ও চোখে বৃষ্টি এলে পর্ব -০৯

#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: নবম
# Tuhina pakira
৯.

” আমাকে কে কি এক কাপ চা কেউ দেবে। সেই কখন থেকে এক কাপ চা চেয়ে চলেছি মা, মেয়ে কারোর কোনো হুশ নেই।”
পেপারের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে সাম্যের বাবা কথাটা বললো। আজ সে অফিস যায়নি, বাড়িতেই রয়েছে। এই কিছুক্ষণ হলো তিনি ঘুম থেকে উঠে হল রুমে বসে পেপার পড়ছেন। নেহাতই বাড়ি আছেন তাই আজ তিনি পুরো পাক্কা সাড়ে এগারোটায় বিছানা ছেড়ে উঠেছেন। তিনি যতই কর্মঠ হোক না কেনো ছুটির দিনে বেশির ভাগ সময়ই তিনি ঘুমিয়ে কাটান। তার কাছে এটা একটা হবি বলা চলে। তাই তো তার এখনও সকালের জল খাবারও খাওয়া হয়নি। এই কিছুক্ষণ হলো তিনি তার স্ত্রী, মেয়ের থেকে এক কাপ চায়ের আশায় বসে রয়েছেন। অন্যান্য সময় এই কিছুক্ষণ হলেও তিনি অপেক্ষা করতেন না। সারা বাড়ি এতক্ষণে মাথায় উঠে যেত। কিন্তু ওই যে ছেলের জন্যে তার হাল আজকে অন্যরকম। বাড়ির কর্ত্রী অর্থাৎ তার স্ত্রী তার উপর খোঁচে রয়েছে। কারণ একটাই তিনি কেনো তার ছেলে বৌমাকে বাড়ি আনছেন না। এই নিয়ে অবশ্য দুই দিন ধরে তাদের মধ্যে খিটমিট চলছিল, তবে কাল রাতে ঝগড়া তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে। ছেলে তার বউকে নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকছে, তারউপর বৌমাও অসুস্থ্য এই ব্যাপারটা বাড়ির কর্তী কিছুতেই মেনে নিয়ে পারছে না। চৌধুরী বাবু অবশ্য এটা বুঝতে পারছে না, তার সঙ্গে এই সব কি হচ্ছে। ছেলের না হওয়া বিয়ের দিন পর্যন্ত তো তার স্ত্রী তার হয়েই কথা বলছিল, কিন্তু আজ তিনি দলে একা। মা, মেয়ে সবাই ছেলের সাপোর্ট করছে।
-” বাবা এই যে চা।”
-” হ্যাঁ দে।”
সাম্যের বাবার ভাবনার মাঝেই কেউ তাকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল। তিনি পেপারের দিকে চোখ সীমাবদ্ধ রেখে চায়ের কাপটা নিলো।
-” দেখো সাম্যের মা আজকাল কী দিন পড়েছে, পেপারে কী লিখেছো দেখো!”
সাম্যের মা রান্না ঘর থেকে একবার স্বামীকে দেখে নিলো, কিন্তু কিছু বললেন না। স্ত্রীকে নিরুত্তর দেখে চৌধুরী বাবু নিজেই খবরের একটা হেডিং দেখে বললো,
-” বউয়ের প্ররোচনায় ছেলে খুন করলো নিজের মা, বাবাকে। ”
কিন্তু তাও সাম্যের মা কিছু বলল না। মাছটা কড়াইয়ে ভাজতে ভাজতে স্বামীর দিকে মুখ বেঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। চৌধুরী বাবু এক চুমুক চা খেয়ে চোখ বন্ধ করে তার স্বাদ নিলো।
-” আজ চা টা খুব ভালো হয়েছে। কে করেছে? সামান্তা! তোমার হাতের বলেও মনে হচ্ছে না। আচ্ছা ছাড়ো যা বলছিলাম, দেখো সাম্যের মা দেখো, কী যুগ বউয়ের কথায় ছেলে কিনা মা, বাবাকে খুন করতে পিছপা হচ্ছে না। তোমার ছেলেও আমাদের সঙ্গে এই একই কাজ করতে পারে, তুমি দেখে নিও। আর তুমি কিনা ছেলেকে সাপোর্ট করছো। আমি বলে দিচ্ছি ছেলে অন্ধ হয়ও না। পড়ে নিজে বিপদে পড়বে আর সাথে আমাকেও ফেলবে। যতসব পাজি বৌমা।”
-” ভালোবেসে বিয়ে করায় শ্বশুর বাড়িতে, শশুর মশাই না মেনে নেওয়ার বৌমা বসলো অনশনে।”

চৌধুরী বাবু নিজের কথার মাঝেই কারোর গলা শুনে সামনে তাকালো। যাকে দেখলো, তাকে দেখে তার চোখ ছানাবড়া। তারমানে তার স্ত্রী তার কাজ নিজেই করে ফেলেছেন। চোখের সামনে পিয়ালকে দেখে কিছুটা হলেও যে চৌধুরী বাবু ভরকে গেছেন তা পিয়াল ঠিক বুঝেছে।
-” বুঝলে মা কি দিনকাল এলো। শ্বশুর গুলোও না, একসময় নিজে লাভ ম্যারেজ করে বিয়ে করেছে কিন্তু পরবর্তীকালে তার ছেলে কিংবা মেয়ে এই কাজ করেছে তো ফেঁসেছে। ”
-” এই মেয়ে তুমি এই খানে কি করছো?”
-” আরে বাবা, আপনি উঠেছেন! আমি সেই কখন থেকে আপনার জন্যে বসে রয়েছি। সে যাইহোক আপনি এতো দেরিতে কেনো ঘুম থেকে উঠলেন! আপনার বয়স হয়েছে বাবা, এবার থেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে একটু ভিজে মাটিতে হাঁটবেন। আপনার ছেলের থেকে শুনেছি আপনার নাকি মাঝে মাঝেই পা ব্যথা হয়। ”
-” এই কে বাবা? আমি তোমার কেনো বাবা হবো! আর তুমি এখানে কি করছো? ”
পিয়াল কিছু বলবে তার আগেই সামান্তা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।
-” আরে বৌদি, তুমি কখন এলে?”
সামান্তা উচ্ছ্বাসে ছুটে এসে পিয়ালকে জড়িয়ে ধরলো। পিয়াল সামান্তার গালদুটো টেনে দিয়ে বললো,
-” এই যে আমার কিউট ননদিনি, কী খবর? সেই লাস্ট হসপিটালে দেখা করেছিলে, আর তো আমার কাছে গেলেই না!”
-” আসলে কলেজে গিয়েছিলাম, কিছু কাজ ছিল তাই যাওয়া হয়নি তবে আজ বিকেলে যাবো ভেবেছিলাম। তবে তুমি যখন এসে গেছো আর কি লাগে।”
-” এই সামান্তা এতক্ষণ কোথায় ছিলি! কতক্ষন ধরে চা চাইছিলাম সেই দিকে তো তোর হুশ নেই। যেই এই মেয়েকে দেখলি ওমনি আঠার মতো চিপকে গেলি বল।”
-” ও চা দেইনি তো কি হয়েছে! তোমার বৌমার হাতের চা কেমন লাগলো?”
সাম্যের মায়ের কথায় চৌধুরী বাবু বিষম খেলো।
-” এই মেয়েটার হাতে তৈরি চা তুমি আমাকে কেনো খেতে দিলে? ” কিন্তু মনে মনে পিয়ালের বানানো চায়ের প্রশংসা করতে ভুললো না।
-” বাবা, আপনি সেই থেকে এই মেয়ে, এই মেয়ে কেনো করছেন! আমি তো আপনার মেয়ের মতো।”
-” কিসের মেয়ে, তুমি তোমার বাবার মেয়ে। আমার কেউ না। আর আমি তোমার বাবা না।”
-” এ মা কি বলেন এইসব। আমি সেই কবে থেকে জেনে আসছি আপনি আমার শ্বশুর থেকে বাবা। সেই আপনি কিনা বলছেন আপনি আমার বাবা না।”
-” সেই কবে থেকে মানে?”
-” ওইতো যাবে থেকে আপনার ছেলে আমাকে প্রপোজ করেছে তবে থেকে।”
সাম্যের বাবা হাঁ করে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” কী!”
-” হ্যাঁ মেসোমশাই। আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েরা প্রেমের শুরুতে ছেলে মেয়ের নাম ঠিক করে নেয়। সেখানে শ্বশুর ও বাবা হয়ে যায়। ”
কারোর কথায় সাম্যের বাবা সামনে তাকিয়ে বললো,
-” এই তুমি কে? সেই দিন হসপিটালে মনে হয় দেখেছিলাম। কে তুমি?”
-” আমি অভি, পিয়ালের পিসতুতো দাদা।”
-” ও তুমি তারমানে মৃন্ময়ীর ছেলে!”

সকলে অবাক হয়ে সাম্যের বাবার দিকে তাকালো। অভি অবাক হয়ে বললো,
-” আপনি কীকরে আমার মা কে চিনলেন?”
-” না চেনার কী আছে। তোমার মামা আর মা আমরা একই কলেজে পড়তাম। তোমার মা খুব ভালো ছিল। তবে তোমার মামা টা বড্ড বেয়াদপ।”
-” বাবা আপনি আমার বাবাকে বেয়াদোপ কেনো বলছেন?”
-” তো কী করবো। তোমার বাবা ভালো বক্সিং করতো বলেতো অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না। ”
-” ও আপনার বুঝি তাই হিংসে হয়।”
-” হুই বয়ে গেছে হিংসে করতে। আমিও বক্সিং জানি, অন্তত তোমার বাবার থেকে ভালো। ”

-” আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এক কাজ করো পিয়ালের বাবাকে একদিন বাড়িতে ডেকে এনে নিজেদের মধ্যে বক্সিং করো। এখন যাও স্নানে যাও।”
কথাটা বলে সাম্যের মা রান্নাঘরে চলে গেলো।

-” হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখবে কে জেতে। আমাকে হারাবে তাহলেই হয়েছে। ”
সামান্তা হুট করে বলে উঠলো,
-” বাবা এখন তোমার নাতি নাতনি নিয়ে খেলার সময়। বক্সিং করে হাত পা ভাঙলে পড়ে ঠেলা বুঝবে।
সামান্তাকে ওর বাবা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। পুনরায় ধমক দিয়ে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” তুমি এখানে কেনো এসেছো বললে না এখনও!”

-” ধুর আপনারা বাবা, ছেলে দুইজনেই এক। কথায় কথায় খালি ধমক দেন। না জানি কবে মারধর করেন।”।
-” বৌদি তুমি তারমানে বলতে চাইছো, বধূ নির্যাতন!”

-” সামান্তা তুই কি যাবি এখান থেকে।”
-” ও কী যাবে, আপনি যান স্নান করে আসুন। খুব খিদে পেয়েছে।”

সাম্যের বাবা একবার ভালো করে পিয়ালকে দেখে নিলো। মাথায় ওর এখনও ব্যান্ডেজ করা।
-” সাম্যের মা তোমার ছেলের বউকে খাইয়ে দাও। আর তুমি মেয়ে এখানে কার সাথে এসেছো? ওই গর্ধব টা কোথায়?”

-” আমি তো একাই এসেছি।”
-” সাম্যের মা দেখো গর্ধবটার কান্ড দেখো। নিজের অসুস্থ্য স্ত্রীকে একা একা ছেড়ে দিয়েছে।”

তিনি আর এক পা ওখানে দাঁড়ালেন না। সোজা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আর বিড়বিড় করে বললো,
-” অসুস্থ্য স্ত্রীকে কিনা একা ছেড়ে দিল। বিয়ের আগের ভালোবাসা জানালা দিয়ে বুঝি পালিয়ে গেছে। শয়তান ছেলে।”
ππππππππππ

দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে সাম্য নিজের কেনা ফ্ল্যাটে ফিরলো। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পুরো ফ্ল্যাট ফাঁকা পেলো। কেউ নেই এখানে। সাম্য ভয় পেয়ে চট করে নিজের ঘরে গেলো। সেখানেও কেউ নেই। সাম্যের মাথায় বারবার উল্টোপাল্টা চিন্তা আসছে, পিয়ালের কিছু হয়নি তো!

নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে অভি কে কল করতে গিয়েও থেমে গেল। এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দিকে। আয়নায় লাগানো একটা চিরকুটের দিকে নজর গেল সাম্যের।
—” মিস্টার বর,
চললাম নিজের ঠিকানায়। ইচ্ছে হলে চলে আসবেন। এই ফ্ল্যাটে আমি একা একা থাকতে পারছি না। তাই বাড়ি চলে গেলাম।
ইতি- আপনার বউ।।”
চিরকুটটা পড়ে সাম্য মাথার চুলগুলো চেপে ধরে বসে পড়লো। আজ সকালে একটা জরুরি মিটিং থাকায় সাম্যকে অফিস যেতে হয়েছিল। সেই সুযোগেই পিয়াল বাড়ি চলে গিয়েছে।
-” এই মেয়েটা আমাকে পুরো পাগল বানিয়ে দেবে দেখি। কী দরকার ছিল একা একা বাইরে যাওয়ার। কাল রাতে এই মাথায় ব্যাথা পেয়েছিল। আবার যদি শরীর খারাপ করে। ”

( চলবে)

{বিঃ : ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।। }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here