#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৩
#সুরাইয়া_নাজিফা
শান ভাইয়া রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে আছে আর আমি ওনার সামনে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আর শাড়ীর আঁচল নিয়ে মুছড়া মুছড়ি করছি। ইতিমধ্যে আমার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। কিছু বলছেও না করছেও না।যেমন ঝড় আসার আগে পরিবেশ গুমোট থাকে তেমনটা।কিছু বললে হয়তো আন্দাজ করতে পারতাম কতটুকু শুনেছে।বাট সে তো রেগেই বোম হয়ে আছে।
শান ভাইয়া গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আমাকে দেখলে তোমার পাগল মনে হয়?”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে তুতলিয়ে বললাম,
“না ম মানে ওই।”
“ফোনটা দেও।”
আচমকা কথাটা শুনে ভয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,
“হ্যাঁ।”
“কি হ্যাঁ হ্যাঁ করছো? ফোনটা দেও।”
কথাটা শুনেই আমার মুখ চুপসে গেল। ফোন দিলে যদি ধরা খেয়ে যাই।না দেওয়া যাবে না। তাই অনেকটা সাহস জুগিয়েই কাঁপা কন্ঠে বললাম,
“আমার ফোন আপনাকে কেন দিবো?”
“আমি বলেছি তাই।”
“আপনি বললেই তো আর আপনার সব কথা শুনতে পারব না। ”
“তুমি দিবে কি না ? ”
“না।”
কথাটা বলতে না বলতে শান ভাইয়া আমার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে এক আছাড়ে দুই টুকরা করে ফেললো। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি রিয়েকশন দেওয়াটাই ভুলে গেছি। শুধু মনে হলো চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এই ফোনটা আমার অনেক প্রিয় ছিল। আমার এইচ. এস.সি পরিক্ষার পর আপু আমাকে গিফট করেছিল। আমি রেগে বললাম,
“এটা কি করলেন আপনি?আমার ফোনটা ভেঙে ফেললেন? আপনি জানেন ফোনটা আমার জন্য কি ছিল?”
“সোজা কথা শুনলে এমনটা হতোই না। তোমার জিনিস নষ্ট হওয়ার জন্য তুমিই দায়ি।”
“আপনি আসলেই একটা হার্টলেস মানুষ। কারো প্রিয় জিনিস হারালে কেমন লাগে সেটা আপনি কি করে জানবেন। আপনার তো আর কোনো প্রিয় কিছু হারায়নি।”
“কারো চোখের সামনেই যদি তার প্রিয় জিনিসটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে তাহলে কতটা কষ্ট হয় সেটা আমার থেকে বেশী কেউ জানেই না। ”
শান ভাইয়ার কথাটা শুনে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল কি হয়েছে উনার?হঠাৎ এমন ব্যবহার কেন করছে?শান ভাইয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এখন আর ওনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না।ফোনটার জন্য কষ্ট হচ্ছে।তাই আমি যাওয়ার জন্য শান ভাইয়ার পাশ কেঁটে যেই না এক পা বাড়িয়েছি অমনি শান ভাইয়া বলে উঠল,
“তাহলে কবে যাচ্ছো?”
আমি পিছনে এসে অবাক হয়ে বললাম,
“কোথায়?”
“কোথায় আবার তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে?এইমাত্রই তো বললে তুমি আমার সাথে থাকতে চাও না।”
শান ভাইয়ার কথা শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।যাক তাহলে কিছু শুনেনি।শুধু শেষের কথা শুনে ভেবেছে বফের সাথে কথা বলছি আর তাতেই এতো রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন?মাথা গরম থাকায় ত্যাড়া ভাবেই বললাম,
“হুম বলছিলাম তো?”
“তো এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বলার কি আছে। তুমি যখন যাবে তখন আমাকে বলে দিও। আমি নিজ দাঁয়িত্বে তোমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে দিয়ে আসব। যতোসব। ”
কথাটা বলেই উনি হনহনিয়ে চলে গেল। ওনার মতো অদ্ভুত মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। নিজের বউকে নাকি অন্যকারো হাতে তুলল দিবে। সাধে কি আর খচ্চর বলি। আমার ফোনটাও ভেঙে দিছে। হঠাৎ নিজের কথা নিজের মাথায় আসতেই থতমত খেয়ে গেলাম বউ? তাহলে কি এই বিয়েটা আমি মেনে নিলাম?উফ নো এবার আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো এই পাগলের সাথে থাকতে থাকতে।
★
★
★
সব নাস্তা প্রায় হয়ে গেছে কিছু বাকি আছে। শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে ভূমিকা ভাবী আর কমলাও হাতে হতে সব কাজ করে ফেলছে। আমাকে কিছু ধরতেও দিচ্ছে না। তাই আমিও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বসে তাদের কাজ করা দেখছি। কিন্তু কতক্ষণ ভালো লাগে চুপচাপ বসতে। ফোনটাও নেই যে একটু গেমস খেলবো। তাই আমি শ্বাশুড়ী মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,
“চা গুলো দিয়ে আসি আমি?”
“পারবি দিয়ে আসতে?”
“পারব।”
“ওকে সোনা দিয়ে আয় তাহলে একটু হেল্প হয়।সকাল থেকে কাউকে কিছু দেওয়া হয়নি এখনো।”
শ্বাশুড়ী মায়ের কথা অনুযায়ী আমিও ট্রেটা হাতে নিলাম। কিন্তু এতো গুলো চায়ের মাঝে দুটো কফি দেখে একটু অবাক হলাম।
“এই কফিটা কাকে দিবো?”
” সাম্য আর শানকে। ওরা চা খায় না। বাম সাইডের কফিটা শানকে দিস। ও চিনি বেশী খায় না। ”
“হুম।”
চিনি কেন খাবে? চিনি খেলে তো আর এই তিতা কফির মতো তিতা তিতা কথা গুলো আমাকে বলতে পারত না। কফিখোর একটা। নিজের মনে কথা গুলো বলেই নিজের কাজে চলে গেলাম।
একে একে সবাইকে চা গুলো দিয়ে দিলাম। তারপর শান ভাইয়ার বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর মশাই বিছানায় আধশোয়া হয়ে কপালে একহাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি গিয়ে দরজায় নক করতেই উনি উঠে চশমাটা পড়ে বললেন,
“আরে সোহা মা এতো ফর্মালিটির দরকার নেই। তুই তো এইবাড়ির মেয়েই। আয় না ভিতরে আয়। ”
আমি ধির পায়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর বললাম,
“আঙ্কেল আপনার চা। ”
উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে চা টা নিয়ে নিলেন তারপর বললেন,
“এই বাড়িটাকে কেমন লাগছে?”
“ভালোই।”
“আর মানুষ গুলাকে। ”
আমি চোখে মুখে খুশি নিয়ে বললাম,
“অনেক ভালো।”
“আমার কিন্তু মনে হয় না।”
শ্বশুর মশাইয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
“না আঙ্কেল তেমন নয়। আপনারা সবাই সত্যিই অনেক ভালো।”
“তাই। যদি আমাদের সত্যি ভালো লাগতো তাহলে আঙ্কেল বলতি না বাবা বলতি। ”
আমি অস্ফুট সুরে বললাম,
“বাবা?”
“হ্যাঁ এখন থেকে বাবা বলবি।আর তোর যা লাগবে সব আমাকে বলবি। কখনো বাসার কথা মনে করে কষ্ট পাবিনা। আজ থেকে আমরাই তোর বাবা মা। কি মানতে পারবি তো? ”
বাবার কথা শুনে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। এমন মনে হচ্ছে যেন আমি এই বাড়ির বউ না মেয়ে।এমন একটা শ্বশুরবাড়ী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর ইশারায় বললেন না কাঁদতে।হঠাৎ উনি আবার বললেন,
“আমি জানি তুই আমাদের সবার উপর রেগে আছিস এভাবে বিয়েটা হওয়ায়।তুই ভাবছিস হয়তো আরশ পালিয়ে গেছে বলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে তোকে শানের বউ করে আনলাম। আসলে এটা সম্পূর্ন ভুল। তোকে আর স্মৃতি দুজনকেই আমার খুব পছন্দ ছিলো শান আর আরশের জন্য। তোকে যখন আমি প্রথমে দেখি তখনি এটা ভেবে নি যে তোকে এই বাড়ির বউ করে আনব।কিন্তু হঠাৎ স্মৃতি যে এমন কাজ করে বসবে ভাবতেই পারিনি। তবে আমি তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তুই সত্যিকারের হীরাটাই পেয়েছিস। শান সবসময় তোকে আগলে রাখবে।দেখিস তুই অনেক সুখী হবি শানের সাথে। ”
ওনার কথা শুনে কি বলবো জানি না। তবে এখন রিয়েলাইজ হচ্ছে আরশ ভাই আর আপু ভুল করেছে। শুধু শুধু এতোগুলো ভালো মানুষ আমাদের কারণে ছোট হলো সবার সামনে। ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে বললাম,
“হুম।”
“তুই কি এখন ফ্রী আছিস। তাহলে বাবা মেয়েতে বসে কিছুক্ষন আড্ডা দেওয়া যেতো।”
“স্যরি বাবা। এখনো বড় ভাইয়াকে কফি দেওয়া বাকি তাই বসতে পারছি না তবে আমি কিছুক্ষন পর অবশ্যই আসবো তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবো। ”
আমি অনেক খুশি হয়ে বললাম। বাবাও হেসে বললো,
“ওকে বেটা আমি অপেক্ষা করব। ”
তারপর আমি বড় ভাইয়ার রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম ভাইয়া পুষ্পের পাশে আধশোয়া হয়ে খবর পড়ছে। দরজায় নক করতেই ভাইয়া উঠে বসলেন,
“গুড মর্নিং ভাইয়া।”
“গুড মর্নিং। কিন্তু তুমি কেন? সকাল সকালই কাজে লাগিয়ে দিলো নাকি?
“না না। কেউ তো কিছু করতেই দেয় না। আমিই ভাবলাম চা গুলো সবাইকে দিয়ে একটু তাদের হেল্প করে দি।”
“হুম। ”
আমি ভাইয়াকে কফিটা দিয়ে দিলাম।
“পুষ্প ঘুমাচ্ছে এখনো?”
“হুম কালকে তো বিয়ে বাড়ির ঝামেলায় কারো ঘুমই হলো না।”
আমি গিয়ে পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। একদমই ছোট্ট একটা মেয়ে। সবসময় আমাকে” মিষ্টি মিষ্টি “বলে অস্থির করে রাখে। এই বাড়ির মধ্যে যদি কারো সাথে আমার ভাব সবথেকে বেশী হয় তাহলে সেটা পুষ্প। ওর মিষ্টি মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলো শুনলেই মন জুড়িয়ে যায়। কিছুক্ষন পুষ্পের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম জমরাজের ঘরে যাবো বলে।
★
★
★
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ভিতরে যাবো কি যাবো না সেটাই ভাবছি। তখন যে রাগ দেখালো। এখন না ঘর থেকেই বের করে দেয়। দিলে দিবে এত কেন ভাবছি। দূর কি ভবছিস সোহা কিছুই হবে না। তুই শুধু যাবি কফিটা দিবি আর বেরিয়ে আসবি শেষ। যেই বাবা সেই কাজ। আর আগে পিছে না ভেবে চলে গেলাম ভিতরে। ভিতরে গিয়েই মাথার মেজাজটা গরম হয়ে গেল।আমি দ্রুত পায়ে শান ভাইয়ার কাছে এসে বললাম,
“এটা কি করছেন আপনি? আমার জামা-কাপড় গুলো ফেলছেন কেন? ”
“আমার আলমারিতে কাকে বলে জামা-কাপড় রেখেছো?”
“এখানে বলতে হবে কেন?ঘরে আপনার আলমারি ছাড়া তো আর কোনো আলমারি নেই যে সেখানে রাখব।এখানে না রেখে আর কই রাখব। ”
“সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার আলমারিতে তোমার কোনো কিছুর জায়গা হবে না। পারলে তোমাকে আমার ঘর আর লাইফ দুইজায়গা থেকেই বের করে দিতাম বাট আফসোস আমার হাত বাঁধা। ”
উনার কথাটা শুনে চোখ থেকে আপনাতেই পানি পড়তে লাগল। কতটা সহজে কথা গুলো বলে দিলো। একবারও ভাবল না আমার দিকটা।কি এমন ক্ষতি করেছি ওনার কেন এমন বিহেভ করছে?
“এই আমার সামনে একদম ন্যাকা কান্না করবে না।একদম চুপ।”
উনার ধমক শুনেই আমি পুরো সোজা হয়ে গেলাম। নিজের চোখের পানি মুছে অভিমানি কন্ঠে বললাম,
“ওকে আমার যেই ফোনটা ভেঙেছেন ফেরত দিন আমি চলে যাচ্ছি। ”
আমার কথা শুনে শানের মুখটা হা হয়ে গেল,
“এখানে তোমার বিবাহিত জীবন খাঁদে ঝুলছে আর তুমি আছো ফোন নিয়ে?আসলেই একটা স্টুপিড তুমি। ধ্যাত বোঁকা বললেও বোঁকার অপমান হবে।”
“ভালো হইছে আমি এমনই। ”
উনাকে মুখ ভেঙালাম। শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হয়তো উনি আমার এমন উত্তর আশা করেনি।
কিছুক্ষন চুপ থেকে উনি আবার বললেন,
“তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় গুলো সরিয়ে রুম খালি করো। কুইক। ”
এবার মাথাটা এতো গরম হচ্ছে বলার বাহিরে। ইচ্ছা হচ্ছে বলি,
“যে জামা-কাপড় গুলো সরিয়ে কি তোর মাথার উপরে রাখব। ”
কিন্তু মুখে বললাম,
“এগুলো সরিয়ে কই রাখব। ”
উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“কেন যার সাথে দুদিন পর যাবে তাকেই বলোনা তোমাকে একটা আলমারি বানিয়ে দেয় যেখানে তুমি তোমার জিনিসপত্র রাখতে পারো। ”
কথাটা বলেই উনি হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি উনার কথা শুনে হা হয়ে রইলাম।
“আরে এখন আমি বয়ফ্রেন্ড পাবো কোথায়? কেন যে কাল বলেছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। এইবার বুঝ মজা। এখন তো মনে হচ্ছে একটা আলমারির জন্য হলেও বয়ফ্রেন্ড বানাতে হবে।”
★
★
★
জামা-কাপড় গুলো গুছাতে গুছাতে প্রায় অনেকটাই লেইট হয়ে গেছে। এর মধ্যে দু’বার কমলা এসে ডেকে গেছে। উফ নির্ঘাত সবাই বকবে আমায়। সব হয়েছে শান ভাইয়ার জন্য। ফাজিল একটা তোর জীবনেও ভালো হবেনা। উল্লুকটা আমার গোছানো কাজ অগোছালো না করলে এমনটা হতোই না।
নিচে আসতে না আসতেই ফুফু শ্বাশুড়ী বলে উঠলেন,
“কি ব্যাপার প্রথম দিনই এতো লেইট তোমার। এতবার কেন ডাকতে যেতে হয়। তোমাকে কি বলা হয়নি সবাই এখন খাবে।”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। শ্বশুর মশাই বললেন,
“আহ!রেশমা এভাবে বলছিস কেন?আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। ”
তখনি শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“শান কই সোহা।নিচে এলো না ঘরে আছে কি?”
“শান ভাইয়া আসেনি এখনও সেই কখন তো নিচে আসার জন্য বেরোলো। ”
আমার কথা শুনে সবাই বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে।কি রে বাবা এমনকি বলে দিলাম যে সবাই আমার দিকে এই লুক দিচ্ছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
“কি হয়েছে?”
তখনি সবাই হেসে দিলো। আমি কিছুই বুঝলাম না। সানিয়া হাসতে হাসতে বললো,
“তুমি এখনো শান ভাইয়াকে ভাইয়া বলে ডাকো।ওহ মাই গড।”
বলে আবারও হাসতে থাকল। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“ঐ আগের অভ্যাস তো তাই। ”
ফুফু শ্বাশুড়ী বাজ খাই গলায় বললো,
“কি দিনকাল আসলো বাবা জামাইরে নাকি কেউ ভাই ডাকে। এতো বড় মেয়ে কোনো কান্ড-জ্ঞান নাই। কালে কালে আর কত কি যে দেখব। ”
ওনার কথা শুনে বিরক্ত লাগল। এই মহিলাটার সমস্যাটা কি বুঝি না সেই সকাল থেকে একটার পর একটা ফোঁড়ন কেটেই যাচ্ছে।
শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে এরপর থেকে আর বলো না লোকে খারাপ বলবে কেমন? ”
আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালাম। আমি নিজের ব্যবহার দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি আমি কখনোই এতো বাধ্য মেয়ে ছিলাম না। আর এখন সেই আমিই কিনা যে যা বলছে মুখ বুঝে শুনছি।
কিছুক্ষন পর শান ভাইয়া চলে এলো।
বাবা বললো,
“কিরে কই ছিলি তুই?”
“ওই তো পুল সাইডে। ”
তারপর সবাইকে নাস্তা সার্ভ করে দিলাম। বাবা বললো,
“সোহা তুইও বসে যা। ”
“না আপনারা খেয়ে নিন আমি পরে বসব।”
“আরে বস না। তোকে কিছুক্ষন আগে কি বললাম ভুলে গেছিস?”
শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“থাক ওকে জোড় করো না। ওর হাত কেঁটে গেছে তাই খেতে পারবে না। ”
“সে কি কিভাবে কাঁটলো?”
“ওয়াসরুমে পড়ে গেছিলাম। ”
কথাটা বলতেই শান ভাইয়া বিষম খেলো। ওনাকে আমি পানি এগিয়ে দিলাম। উনি খাওয়া ছেড়ে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। উনি হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন আমি সত্যিটা বলে দিবো। কারণ আমার জন্য এমন পরিস্থিতিতে উনি অনেকবারই পড়েছে।
বছর খানিক আগে শান ভাইয়ারা স্ব-পরিবার মিলে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। আসলে আঙ্কেল আর আব্বু খুব ভালো বন্ধু ছিল এখনও আছে। তাই সুযোগ পেলেই চলে আসত। নাহয় আমরা যেতাম। কারণ সারা বছর কাজের চাপে তো সম্ভব হতো না । শান ভাইয়ার সাথে কখনো আমার ঝগড়া ছাড়া ভালো ভাবে কথাই হতো না। কারণ ওনার এই ত্যাড়া কথা গুলো পছন্দ ছিল না। তখন আমার এইচ.এস.সি সামনে ছিল। কিন্তু কিছুদিন অসুস্থতার কারণে আমি পড়া পিছিয়ে পড়েছিলাম।তাই নোট আনতে গিয়েছিলাম সোহেল নামের একটা ফ্রেন্ডের কাছে।নোটটা নিয়ে আসব তখনই সোহেল বললো ও যে মেয়েটাকে ভালোবাসত সে ওকে ছেড়ে চলে গেছে তাই ওকে শান্তনা দিচ্ছিলাম তখনই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল,
“ওহ আজকাল নোট আনার নাম করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রেম করা হচ্ছে জানতাম না তো।”
শান ভাইয়াকে দেখে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম,
“আপনি? আপনি এখানে কি করছেন?”
“কেন ডিস্টার্ব করলাম নাকি?ভাগ্যিস এসেছিলাম।”
“মাথার স্ক্রু তো আগেই ডিলা ছিল এখন কি বাকি গুলোও খুলে গেছে নাকি কি? কি বলছেন?আমি তো কিছুই বুঝতেছি না?”
“বুঝতে হবে না। নেক্সট টাইম তোমাকে যেন কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে না দেখি মনে থাকে যেন? ”
“আপনি বললেই হলো। আমার ফ্রেন্ডদের সাথে আমি একশত বার কথা বলব আপনার কি তাতে?”
“তোমাকে বলতে ইচ্ছুক নই। তবে কথার নড়চড় যেন না হয়।নিজের ভাই ছাড়া বাকি সব ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ।”
“আপনার কথা আমি শুনব কেন?”
“মুখে মুখে তর্ক করলে একটা থাপ্পড় মারব যে পরে আর কথাই বের হবে না মুখ থেকে।এখনি যাও বাসায়। ”
উনার কথা শুনে প্রচুর রাগ হলো।কত বড় সাহস আমাকে ধমক দেয়। বাসায় এসে আমি কান্না করে করে সবাইকে বললাম,
“শান ভাইয়া রাস্তায় সবার সামনে আমাকে থাপ্পড় মারছে।”
আমার কথা শুনে শান ভাইয়া নিজেও অবাক।কারণ উনি শুধু বলেছে।আমি এমনি ছিলাম। উনি আমাকে যা বলতো বা যা করত আমি তার থেকে এক দুই লাইন সবসময় বাড়িয়েই বলতাম। এরপর আর কি শান ভাইয়ার আব্বু ওনাকে অনেক বকা দিলো।উনাকে বকা খেতে দেখে আমি মজা নিচ্ছিলাম।
কথা গুলো মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।এতোটা বাঁদর ছিলাম। তাই হয়তো এখন এতোটা ভালো মানুষি আমার থেকে নিতে পারেনি। হঠাৎ বাবার কথা শুনে অতিত থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম,
“শান তাড়াতাড়ি নিজে খেয়ে সোহাকেও খাইয়ে দিস।”
“আমি পারব না। যার খাওয়া সে খাবে।”
শান ভাইয়ার কথা শুনে শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“এটা কেমন কথা শান দেখিস না মেয়েটার হাত কেঁটে গেছে কেমনে খাবে?”
“না পারলে না খেয়ে থাকবে আমার এতো ঠেকা পড়ে নাই কাউকে খাওয়ানোর। ”
কথাটা বলেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবার সামনে মানুষ এমন ব্যবহার কেমনে করতে পারে একটুও খারাপ লাগলো না তার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শ্বাশুড়ী মা বললেন,
“হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে তোর উপর রেগে আছে। মন খারাপ করিস না। শান কিন্তু মোটেও এমন না। রাগ পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে রাখবি যে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে সেই বেশী অভিমান করে। যা গিয়ে ওর অভিমান ভাঙ্গা। ”
“হুম।”
ভালোবাসা না ছাই।এখন হয়তো আর সহ্য হচ্ছে না আমাকে। আমার সাথে এই ব্যবহার এইজন্য করছে যেন আমাকে তাড়িয়ে ঐ শাকচুন্নিকে তাড়াতাড়ি ঘরে তুলতে পারে। আমিও এতো সহজে ছাড়ব না। একবার সুযোগ পাই সব সুদে আসলে উসুল না করেছি তো আমার নামও সোহা না ।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
.#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪
#সুরাইয়া_নাজিফা
“আমার কাছে আসো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
শান ভাইয়া এসে আমার পাশে বসল। আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এখন আসছে দরদ দেখাতে। একটু আগে শ্বাশুড়ী মা যখন বললো তখন কি ক্ষতি হতো খাইয়ে দিলে। আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,
“লাগবে না কারো হেল্প। ”
শান ভাইয়া কিছু না বলে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইল। আমিও আমার খাওয়ায় মন দিলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কাঁটা হাত দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। এবার চামচ দিয়ে গুঁতাগুঁতি করতে থাকলাম। কিন্তু বাম হাত দিয়ে কতটাই বা পারা যায়। কালকে রাতে অতটা বুঝতে পারিনি তবে হাতটা বেশ কয়েক জায়গায় অনেকটাই কেঁটে গেছে। শ্বাশুড়ী মা, ভূমিকা ভাবী, বাবা বেশ কয়েকবার চেয়েছিল খাইয়ে দিতে। কিন্তু আমিই বারণ করেছি। ভেবেছিলাম পারব। কিন্তু এখনও একটুও মুখে দিতে পারিনি। শান ভাইয়া অনেকক্ষন ধরে আমার কান্ড-কারখানা দেখে চলেছে।উনার এভাবে তাকিয়ে থাকাতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই চামচটা হাত থেকে প্লেটে ফেলে বললাম,
“দূর খাবোই না। ”
চোখ মুখ কুচকে কথাটি বলতেই শান ভাইয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি উনার দিকে একবার তাকালাম ওনার হাসিটা দেখে আরো রাগ হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে উনি আমাকে ব্যঙ্গ করছেন। উনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিরক্ত হয়ে উনার পাশ থেকে উঠে যেতে চাইতেই শান ভাইয়া আমার হাত ধরে টান দিয়ে আবার উনার পাশে বসিয়ে দিলেন।
“এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? ”
“অসভ্যতামি তো এখনও শুরুই করিনি তবে তুমি দেখতে চাইলে করতে পারি কি দেখতে চাও? ”
শান ভাইয়া বাঁকা হেসে আমার আরো একটু কাছ ঘেঁসে বসল। উনার এমন বিহেভ দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মানে এই কিছুক্ষন আগেই তো কেমন ব্যবহার করল এর মধ্যেই আবার পাল্টি খেয়ে গেল। আমি ওনার থেকে একটু সরে গিয়ে বললাম,
“আচ্ছা আপনার কি ছোটবেলায় কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”
শান ভাইয়ার হাসি মুখ থেকে গায়েব হয়ে অবাক হয়ে বললো,
“মানে? এক্সিডেন্ট হবে কেন?”
“হতেও পারে হয়তো আপনার মনে নেই। এই যে যেমন ধরেন মাথায় কোথাও চোট ফোট পেয়েছেন এরপর থেকে একটু আগে যা করেছেন কিছুক্ষন পর সেটা ভুলে যান।”
এবার শান ভাইয়ার অবাকের মাত্রা দ্বিগুন হলো। উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি ভুলে গেছি আমি?
“কেন একটু আগেই আমার সাথে তিতা করলার মতো ব্যবহার করলেন। এখন মুখ থেকে মধু ঝরে কিভাবে?”
আমার কথা শুনে উনি কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই হো হো করে হেসে উঠল যাকে ঘর কাঁপানো হাসি বলে,
“এভাবে হাসার কি হলো? আমি হাসার মতো কি বললাম। ”
শান ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো,
“যতই ভাবি রাগ করে থাকব। কথা বলব না। বাট তোমার এই কিউট কিউট কথা গুলো কখনো হতেই দেয় না। ”
“কথা আবার কিউট কিউট হয় নাকি? ”
“হয়। এইবার হা করো সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। ”
“না খাবো না। আমি না খেলেও বা কার কি? কারো তো আর ঠেকা পড়ে নাই আমাকে খাওয়ানোর। ”
আমি কথাটা শান ভাইয়াকে খোঁচা মেরেই বললাম। কারণ তার তখনের কথাটা আমার অনেক খারাপ লেগেছে। শান ভাইয়া গালে হাত দিয়ে বললো,
“বাবা এখানে দেখছি আমার উপর একজন অভিমান করে বসে আছে।”
আমি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললাম,
“আমি কারো উপর অভিমান করিনি। ”
“জানি আমি। তা কি পেলে রাগ কমবে?”
“আমার কিছু চাই না। ”
“আচ্ছা। তাহলে আর কি করার। তবে এখন তো খাওয়াটা খেতে হবে। ”
“খাবো না আমি। ”
“কোনো না শুনতে চাইনা। দেখি হা করো। ”
“বললাম তো খা।”
পুরো কথাটা আর বলতে পারলাম না তার আগেই উনি খাবারটা আমার মুখে পুড়ে দিলেন,
“একটা কথাও সোজা ভাবে শুনতে চাও না। তোমার জন্য সবসময় বাঁকা পথটাই বাঁচতে হয়। ”
আমি উনাকে মুখ ভেঙালাম উনি হাসলেন।
“আচ্ছা আপনার সাথে আমার একটা কথা ছিল।”
“বলো? ”
“নিচে তখন সবাই আমাকে বকেছে।”
শান ভাইয়া অস্থির হয়ে বললেন,
“কে বকেছে? কেন বকেছে? কি হয়েছে বলো আমাকে? ”
“আরে আপনি এতে অস্থির হচ্ছেন কেন? বলছি তো।ঐ আপনাকে বিয়ের পরেও এখনো ভাইয়া ডাকি তাই শুনে বকেছে।”
আমার কথাটা শুনে উনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন,
“বেশ করেছে। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
” বেশ করেছে মানে? ”
“দেখো আমরা মানি আর না মানি আমাদের বিয়েটা তো হয়ে গেছে। এখন তুমি যদি সবার সামনে নিজের হাজবেন্ডকে ভাইয়া বলো তাহলে সেটা তো দৃষ্টিকটু দেখাবেই। ”
আমি হতাশ হয়ে বললাম,
“তাহলে কি ডাকব?”
“শান বলবে?আমার নামটা কি ডাকার মতো না?”
“সেটা না কিন্তু আমার শান ডাকতে কেমন জানি লাগে। ”
“কেমন লাগে। ”
“জানি না। মনে মধ্যে সুড়সুড়ি লাগে।”
শান ভাইয়া আবারও খিলখিল করে হেসে দিলেন,
“প্লিজ সোহা আর কিছু বলো না। তুমি আজকে হাসাতে হাসাতেই আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁপের জন্মে এমন কথা শুনিনি। তোমার সাথে থাকলে যে আরো কতো নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারবো আল্লাহ ভালো জানেন। ”
আমি দুইহাত দুই দিকে প্রসারিত করে বললাম,
“আরো অনেক কিছু শিখতে পারবেন যেটা আগে জানতেনই না। ”
শান ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“বাচ্চা মেয়ে। আচ্ছা তোমার যেটা ডাকতে ইচ্ছা হয় সেটা ডেকো।এইবার খাওয়াটা শেষ করো।”
উনি একমনে আমাকে খাইয়ে যাচ্ছেন।একদম বাচ্চাদের মতো যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। আমার কেমন অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল। ওনাকে চুপ থাকতে দেখে বললাম,
“আচ্ছা আপনি কি রাগ করেছেন? ”
“রাগ করার কোনো কারণ আছে কি?”
“আচ্ছা শান ডাকব হ্যাপি। ”
শান ভাইয়া অবাক হয়ে বললো,
“কি বললে শুনতে পেলাম না? ”
“নাটক করবেন না তো আপনি কি কানে কম শুনেন নাকি? ”
“ব্যাস শ্রীমতী চলে এসেছে নিজের রূপে। তোমার এই রূপটাই এতক্ষন মিস করছিলাম। ”
“তাই নাকি?
“একদম। আচ্ছা তখন মিথ্যে বললে কেন যে ওয়াসরুমে পড়ে গেছ সত্যিটা কেন বললে না। ”
“এখন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে না এখন চাইলেই তো সবাইকে সব বলা যাবে না। ”
“বাবা মেয়ে তো দেখি বড় হয়ে গেছে। ”
“তো আপনার কি মনে হয় আমি বাচ্চা? ”
আমি কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম। শান ভাইয়া একটু মুচকি হেসে বললেন,
“না কার এতো সাহস আছে তোমাকে বাচ্চা বলবে তুমি তো পাকা বুড়ি।”
আমি হেসে বললাম,
“দূর কি যে বলেন না। ”
“হুম। একটা কথা রাখবে।”
“কি?”
“কখনো চেন্জ হয়ো না। তোমাকে এরকম ভাবেই ভালো লাগে। তুমি একটু চেন্জ হলেই ভয় হয়। তাই প্লিজ।”
আমরা দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক না বলা কথা একে অপরের চোখে চোখ রেখেই যেন বলে দিচ্ছিলাম। ওনার এতো আবেগময় কথা মাঝে মাঝে আমার মনটা তোলপাড় করে দেয়। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিলো তাই চোখ সরিয়ে মাথা একবার উপর নিচ করে নাড়ালাম।
“আচ্ছা আরেকটা কথা বলি?”
“এখন আর কোনো কথা না আগে খেয়ে নেও। খাবার সময় এতো কথা বলতে হয় না। বিষম লাগবে।”
“কিছু হবে না। ”
মুখের কথা মুখে রয়ে গেল আর তখনই আমার বিষম লেগে কাঁশতে আরম্ভ করলাম। শান ভাইয়া তাড়তাড়ি পানি এগিয়ে দিয়ে মাথা আর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষন পর আমি একটু স্বাভাবিক হতেই রেগে বললেন,
“একটা কথাও যদি আমার শুনতে তুমি।কখনো মানুষ হবে না। ”
কথাটা বলেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমি হা করে রইলাম,
” যাক বাবা তাহলে এখন কি আমি মানুষ না তাহলে কি? অদ্ভুত।”
★
★
★
দুপুরে খাওয়ার পর একটু সুয়ে ছিলাম। কালকে রাতে ঘুম হয়নি তাই শোয়া মাত্রই চোখে ঘুম নেমে আসল।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরেই সব আত্মীয়-স্বজনরা চলে গেছে তাই একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারলাম। শান ভাইয়া বাড়িতে নাই। দুপুরে খেয়েই কোথায় জানি বেরিয়েছে। যদিও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি শুধু বলেছিল কাজ আছে বাট কি কাজ সেটা বলেনি। আমিও আর জিজ্ঞেস করিনি।
আমার চোখ খুলতেই চাইছে না।আমি ঘুমালে আমার মাথার পাশে বসে মা যেমন বিলি কেঁটে দিতো তেমনি অনুভব হচ্ছে।যেন কারো ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো সারা চুলে খেলে বেড়াচ্ছে। চোখ খুলতে না চাইলেও কে দেখার জন্য চোখ খুলতেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল,
“আরে আমার পুষ্প সোনা যে কখন এলে তুমি? ”
“তুমি যখন ঘুমাচ্ছিলে তখন। ”
“আমাকে ডাকোনি কেন সোনা তাহলে?”
“তোমাকে ঘুমাতে দেখে অনেক মিষ্টি লাগছিলো তাই ডাকিনি। ”
বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলাম। পুষ্পর বয়স মাত্র পাঁচ বছর। কিন্তু এখনি যেভাবে কথা বলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে কথা গুলো কোনো পিচ্ছি বলছে একদম গুছিয়ে।এতো গুছিয়ে মনে হয় আমিও কথা বলতে পারিনা। যেকোনো মানুষকে ওর কথার দ্বারাই সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারবে। আমি ওকে ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,
“পাঁচটা বাজে।”
কিন্তু তখনও শান ভাইয়া আসেনি।পুষ্প আবার বললো,
“মিষ্টি এখন থেকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে?”
“হুম এখন থেকে আমি পুষ্পের সাথে থাকব। ”
কথাটা বলতেই পুষ্প লাফিয়ে আমার কোলে উঠে আমার গালে একটা চুম্মা দিয়ে বললো,
“ইয়ে তাহলে এখন থেকে আমি সবসময় তেমার সাথে থাকব আর অনেক মজা করব। ”
পুষ্পের খুশি দেখে আমার মুখেও হাসি ফু্ঁটে উঠল।আমি পুষ্পকে বসিয়ে রেখে ফ্রেস হয়ে নিলাম। ঘরে আর থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। তাই ভাবলাম পুষ্পকে নিয়ে একটু বাগানের দিকটায় ঘুরে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ।
আমি আর পুষ্প বাগানের একটা বেন্ঞ্চে গিয়ে বসলাম। অনেক সুন্দর পরিবেশ। না আলো না অন্ধকার। মাঝে মাঝে একটা ঠান্ডা ধমকা হাওয়া দিচ্ছে আর তার সাথে নাকে এসে ঠেকছে বিভিন্ন ফুলের সুভাস। একদম মনটা শান্ত হয়ে যায় এমন পরিবেশে এলে। সব সমস্যা,চিন্তা ভুলে যাওয়া যায় এক নিমিষে। হঠাৎ পুষ্প বললো,
“মিষ্টি তুমি ঘুড়ি বানাতে পারো?”
“পারি তো কেন?”
“আমি পারিনা কিন্তু ঘুড়ি উড়াতে চাই কিন্তু মা, দাদু,দাদি মনি, শান, আরশ, বাবা কেউ পারে না। তাই আর উড়াতেও পারিনি। ”
“ওকে আমি আছি তো আমি শিখিয়ে দিবো হবে না? ”
পুষ্পের চোখে মুখে খুশি ফুঁটে উঠল,
“সত্যি?”
“একদম। ”
“কখন?”
“এখনি।”
“ইয়ে মিষ্টি ইউ আর বেষ্ট। ”
“বেষ্ট তো হতেই হবে পুষ্পের মিষ্টি বলে কথা। এখন তুমি গিয়ে কমলাকে ডেকে নিয়ে আসো বলো যে মিষ্টি ডাকছে যাও। ”
কথাটা বলতেই পুষ্প দৌঁড়ে গিয়ে কমলাকে ডেকে নিয়ে আসল। কমলা আসতেই বললো,
“আফনে আমারে ডাকছিলেন ভাবী? ”
“হুম। তুমি এক কাজ করো তো কমলা শলা, পেপার আর সুতা নিয়ে আসো তো। ”
“আফনার কি কাম করতে হইবো হেইডা কন। হেগুলা দিয়া আফনে কি করবেন?”
“ঘুড়ি বানাবো। ”
“আফনে ঘুড়ি বানাইতে পারেন?”
“হুম পারি।এখন বেশি কথা না বলে নিয়ে আসো। ”
কমলা চলে গেল।অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে। পুষ্পের দেখা শুনা করে। ওকে একটা কাজ বললে ও কখনো না করেনা। বিয়ের আগেও যখন মাঝে মাঝে আসতাম দেখতাম ভাবী আর শ্বাশুড়ী মা ওকে ছাড়া থাকতেই পারে না।অনেক খেয়াল রাখে সবার।
“এই যে আফা লন আফনের জিনিস। ”
আমি শলা আর পেপার কেঁটে ঘুড়ি বানাতে থাকলাম। আমার পাশে পুষ্প আর কমলা বসে চুপচাপ মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষন পর আমার ঘুড়ি বানানো শেষ হলে সেটাতে সুতা বাঁধতে বাঁধতে কমলাকে বললাম,
“তুমি ঘুড়ি উড়াতে পারো কমলা?”
“হয় পারি। আমাগো গেরামে একবার ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম পুরষ্কার পাইছিলাম। ”
“ওহ তাহলে তো ভালোই তাহলে হবে নাকি আমার সাথে একবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা? ”
“হইতেই পারে খারাফ না। ”
ওর কথা শুনে হেসে দিলাম। তারপর কমলাও একটা ঘুড়ি বানিয়ে নিল। আমি আর কমলা দুজনেই ঘুড়ি উড়িয়ে দিলাম। পুষ্প দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল আর আমাকে উৎসাহ দিচ্ছিল ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ও অনেক উপভোগ করছে বিষয়টা। খেলা পুরো জমে উঠেছে। আমি ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে কখন বেন্ঞ্চের উপরে উঠে গেছি খেয়াল নেই। তখনই পাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠল,
“এসব কি হচ্ছে এখানে বাচ্চাদের মতো । ”
কন্ঠটা শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে এটা শান ভাইয়া। আমি বললাম,
“চোখ নাই সাথে দেখতে পাচ্ছেন না। ”
“এখনি নামো তুমি কোথায় উঠছো এখনি পড়বে। ”
“উফ বিরক্ত করবেন না তো নাহলে আমি হেরে যাবো।”
“কথা শুনবে না তো যখন এখান থেকে পড়বে তখন বুঝবে।”
কথাটা বলেই শান বেন্ঞ্চে বসে পড়ল। তখনি আমি কমলার ঘুড়িটা কেঁটে দিলাম আর খুশিতে আমি আর পুষ্প চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা ভুলেই গেলাম ব্যাস আর কি আমার লাফালাফিতে ধপাস করে বেন্ঞ্চ থেকে কাঁত হয়ে পড়ে গেলাম। আমি পড়তেই কমলা আর পুষ্প ভয়ে চিৎকার করে উঠল আর আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম।
পড়ার পরও যখন শরীরে একটুও ব্যাথা পেলাম না তখনই তাড়াতাড়ি চোখ খুলে তাকালাম। চোখ খুলতেই আমার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। আমি শান ভাইয়ার কোলে ছিলাম। আর শান ভাইয়া আমাকে দুহাতে শক্ত করে ওনার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল আমাকে চোখ মেলতে দেখেই শান বললো,
“বলেছিলাম না দেখলে তো বড় মানুষের কথা না শুনলে এমনটাই হয়। ”
“কি এমন হতো একটু ব্যাথা পেতাম তেমন তো কিছু না। ”
“এজন্যই বলে কারো সাহায্য করতে নাই। কই ধন্যবাদ দিবে তা না ঝগড়া করছে। ”
হঠাৎ খিলখিলিয়ে হাসার শব্দ কানে আসতেই দেখলাম পুষ্প হাসছে। আর কমলা ওড়নার আঁচল মুখে দিয়ে মুচকি হাসছে। আমার খেয়াল হলো আমি এখনো শান ভাইয়ার কোলে আর উনি এখনো আমাকে ওভাবেই ধরে আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ওনার কোল থেকে নেমে গেলাম। কি লজ্জা আল্লাহ।
শান বললো,
“এমন জংলী বিড়ালের মতো করছো কেন? অদ্ভুত তো। ”
আমি উনার দিকে রাগি চোখে তাকালাম কিন্তু কিছু বললাম না। শানকে দেখে কমলা চলে গেল।পুষ্প শানের কাছে গিয়ে বললো,
“জানো শান আজ থেকে মিষ্টি আমাদের সাথে থাকবে। ”
শান পুষ্পকে কোলে নিয়ে বললো,
“জানি তো প্রিন্সেস। তোমার মিষ্টিকে তো আমিই নিয়ে এসেছি কাল তেমার জন্য।”
পুষ্প খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি?”
“হুম।”
পুষ্প শানের গালে একটা কিস করে বললো,
“আই লাভ ইউ শান।”
“লাভ ইউ টু প্রিন্সেস। ”
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের কাহিনী দেখছিলাম। এদের সম্পর্কটা এমন যে দেখলে কেউ বলবেই না শান ওর চাচ্চু। ওর মানা হলো ও শান ভাইয়াদের মতো বড় তাই ও শান ভাইয়া আর আরশ ভাইয়াকে সরাসরি নাম ধরে ডাকে। যদিও এই ডাকটা শান ভাইয়াই শিখিয়েছে। পুষ্পর মুখে নাম ধরে ডাকলেও শুনতে খুব ভালোই লাগে।
তারপর পুষ্প শানের কোল থেকে নেমে আমার কাছে এসে বললো,
“চলো মিষ্টি আমরা আরো অনেক কিছু খেলবো ঘরে গিয়ে।”
“ওকে সোনা চলো। ”
তখনই শান ভাইয়া বলে উঠল,
“প্রিন্সেস তুমি শানকে ফেলে চলে যাচ্ছো?”
“হুম যাচ্ছি। কারণ এখন আমি মিষ্টির সাথে খেলবো। ”
“আমিও খেলবো আমাকেও নেও। ”
“না তোমাকে নিবো না। অন্য সময় যখন বলি তোমাকে তুমি তো খেলো না বলো বিজি। আর আমি বিজি মানুষদের সাথে খেলি না। যাও এখন। ”
শান পুষ্পের সামনে বসে বললো,
“এমন করে বলছো কেন সোনা?মিষ্টিকে নিয়ে গেলে শানের কি হবে ভাবো একবার। ”
“শোনো এই বাড়িতে যারা আছে সব আমার আর এখন মিষ্টিও আমার একদম ভাগ বসাবে না। ”
তখন শান মন খারাপ করে বললো,
“হ্যাঁ মা এই বাড়ির সব তোর। আমার মা ও তোর, আমার বাবা ও তোর, আমার ভাইও তোর, আমার ভাবীও তোর। থাকার মধ্যে যা ছিল বউটা এখন সেটাও তোর বলে নিয়ে নিলি এই কষ্ট কই রাখব। ”
শান ভাইয়ার কথা শুনে কেন জানি না আমার অনেক হাসি আসল। আমি আর হাসি আটকাতে না পেরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। শান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমাকে হাসতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে উনিও মুচকি হাসলো।
.
.
চলবে
.
চলবে