কথা দিলাম পর্ব -০৬+৭

কথা দিলাম 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬||
কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

দুদিন পর,

“আজ দুদিন হতে চললো আধভিক কোনো রকম কোনো খবর দিলো না। ব্যাপারটা কি? আমি কি একটা ফোন করে খোঁজ নেবো? নাহ, এটা ভালো দেখাবে না। কিন্তু ওর সাথে কথা বলাটা আমার জরুরি। আমি চাই না আঙ্কেল বা দেব জানুক আমি ওর প্রোডাকশন হাউজ বা এ. ভি. আর. ডিজাইনসের হয়ে কাজ করছি। তাছাড়া আমি তো মডেলিংয়ের বিশেষ কিছু জানি না, আঙ্কেলের কথায় প্রথম দেবী করতে যাচ্ছিলাম। এগুলো তো জানানো হলো না।”

সিয়ারা হাতে ফোনটা নিয়ে পায়চারি করছে ঘরের মধ্যে আর নিজে নিজে কথা বলছে। এমন সময় নীচ থেকে রাতের খাওয়ারের জন্য ডাক পরলে সে ফোনটা টেবিলে রেখে নীচে চলে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষে সে ঘরে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। শোয়ার জন্য বিছানায় উঠতেই নিজের ফোনের কথা মনে পরলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ফোনটা টেবিলে। এগিয়ে এসে টেবিল থেকে ফোনটা তুললেই ফোনের লাইট জ্বলে ওঠে আর সাথে সাথে একটা নোটিফিকেশন দেখতে পায় আর মনে মনে বলে,

“আধভিক টেক্সট করেছে?”

তৎক্ষণাৎ মেসেজ ওপেন করে সিয়ারা দেখে আধভিক কল করার জন্য অনুমতি চেয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। সিয়ারাও তো কথা বলতেই চেয়েছিলো তাঁর সাথে তাই আর না ভেবে উত্তর দিলো,

“ইয়াহ, সিওর।”

আধভিকের কলের ওয়েট করতে থাকে সিয়ারা। যেহেতু কথা নরমাল মেসেজে হচ্ছে তাই বোঝার উপায় নেই অপরজন মেসেজ দেখেছে নাকি না। প্রায় পাঁচ দশ মিনিট পর হঠাৎ করেই সিয়ারার ফোন বেজে ওঠে।

“হ্যালো?”

“স্যরি ফর লেট। আমি একটু বিজি ছিলাম তাই আপনার রিপ্লাই টা খেয়াল করিনি।”

“ইটস ওকে। লেট আমারও হয়েছে রিপ্লাই করতে। বলুন কি বলবেন?”

“হ্যাঁ বলছি। আপনি আমাকে আপনার মেইল আইডিটা একবার মেসেজ করে দেবেন প্লিজ?”

“মেইল আইডি কেন?”

“কিছু ডিজাইনসের ছবি পাঠাবো।”

“ড..ডিজাইনস?”

“হম। আমি যেই ছবিগুলো পাঠাবো সেগুলো একবার দেখে নিয়ে ওই ক্যাটাগরির নিউ ডিজাইনস আমাকে বানিয়ে দিতে হবে আপনাকে।”

“আমি পারবো না।”

সিয়ারা এক নিশ্বাসে কথাটা বলে ফেললো। সে ভারী নিশ্বাস নিচ্ছে আর মনে মনে যেটা ভাবছে সেটা বলা শুরু করলো আধভিককে।

“তু…আপনি কি ঠিক করেছেন বলুন তো? আমাকে আমার অতীতের মুখোমুখি প্রতিটা মুহূর্তে করবেন তাই তো? এইভাবে প্রতিনিয়ত আমাকে নিজের অতীতের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছেন? বেশ ভালো পথ বেছে নিয়েছেন শাস্তি দেওয়ার। ঠিক যেই জিনিসের মুখোমুখি আমি হতে চাই না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আপনি সেই জিনিসগুলোর সামনেই আমাকে দাঁড় করাচ্ছেন। আমি…

“সিয়ারা প্লিজ!”

আধভিকের কণ্ঠস্বর বদলে যাওয়ায় সিয়ারা থেমে গেলো। হঠাৎ করেই আধভিকের কণ্ঠের স্বর আদেশ থেকে অনুরোধে বদলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে সিয়ারার। সে চুপ করে রইলো আধভিকের পুরো কথা শোনার জন্য।

“আই..আই নিড ইউর হেল্প সিয়ারা। দেখুন, আপনার কথা মতো আমি যদি আপনাকে শাস্তি দিতে চাইতাম তাহলে প্রথম দিনই আপনাকে নিজের কোম্পানিতে নিয়ে আসতে পারতাম আর ডিজাইন করতে বলতাম। আমার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না আপনাকে ডিজাইন করতে বলার কিন্তু আমি একটা সমস্যায় পরেই আপনাকে বলছি।”

“সমস্যা? কি সমস্যায় পরেছেন?”

“অ্যাকচুয়ালি যে এম্প্লয়ীর ডিজাইন দেওয়ার কথা ছিলো সে হঠাৎই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছে। ডিজাইন করার মতো অবস্থা তাঁর নেই। এদিকে আমাদের হাতে সময়ও নেই, ক্লাইন্ট কে পরশু দিনের মধ্যে ডিজাইনগুলো দেখাতে হবে। ইউনিক ডিজাইনস উনি চেয়েছিলেন কিন্তু সেটা হয়তো এই মুহুর্তে পসিবল না। তবে যদি কোনো ডিজাইনসই না দেখাতে পারি তাহলে সেটা খুব বাজে দেখাবে। আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন…

“আমার একটা শর্ত আছে। যদি সেটা মানেন তাহলেই আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি নাহলে আমার কিছু করার নেই।”

“বলুন, কি শর্ত আছে আপনার।”

“আমি আপনাকে ডিজাইনস বানিয়ে পাঠিয়ে দেবো। আপনাকেই সেগুলো প্রেজেনট করতে হবে ক্লাইন্টের সামনে। আমি যেতে পারবো না কারণ..

“কারণ আপনি চান না সুধাংশু বাবু জানুক আপনি আমাদের হয়ে কাজ করছেন। তাই তো?”

“আপনি কীভাবে জানলেন?”

সিয়ারা বেশ অবাক হলো আধভিক ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে দেওয়ায়। আধভিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“আমিও চাই না এখনই কেউ জানুক আপনি আমাদের হয়ে কাজ করছেন। আমি আপনাকে আমার অফিসে আজকে ডাকতেই পারতাম কিন্তু ডাকিনি শুধুমাত্র জানাজানি হবে সেই ভয়ে। ইভেন আপনাদের প্রোডাকশন হাউজ যে আমরা কিনে নিয়েছি সেটাও প্রকাশ্যে যাতে না আসে তার সবরকম চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি। আমি চাই না সুধাংশু স্যারের কোনো রকম অসন্মান বা অপমান হোক। নাহলে আমি আজকে আপনার বাড়িতে গিয়ে কথাটা বলতে পারতাম আর আপনি আমার হয়ে কাজ করতে বাধ্য কনট্র্যাক্ট পেপার অনুযায়ী সেটাও জানিয়ে দিতে পারতাম।”

সিয়ারা নীরব থাকলে আধভিকও নীরব হয়ে যায়। সে জানে সিয়ারার অবস্থাটা এখন কি। সে জানে সিয়ারা নিজের কান্না আটকানোর অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে। আধভিকের ধারণাটা সঠিক প্রমাণ করে দিলো সিয়ারা কিছুক্ষণের মধ্যেই। হালকা ফোঁপানোর আওয়াজ পেলো সে ফোনের অপর পাশ থেকে, সাথে সাথে হাত মুঠ করে চোখ বন্ধ করে নিলো আধভিক।

“আপনি আমাকে ডিজাইনস পাঠিয়ে দিন আমি নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো কমপ্লিট করে দেওয়ার।”

“ওকে, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“থ্যাংক ইউ টা সত্যি কি আপনার বলা উচিত এ. ভি. আর.?”

আধভিক নীরব রইলো। আজ বহুদিন পর সিয়ারার মুখে নিজের শর্ট ফর্মের নাম শুনতে পেলো। সিয়ারাই এই নামের উল্লেখ করেছিলো প্রথম। সিয়ারাকে দেখলেই খালি অতীতগুলো হাতছানি দেয় আধভিককে। বারবার সে অতীতে হারিয়ে যায়। কারণ সিয়ারা যে তাঁর জীবনের সাথে সাথে তাঁর অতীতের সাথেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বাস্তবে সিয়ারা তাঁর ভবিষ্যত হতে না পারলেও কল্পনায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছুই শুধু সিয়ারা। সত্যি সে তাঁর জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তাই তো কিছুতেই ভুলতে পারেনি তাঁকে হাজার চেষ্টার পরেও।

“এ. ভি. আর. আমি আপনাকে আরো কিছু বলতে চাই।”

“হ.. হম! বলুন কী বলবেন। শুনছি আমি।”

“আসলে, আমি এই প্রথম আঙ্কেলের কথায় অভিনয় জগতে পা রাখতে চলেছিলাম। তাই আমি কিন্তু খুব একটা পারদর্শী নই অভিনয়ে। আর মডেলিং? ওরে বাবা ওই জিনিসটা আমার জন্য নয়। তাই প্লিজ, আপনার কাছে আমার একটাই রিকুয়েস্ট আপনি আমাকে মডেল হওয়ার জন্য বলবেন না।”

“আচ্ছা, আর কিছু?”

“আর, আমি প্রায় অনেকগুলো দিন পেন্সিল ছুঁয়ে দেখিনি। তাই হয়তো খুব একটা ভালো ডিজাইন তৈরী করতে পারবো না। তবে চেষ্টা করবো ভালো করার।”

“আর?”

“আর… ক..কিছু না। আর কিছু না।”

“আমি তাহলে রাখি?”

“হ্যাঁ। গুড নাইট।”

“গুড নাইট।”

আধভিক ফোন রেখে দিলে সিয়ারা মনে মনে বলে,

“নিজেকে সংযত কর সিয়া! তোর মনের মানুষ এখন অন্য একজনের স্বামী। আর সেই অন্য একজন টা তোর বোন। নিজের সীমা অতিক্রম করিস না, আজ নিজের ভুলেই তোর এই পরিস্থিতি। নিজের বোকামির জন্য তুই সব পেয়েও হারিয়েছিস। আধভিকের সাথে তোর সম্পর্ক শুধুমাত্র এক বছরের, তারপর আবার যে যার পথে।”

কথাটা নিজেকে ভালো মত বুঝিয়ে দিলো সিয়ারা। একটা নিশ্বাস ফেলে সে বিছানায় গিয়ে চোখ বুজলো। ঘুম আসছে না, কেন জানো অতীতের ভুলগুলো আজ কাল চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে। আগে শুধু রাতে মনে পড়তো কিন্তু এখন তো চোখ বুজলেই মনে পরে। ভীষণ অস্বস্তি হয় ওর, মনে হয় “ইশ! যদি অতীতে গিয়ে নিজের ভুল শুধরে সবটা ঠিক করে ফেলতে পারতাম? কতই না ভালো হতো।” আর ভাবে না এই বিষয়ে। যেই বিষয় নিয়ে ভাবা বৃথা সে বিষয় নিয়ে ভেবে লাভ নেই, এখন ফোকাস করতে হবে নিজের কাজের উপর।

অন্যদিকে,

“সমরেশ বাবু আপনি স্ক্রিপ্ট টা এতো তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলেছেন?”

“কি করবো বলো? পড়া শুরু করতেই কেমন একটা নেশা লেগে গেলো পরবর্তীতে কি হবে তা জানার জন্য। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

“হ্যাঁ করুন না। আপনার কি ভালো লাগেনি স্ক্রিপ্ট টা নাকি কোনো চেঞ্জ করতে হবে?”

“ভালো না লাগার প্রশ্নই ওঠে না। আমি জানতে চাইছিলাম যে, এটা তোমার লেখা তাই না?”

আধভিক নীরব থাকে সমরেশ বাবুর প্রশ্নে। একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব হয় তাঁর বুকের বাম পাশে।

“আমি নিশ্চিত এটা তোমার নিজস্ব লেখা। কারণ তুমি যেই অনুভূতি নিয়ে এটা লিখেছো সেটা তোমার সাথে ঘটেছে বলেও তুমি লিখতে পেরেছো। পড়লেই বোঝা যাচ্ছে যে, তোমার অভিজ্ঞতার অনুভূতি তুমি নিজের লেখায় ফুটিয়ে তুলেছ। অন্তত আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা তো এটাই বলছে আমাকে।”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলছে আপনার অভিজ্ঞতা।”

এতো নীচু গলার স্বর শুনে সমরেশ বাবুর কেমন জানো একটা খারাপ লাগলো। তিনি বুঝতে পারলেন আধভিক কতোটা আঘাতপ্রাপ্ত। কৌতূহলবশত আবার জিজ্ঞেস করে ফেললেন,

“আর কিছু কি করা যেতে পারে না?”

“নাহ। সব রাস্তা বন্ধ। আচ্ছা আমি আপনার সাথে আগামীকাল কথা বলছি। আমার একটা কাজ আছে।”

“আচ্ছা।”

আধভিক কল কেটে ফোনটা রেখে দিয়ে দু আঙুল নিজের কপালে চেপে ধরে চোখ বুজে। কিছুক্ষণ পর, ঘুমাতে যাওয়ার ডাক পরলে সে চোখ খুলে সজোরে একটা বারি মারে টেবিলে আর বলে ওঠে,

“কেন তুমি ফিরে এলে? কেন? তুমি ফিরে আসার পর থেকে প্রতিটা মুহুর্তে আমার সাথে যা ঘটছে তার অধিকাংশ তোমার সাথে রিলেট করতে পারছি। অনেক কষ্টে এই জিনিসটা থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম আমি কিন্তু সেই সময়ই তুমি ফিরে এলে। কেন সিয়ারা? আমাকে কি শান্তিতে বাঁচতে দেবে না তুমি? ফেড আপ হয়ে গেছি আমি, জাস্ট ফেড আপ হয়ে গেছি।”

আধভিক চোখ বুজে নিজের চেয়ারে পিছন দিকে মাথা এলিয়ে দেয়। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে ওর। মাথা যন্ত্রণা করছে তাই আবারও আঙুলটা কপালে রেখে ডলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই অনুভব করে কেউ ওর মাথাটা টিপে দিচ্ছে। আধভিক নিজের হাত নামিয়ে দেয় আর হালকা হাসে। নিমিষে ঘুমিয়ে পরে।

এদিকে,

সিয়ারা নিজের হাতে একটা খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। কিছুতেই ঘুম না আসে হঠাৎ ওর এই খাতাটার কথা মনে পরে। সঙ্গে সঙ্গে খুঁজতে আরম্ভ করে আর বেশ কিছুক্ষণ পর পেয়েও যায়। সবকটা পেজ দেখা শেষে খাতাটা বন্ধ করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে খাতাটাকে সিয়ারা। চোখ বন্ধ করতেই চোখ দিয়ে জল গাল গড়িয়ে পরে। সে বলে ওঠে,

“এটাই তো আমার স্বপ্ন ছিলো। আমি জানতাম এটা কখনও পূরণ হবে না তাই অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। নিজের সবটুকু দিয়ে বোনের স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করছিলাম। আর সেই সময়েই তুমি এলে আমার জীবনে আধভিক। না না, আমি তোমার জীবনে ঢুকে পড়েছিলাম। ভুল করে! কিন্তু এই ভুলটা যদি না করতাম তাহলে প্রেমিকের ভালোবাসা ঠিক কি? সেটা বুঝতাম না।”

কিছুক্ষণ কাঁদার পর একটু নিশ্বাস নিয়ে সিয়ারা আকাশের দিকে চেয়ে অভিযোগ করলো,

“এমনটা কেন করলে মা? কেন এভাবে আমার থেকে সবটা কেড়ে নিলে? নিজের সবটা আমি তোমাকে আর বোনকে উজাড় করে দিয়েছিলাম, কখনও নিজেকে নিয়ে ভাবিনি। তাহলে কেন তুমি আমাকে নিয়ে একটু ভাবতে পারলে না? দিনের পর দিন এইভাবে মরণ যন্ত্রণা সহ্য করার দিকে আমাকে ঠেলে দিতে পারলে? নিজের চোখে নিজেকে অপরাধী বানিয়ে দিলে আমায়? কীভাবে করতে পরলে তুমি এটা আমার সাথে? কীভাবে?”

সিয়ারা ছুটে ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলো ও।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
কথা দিলাম 🌸❤️
||পর্ব ~ ৭||
কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

“আধভিক বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু? ছাড়ো আমাকে।”

“একদমই না। আগে আমি যেটা করতে বলছি সেটা করো নাহলে ছাড়বো না।”

“উফ! ঠিক আছে, কি করতে হবে?”

“ওয়েট! ওকে এইবার বলো যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো।”

“কি? ইম্পসিবল! পারবো না।”

“ফাইন, আমিও ছাড়বো না তাহলে।”

“উফ, কি জ্বালায় পড়লাম। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। হয়েছে? এবার ছাড়ো!”

“উহুম! কথা দাও, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না। সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসবে আমাকে।”

“কথা দিলাম!”

ফোনটা বেজে উঠলো আধভিকের। স্ক্রিনে চলতে থাকা ভিডিও টা পজ হয়ে গেছে ফোন আসায়। পপ আপ নোটিফিকেশনে দেখা যাচ্ছে “সিয়ারা” নামটা। আধভিক ফোনটা রেখে দিয়ে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন এলে আধভিক হাত সরিয়ে একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে।

“বলুন।”

“গুড মর্নিং এ.ভি.আর.।

“গুড মর্নিং!”

“আব, আমি কয়েকটা ডিজাইন পাঠিয়েছি মেইলে। একবার দেখবেন? সব কটা ক্যাটাগরি থেকে একটা একটা ডিজাইন ড্র করেছি। ঠিক হলে আর গুলো শুরু করবো।”

“আমি দেখে জানাচ্ছি আপনাকে।”

আধভিক ফোনটা রেখে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলে ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে। হঠাৎ করেই ফোনে তারিখটার দিকে চোখ যায় আধভিকের। আবারও সিয়ারার কথা মনে পরে যায় ওর। এই দিনটা অনেক বিশেষ আধভিকের কাছে, এখনও। এক চিলতে হেসে ফোনে গ্যালারি ওপেন করে সিক্রেট ফোল্ডারে চলে যায় আধভিক। একটা ভিডিও ওপেন করে দেখতে থাকে। ভিডিওটা ঠিক কয়েক বছর আগের এই দিনে বানানো, সিয়ারার সাথে। আধভিক উঠে বসে চোয়াল শক্ত করে বলে,

“কথা রাখোনি তুমি সিয়ারা। মিথ্যে বলেছো আমাকে। অনেক বড়ো আঘাত দিয়েছো। দিনের পর দিন মরণ যন্ত্রণার মধ্যে রেখে দিয়েছো।”

আধভিক নিজের ফোনের মেইল বক্স চেক করে দেখে সিয়ারার মেইল আইডি থেকে পিডিএফ এসেছে। সে পিডিএফটা ওপেন করে পুরোটা দেখতেই হাসে।

“যাক, তোমাকে আবার তোমার স্বপ্ন পূরণের রাস্তায় নিয়ে আসতে পারলাম তাহলে? আমার মাথায় কখনও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আসেইনা। কেন জানো? তুমি কষ্ট পেলে আমি তার দ্বিগুণ কষ্ট অনুভব করি। আমি শুধু চাই তুমি সত্যির মুখোমুখি হও। তারপর সারাজীবনের মতো হারিয়ে যাবো তোমার জীবন থেকে।”

আধভিক “অলরাইট” টেক্সট করে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এদিকে সিয়ারা নার্ভাস হয়ে ঘরে পায়চারি করছে আর ফোন দেখছে। বারবার রিফ্রেশ করছে এই বুঝি আধভিক রিপ্লাই করলো। অবশেষে আধভিকের রিপ্লাই পেতে আনন্দে নেচে উঠলো সে। ফোনটা দু হাতে ধরে মুখের সামনে নিয়ে একটা চুমু খেলো তারপর বিছানায় গিয়ে সোজা হয়ে হাত ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণ পর ফোনটা চোখের সামনে এনে কল কিপ্যাডে গিয়ে কোড নাম্বার টাইপ করতেই সিক্রেট ফোল্ডার খুলে গেলো।

“এই দিনটার কথা আমি ভুলিনি। কখনও ভুলতেও পারবো না। তোমার একেকটা ছেলে মানুষীর কথা আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। কতটা বদলে গেছো এখন তুমি। কয়েক বছর আগের আধভিকের সাথে এখনকার আধভিকের কোনো মিল নেই। অবশ্য আমিই দায়ী এর জন্য। আজ যদি উপায় থাকতো তাহলে আমি আবার চেষ্টা করতাম তোমাকে আগের মতো করে তোলার কিন্তু এখন আমাদের পথ আলাদা।”

সিয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসে। ফোন রেখে নিজের ডেস্কে বসে ড্র করা শুরু করে। দুটো ডিজাইন ড্র করে আড়মোড়া ভাঙে। তারপর উঠে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পরে। গত রাতে ঘুম না আসায় ড্র করে ফেলেছিলো প্রত্যেকটা ক্যাটাগরি থেকে একটা করে ডিজাইন। এখন ভীষণ টায়ার্ড লাগছে তাই না শুলে হবে না।

পরেরদিন,

“সিয়ারা? ফোন কেন ধরছিলেন না? আমি কখন থেকে ফোন করছি জানেন?”

“স্যরি, আমি একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”

“হোয়াট? আপনি, আপনি ঘুমিয়ে পরেছিলেন? লাইক সিরিয়াসলি? আপনি কি কখনও কোনো কিছু সিরিয়াসলি নিতে জানেন না?”

“আমি…

“আমি আর আপনার থেকে কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমারই ভুল যে আমি আপনাকে আবার বিশ্বাস করেছি। আপনাকে হেল্প করতে না বলে অন্য কাওকে বললে সে এটলিস্ট চেষ্টা করতো কাজটা কমপ্লিট করার। এভাবে আপনার মতো নিশ্চিন্তে পরে পরে ঘুমাতো না। শিট!”

“আপনি একবার…

“একবার? বারবার বিশ্বাস করলেও, সুযোগ দিলেও পরিণাম একই থাকবে। কারণ এটা আপনি মিসেস সিয়ারা। যে কি না বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে জানে না। আরো একবার আমাকে সবার সামনে ছোটো হতে হবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বারবার আমায় অপদস্ত করার জন্য। আমি তো এটাই ডিজার্ভ করি আপনার থেকে এতকিছুর পরেও।”

আধভিক রেগে কল কেটে ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলে। আর এক ঘণ্টা পর ওর মিটিং ক্লাইন্টের সাথে। কিন্তু কি মিটিং সে করবে? মিটিংয়ে কি দেখাবে? ডিজাইনই তো রেডি নেই। সকাল থেকে সিয়ারাকে সে সমানে টেক্সট, কলস করেই গেছে কিন্তু কোনো রেসপন্স আসেনি। তখন তো ওর ভয় উঠে গেছিলো, এইভেবে যে সিয়ারার কোনো ক্ষতি হয়নি তো? কিন্তু নাহ? সে কি জানতে পারলো? সিয়ারা ঘুমাচ্ছিলো। অসহ্য হয়ে সে বিছানায় বসে পরলো কপালে দু আঙুল রেখে। ভাবতে লাগলো, একটু বেশিই কি বলে ফেললো সিয়ারাকে? সেই সময় হঠাৎ করে নোটিফিকেশন সাউন্ড কানে আসে ওর। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মেইল এসেছে। মেইল বক্স ওপেন করে দেখে সিয়ারা পিপিটি পাঠিয়েছে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে সেটা ওপেন করতেই আধভিক স্তব্ধ হয়ে যায়।

“ওহ গড! এটা আমি কি করলাম? ওর কথা না শুনেই এতো কিছু শুনিয়ে দিলাম ওকে? আমি সিওর ও গতকাল সারাদিন ডিজাইন বানিয়ে গেছে। নাহলে এতগুলো ডিজাইন কমপ্লিট করা সম্ভব নয়। আমি ওকে বলেছিলাম সব করতে হবে না বাট ও নিজের বেস্টটা দিয়ে যত কটা ডিজাইনস দরকার সবটা করেছে। আর আমি কি না এতগুলো কথা শোনালাম ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে?”

আধভিক সাথে সাথে কল করে আবার সিয়ারাকে। কিন্তু ফোনটা সুইচ অফ! খারাপ লাগে আধভিকের। সে জানে সিয়ারা খুব কষ্ট পেয়েছে। এভাবে অতীত টেনে কথাগুলো না শোনালেও পারতো সে। কিন্তু সে’ই বা কি করবে? তাঁর ভিতরেও তো এতদিনের জমা কষ্টগুলো ঘুসছে।

“মিটিংয়ের পর একবার কল করতে হবে ওকে। ততক্ষণ না হয় নিজেকে একটু টাইম দিক।”

আধভিক অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়। একজন মডেলকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। ডিজাইন পছন্দ হলে মডেলও উনি ওদের কোম্পানি থেকে চুজ করতে পারেন।

“ড্যাড আজকে তুমি প্রোডাকশন হাউজে চলে যাও। আমাকে একটু জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে।”

“ঠিক আছে সাবধানে যা। বেস্ট অফ লাক!”

আভাস বাবুকে বলে আধভিক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ হবে ততো তাড়াতাড়ি সে সিয়ারার সাথে কথা বলতে পারবে। অফিসে যেতে যেতে আরেকবার ফোন করলো সে সিয়ারাকে কিন্তু সুইচ অফ বলছে এখনও।

অন্যদিকে,

সিয়ারা শুয়ে রয়েছে চুপচাপ। চোখের জলে বালিশটা ভিজে গেছে। দরজায় টোকা পরলে চোখ মুছে উঠে বসে ও।

“কে?”

“আমি! কি ব্যাপার? আজ ঘর থেকে বেরোসনি যে? কিছু হয়েছে?”

দেবাংশু ঘরে ঢুকে এলে সিয়ারা চুপ করে বসে থাকে। দেবাংশু বুঝতে পারে সিয়ারার মন খারাপ। কিন্তু কি নিয়ে সেটা বুঝতে পারে না। এই মুহূর্তে জানতে চাওয়া ঠিক হবে না ভেবে কথা ঘুরিয়ে সে বললো,

“এভাবে মুড অফ করে বসে থাকিস না। রেডি হয়েনে। বেড়াবো।”

“কোথায়? আজকে না দেব। আজকে…

“আমি বাড়তি কোনো কথা শুনতে চাই না। যেটা বলেছি সেটা কর। চুপচাপ রেডি হয়েনে নাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আজ অনেকদিন পর বেড়াবো আমরা।”

সিয়ারা ভাবলো মানা করাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া ওর মনটাও একটু ভালো হবে হয়তো বেরালে। তাই রেডি হতে চলে গেলো দেবাংশুর কথা মতো। রেডি হওয়ার পর সুধাংশু বাবুকে বলে দেবাংশু আর সিয়ারা বেড়িয়ে গেলো। একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট-এ ওরা গেলো যেখানে সেলিব্রিটিদের বেশি আনাগোনা। একটা টেবিলে বসে, আশেপাশের পরিবেশটা সিয়ারা উপভোগ করতে লাগলো। হালকা সফট মিউজিক বাজছে যার কারণে আরো বেশি ভালো লাগছে সিয়ারার।

“একটু হলেও কি মন ভালো হয়েছে ম্যাডাম?”

দেবাংশুর কথায় সিয়ারা কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগলো। দেবাংশু সেটা বুঝে হেসে ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,

“আমাদের সম্পর্কটা আমি সহজ করতে চাই সিয়া। আগে আমি তোর ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে চাই। দরকার পরলে সারাজীবন তোকে বন্ধু হিসেবেই আগলে রাখবো, সে সম্পর্কের নাম যাই হোক না কেন।”

সিয়ারা দেবাংশুর মুখের দিকে তাকালে দেবাংশু হালকা হেসে চোখ দ্বারা সম্মতি জানালে। সিয়ারাও হালকা হাসে কিন্তু পরক্ষণেই ওর হাসি মলিন হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সিয়ারার নজর দেবাংশুর উপর থেকে সরে পিছন দিকে গেলেই ও দেখতে পায় আধভিক বসে আছে। আধভিকের বিপরীতে একটি মেয়ে বসে আছে যার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সিয়ারা কারণ মেয়েটি ওর দিকে পিছন দিক হয়ে বসে আছে ঠিক যেমন দেবাংশু আধভিকের থেকে পিছন দিক হয়ে বসে আছে।

“এ..এটা তো..??”

সিয়ারা কেমন জানো স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চিনতে পেরেছে মেয়েটি কে। কেন চিনতে পারবে না? ছোটো থেকে যাকে বড়ো হতে দেখেছে, তাকে চিনতে না পারলে হয়? এতো ওর বোন! আধভিকের সাথে ওর বোনকে বসে থাকতে দেখেও সিয়ারা তাকিয়ে থাকে আধভিকের দিকে। আধভিক নিজের মনে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে।

“তাহলে কি আধভিক আর বোনের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই?”

এটা ভাবতে ভাবতেই দেবাংশু সিয়ারার গালে হাত দেয় আর সিয়ারার নাম ধরে ডাকে। সিয়ারা দেবাংশুr দিকে তাকালে দেবাংশু বলে,

“কাজল গালে কীভাবে গেলো তোর? এতক্ষণ তো দেখিনি?”

“কই?”

“আব নাহি হেইন হামকো অ্যাসে জীনা
তেরা হোকে ভিনা তেরা হোনা”

হঠাৎ করেই সিয়ারার নজর আবার আধভিকের উপর পরে। এইবার আধভিকও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

“তুমসে মহাব্বত হেইন হান,
তুমসে মহাব্বত হেইন হান,
বাস তুমসে হান, তুমসে হি হান।”

“হ্যা আগার মহাব্বত তো আখোন সে কেহদে,
শুনু মেইন দিল কি ইয়ে মানু ভি ক্যায়সে?
হ্যা মান তুঝি মেইন মাগার চাহ কে ভি,
ইয়ে হাথ থামু তো থামু ভি ক্যায়সে?”

“ইয়ুন দূর জাকে ক্যায়া ভুল পাওগে?
বাতেন হামারি ক্যায়া ভুল পাওগে?
হাম তো তারাস্তে হেইন, রোকে ভি হাসতে হেইন,
যো দিল আওয়াজ দে ক্যায়া লউট পাওগে?”

সিয়ারা উঠে বেড়িয়ে যায় ওখান থেকে। হঠাৎ সিয়ারার আচরণে দেবাংশু থতমত খেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না সিয়ারা হঠাৎ করে এভাবে কেন উঠে চলে গেলো। বেশি না ভেবে দেবাংশু সিয়ারার পিছনে চলে যায়। অপরদিকে আধভিক নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণ আগে দেবাংশুর গলায় সিয়ারার নাম শুনে আধভিকের নজর সামনের দিকে গিয়ে পরে। সে দেখে সিয়ারার গালে হাত দিয়ে রেখেছে দেবাংশু। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলেও সে একভাবে তাকিয়ে থাকে সিয়ারার দিকে। ঠিক সেই সময় মিউজিক সিস্টেমে গানের লাইনগুলো বেজে উঠলে সিয়ারাও তাঁর দিকে তাকায়। হয়তো তাঁর মতো সেও মিল পেয়েছে তাঁদের পরিস্থিতির সাথে এই গানটার একেকটা লাইনের। আধভিকের তো এটাই ধারণা, এই গানটা তাঁদের জন্যেই তৈরী হয়েছে। আধভিকের হুঁশ ফেরে ক্লাইন্টের ডাকে। সে এখানে এসেছে ক্লাইন্টের সাথে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here