এক_রক্তিম_ভোর পর্ব ২

#এক_রক্তিম_ভোর
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২

ভার্সিটি থেকে বের হতেই নাবিলার সামনে একটা সাদা গাড়ি এসে থামলো। অন্যমনস্ক হয়ে হাটার ফলে নাবিলা কিছুটা চমকে যায়। তারপর চিরচেনা গাড়িটা দেখেই হাফ ছাড়ে।
গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিয়ে ভেতর থেকে গম্ভীর কন্ঠে কেউ আওয়াজ করে।

‘ উঠে এসো।’

নাবিলা বাধ্য মেয়ের মতো সামনের সিটে উঠে বসে সিটবেল্ট লাগাতেই গাড়ি চলতে শুরু করে।

‘ভার্সিটি কেমন কাটলো?’

‘ ভালো।’
নাবিলা ছোট করে জবাব দিলো।

এই লোকটার সাথে দুই বছর আগে ওকে বেধে দেওয়া হয়েছে। নাবিলার দাদু মারা যাবার আগে তার নাতনীর জন্য পাত্র ঠিক করে দিয়ে যায়। তখন নাবিলার বয়স পনেরো। ক্লাস টেনে উঠেছে। কথাটা নাবিলার বাবা, মা এবং দাদি ছাড়া কেউ জানতো না। পাত্রের নাম অয়ন।

ব্যবসা সূত্রেই অয়নের পরিবারের সাথে নাবিলার পরিবারের বন্ধুত্ব হয়। তাই নাবিলার দাদুর এমন প্রস্তাবে দুই পরিবার রাজি হয়। অয়নের বয়স তখন ছিলো তেইশ বছর। ব্রিটেনে থেকে পড়াশোনা করেছে৷ দুজনের বয়সের পার্থক্য আট বছর। নাবিলা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরই অয়ন দেশে আসে।
অয়ন দেশে আসতেই অয়নের পরিবার এঙ্গেজমেন্ট এর কথা জানায়। তারপরই মূলত নাবিলা সব জানতে পারে। এই সম্পর্কে সবথেকে বেশি খুশি নাবিলার দাদি নয়নতারা বেগম। তার স্বামীর শেষ ইচ্ছা তারও এখন একমাত্র ইচ্ছা।

দুজনের এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার পরই নাবিলার জীবনে নিজের স্বকীয়তা কমতে থাকে। তার সব ব্যাপারে মতামত প্রদান করে অয়ন। আগে প্রয়াসকে নাবিলার বিরক্ত লাগতো। কারন প্রয়াস ওকে ভালো মন্দ শেখাতো। কিন্তু অয়ন নাবিলাকে পুরোপুরি বদলে ফেলতে চাইছে। পাশ্চাত্যর ধারনা নিজের মধ্য ধারন করে তা নাবিলার মধ্যেও সঞ্চার করতে চায় অয়ন।

‘সবুজ রঙের ড্রেস কেনো পড়েছো? তোমার গায়ের রঙের সাথে এগুলো একদম যায় না, জানো না?’

নাবিলা মাথা নিচু করে নিলো মনে মনে প্রচুর রাগ হলেও মুখে তা প্রকাশ করতে পারে না। এতে দাদির বকা শুনতে হয় । এখন থেকে তাহলে ড্রেসের রঙও গায়ের রঙ মাথায় রেখে পড়তে হবে।

গায়ের রঙ কিছুটা মলিন হওয়ায় নাবিলার মাঝে কখনো হীনমন্যতা ছিলো না। আর যাই হোক পুরোপুরি শ্যামলা বলা যায় না নাবিলা কে। কিন্তু অয়নের সাথে এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার পর নাবিলার মনে হয় এই রঙটা বুঝি খুব বাজে। ছোটবেলা থেকে কেউ গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলেনি। প্রয়াস ভাইয়াও না। শুধু এই রঙ নিয়ে চিন্তা ছিলো দাদির। তবে অয়নের এই রঙ নিয়ে বারবার কথা শোনানো নাবিলার কাছে এখন অসহ্য লাগে।

দাদি কে এই নিয়ে কিছু বললে দাদুর শেষ ইচ্ছা বলে মুখ আটকে দেয়। নাবিলার বাবা মাও ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। যেই ছেলে বিয়ের আগেই গায়ের রঙ নিয়ে চিন্তা সে বিয়ের পর নিশ্চয়ই আরো বেশি কথা শোনাবে। এই নিয়ে অয়নের পরিবারের সাথে কথাও হয় নাবিলার বাবা মায়ের। তবে অয়ন তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় যে নাবিলার গায়ের রঙ নিয়ে ওর সমস্যা নেই। সে চায় নাবিলা তার মতো স্মার্ট হোক। এবং নিজের সাথে মানানসই ড্রেস পড়ুক এবং স্মার্টলি চলুক। ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস হোক।নাবিলাই কথাটাকে রুড ভাবে নেয়। ও চায় নাবিলাকে নিজের মতো গড়ে নিতে। একটা উজ্জল ভবিষ্যৎ উপহার দিতে।

এরপর আর নাবিলার বাবা মায়ের বলার কিছু থাকে না। এমনিতেও অয়নের পরিবার খুবই ভালো। কিন্তু অয়নের এই ব্যাবহার নাবিলার পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই। পুরো এলাকা জেনে গেছে অয়নের সাথে নাবিলার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে এবং খুব শীগ্রই বিয়ে। এখন বিয়ে ভেঙে দিলে নাবিলার পরিবারের জন্য তা খুবই লজ্জাজনক। এছাড়া পরবর্তীতে নাবিলার বিয়ে দিতে গেলেও সমস্যা হবে। তাই নাবিলা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। নিজেকে আপগ্রেড করতে চাইছে যদিও তা ওর নিজস্ব সত্তার বাইরে।

অয়ন নাবিলাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়।বাড়ি পৌঁছে নাবিলা দেখলো রুমকি এসেছে। রুমকি এই এলাকায়ই থাকে। নাবিলার থেকে একটু বড় হবে। তার একটা অনলাইন বিজনেস বিজনেস আছে, যেখানে রুমকি ত্বক ফর্সা কারী ক্রিম বিক্রি করে।
নাবিলার দাদি নয়নতারা বেগমকে সে মাঝে মাঝেই হাত করে ক্রিম বিক্রির চেষ্টা করে। কিন্তু নাবিলা সাফ নাকচ করে দিয়েছে সে একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এইসব বাজে জিনিস মাখবে না। কিন্তু নয়নতারা বেগম রুমকির ধবধবে সাদা মুখ দেখে নাবিলার জন্যও কিনতে চান। অয়ন ফর্সা, রাজপুত্রের মতো দেখতে। সেখানে তার নাতনী অয়নের অর্ধেক ও না। এইসব মেখে যদি সুন্দর হওয়া যায় তবে সমস্যা কোথায়?

নাবিলা কটমট চোখে রুমকির দিকে তাকালো। রুমকিকে এখন দেখে মনে হচ্ছে একটা প্লাস্টার করা সাদা দেয়াল কালো জামা পড়ে আছে। আবার দাত কেলিয়ে হাসছে। নাবিলাকে ওভাবে তাকাতে দেখে বললো,

‘নাবিলা আপা! এইবার আর কোনো পাকিস্তানি ক্রিম নিয়ে আসি নাই। এইসব নতুন। একদম থাইল্যান্ড থেকে ইমপোর্ট করা। সাত দিনে চোখে পড়ার মতো রেজাল্ট। বিয়ের আগেই দুলাভাই এর থেকে বেশি ফর্সা হয়ে যাবেন।’

‘ তোমায় কতবার বলেছি এইসব নিয়ে আসবে না। আমি এইসব মাখবো না। তবুও কেনো আসছো?’
দাতে দাত চেপে বললো নাবিলা।

নয়নতারা বেগম ধমকে বললেন,
‘ তুই থাম। ওকে আমি ডেকেছি। আর মাখবিনা কেনো শুনি? রুমকি কে দেখেছিস? কি জেল্লা। ভীড়ের মাঝে সবাই আগে ওর দিকেই নজর দিবে। তোর দিকে না।’

নাবিলা বিড়বিড় করে বললো,
‘ দিনের বেলা ভূত বের হলে দেখবেই তো।’

নয়নতারা বেগম না বুঝে বললো,
‘ কি বললি?’

‘না কিছু না। হে হে।’

এমন সময় প্রয়াস আপেল শূন্যে ছুড়ে ক্যাচ করতে করতে নাবিলার বাড়ি ঢুকলো।

‘ কি ব্যাপার? কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এখানে?’

প্রয়াসকে দেখে নয়নতারা বেগম বললেন,
‘ এই মেয়েকে একটু বুঝাতো প্রয়াস। রাজপুত্রের মতো বর পেতে চাইলে নিজেকেও তো রাজকন্যা বানাতে হবে নাকি। সুন্দর হতে এই মেয়ের কি সমস্যা বুঝি না আমি।’

প্রয়াস নাবিলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। নাবিলা একপলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। প্রয়াস নয়নতারা বেগমের পাশে বসলো। রুমকি প্রয়াসকে দেখে যেনো নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেয়েছে এমনভাবে হাসলো। নাবিলার চোখে সেটা ভালোভাবেই ধরা দিলো।

প্রয়াস বললো,
‘ তোমার নাতনি যদি রাজকন্যা হতে গিয়ে চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যায় তাহলে তোমার ভালো লাগবে?’

দাদি অবাক হয়ে বললো,
‘ এসব কি বলছিস? তা হবে কেনো?’

‘একটা রুপকথার গল্প শুনেছিলে না! সুন্দর হতে গিয়ে বেশি লোভে পুকুরে তিনটার বেশি ডুব দিয়ে মেয়েটি আরো বিশ্রী হয়ে যায়। এইসব দিলে তোমার নাতনীর ও একই দশা হবে।’

‘ কিন্তু রুমকির তো তেমন কিছুই হচ্ছে না। ও দুই বছর ধরে এইসব মাখছে আবার বিক্রিও করছে৷ ওর কিছু হলো না কেনো?’

‘ স্লো পয়জন বোঝো? যা ধীরে ধীরে শরীরকে বিষিয়ে তুলবে। একেবারে মারবে না। রুমকিকে বলো একমাস ব্যাবহার না করতে। তখনো ভীড়ের মাঝে ওকে চোখে পড়বে। কিন্তু সেটা সাদা হওয়ার জন্য না কালো এবং বাজে ত্বকের জন্য।

এইসব ফর্সা কারী ক্রিমে মাত্রাতিরিক্ত পারদ, মার্কারি, মারকিউরাস ক্লোরাইড থাকে। যেগুলো দীর্ঘমেয়াদে স্কিন ক্যান্সার ঘটাতে সাহায্য করবে। শুধু তাই নয়, মার্কারি ত্বকের পাশাপাশি আমাদের কিডনি, লিভার, নার্ভসহ অনেক ইন্টারনাল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেও ক্ষতি করে। এছাড়া এটি দৃষ্টিশক্তি কমায় এবং ত্ব জ্বালাভাব সৃষ্টি হয়।

এইসব ক্রিম বিএসটিআই আপ্রুভালও পায় না। চোরাইপথে কাস্টম ফাকি দিয়ে আসে। আবার অনেকগুলো বাংলাদেশেই তৈরি হয়। শুধু প্যাকেজিং টা বিদেশি মোড়কে ঢেকে দেয়। তারপর এই নিম্নমানের পন্যগুলো চড়া দামে সারাদেশের মার্কেট, শপিংমলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম ব্যাবহারে এইসকল ক্রিম ত্বকের মেলানিন স্তরকে সরিয়ে দিয়ে চামড়া পাতলা করে ফর্সা দেখাবে। কিন্তু যতদিন যাবে ত্বকের বিভিন্ন অংশে মেস্তার মতো চিরস্থায়ী দাগ পর্যন্ত পড়বে।’

নাবিলা চোখ বড় বড় করে প্রয়াসের কথাগুলো শুনলো। দাদিকে ও এভাবে কোনোদিন বলতে পারতো না। আর না দাদি বুঝতো। রুমকি উশখুশ করতে লাগলো চলে যাওয়ার জন্য।

প্রয়াস আবার বললো,
‘ এবার বলো দাদি। তোমার বংশের একমাত্র উত্তরসূরীকে এভাবে ঝুকিতে ফেলতে চাও?’

নয়নতারা বেগম বললো,
‘ না চাই না। থাক এসব ব্যাবহার করতে হবে না। আমি বরং হলুদ, চন্দন মেখে দেবো। লাগবে না এসব হাবিজাবি।’

প্রয়াস বললো,
‘ হ্যা তা লাগাতে পারো। হলুদ, চন্দন, মধু, দুধ, জাফরান, ফরমালিন মুক্ত কলা, পাকা পেপে, বিটের রস, নিম, তুলসী লাগাতে পারো। প্রাকৃতিক উপাদানে ফর্সা না করলেও ক্ষতি করে না। তবে ত্বকের ধরন বুঝে ব্যাবহার কোরো। কোনো উপাদান স্যুট না করলে তা ব্যাবহার করার দরকার নেই। সাথে ফরমালিন মুক্ত ফলমূল এবং শাক-সবজি খাওয়াতে পারো বেশি বেশি।’

নাবিলার ওষ্ঠ্যদ্বয় আপন শক্তিতে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলো প্রয়াসের কথা শুনতে শুনতে।
প্রয়াস উঠে যাওয়ার সময় দাদির অগোচরে নাবিলার থুতনি ধরে উচু করে হা করা মুখ বন্ধ করে দিয়ে মুচকি হাসলো।

‘তুমি এগুলোও জানো?’ নাবিলা বললো।

‘ জানবোনা কেনো? তোর মতো বাহিরে বাঘিনী, ঘরে হরিণীর মতো মেয়ে আশে পাশে থাকলে সব জানতে হয়। আর না জানলে আজ তোর কপালে ত্বক ফর্সা কারী ক্রিম ছিলো। সবসময় দাদির সামনে তোতলালে চলে না। কখনো কখনো জোর গলায় সঠিক কথা বলতে হয়। নাহলে উনি জানবে কিভাবে যে জিনিসটা সত্যিই ভালো নাকি খারাপ। উনি কি তোর পর? না খারাপ চায়?
উনি আগের দিনের মানুষ। তাই তার সমাজে প্রচলিত রীতিই তিনি মানবেন। দাদির ভূল ধারনা আমাদেরই দূর করতে হবে। বুঝলি!’
বলে প্রয়াস হাতের আপেলটা নাবিলার হাতে দিয়ে চলে গেলো।

নাবিলা প্রয়াসে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটা হাজার শাসন করলেও সবকিছুতে নাবিলার ভালোটাই দেখে। নাবিলাও তা জানে। ওর কৈশোরের প্রথম ভালোলাগা ছিলো প্রয়াস ভাইয়া। অধিক ফর্সা না হলেও নাবিলার থেকে ফর্সা তার গায়ের রঙ। বেশিরভাগ সময় প্রয়াস থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং টিশার্ট পড়ে থাকতো। নাবিলার সবচেয়ে পছন্দ ছিলো প্রয়াসে এলোমেলো চুল। এতে প্রয়াসকে দেখতে নাবিলার খুব ভালো লাগতো।

প্রয়াসের শাসনে ভাবতো হয়তো প্রয়াস ভাইয়াও ওকে পছন্দ করে। কিন্তু এস এস সি দেওয়ার পরই জানতে পারে প্রয়াস ভাইয়া অন্য কাউকে ভালোবাসে। সেই থেকে নাবিলা নিজেকে সংযত করে এবং প্রয়াস ভাইয়া হয়ে ওঠে ওর জন্য অসহ্য একজন মানুষ। ভয় ও পেতো কিছুটা। তাই মুখ বুজে শাসন শুনে যেত। এর পর প্রয়াস ভাইয়া হুট করেই একদিন কানাডা চলে গেলো। নাবিলাও অয়নের সাথে জড়িয়ে গেলো।

নাবিলা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আপেলটার দিকে তাকালো। আপেলের সাথে নজরে এলো জ্বলজ্বল করতে থাকা আংটিটা। অয়নের দেওয়া এঙ্গেজমেন্ট রিং। হালকা হেসে ভাবতে লাগলো,

‘ ভাগ্যিস শুধু ভালোলাগা ছিলো। নাহলে এই আক্ষেপ নিয়ে আমি বাচতাম কিভাবে।’
তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here