এতোটুকুই তো ঝড়বৃষ্টি পর্ব ০৪ ও শেষ

এতোটুকুই_তো_ঝড়বৃষ্টি
পর্বঃ০৪
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

-“বিয়ে করবি না,করবি না করেও বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলি।এখন রীতিমতো লাফাচ্ছিস!ব্যাপার কি বল তো?শুনেছি তোর হবু বর নাকি বলিউড হিরো রানবীন কাপুরের মতো দেখতে!চেহারা দেখেই ফেঁসে গেলি?”

লাবণ্যের কথায় প্রমার মধ্যে কোনোরকম আগ্রহ দেখা গেল না।সে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।মনের ভেতরটা কাতরতায় ভুগছে।এ নিদারুণ মনঃকষ্টের একমাত্র কারণ হলো সাজিম!চব্বিশ ঘন্টা হতে চলছে অথচ সাজিম একবারও ফোন দিলো না?গত তিনমাসে তো কখনোই এমন হয় নি!

সাজিমের জন্মস্থান,বেড়ে উঠা ঢাকায়।এমনকি পড়াশোনাও সে ঢাকা থেকেই শেষ করেছে।কর্মসূত্রে তাকে এখন চট্টগ্রাম থাকা লাগে।সাজিমের পরিবার বলতে তার মা আর সে।সাজিমের সাজিমের জন্মের আগেই নাকি তার বাবা মারা গেছে।মায়ের হাতেই সে মানুষ হয়েছে!সাজিমের মা তনিমা বেগম চমৎকার একজন মহিলা।প্রথম যেদিন তার সাথে কথা হয়েছিল প্রমা তখন ঘুমে বিভোর।ঘুম চোখে না দেখেই প্রমা ফোন রিসিভ করেছিল।

——-

-“হ্যালো!”
-‘হ্যালো প্রমা, আমি তনিমা বলছি।সাজিমের মা।ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”

সাজিমের মায়ের ফোন!প্রমা টনক নড়ল। ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো।কথা বলার এক পর্যায়ে তনিমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

-“তোমার আন্ডার গার্মেন্টসের সাইজ কতো যেন?চৌত্রিশ নাকি ছত্রিশ?একটু বল তো!আমি দোকানে দাঁড়িয়ে আছি।”

প্রমা বিষম খেল।লজ্জায় কান দিয়ে অদেখা ধোঁয়া বের হতে লাগলো। দোকানে দাঁড়িয়ে উনি এতো জোরে জোরে কথা বলছে!সর্বনাশ!সবাই শুনে ফেলেছে নিশ্চয়ই!

-“বিয়ের অর্ধেক কেনাকাটা এখনো বাকি।চার মাসে কি করে কি হবে বল তো!সাজিম তো নিজের মতো ব্যস্ত।এক কাজ করো, তুমি না হয় চট্টগ্রাম এসে পড়ো।এই শহরটা ভীষণ সুন্দর।মা মেয়ে একসাথে মিলে না হয় শপিং করবো আর এদিক সেদিক ঘুুরে বেড়াবো।তুমি আসবে না….. মা!”

তনিমা বেগমের শেষ কথাটুকুতে কিছু একটা ছিলো।ব্যস!সেদিনই প্রমার মনের সকল দ্বিধা কেটে গেলো।মা পেতে চলেছে সে।মমতাময়ী মা।সাজিম তো এমনিতেই রাজি,তবুও দরকার পরলে না হয় ধরে বেঁধে বিয়ে করে নিবে।

———-

তিনমাস হয়েছে মানুষটা চট্টগ্রাম ফিরে গেছে।আর একমাস পর তাদের বিয়ে।প্রমা কেবল একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিলো।সাজিম সেদিন সাথে সাথে তার ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দেয়।পরবর্তী দু’দিন ছিলো,দুজনের কাছে স্বপ্নের মতো।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট প্রমা।তিন বছর কেবল বাড়ি টু ক্লাসরুম যাতায়াত করেছে। ক্যাম্পাসের একটা কোণাও সে অভজার্ভ করে দেখে নি!সাজিমের বদৌলতে সেই দু’দিন টিএসসি,দোয়েল চত্বর,কার্জন হল,কলা ভবন,শাহাবাগ,রবীন্দ্র সরোবর ও ধানমন্ডি লেক সহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে বেড়িয়েছে।মায়ের মৃত্যুর পর জীবনটা প্রথম উপলব্ধি করেছে।

চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রথম কয়দিন সাজিম যখন প্রমাকে ফোন করতো,কিছুই বলতো না।ঘন্টার পর ঘন্টা কানে ফোন লাগিয়ে রাখতো।যেন প্রমার শ্বাস গুণছে সে!প্রমা প্রথম ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতো।সেও চুপ থাকতো।একসময় বিরক্ত হয়ে পড়ে!নিজ থেকে কথা বলা শুরু করে। আস্তে আস্তে বেশ সহজ হয়ে যায়।দু’জন দু’জনের কাছে একে অপরকে মেলে ধরে৷

——–

-“কিরে কথা বলছিস না কেন?ইন্জিনিয়ারের বউ না হতেই, তোর ভাব বেড়ে গেছে দেখি!এই শোন না,খবর নিয়েছিস তো!বাংলার রানবীন কাপুর আবার বলিউডের রানবীর কাপুরের মতো সেকেন্ড হ্যান্ড না তো?”

-“সাজিম পিউর ভার্জিন।একদম এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের মতো!কিন্তু আমার ভাই কিন্তু সাজিমের মতো না।তুই একটু ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে নিস কিন্তু!”

প্রমার জবাব শুনে লাবণ্যর মুখ চুপসে গেল।তার আর প্রিয়মের সম্পর্কের ব্যাপারটা কেউ জানে না।প্রমা কি করে জানলো?প্রিয়ম বলেছে হয়ত!লাবণ্য সম্পর্কে প্রমা প্রিয়মের চাচাতো বোন।প্রমার সমবয়সী সে!কিশোরী বয়স থেকেই তার সাথে প্রিয়মের প্রেম।

-“শোন তোদের বিয়ের পর কিন্তু,তুই আমাকে ননদিনী বলে ডাকবি।কেমন?আমি কিন্তু তোকে ভাবী বলতে পারবো।আমার থেকে এ নিয়ে কোনো এক্সপেক্টটেশনও রাখবি না।”

প্রমা ব্যঙ্গ করে বলল।হঠাৎ লাবণ্যর নজর প্রমার হাতের দিকে পরলো। চমকে উঠলো সে।প্রমার ঘরের জানালার ওপরে ভেন্টিলেটর ফ্যানের ফাঁকে মৌমাছির ছোটখাট একটা চাঁক রয়েছে।সেখান থেকে একটা মৌমাছি এসে প্রমা ডান হাতের উপরের পিঠে হুল ফুটিয়েছে।কয়েক মিনিটে হাত ফুলে একাকার!অথচ মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে আছে।একদমই উদাসীন। প্রমাকে জড়িয়ে ধরলো লাবণ্য। আস্তে আস্তে বলল,

-“কি হয়েছে রে,বনু?তোর ভেতরটা কেমন ধকধক করছে!কিসের অস্থিরতা তোর?”

এইটুকু আদরমাখা কথায় প্রমা কেমন ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।নিজেকে এতো সময় উপরে উপরে শক্ত রাখলেও,এই মূহুর্তে মন ভেঙে কান্না করে দিলো।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

-“চব্বিশ ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে মানুষটার কোনো খবর নেই,লাবু।আন্টির ফোনেও কল ডুকছে না!চট্টগ্রামে সাজিমের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই,যে খবর নিবো।নিউজে দেখলাম ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দর গুলোতে সতর্ক সংকেত দিচ্ছে।অবস্থা ভয়াবহ।তুই আমাকে সাজিমের কাছে নিয়ে চল….প্লিজ।”

লাবণ্য আঁতকে উঠলো।সকাল থেকে সারাদেশে ঝড় হচ্ছে।ঢাকায়ও ব্যতিক্রম নয়। বৃষ্টির সাথে উড়নচণ্ডী বাতাস।রাস্তা একটা মানুষও নেই।সন্ধ্যাও হতে চলছে।সেই সাথে তুফানের বেগ বেড়েছে।

-“তোর মাথা ঠিক আছে।বাহিরে তীব্র ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।শো শো শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে।এর মধ্যে বাহিরে বের হওয়া অসম্ভব।”

-“তুই সবসময় বেশি বেশি দেখিস।আমার লিটল ফিঙ্গারটা দেখেছিস না।ঠিক এতোটুকুই তো ঝড় বৃষ্টি বাহিরে।তুই যা ভাইয়াকে যেয়ে বুঝা।না হয় আমি একাই চলে যাবো।”

প্রমা ক্ষুদ্ধ গলায় বলল।হবু ননদের ঝারি খেয়ে,লাবণ্য কাচুমাচু মুখে প্রিয়মের রুমে দিকে পা বাড়াল।

———

চৌদ্দগ্রাম গ্রান্ড ক্যাসেল হোটেলের রিসিপশনে বসে আছে প্রিয়ম।তার বিপরীত পাশের সোফায় বসে আছে প্রমা।আজ রাতটা বোধহয় এখানে কাটাবে তারা!বোনের জেদের কাছে হার মেনে ঝড়,তুফান মাথা নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো ঠিকি।কিন্তু কুমিল্লা এসে তাদের যাত্রায় বাঁধা পড়বে কে জানতো?বড় একটা বট গাছ ভেঙে পড়ায়,রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে।প্রিয়ম কি করবে বুঝে পেলো না!ভীষণ রাগ হলেও, প্রমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না।কিন্তু মনে মনে সাজিমকে গালি দিলো।আসার সময় বাবা তাদের মুখের দিকে ফিরেও তাকায় নি!প্রমার খুশির কথা চিন্তা করে,এমন ঝোঁকের মাথা সিদ্ধান্ত নেওয়া৷ যে একদমই ঠিক হয় নি,প্রিয়ম তা হারে হারে টের পেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বারোটা পনেরো মিনিট।এদিকে প্রমা সাজিমের চিন্তায় কেঁদেকেটে অস্থির।এমন অবস্থায় জন্মদিনের উইশ করা ঠিক হবে কি না,বুঝতে পারলো না প্রিয়ম।ভেবেছিলো জন্মদিনের উপহার স্বরূপ বোনকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে নিয়ে যাবে।তার আর কই হলো!বুক থেকে দীর্ঘ শ্বাস বের হলো তার।

—–

-“আ’ম অ্যাবসোলিউটলি ফাইন,লিটু।না,না তোর এই বৃষ্টির মাঝে আসার প্রয়োজন নেই।রাস্তা ব্লক না হলে,এতোক্ষণে ঢাকা পৌঁছে যেতাম।”

কিছুসময় নিরবতা।ফোনের ওপাশের কথা শোনা গেল না।

-“কি আর করার?আজ রাতটা না হয় হোটেলেই কাটিয়ে দিবো।তুই জাস্ট একটা ফেভার কর। কেকের ব্যবস্থা করে রাখ।রেড ভেলভেট কেক কিন্তু!প্রমা অন্য কোনো কেকে খেতে পারে না।সকালে তোর থেকে কেক কালেক্ট করে আমি সোজা প্রমার বাসায় হাজির হবো।দু’দিন হয়ে যাচ্ছে।সারপ্রাইজ দেওয়ার চক্করে ওর সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছি।”

-“ওকে বায়।রাখলাম তাহলে।”

কথা শেষ হতেই ফোন কেটে পকেটে ভরে নিলো সাজিম।সামনে ঘুরে দাড়াতেই তার গালে বেশ শক্ত একটা ঘুষি পরলো।ফ্লোরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে।চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে লাগলো।আকস্মিক ঘুষি পড়ায় সে তাল হারিয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতেই সামনে তাকাল।প্রিয়মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো। এতোদিন তো প্রমাকে নিয়ে হ্যালুসিনেশন হয়েছে।এখন আবার প্রিয়ম!প্রেমে পড়ে সে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে।সাজিম নিয়ের ভাবনায় এতোই মশগুল ছিলো যে,প্রিয়মের পেছনের থাকা প্রেমাকে খেয়ালই করলো না।

[পরিশিষ্টঃ-
দু’বছর পর——-

হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালের কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করলো সাজিম।কেবিন দরজা খোলার জোরালো শব্দে বাচ্চারা কেঁদে উঠলো।প্রমা সাজিমের দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকাল।তার এক পায়ে দুই ফিতায়ালা স্যান্ডেল,অন্য পায়ে লোফার।উল্টো টি-শার্টে তাকে বিকারগ্রস্ত মনে হচ্ছে।চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে,সেই সাথে মাথার চুলগুলোও এলোমেলো।সব মিলিয়ে একদম হাবলুুর মতো লাগছে।প্রমার হাবলু।

একাধারে দু’দিন না ঘুমিয়ে মাল্টি পারপাস কার্গো ভেসেলের ডিজাইনের পেছনে সময় ব্যয় করে,সবেমাত্র ঘুমিয়ে ছিলো সাজিম।প্রিয়মের ফোন পেয়েই ফ্লাইটে করে আধঘন্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছে।প্রমাকে বিয়ের পর থেকে প্রায় সময় তাকে তার প্রমাকে ঢাকা টু চট্টগ্রাম দৌড়াদৌড়ি করা লাগে।সপ্তাহে একদিন অন্তত মাহবুব সাহেবের প্রমাকে দেখতেই হয়।প্রেগন্যান্সির প্রথম পাঁচ মাস চট্টগ্রাম থাকলেও,ছয় মাসে পড়তেই মাহবুব সাহেব প্রমাকে এক প্রকার জোর করেই ঢাকা নিয়ে আসেন।তনিমা বেগম অসুস্থ হওয়ায় সাজিমের সাথে আসতেই পারেন নি।কিন্তু নাতি নাতনিদের জন্য দু’আ ঠিকি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

-“ইসস,দিলে তো আমার বাচ্চাদের কাঁদিয়ে।মজা পেয়েছো না?খুব শান্তি লাগছে এখন!”

সাজিম নিরুত্তর।শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রমাকে।মিনিট দশেক ঘাড়ে মাথা গুঁজে পড়ে রইলো।প্রমার পিঠে ভেজা ভেজা অনুভব হলো।সাজিমের মনের ভয়টা বুঝতে পারলো।নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাজিমের দেহের সাথে মিশে রইল।

-“ইট’স ওকে।কিছু হয় নি আমার!আমি একদম ঠিক আছি।এতো ভীতু হলে চলে….তুমি বলো?”

সাজিম ফিসফিস করে বলল,

-“তোমার বেলায় আমি সবসময়ই ভীতু।আর এই ভীতু আমিটাকে তুমি ভীষণ ভালোবাসো।তাই আমি চিরকালই এমন থাকতে চাই।”

প্রমা মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ডেলিভারির সময়টুকু সে নিজেও খুব ভয় পেয়েছিলো।আশেপাশে সাজিমকে খুঁজ ছিলো।সাজিম আড়চোখে দোলনার দিকে তাকালো।সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্প দুটি কেমন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তাদের তুলে নেওয়ার জন্য সাজিমকে আহ্বান জানাচ্ছে।সাজিম প্রমাকে ছেড়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।এই পিতৃ আহ্বান এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো বাবার পক্ষেই সম্ভব না।সাজিমও সেই আহ্বানে সাড়া দিলো।ফুল দু’টোকে দু’হাতে তুলে নিলো।মিশিয়ে নিলো বুকের গভীরে।

সমাপ্ত

গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।সেই সাথে ভুল ত্রুটি গুলো তুলে ধরবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here