কল্পকুঞ্জে কঙ্কাবতী পর্ব -০৩

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩|

হাতে কফির মগ নিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছি। মেজাজ আমার সপ্তম আকাশ ছুঁয়েছে। আমাদের বাসায় চারটা বেডরুম। একটা আব্বু-আম্মুর, একটা আমার আর আপির, একটা গেস্ট রুম ও অন্যটা কুঞ্জ ভাইয়ের। নিজের বাসার চেয়ে মহারাজের এ বাসায় থাকতে বেশি ভালো লাগে। ঠিক সেই কারণেই ওঁর জন্য এ বাসায় বরাদ্দকৃত একটা আলাদা রুম রয়েছে।
আজ এখানেই থাকবেন উনি। গোগ্রাসে জামাই আদর গিলবেন। এমনিতেই আমার মেজাজ চোটে আছে, তার উপর আবার আমার জন্মসূত্রের আম্মাজান আমাকে কুঞ্জ ভাইয়ের জন্য কফি দিতে ওঁর রুমে পাঠাচ্ছেন। মায়ের বাধ্য মেয়ে কি না! না বলতে পারিনি।

হাজার খানেক ভাবনা নিয়ে রুমের ভিতর পা বাড়ালাম। দরজা নক করতে মনে নেই। সোজা ঢুকে পড়লাম। দেখলাম, কুঞ্জ ভাই ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। উনি ল্যাপটপে কিছু একটা করছেন। হাত কী-বোর্ডের উপর। তাই ফোনটা স্পিকারে দেওয়া। ওঁদের কথা বার্তা এরকম ছিল—

“ভাই, তুমি যেতেই আবারও ঝামেলা লেগে গেছে। আসবা কবে?”

কুঞ্জ ভাই জবাব না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোরা সামলাতে পারবি না?”

“পারব, কিন্তু…”

“কী?”

“ওরা বাড়াবাড়ি করছে।”

“আপাতত সামলে নে। বাকিটা আমি ফিরে দেখব। শালাদের পাঙ্খা গজিয়েছে!”

কথাটা বলার পরপরই দরজার সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বললেন, “দু’দিন আর ডিস্টার্ব করবি না। যদি একটা কলও পাই, তবে তোকে ভার্সিটির সব মেয়েদের সামনে শাড়ি পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখব। বুঝলি?”

অপর পাশের উত্তরের আর অপেক্ষা করলেন না। কল কেটে দিয়ে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমার মতো সিঙ্গেল অ্যান্ড ভার্জিন ছেলের ঘরে নক না করে ঢোকার মানে কী, নবু? বাই এনি চান্স, আমাকে বেইজ্জতি করার ফন্দি আটিসনি তো?”

শেষ বাক্যটি বলতে বলতেই ল্যাপটপ পাশে রেখে, অপর পাশ থেকে কাঁথা তুলে গলা অবধি জড়িয়ে ফেললেন। আমি হা হয়ে গেলাম। আবার শুরু হলো! একটু আগেই না সিরিয়াস মুডে ছিলেন! কতটা গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন! এত জলদি একটা মানুষের কণ্ঠস্বরের এমন পরিবর্তন কী করে হয়? এটা মানুষ না। আমি নিশ্চিত কুঞ্জ ভাই, আপনি গিরগিটি!

পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। কফির মগটা দিয়েই কেটে পড়ব। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকার কোনো মানে নেই।
সেই উদ্দেশ্যেই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, “আপনাকে বেইজ্জতি করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আম্মু কফি দিতে পাঠিয়েছিল, সেটাই দিতে এলাম। নয়তো এই নবনী আপনার ছায়াও না মাড়ায়, মি. ফাহিম কুঞ্জ!”

উনি চোখ বড়ো বড়ো করে কাঁথাটা আরও শক্তকরে চেপে ধরে বললেন, “একদিনেই নামের পাশের ভাই ট্যাগটা সরিয়ে ফেললি তুই? একটু আগে মজা করে বললেও এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, নবু। তুই কফির সাথে অ্যালকোহল মেশাসনি তো! না মানে আমার…”

আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললাম, “না। বিষ মিশিয়েছি। খান, খেয়ে মরে যান।”

“তোর উপর বিশ্বাস নেই। মেশাতেও পারিস। কিন্তু এতে তো তুই বিয়ের আগেই বিধবা হবি।”

“হলে হব।”

“পাষাণ নবু!”

আমি কণ্ঠভরা বিরক্তি নিয়ে বললাম, “কিছু মেশাইনি, কুঞ্জ ভাই। নিন না!”

“না, নবু। না। তুই নির্দয় হলেও আমার হৃদয় অনেক বড়ো। তোকে বিধবা করতে চাই না।”

“সত্যি বলছি, এতে কিছু মেশাইনি।”

“তোকে বিশ্বাস করি না। আমার মরার পর আমার একমাত্র বউটার উপর কোনো অনাচার হোক, তা আমি হতে দেব না। ভুলে যাস না নবু, তোর হবু বর ভীষণ সচেতন। আগে এই কফি তুই খাবি।”

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, “ব্যাস! অনেক হয়েছে। আপনার খেতে ইচ্ছে হলে খান। নয়তো ফেলে দিন। আমি আপনার কথা শুনতে পারব না। আসলে শুনব না। না মানে না। ’ন’-আকার না। বুঝলেন?”

আমার কথা শুনেই উনি কাঁথা সরিয়ে ফোন হাতে নিলেন। ভ্রু-কুঁচকে ফেললাম আমি। ফোনে কিছু একটা বের করেই আমার দিকে ধরলেন। কলেজের সেই ভিডিয়োটা!

আমি মেকি হেসে বললাম, “আরে, কুঞ্জ ভাই! মাইন্ড খাচ্ছেন কেন? খাচ্ছি তো আমি। না মানে গিলছি! কফি! আহা! এই কফিটা খাওয়ার জন্য তো আমি মরেই যাচ্ছিলাম। আমাকে এটা দিয়ে ধন্য করার জন্য আপনাকে এভারেস্ট সমান ধনেপাতা।”

কুঞ্জ ভাই বাঁকা হেসে বললেন, “দে, ধনেপাতার ব্যবসা করব। আমি হব ধনেরাজা আর তুই হবি আমার ধনেরানি। একসাথে একটা ধনেবংশ তৈরি করব। ঠিক আছে?”

আমি নির্লিপ্ত রইলাম। ওঁর থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়!
কুঞ্জ ভাই হাই তুলতে তুলতে বললেন, “এটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তোর বকবকানির জন্য। যা, নতুন করে বানিয়ে আন।”

আমি কিছু না বলেই বের হয়ে গেলাম। এখানে কিছু বললে আরও কথা শুনিয়ে দেবেন। রান্নাঘরে এসে দেখলাম আম্মু সবকিছু গোছাচ্ছে। আমার আগমনের আভাস পেয়ে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিয়ে বলল, “কফি দিতে যাসনি?”

আমি মনে মনে কুঞ্জ ভাইকে গালি দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। আম্মুর কথা শুনে জোরপূর্বক হাসলাম। কুঞ্জ ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটা শব্দও আম্মুকে বলা যাবে না। যদি বলি, তবে আম্মু বলবে, “তোরা বাপ-বেটি আমার বাপের বাড়ির লোকদের সহ্য করতে পারিস না, তাই না? ওমন চান্দের টুকরো ছেলেকে নিয়ে এমন বানোয়াট কথা বলতে তোদের বিবেকে বাঁধে না?”

এভাবে শুরু হবে আম্মুর কথা, শেষ হবে আমার ফোনের টপিকে এসে। তাই আর ওঁর বিরুদ্ধে কিছু না বলে বললাম, “উনি কিছু কাজ করছিলেন, আম্মু। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। নতুন করে বানিয়ে দাও তো!

আম্মু বরাবরের মতোই বলল, “দেখেছিস? কয়েকমাস পর বাসায় এসেছে ছেলেটা। এসেও কাজ! এই বয়সেই আমার ভাতিজা লেখা পড়ার পাশাপাশি নিজের খরচ নিজে মেটায়; বাসা থেকে এক টাকাও নেয় না। উলটো ভাবিকে মাঝে মাঝে কেনাকাটা করে দেয়। ঐ ছেলের নখেরও যোগ্য না তুই, আবার আসিস ওর বদনাম করতে!
সারাদিন ম্যা ম্যা ছাড়া আর পারিস কী করতে? যা! ছেলেটা যাওয়ার আগে ওর পা ধোয়া পানি খাবি। খেতেই হবে। তাও যদি তোর আক্কেল-জ্ঞান হয়!”

আমি আম্মুর কথাগুলো শুনেও শুনলাম না। সয়ে গেছে এসব। এ বাসায় আমার দাম ভালো করেই জানা আছে। ঐ যে! ব্রয়লার মুরগি! ঐ মুরগির দামও বাড়ে। কিন্তু আমার! এক আনাও না। ছ্যাহ্! ছ্যাহ্! ছ্যাহ্! অকর্মা নবু!
এই বাসায়, দিনের শুরুতে আম্মুর চিল্লানো শুরু হয় বাবার কারণে আর শেষ হয় আমাদের দু’বোনের ফোন ঘাটাঘাটিতে এসে। আহা! আমি বেচারি!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আম্মুকে বললাম, “তোমার চান্দের লাহান পিতলার পাতিলডার কফিখানা বানিয়ে দাও।”

আমার সহজ-সরল আম্মু এই জটিল কথাটা না বুঝে বলল, “আমি নামাজ পড়ব। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকিস, কফিটা অন্তত বানা।”

আবারও অপমানস! আমি হতাশ নিশ্বাস ফেলে কফি বানিয়ে নিয়ে গেলাম। এবার আর দরজায় নক করতে ভুললাম না।

দরজায় করাঘাত করে বিষাদে ভরা হাসি দিয়ে বললাম, “আসতে পারি, কুঞ্জ ভাই?”

কুঞ্জ ভাই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার ডাকে পিছু মুড়লেন। পরনে অ্যাশ কালার টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার। টিশার্টটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। চুলগুলো হালকা ভেজা। সন্ধ্যায় শাওয়ার নিয়েছিলেন, এজন্য। সত্যি বলতে, ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওঁকে। আচ্ছা! এই মানুষটা সবসময় এমন শান্ত-শিষ্ট হয়ে থাকতে পারেন না? উনি কি জানেন, এভাবে ওঁকে ঠিক কতটা সুন্দর লাগে! খুব বলতে ইচ্ছে হয়, চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগে এভাবে আপনাকে, কুঞ্জ ভাই।

আমাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুঞ্জ ভাই লাজুক হেসে বললেন, “পারমিশন নেওয়ার কী আছে, নবু? যেখানে আমি নিজেই তোর, সেখানে অটোমেটিকালি আমার সব কিছু তোর। আমার লাইফের মতো হুট-হাট সব জায়গায় চলে আসার অনুমতি তোর আছে, বুঝলি?”

অন্য সময় হলে হয়তো কুঞ্জ ভাইয়ের এমন আবেগী কথায় আমি প্রভাবিত হতাম, মুচকি হাসতাম, লজ্জা পেতাম। কিন্তু এখন আমার এরকম অনুভূতি হচ্ছে না। আগেরবারই তো বিনা পারমিশনে আসার জন্য কী কী কথা শুনিয়ে দিলেন! আর এখনই! কালই গিয়ে মণিকে বলব, তার ছেলের মাথার সবগুলো তার ছিঁড়ে গেছে। তার ছেলে একটা তারছিঁড়া।

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সোজা গিয়ে জানালার ধারে, কুঞ্জ ভাইয়ের পাশে দাঁড়ালাম। ওঁর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিতেই উনি ভ্রু-কুঁচকে বললেন, “তোকে দিয়ে বিশ্বাস নেই, নবু। আগে তুই টেস্ট করবি।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। চা-কফি খেতে পারি না আমি। প্রতিবারই জিভ পুড়ে যায়। তাই জোড়ে জোড়ে ফুঁ দিতে লাগলাম। কুঞ্জ ভাই এক দৃষ্টিতে আমার কাহিনি দেখছেন। আমি সেটা বুঝতে পেরে ফুঁ দেওয়া বন্ধ করে হালকা কেশে বললাম, “জানেন? কফির জায়গায় আপনি থাকলে, এই জানালা দিয়ে পড়ে যেতেন।”

কুঞ্জ ভাই ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তোর ফুঁ-তে এত দম! ইন্টারেস্টিং! দে। ফুঁ দে।”

আমি এবার কফির মগটা জানালার পাশের টেবিলে রেখে ওঁর মুখশ্রীতে ফুঁ দিতে লাগলাম। উনি চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। ঠোঁটের কার্নিশ হালকা বেঁকে আছে। আচ্ছা! উনি কি হাসছেন? এত সুন্দর লাগছে কেন ওঁকে?
কুঞ্জ ভাই! আপনার সবগুলো রূপ এরকম কেন? আলাদা কেন? আপনার মুখ চলার সঙ্গে সঙ্গে আমার রাগ আকাশ ছুঁয়ে যায়। আপনি দু’চোখ বন্ধ করে নিলে শীতল এক হাওয়া আমার বক্ষে ঝড় তুলে দেয়। কেন, কুঞ্জ ভাই? কেন? এখন ইচ্ছে হচ্ছে, আপনার এই স্নিগ্ধ মুখখানা ছুঁয়ে দিতে।
মনে মনে এসব ভেবে সেই উদ্দেশ্যেই হাত বাড়ালাম। তৎক্ষনাৎ কুঞ্জ ভাই চোখ খুললেন। আমাকে নিজের এতটা কাছে দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দূরে ছিটকে গেলেন।

আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বললেন, “তোর প্ল্যান আমি ধরতে পেরেছি, নবু। আমার আম্মুর এই বয়সেও এত ইয়াং আছে বলে তোর জ্বলছে। তাই এখনই তাকে দাদি বানানোর ধান্দা, না? ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ। আমার তেইশ বছরের ভার্জিন উপাধিটা আমি তোকে ছিনিয়ে নিতে দেব না। কখনও না। ওগো! কেউ আছ? এই লুচু মহিলা আমার সর্বনাশ করে দিচ্ছে। বাঁচাও। বাঁচাও।”

আমি বরাবরের মতই হা হয়ে গেলাম। আমি স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! আমি লুচু মহিলা? আর কী কী শুনতে হবে আমায়!

চলবে…

[বিঃদ্রঃ আগামি পর্ব রবিবার পাবেন❣️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here