিজেও ধীর গলায় বললো,
-না টুইঙ্কেল। তুমি গিয়ে উইশমামকে বকে দাওতো! এতো সকালে গোসল করেছে,চুলগুলো ভালোভাবে না মুছলে অসুখ করবে তো!
দোয়া ভ্রুকুচকে ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। টুইঙ্কেল ওকে বলে আরাবের কোল থেকে নেমে দোয়ার দিকে এগোলো। দোয়া ভ্রু নাচিয়ে একবার আরাবকে বোঝালো কি বললো টুইঙ্কেল। আরাব একটা ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললো,
-হ্যান্ডেল হার কোশ্শেনস্!
বেখেয়ালিভাবে হেলেদুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো আরাব। দোয়া অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। কি বলে গেলো আরাব? টুইঙ্কেলের প্রশ্ন সামলাবে মানে? কি এমন বলবে টুইঙ্কেল? ওর দিকে তাকালো দোয়া। টুইঙ্কেল দোয়ার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে বেডের উপর উঠে দাড়ালো। তারপর দোয়াকে ইশারা করলো এগিয়ে দাড়াতে। দোয়া করলোও তাই। টুইঙ্কেল তোয়ালে দিয়ে ওর মাথা মুছতে মুছতে বলে উঠলো,
-এত্তো শীতে,এত্তো সকালে গোসল কেনো করেছো উইশমাম?
নিরব বজ্রপাতের শব্দ যেনো কানে বাজলো দোয়ার। অসহায়ভাবে ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকালো ও। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে শাওয়ারের সাথে হুইস্টলিংয়েরও শব্দ আসছে। এখানে টুইঙ্কেলকে উসকিয়ে,ওকে টুইঙ্কেলের উদ্ভট প্রশ্নফাদে ফেলে জনাব সিটি বাজিয়ে বাজিয়ে,নির্বিঘ্নে স্নানে ব্যস্ত? দাতে দাত চেপে রইলো দোয়া। আরাবকে উদ্দেশ্য করে ওর ভেতরের কোনো ক্ষিপ্ত সত্ত্বা যেনো চেচিয়ে বলে উঠলো,
-এবার আসুক! তারে আমি মজা দেখাবো!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৭
আরাব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে টুইঙ্কেল বিছানায় বসে ফুল নাড়াচাড়া করছে। তবে ওর কাছে দোয়া নেই। মাথায় তোয়ালে চালিয়ে আশেপাশে দোয়াকে খুজতে লাগলো ও। টুইঙ্কেলকে কি বলে দোয়া সরেছে আর টুইঙ্কেলই বা এতো সুন্দরমতো বসে আছে কিভাবে,মাথায় ঢুকছে না ওর। ওকে বেরোতে দেখে টুইঙ্কেল বললো,
-বেরিয়েছো?
-হুম। তোমার উইশমাম…
-উইশমাম তো নিচে চলে গেছে।
-ও। ত্ তো তোমার কোশ্শেনের আন্সার দিয়েছে উইশমাম?
টুইঙ্কেল উঠে দাড়ালো বেডের উপর। চেচানোপ্রায় আওয়াজে বলে উঠলো,
-না। উইশমাম বলেছে,তোমার কাছ থেকে জেনে নিতে। আর যদি আন্সার না করো,তাহলে তোমার নামে রংধনুর সবার কাছে নালিশ করতে। তুমি জোর করেছো উইশমামকে এতো সকালে গ্….
তোয়ালে বিছানায় ছুড়ে মেরে টুইঙ্কেলের মুখ চেপে ধরলো আরাব। পেছন থেকে ওর অবস্থা দেখে শব্দ করে হেসে ফেললো দোয়া। আরাব একবার দোয়ার দিকে তাকালো। তারপর টুইঙ্কেলকে বললো,
-এই টপিক ভুলে গেলে মামা টুইঙ্কেলকে অনেকগুলো চকলেট দেবে।
টুইঙ্কেল মুখ ওভাবে চেপে থাকা অবস্থাতেই অস্ফুটস্বরে বললো,
-ডিল?
আরাব বুঝলো ওর কথা। হার মেনে নেওয়ার চেহারা বানিয়ে বললো,
-ডিল।
টুইঙ্কেলকে ছেড়ে দিলো আরাব। ও নাচতে নাচতে দোয়ার কাছে গিয়ে বললো,
-মামার কাছ থেকে চকলেট আদায়ের আইডিয়াটা দারুন ছিলো উইশমাম! থ্যাংকিউ!
দৌড়ে বেরিয়ে গেলো টুইঙ্কেল। আরাবের দিকে তাকালো দোয়া। করুনার স্বরে বললো,
-আহারে! প্রেমাখ্যান পড়তে পড়তে “পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকই” নিউটনের এই তৃতীয় সুত্র ভুলে গেছেন বুঝি? বেচারা সাইন্টিস্ট!
-তাই না?
আরাব এগোলো ওর দিকে। রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আসলো দোয়া। সিড়ির কাছে আসতেই সোফায় তৌফিকা,মুফতাহির,টুইঙ্কেল আর মিসেস ওয়াহিদকে দেখতে পেলো ও। দোয়া শাড়ির আচলটা মাথায় তুলে দিয়ে এগিয়ে গেলো। মৃদ্যুস্বরে সালাম দিয়ে বললো,
-গুড মর্নিং।
মিসেস ওয়াহিদ সালামের উত্তর নিলেন। মুফতাহিরও পেপার ছেড়ে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে,উত্তর নিলো সালামের। তৌফিকা বললো,
-গুড মর্নিং! আয়! এদিকে এসে বস!
তৌফিকার তুই সম্বোধনে দোয়া খুশি হয়ে গেলো। এগিয়ে যাবে,মুফতাহির পেপার পড়তে পড়তেই বললো,
-দোয়া সবে আসলো রংধনুতে,এখনই তুই করে বলছো তৌফিকা?
-মা তো বলেই দিয়েছে,দোয়া এ বাড়ির মেয়ে। আমিও ওকে ছোটবোন মানি। তুই করেই বলবো! কিরে দোয়া? তোর কি খারাপ লাগবে আমি তোকে তুই করে ডাকলে?
দোয়া তৌফিকার হাত মুঠো করে নিয়ে বললো,
-না আপু। আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো! আপনি তুই করেই ডাকুন আমাকে।
-তাহলে তো তোরও তৌফিকার সাথে আপনি চলবে না দোয়া! তুমি করেই বলতে হবে! আমিও তুই করেই ডাকবো তোকে,তাই আমাকেও তুমি করে বলতে হবে!
মিসেস ওয়াহিদের কথায় মুচকি হাসলো দোয়া। বললো,
-জ্বী,চেষ্টা করবো।
মিসেস ওয়াহিদ দোয়ার গালে হাত রাখলেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন,
-চল ব্রেকফাস্ট করবি চল।
দোয়া অবাক হয়ে তাকালো। ও ভেবেছিলো নিজেহাতে খাবার বানাবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়িই এ বাসায় ব্রেকফাস্ট করে সবাই তা তো ওর জানা ছিলো না। ইতস্তত করে বললো,
-এ্ এখনি?
তৌফিকা হেসে দিয়ে বললো,
-আজকে তাড়াতাড়িই খাবো আমরা। তোদের রিসেপশন নিয়ে প্লানিং করতে হবে না?
দোয়া আর কিছুই বললো না। মাথা নিচু করে মৃদ্যু হাসলো শুধু। সবাই মিলে ডাইনিংয়ে এসে বসে গেলো। কেয়ারটেকার খাবার বেড়ে দিলে মুফতাহির আর মিসেস ওয়াহিদ খাওয়া শুরু করে দিলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে দোয়া। আরাব,ওর শশুড়কে ডাকলো না কেনো কেউ? তৌফিকা টুইঙ্কেলকে খাওয়াচ্ছিলো। দোয়াকে খাওয়া বাদ দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,
-কিরে? খাচ্ছিস না কেনো?
-আ্ আসলে…
-আরাবের জন্য ওয়েট করছিস?
-হ্যাঁ মানে ন্ না মানে আপু…
মিসেস ওয়াহিদ হেসে বললেন,
-ওর ঘুম থেকে ওঠা দেরি আছে। তুই খেয়ে নে!
টুইঙ্কেল এতোক্ষন পুতুল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো। মিসেস ওয়াহিদের কথা শুনেই বলে উঠলো,
-মামা আজকে সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠেছে তো! আজ ঘুমিয়ে নেই! সকালে উইশমামকে….
ওকে বলতে না দিয়ে দোয়া বলে উঠলো,
-ব্ বাবা কোথায়?
টুইঙ্কেল থেমে গেলো। তৌফিকা মেয়ের পাকনামো বুঝেছে। ওরও মনে পরলো,আরাব বিবাহিত। আগের রুটিনে পরিবর্তন আসবেই এখন। টুইঙ্কেলের মুখে খাবার দিয়ে চুপ থাকতে চোখ রাঙালো ওকে। ও আর কিছুই বললো না। মিসেস ওয়াহিদ গলা ঝেরে বললো,
-ওহ্! ভালো কথা মনে করিয়েছিস দোয়া। তৌফিকা? তোর বাবার খাবারটা রুমেই দিয়ে আয়। আসার সময় দেখলাম ফাইল নিয়ে বসেছে। তার কি আর খাওয়ার কথা মনে থাকবে?
ট্রে নিয়ে খাবার বাড়তে লাগলো তৌফিকা। দোয়া আরো বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মুফতাহির পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে দোয়ার বিস্মিত চেহারা দেখে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-বিয়ের ব্যস্ততায় দুদিন অফিস যায়নি। কাজ বাড়তি হয়ে গেছে এজন্য। রুমেই খাবারটা দিয়ে আসো তৌফিকা।
দোয়ার একবার মনে হলো কথাটা ওকে উদ্দেশ্য করেই বললো মুফতাহির। একটু চুপ থেকেই হাসি ফুটালো মুখে। উঠে দাড়িয়ে বললো,
-বাবার খাবারটা আমি দিয়ে আসি আপু?
-তা কেনো? তুই খেয়ে নে,আমিই…
-প্লিজ আপু। যাইনা আমি?
মিসেস ওয়াহিদ মাথা নেড়ে তৌফিকাকে বললো ওকে যেতে দিতে। দোয়া খুশি হয়ে খাবার বেড়ে নিয়ে চললো। আরাবের ঘর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো ও। তখনই মনে পরলো,তৌফিক ওয়াহিদের ফোনটার কথা। ঘরে ঢুকে দেখে আরাব কালো টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে। চুল এখনো ঠিকমতো মোছেনি। এলোমেলো হয়ে আছে চুলগুলো। সে ব্যক্তি কাবার্ডের নিজের সব জামাকাপড় নামিয়ে বিছানার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে,দোয়ার শাড়ি ভেতরে ঢুকাচ্ছে।
দোয়া পুরো ঘরে আরেকবার চোখ বুলালো। বিছানার চাদর নিচে পরে আছে,টেবিলের বইখাতা এলোমেলো,চেয়ারটাও বাকা হয়ে আছে,সামনেই খাতায় কিছু লেখা,যেনো সকালে উঠেই কয়েকদফায় পড়াশোনা শেষ আরাবের। টি টেবিলের উপর রাখা ফাইলগুলোও দুটো খোলা,বাকি চারটে অগোছালো। দোয়া বড়সড় একটা দম নিলো। তৌফিকা ভুল কিছুই বলেনি। এলোমেলো ঘর! আস্তেধীরে আরেকটু এগিয়ে বললো,
-আরাব?
আরাব পেছন ফিরলো। দোয়াকে দেখেই হাসি ফুটলো ওর চেহারায়। কিন্তু ওর হাতে খাবারের ট্রে দেখে হাসিটা মলিন হয়ে গেলো। ভ্রু নাচিয়ে বুঝালো ওটা কার। দোয়া বললো,
-বাবার খাবার। ওনার রুমে নিয়ে যাচ্ছি।
আরাব হেসে এগিয়ে আসলো। ট্রে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে ওর কোমড় জরিয়ে ধরে বললো,
-একদম বউবউ লাগছে তোমাকে।
-ঘরের এ অবস্থা কেনো?
দোয়াকে ছেড়ে ঘাড় চুলকালো আরাব। দোয়া মুচকি হাসলো। এগিয়ে গোড়ালি উচিয়ে দাড়ালো আরাবের আরো কাছে। বাহাতে আরাবের একহাত নিজের কোমড়ে রেখে,চুলগুলো ডানহাতে ঠিক করতে করতে বললো,
-ডোন্ট ওয়ারি। আপনাকে,আপনার ঘরকে গুছিয়ে রাখতে,আ’ম প্রিটি এনাফ!
হেসে দিয়ে দোয়ার নাকে নাক ঘষলো আরাব। দোয়া নিজেকে ছাড়িয়ে ট্রে হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আরাব পেছন থেকে ডাকলো ওকে। দোয়া থেমে গেলো। এগিয়ে এসে ট্রের উপর তৌফিক ওয়াহিদের ফোনটা রাখলো আরাব। দোয়া মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। যে জন্য ঘরে ঢোকা,সেটা ও ভুললেও,না জেনেই আরাব ঠিক মনে করিয়ে দিলো ওকে। আরাব খানিকটা ঝুকে,মুচকি হেসে বললো,
-ডোন্ট ওয়ারি। তোমার সবকাজে,সবসময় পাশে আছি। এন্ড আই থিংক,আ’ম অলসো প্রিটি এনাফ!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-৪৮
দরজায় নক পরায় প্রচন্ড বিরক্তিতে কাম ইন বলে আরাবো কাজে মনোযোগ দিলেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়া দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সালাম দিয়ে বললো,
-গুড মর্নিং বাবা।
চোখ তুলে তাকালেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়াকে দেখে ধীরগলায় সালামের উত্তর নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলেন উনি। দোয়া খাবারটা টি টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। তৌফিক ওয়াহিদ টের পেলেন রুমে কিছু ঘটছে,তবুও কিছু বললেন না। বিছানার চাদরটা ভাজ করে ফাইলের তাকগুলো গোছালো,এসি,ফ্যান,লাইটের রিমোটটা অবদি ঠিকঠাক জায়গায় রেখে তৌফিক ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে তখনো সোফায় বসে ফাইল ঘাটছে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে আসলো ও। খাবার হাতে নিয়ে সোফায় তৌফিক ওয়াহিদের ঠিক পাশে বসে গেলো ও। তখনই নিজের কাজে ব্যস্ত তৌফিক ওয়াহিদ। হঠাৎই মুখের সামনে খাবার দেখে চমকে উঠে পাশে তাকালো সে। পরনে শাড়ি,মাথায় আঁচল দিয়ে বসে তার ছেলের বউ! দোয়া! তাকে খাইয়ে দিচ্ছে! তৌফিক ওয়াহিদ ফাইল বন্ধ করে কড়াভাবে বললেন,
-হোয়াটস্ দিস ননসেন্স?
-সেন্স ননসেন্সের কথা তো আপনি নাই বলুন তো ভালো বাবা! সকাল সকাল কেউ ব্রেকফাস্ট বাদ দিয়ে ফাইলের ঘ্রানে পেট ভরায়,এটা কোন ধরনের সেন্স বলুনতো?
-দেখো দোয়া…
দোয়া খাবার মুখে পুরে দিয়েছে তৌফিক ওয়াহিদের। আটকে পাথর হয়ে রইলেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়া আবারো খাবার মাখাতে মাখাতে বললো,
-সাফাত রওশনের এন্টিডোড যদি রংধনু থেকে লন্চ করাতে চান,আমার দু চারটে আবদার মানতে শিখুন বাবা!
আপনাআপনিই মুখ চলতে লাগলো তৌফিক ওয়াহিদের। দোয়া ওনাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,
-বিজনেসের ভাষায় আরেকটা কথা বলি বাবা? দুটো ওয়েতে আপনি প্রফিট করতে পারেন। এক, হয় আপনি রেগুলার সবার সাথে বসে খাবার খাবেন,নয় আমি রেগুলার আপনাকে খাইয়ে দিয়ে যাবো! যেটা আপনার ভালো লাগে,সেটাই মন্জুর। কোনো জোরাজুরি নেই।
তৌফিক ওয়াহিদের কাশি উঠে গেছে। দোয়া তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলো তাকে। ব্যস্তভাবে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। তৌফিক ওয়াহিদ বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এইসব কথা বলে ওই বাধ্য করছে ওনাকে প্রেশার নিতে,আবার ওই ব্যস্ত হয়ে পরছে। কাশি থামলে দোয়া আলতোভাবে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছিয়ে দিতে যাচ্ছিলো তৌফিক ওয়াহিদের। উনি তৎক্ষনাৎ পিছিয়ে গেলেন। দোয়া মুচকি হেসে বললো,
-বউমা হতে আসিনি বাবা। মা হতে এসেছি। শুনেছি মায়ের চেয়ে বেশি নাকি ছেলেকে আর কেউ বোঝে না। আর আপনার ছেলে বলেছে,আপনাকে বোঝার কেউই নেই নাকি। একটু অনুমতি দিন না বাবা? আমিও দেখি,বুঝতে পারি কিনা আপনাকে। হতে পারি কিনা আপনার..মা।
আরেকদফায় চুপ হয়ে গেলেন তৌফিক ওয়াহিদ। দোয়া শাড়ির আঁচলেই মুখ মুছিয়ে দিলো তার। এবার আর বাধা দেয়নি সে। দোয়া আর কোনো কথা না বলে খাবারের ট্রে নিয়ে বেরিয়ে আসলো ও ঘর থেকে।
•
দুপুরের খাবারটা খেয়ে হাটতে হাটতে মুখার্জীবাড়ির পেছনের পুকুরের দিকে আসলো তন্নি। তৃষা টিউশনির জন্য বেরিয়ে গেছে। ওর স্টুডেন্ট নানুবাড়ি বেরাতে গেছে বলে ছুটি নিয়েছে। দিয়ানকে ঘুমোতে দেখে কিছুক্ষন ওউ চেষ্টা করেছিলো ঘুমোনোর,অভ্যেস নেই বলে ঘুম আসেনি। মনটাও ভালো নেই। দোয়া চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়িতে এক অপুরনীয় শুন্যতা জেকে বসেছে। সালমা বেগমকে কিছুটা ভুলিয়ে রাখতে সবাই যতোটুকো স্বাভাবিক ব্যবহার করা সম্ভব,করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দোয়ার অনুপস্থিতি সবাইকেই খুটিয়ে বেরায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্নি পাড়বাধানো ঘাটের সিড়িতে পানিতে পা ভিজিয়ে বসলো। একধ্যানে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ পুকুরে কোনো পদ্ম নেই। স্থির পানিতে ওর নিজেরও বিষন্ন প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এইতো কিছুদিন আগে,কতোটা উচ্ছ্বল ছিলো ও,তৃষা,দোয়া। সেদিন ছাদ থেকে দেখেছিলো,পদ্মভর্তি এই পুকুরেই দোয়া বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝাপ দিয়েছিলো। প্রথমবারের মতো মুখার্জীবাড়িতে বৃষ্টিবিলাস করেছিলো দোয়া। আর সেটা আরাবের সাথে দেখা হওয়ার পর। আরাবকে ভালোবাসার পর। ভালোবাসা নিয়ে সুক্ষ্ম ধারনা না থাকা সত্ত্বেও মৃদ্যু হেসে মনেমনে আওড়ালো,ভালোবাসা সুন্দর। পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
-ইচ্ছে করে পানিতে পা ডুবিয়ে,সব মাছ ভাগিয়ে দেওয়ার ধান্দায় বসেছো রাইট?
কপাল কুচকে পেছনে তাকালো তন্নি। বড়শি হাতে স্বস্তিক ঠিক ওর পেছনেই দাড়িয়ে। পানি থেকে পা তুলে পেছন ফিরে দাড়ালো ও। স্বস্তিক এমনিতেও লম্বা,তার উপর তন্নির চেয়ে এক সিড়ি উপরে দাড়িয়ে। মাথা উচু করে তাকিয়ে তন্নি বললো,
-একদম ফালতু বকবেন না! ইচ্ছে করে পা ডুবিয়ে বসা মানে? মাছ ভাগিয়ে দেওয়ার ধান্দা মানে?
স্বস্তিক ওকে পাশ কাটিয়ে দু সিড়ি নিচে নামলো। ওখানে ঠেকানো বড়শি পানি থেকে তুলে তন্নির সামনে ধরে বললো,
-সি! একটাও মাছ পরেনি!
কিছুটা দমে গেলো তন্নি। ও খেয়ালই করে নি ওখানে বড়শি দেওয়া ছিলো। বেশ দামী বড়শি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আরো একটা হাতে! বিদেশীবাবুর মাছ ধরার শখ বেশিই,টের পেলো ও। দোষ ঢাকতে বললো,
-এক ছিপে একটা ছেড়ে কয়টা মাছ ধরে?
-তোমার এই পা ভিজিয়ে বসার জন্য একটাও ধরেনি!
কথাটা বলে স্বস্তিক বড়শিতে দানা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো তন্নি। এই বিলেতি কদু ওকে কথা শুনিয়ে জিতে যাবে,তা কি করে হয়? সিড়ির পাশেই দুটো ছোটছোট কচুগাছ। একটু বাকা হেসে তা থেকে একটা কচুপাতা ছিড়ে সিড়িতে রেখে উঠে আসলো তন্নি। স্বস্তিক বড়শি ঠিক করে সবে নিচের সিড়িতে পা রেখেছে,কচুপাতায় পা পরতেই পিছলিয়ে সোজা পুকুরে পরেছে ও। আড়াল থেকে পুরোটা দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে মুখ চেপে ধরলো তন্নি। স্বস্তিককে শায়েস্তা করতে পেরে বিশ্বজয়ের এক হাসি দিয়ে চলে আসছিলো ওখান থেকে। স্বস্তিক পানিতে হাতপা ছুড়তে ছুড়তে বলে উঠলো,
-হেল্প! আই কান্ট সুইম! ক্ কেউ আছো? বাচাও!
তন্নির পা থেমে গেলো। আস্তেধীরে পেছন ফিরলো ও। স্বস্তিক প্রানপণ চেষ্টা করছে ওঠার,তবুও ভারসাম্য রাখতে পারছে না। বিদেশী থেকেছে এতোদিন,সাতার না জানা অস্বাভাবিক কিছু না। সাতার না জানলে তো মরে যাবে মানুষটা! কিন্তু তন্নি তো ঠান্ডা পানিতে চুবাবে বলেই…স্বস্তিক আবারো চেচিয়ে উঠলো,
-কেউ বাচাও! আমি সাতার জানিনা! হেল্প!
একমুহুর্ত দেরি করেনি তন্নি। ছুট লাগিয়ে এগিয়ে গেলো পুকুরপারে। স্বস্তিক ডুবে যাচ্ছে,আবার কোনোমতে মাথা তুলে শ্বাস নিচ্ছে। দিশেহারার মতো আশেপাশে ওকে বাচানোর মতো কিছু খুজলো তন্নি। পায়নি। ফাকা মাথায় গলায় থাকা ওড়নাটা ছুড়ে মারলো পানিতে। চেচিয়ে বললো,
-এটা ধরুন! আমি টেনে আনছি! শক্তকরে ধরুন এটা!
স্বস্তিক অসাড় হয়ে আসছে ক্রমশ। ওর কথা কানে গেলেও,বোঝেনি কিছুই। ঠান্ডা পানিতে আরো জমে যাচ্ছে যেনো। ঝাপসা চোখে লাল ওড়নাটাকে বাচার সম্বল ভেবে একহাতে পেচিয়ে ধরলো ও। কোনোমতে টেনে ওকে সিড়ি অবদি আনলো তন্নি। কিনাড়ায় এসে সিড়িতেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলো স্বস্তিক। তন্নি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। স্বস্তিককে ঝাকিয়ে সরি বললো দুবার। চোখ না মেলে স্বস্তিক হাতের মুঠোয় থাকা ওড়নাটা তন্নির গলায় জরিয়ে দিয়ে বললো,
-নিজের আত্মসম্মানের পরোয়া না করে আমার মতো ভিনদেশী,ভিনধর্মী কাউকে না বাচালেও পারতে।
স্তব্ধ হয়ে গেলো তন্নির চারপাশ। দুহাত নিজের বুকে গুজে ছুট লাগালো ও। পায়ের আওয়াজ শুনে স্বস্তিক বুঝলো ও চলে গেছে। চোখ মেলে আস্তেধীরে উঠে বসলো স্বস্তিক। দুবার কাশি দিয়ে,ভেজা চুলগুলো উল্টালো স্বস্তিক। পেছনে হাত রেখে,আকাশের দিকে মুখ উচু করলো। তারপর চোখ বন্ধ করে ভেজা শরীরেই বসে রইলো ওভাবে।
•
দোয়া টুইঙ্কেলকে নিয়ে ব্যালকনির ফুলগুলো দেখাচ্ছে আর বাংলা,ইংরেজীতে ওগুলোর নাম শেখাচ্ছে। টুইঙ্কেল মজায় মজায় শিখছে ওগুলো,খুশিতে হাততালি দিচ্ছে। ফোন স্ক্রল করতে করতে ঘরে ঢুকলো আরাব। ওর চোখ গেলো সোজা বারান্দায়। দোয়া আর টুইঙ্কেলের হাসিতে। ব্যালকনিতে আজ যেনো ফুলের মেলা বসেছে। হলুদ রঙের জামা পরা টুইঙ্কেলকে দেখে সুর্যমুখী ফুলের মতোই দেখাচ্ছে। আরাব চোখ আটকালো দোয়ার পেছনের অবয়বের দিকে। কোমড় অবদি ছাড়া কোকড়া চুল,হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি গায়ে,পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে লাগছে দোয়ার গায়ে,এটুকো দেখেই আরাবের মনপ্রান জুরে স্নিগ্ধতা। আজ বুঝি বসন্ত! ওর ব্যালকনিতে থাকা ফুলেরা শীতের জীর্নতাকে থামিয়ে দিয়ে,বসন্তের রঙ বইয়ে দিচ্ছে। টুইঙ্কেল আরাবকে দেখে দৌড়ে এসে ওর আঙুল ধরে ব্যালকনির দিকে এগোতে এগোতে বললো,
-দেখো মামা! উইশমাম সবগুলোর নাম শিখিয়ে দিয়েছে আমাকে!
আরাব একধ্যানে দোয়ার দিকেই তাকিয়ে হাটছে। ওর চাওনি দেখে কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো দোয়া। টুইঙ্কেল আরাবকে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে থামলো। ফু দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে লাগলো,
-দেখো মামা! এইটা রোজ! এইটা বেলি! এইটা…
টুইঙ্কেল বলেই চলেছে। কিন্তু কানে যায়নি আরাবের। ও তখনও দোয়ার দিকেই তাকিয়ে। দোয়া রেলিং ধরে গেইটের কাছের কাঠগোলাপ গাছটা দেখছে। ওর চুলের কাছ দিয়েই কাঠগোলাপ দেখা যায়। আরাবের মনে হচ্ছিলো,ফুলগুলো যেনো দোয়ার খোলা চুলেই সাজবে বলে ফুটেছে। হঠাৎই টুইঙ্কেলকে ডাক লাগালো মিসেস ওয়াহিদ। দোয়া আরাবের দিকে ফিরলো। ধ্যান ভাঙলো আরাবের। টুইঙ্কেল গাল ফুলিয়ে বললো,
-দেখেছো মামা! একদন্ডও শান্তি নেই!
দোয়া হেসে দিলো। বললো,
-চলো যাই টুইঙ্কেল। নানুমনি কেনো ডাকছে শুনে আসি।
দোয়া টুইঙ্কেলকে নিয়েই হাটা লাগাচ্ছিলো।আরাব বাধা দিতে যাচ্ছিলো দোয়াকে। কিন্তু টুইঙ্কেলই নিজে থেকে থেমে গিয়ে বললো,
-না না উইশমাম! তুমি গেলে নানুমনি আরো আড্ডা জুড়বে! তখন আর আমরা তিনজনে ফ্লাওয়ার্স দেখতে পারবো না! নানুমনির পুরোনো কাহিনী শুনতে হবে! তুমি এখানেই থাকো,আমি একদৌড়ে যাবো,একদৌড়ে আসবো! টাটা!
দোয়ার হাত ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো টুইঙ্কেল। আরাব মুচকি হেসে এগিয়ে দোয়ার দু গালে হাত রাখলো। বললো,
-আজ আমার ঘর,আমার ব্যালকনি ফুলে ফুলে সেজেছে। আমার জন্য! এন্ড ইউ নো হোয়াট দোয়া? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর,সবচেয়ে স্নিগ্ধ,সবচেয়ে আদুরে ফুল এখন আমার দুহাতের মাঝে। যাকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে,বারবার মোহিত হয়ে হারাতে ইচ্ছে করে,বারবার…আদর করতে ইচ্ছে করে।
দোয়া মাথা নামিয়ে নিলো। বলা শেষ করে অতি সন্তর্পনে দোয়ার ঠোটে ঠোট ছোয়ালো আরাব। চোখ বন্ধ করে ওর টিশার্ট খামচে রইলো দোয়া। ওর কাপতে থাকা চোখের দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাব। ইজিচেয়ারে রাখা আরাবের ফোনে ম্যাসেজের শব্দে সেদিকে তাকালো দোয়া। একপলক সেদিকে তাকালো আরাবও। হাসি প্রসারিত হলো আরাবের চেহারায়। দোয়াকে আবারো নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
-তোমার রিসেপশনে দিয়ান আসবে দোয়া। এক নতুন দিয়ান! সম্পুর্ন সুস্থ্য দিয়ান। এজন্যই রিসেপশন ডিলে করিয়েছি। কাল দিয়ানের অপারেশন দোয়া। এটা তারই কনফার্মেশন ম্যাসেজ।
দোয়ার চোখ ভরে উঠলো নিমিষেই। এই মানুষটাকে ওর আগে থেকে কিছুই বলার প্রয়োজন হয়না। এমনকি ওর কি প্রয়োজন,সেটা ওরও উপলব্ধির প্রয়োজন হয়না। প্রতিবার ওর উপলব্ধির আগেই তা বুঝে,ওকে সেই চাওয়ায় ভরিয়ে দেয় আরাব। নিজের উপর নিজেরই হিংসা লাগছিলো ওর। খুশিতে দিশেহারা লাগছে। আরাব বুঝলো,ওই চোখে অশ্রু ঝরতে শুরু করবে এখনই। হোক তা আনন্দঅশ্রু! দোয়ার চোখের জল বেরিয়ে আসার আগেই ওর দু চোখে চুমো একে দিয়ে সে অশ্রুকে থামিয়ে দিলো ও।
#চলবে…
❤ ]