কাছে দূরে পর্ব ৪১

#কাছে_দূরে 💕
#moumita_meher
#পর্ব___৪১

আজিম সাহেব তেতে উঠে বললেন,

—-‘ সাবাব! মনিকা ঠিকই তো বলছে। এভাবে বিয়ে করবো বললেই তো বিয়ে করা যায় না। আর একা তোমার মতই যথেষ্ট নয়। হীর কি বলে সেটাও তোমার শুনে নেওয়া উচিৎ।’

হীর স্বাভাবিক সেন্সে নেই। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে সাবাবের মুখের দিকে। সে তো তখনই হতভম্ব হলো যখন সাবাব বলল, ‘আগে তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। সত্যি কি একটা বিয়ে চাইলেই এভাবে হওয়া সম্ভব?

সাবাব বাবার কথায় অবাক হচ্ছে না। কারন তার বাবা বরাবর বড় অদ্ভুত। তার বাবা খুব ভালো করেই জানে সে হীরকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে কখনও কাছে টানবেনা। এমনকি ঐ নজরেও কখনও দেখবেনা তবুও সে মানছেনা। তবুও সে মানবেনা হীরকে তার ছেলে ভালোবাসে। সেই ছোট থেকেই।

মনিকা কন্ঠে অধিকার বোধ এনে বলল,

—-‘ আমি মানবো না এই বিয়ে। তোমার আর হিরের কিছুতেই বিয়ে হতে পারেনা।’

সাবাব ভাবলেশহীন ভাবে তাকালো মনিকার দিকে। যেন মনিকা নিজের গলায় ছুরি ধরেও যদি বলে,’তুমি হীরকে বিয়ে করবেনা’ তবুও তার কিছু যায় আসেনা। মুলত সাবাব মনিকাকে পাত্তা দিচ্ছে না। মনিকা ভেতর থেকে ফুঁসতে লাগল। সাবাব হঠাৎ এমন কোনো প্ল্যান করে ফেলবে তা মনিকা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। না ভাবাটাই স্বাভাবিক। সাবাব যে ধরনের ছেলে তাতে সে হঠাৎ করে বিয়ে করার কথা কিছুতেই ভাববেনা। প্রথমত তার বাবার বিশাল সম্মানের কথা ভাববে। বাবার সম্মান বাঁচাতে দায়ে পড়ে হলেও সে এমন কাজ কোনোদিন করতেই পারেনা। তবুও কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলো সাবাব? অতিরিক্ত চাপ মনিকা নিতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে এখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলতে। যাতে করে সব কটা একসাথে মরে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই মনিকা পারছেনা। রাগান্বিত হয়ে বা থ্রেড দিয়েও সে কিছু বলতে পারবেনা সাবাবকে। কারন সাবাব চাইলেই মারাত্মক কেসে ফাঁসিয়ে দিতে পারে তাকে। ভয় ভয় ভয়। সব দিক থেকে ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে সে। শিলা আন্দাজ করে করতে পারলো মনিকার মনের দহন। সে মনিকার পেছনে এসে চুপটি করে দাঁড়ালো। মনিকা রাগের বসে যা খুশি করে ফেলতে পারে বলে তার ধারনা। যদি এমন কিছু করেও ফেলে সে যেন আঁটকাতে পারে তাকে।

—-‘ মা।’

সাবাব হীরকে নিয়ে নাজমা বেগমের সামনে দাঁড়ালো। মা বলে ডাকতেই মলিন মুখে তাকালেন নাজমা বেগম। ছেলের গালে হাত রেখে স্নেহ ভরা কন্ঠে বললেন,

—-‘ মা তার ছেলেকে ভুল বুঝবেনা। মা চায় তার হীরপরী যেখানেই থাকুক আর যার সাথেই থাকুক যেন সবসময় ভালো থাকে। সুখে থাকে। কোনে বিপদ যেন তাকে ছুঁতে না পারে। কোনো বিপদ তাকে ছোঁয়ার আগে যেন তাকে আগলে রাখা বটগাছটার ছায়া মাড়তে হয়। পারবি তো আমার পরীটার রক্ষাকবচ হতে?’

সাবাবের চোখ ভিজে উঠলো মায়ের মতো। সে মায়ের হাতটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলল,

—-‘ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মা। মা, বাবাই আর ছোট মাকে তো কোনো দিন ফিরে পাওয়ার সম্ভব নয়। আর তাদের সামনে থেকে প্রমিজ করাও সম্ভব নয় তাই তোমাকেই বলছি। তুমিই তো ছিলে তাদের মাথার উপর। বটগাছের মতো ছায়া দিয়েছো তাদের। সব থেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছো। নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে সবসময় দু’জনকে আগলে রাখতে চেয়েছো। আমি জানি এবং বিশ্বাস করি মা, তোমার থেকে বেশি ভালোবেসে আগলে রাখা এবং তাদের সাপোর্টার কেউ ছিলো না। আর আমারও সব থেকে বড় সাপোর্টার তুমি মা। জানি, বাবাই এবং ছোটমার মতো একই ভাবে তুমিও আমাদের আগলে রাখবে।’

নাজমা বেগম চোখে জল নিয়ে হেসে উঠলেন। ছেলের দুগালে হাত রেখে কপাল নুইয়ে চুমু খেলেন। পাশে শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হীরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন,

—-‘ যা হয় ভালোর জন্যই হয়। বিশ্বাস করিসতো?’

—-‘ মা ছেলের নাটক শেষ হলে আমি কিছু বলতে পারি?’

আজিম সাহেবের বাজখাঁই গলা ভেসে আসলো। নাজমা বেগম ভাবলেশহীন ভাবে হীরের মাথায় হাত বুলিয়ে হীরের কপালে চুমু খেলেন। নাজমা বেগমের ভাবলেশহীন ভাবে আজিম সাহেবের রাগ বেজায় বেড়ে গেলো। ফোঁস করে উঠে বললেন,

—-‘ আমি এই বিয়ে মানবো না। কিছুতেই না।’

সাবাব পেছন মুড়ে তাকালো। বাবার চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,

—-‘ একটা যুক্তিযুক্ত কারন দেখাও বাবা।’

আজিম সাহেব ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,

—-‘ আমি চাইনা হীরের জন্য তোমার জীবনটা নরক হয়ে যাক। এক তো বাবাই বাবাই করতে করতে দিনদিন বাবাইয়ের মতো হয়ে উঠছো। আর তারউপর বাবাইয়ের মেয়েকেই পছন্দ হলো বিয়ে করার জন্য? সাবাব আমি তোমায় সর্বদা বারন করি বাবাইয়ের মতো হওয়া, বাবাইয়ের মতো এই করা সেই করা এসব বন্ধ করো। জানো তো বাবাইয়ের শেষ পরিনতি কি ছিলো? মরন তাদের গ্রাস করে নিয়েছিলো মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। সেই থেকে আজও অব্দি হীর এক মিনিটের জন্যও শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে কিনা জিজ্ঞেস করো ওকে? ওর জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়াই তো মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি কি ভাবছো তুমি ওকে বিয়ে করে নিলেই হীরের জীবন সেফ? আরে তুমি এটা কেন ভাবছো না শত্রুরা রিয়াদ এবং কনিকার ন্যায় তোমাদের দু’জনকেও একইভাবে শেষ করে দিতে পারে। কেন বুঝতে চাইছো না? তুমি আমার একমাত্র ছেলে সাবাব! তুমি হীরের জন্য কিছুতেই মরতে পারোনা?’

আজিম সাহেবের কথা গুলো তীরের মতো বিঁধল হীরের মনে। হঠাৎ যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো তার। বাবাইয়ের কথা গুলো কষ্টদায়ক হলেও তার প্রত্যেকটা কথাই বাস্তব। তার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আহমেদ ভিলার এক একটা মানুষ যে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে সবটাই দায়িত্ববোধে। ভাইয়ের অসহায় মেয়েটা একা থাকবে, অসহনীয় মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবে এসব থেকে তাদের দায়িত্ববোধ জন্মেছে। বাবা-মায়ের মতো নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসেনি কেউ। কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই বড় আফসোস হলো। সেদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে একই সাথে পৃথিবী ছেড়ে দিলে কি এমন অপরাধ হতো? বরং সবই ঠিক থাকতো। আজ এমন একটা দিনও আসতো না। আর এমন কিছু অপ্রত্যাশিত কথাও উঠতো না। হীর ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে সাবাবের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো,

—-‘ আমার হাতটা ছেড়ে দাও ভাইয়া। সেই তখন থেকে যে বিয়ে বিয়ে করছো কই একবারও তো আমার কথা ভাবলে না? আমি রাজি কিনা? এই বিয়েতে আমার মত আছে কি না? ওহ তুমি তো আবার দ্যা গ্রেট সাদমান সাবাব। তোমার বিরুদ্ধে কথা বলে এমন লোক তো পৃথিবীতে জন্মই নেয়নি। তাই তো? তবে তুমিও শুনে রাখো আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। আমি মরে যাবো তবুও এই বিয়ে করবো না। কে হও তুমি আমার? আমার উপর তোমার এতো অধিকার কিসের? আমি তোমাদের দয়ায় এখনও বেঁচে আছি তারই সুযোগ নিচ্ছো তুমি? কে বলেছে এতো দয়া করতে? আমি বলেছি? নাকি আমার মৃত বাবা-মা বলেছে? কেউ বলেনি! বলেনি কেউ!(ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল)। অনেক হয়েছে। এবার আমাকে যেতে দাও। কারোর দয়া নিয়ে বাঁচতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। ব..বড় মা! তোমার যদি অনুমতি থাকে ত…তাহলে আমি আমার নিজের বাসায় ফিরে যাই প্লিজ? আমার এখানে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বড় মা। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমি মরে…’

কথা গুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল হীর। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ে যাচ্ছে। নিজেকে সে সামলাতে পারছেনা। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে তার মনটা। তার এতগুলো কথায় বিন্দু মাত্র হেলদোল দেখা গেলো না সাবাবের মাঝে। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আগের মতো করেই দাঁড়িয়ে আছে।

এতসব কান্ডে উপস্থিত সবার মাঝে গুঞ্জন উঠলো। হীরের বন্ধুরা তার কান্না দেখে দৌড়ে এলো তার পানে। উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক আজিম সাহেবের কথা গুলোয়। সাবাবের বন্ধুরা, তার বাকি টিম মেম্বাররা সবাই হতভম্ব হয়ে আছে। তবে সাবাব স্বাভাবিক। যেন তার বাবার থেকে এই কথাগুলোই আশা করছিলো। নাজমা বেগমও ছেলের ন্যায় স্বাভাবিক। আদ্র, এশা এবং মিলি হীরকে ঘিরে দাঁড়াতে সানিয়াও উঠে এলো। বকার সুরে বলল,

—-‘ একটা চড় দিবো বেয়াদব মেয়ে। তুই আমাদের ছেড়ে আলাদা থাকার কথা ভাবছিস কি করে বলতো? কেন বলছিস এসব কথা?’

হীর জবাব দিলো না। সে কাউকে দেখাতে পারছেনা তার বুকের ভেতরের রক্তক্ষরণ। সবাই তাকে শান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু এই শান্তনাও যে তার কানে বিষাক্ত লাগছে। সবাই যেন আপন হওয়ার নাটক করছে। তারা যেটা দেখাচ্ছে সবটাই লোক দেখানো। এসব কিছুই সত্যি নয়। সবটা মিথ্যে। মিথ্যে অভিনয়।

হঠাৎ কোলাহলের মাঝে মুখ খুললো সাবাব। তার কন্ঠে কোনো রকম তেজ নেই। একদম শান্ত। শান্ত কন্ঠেই বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো সে,

—-‘ বাবা, তোমার অবান্তর কিছু যুক্তির যুক্তিযুক্ত উত্তর দিচ্ছি। এক এক করে মিলিয়ে নাও। প্রথমত, হীরের জন্য আমার জীবন যে কোনোদিন নরকে পরিনত হবে এ তোমার ভুল ধারনা। বরং হীরের জন্যই আজ আমি এখানে। এই সিচুয়েশনে এই প্রফেশনে। আর দ্বিতীয়ত, তোমার ভাই রিয়াদ আহমেদ। আমার বাবাই। যার জন্য সেই জন্মের পর থেকে আমার এক অদ্ভুত টান। যা আমি কোনোদিন তোমার জন্যও ফিল করিনি বাবা। বাবাই আমার কাছে এমন একজন মানুষ যার কথায় আমি দুনিয়া ছাড়তে দু’বারও ভাবতাম না৷ অথচ তুমি বললে আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতাম। বাবাই আমার কাছে সেই মানুষ যাকে আমি মান্য করে চলি। আমি তোমার কথায়,মনির কথায় এমনকি এই দুনিয়ার কথায়ও হীরকে বিয়ে করার মত থেকে পিছপা হবোনা। তবে বাবাই যদি একবার মুখ ফুটেও উচ্চারণ করে ‘সাবাব,এই বিয়ে তুই করবিনা।’ আমি বিনাবাক্যে পিছিয়ে যাবো। তাহলে ভেবে দেখো বাবাই আমার কাছে ঠিক কি। তারপরে আসি বাবাইয়ের শেষ পরিনতিতে। তার মতো সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ আমাকে দ্বিতীয়টি দেখাও বাবা। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিৎ তোমার ভাইয়ের প্রতি। তুমি সেটা না করে আফসোস করছো। বাবা আমার মৃত্যুতে ভয় নেই। কাপুরুষের মতো লেজ গুটিয়ে মরার চেয়ে বাবাইয়ের মতো সততা এবং নিষ্ঠা নিয়ে মরা ঢের ভালো। বাবা তুমি খুব ভালো করেই জানো বাবাইয়ের দুর্বলতা কি ছিলো? তার আপনজন। আপনজনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস। আর সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমার কোনো দুর্বলতা নেই। আর না আছে মুখোশধারী কোনো আপনজনের প্রতি অটুট বিশ্বাস।( মনিকার দিকে তাকিয়ে)। বাবা তুমি ভাবছো আমি তোমার একমাত্র ছেলে। কিন্তু এটা ভাবছো না হীর তার বাবা-মায়ের একমাত্র স্মৃতি। শেষ স্মৃতি। তাদের ভালোবাসার শেষ চিহ্ন এই মেয়েটা। তাকে তুমি হারাতে দ্বিধা করো না অথচ তার সঙ্গে তোমার ছেলে বিয়ে করবে বলে তোমার কষ্ট হচ্ছে। তোমার মনে হচ্ছে তোমার ছেলের জীবনটা নরক হয়ে যাবে। তোমার যদি সত্যি এমনটা মনে হয় তবে তাই বাবা। আমার আর কিছু বলার নেই তোমার একান্ত ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর। আমি সাদমান সাবাব। এই মেয়েটাকে বিয়ে করে আগলে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। আর আস্তে আস্তে সেটাই সবাই দেখবে। দেখবে সাদমান সাবাবের রাগ, দেখবে তার ক্ষোভ। অনেক পাল্টা আঘাত তো সহ্য করে নিয়েছি বাবা এবার তারা প্রস্তুত হোক সাবাবের ক্ষোভ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। কাজীসাহেব, বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’

সাবাবের কথা গুলোয় থম মেরে বসে পড়লেন আজিম সাহেব। মনিকা নিজেকে কোনো ভাবেই আর সংযত করতে পারছেনা। সে রেগেমেগে প্রস্থান করলো। নাজমা বেগম মনে মনে হাসলেন। একই ভাবে মনেমনে খুশি হলো সাবাব এবং হীরের বন্ধুরা,সানিয়া,নেহাল এবং সাবাবের পুরো টিম মেম্বাররা। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সাবাব হীরকে নিয়ে কাজী সাহেবের সামনে যেতে নিলেই বেঁকে বসলো হীর। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

—-‘ তুমি কি শুনতে পাওনি কি বলেছি আমি? আমি তোমাকে বিয়ে করবো না ব্যস। আমার হাত ছাড়ো।’

সাবাব অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হীরের দিকে। যা দেখে মুহুর্তেই চুপসে গেলো হীর। দমে গেলো তার রাগ। সাবাব ভারী কন্ঠে বলল,

—-‘ সাহস থাকলে আর একটা বাক্য উচ্চারণ কর?’

হীর কেঁপে উঠলো ভয়ে। মুখ টিপে হাসলো বাকি সবাই। সাবাব হীরকে টেনে নিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসালো। গত একঘন্টা যাবত একই ভাবে হীরের হাতটা শক্ত করে চেপে রেখেছে নিজের হাতের মুঠোয়। তার উদ্দেশ্য এই একই ভাবে সারাজীবন তার হাতটা এভাবেই ধরে রাখবে। কখনও মুঠো আলগা করবেনা। ঠিক এভাবেই শক্ত করে রাখবে।

—-‘ ছেলের বাবার নাম?’

কাজী সাহেব প্রশ্ন করলেন। সানিয়া আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,

—-‘ কাজী সাহেব। পাত্র আমার ভাই।’

কাজী সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,

—-‘ আচ্ছা আম্মা। মেয়ের বাবা মায়ের নাম বলুন?’

হীর অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো নাজমা বেগমের দিকে। নাজমা বেগম এগিয়ে এসে হাত রাখলেন হীরের মাথার উপর। হীরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কাজী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,

—-‘ মরহুম রিয়াদ আহমেদ এবং মরহুমা কনিকা নুর।’

নাম দুটো নিতে নিতে তার চোখও ভরাট হয়ে উঠলো। সাবাব হীরের হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলো। হীর মাথা নীচু করে চোখ বুজতেই তার চোখের জলে হাত ভেসে উঠলো সাবাবের হাত। সাবাব চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলো সানিয়া। কাজী সাহেব নাম দুটো শুনে একবার মুখ উঁচিয়ে তাকালেন। ফের মাথা ঢুলিয়ে ঢুলিয়ে নাম লিখে বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন।

______________

সানিয়ার বিদায়ে নিচে নামেনি হীর। বিয়ে পড়ানোর পর পেরিয়ে গেলো ঘন্টা তিন। সেই থেকেই নিজেকে ঘর বন্ধি করেছে সে। নাজমা বেগমের আদেশে তাকে আর কেউ বিরক্ত করেনি। ঘড়ির কাটা ১১টার ঘরে স্থির। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে হীর। পাশে ফ্রেমে বাঁধানো বাবা-মায়ের ছবি। মায়ের মুখে হাত বুলাচ্ছে সে। আর এলোমেলো সব কথা বলছে। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন হীর। সে আনমনে কথা বলছে বাবা-মায়ের সঙ্গে। পেছন থেকে মাথার উপর কেউ হাত রাখতেই মা বলে চমকে উঠলো হীর। মানুষ টার মুখ না দেখেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার কোমর। আবারও মা বলে কেঁদে উঠল। নাজমা বেগম নিজেকে সংযত রেখে মায়ের মতো স্নেহ করে আগলে নিলেন হীরকে। কোমল স্বরে প্রশ্ন করলেন,

—-‘ এত দুঃখ কিসের আমার মেয়েটার?’

হীর ফোপাঁতে ফোপাঁতে জবাব দিলো,

—-‘ বাবাই আমাকে ভালোবাসেনা না মা। কেবল দায়িত্ববোধ থেকে আমাকে এতদিন আগলে রেখেছে। ভালোবাসা থেকে নয়! মা, দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসার মাঝে তো আকাশপাতাল পার্থক্য। দায়িত্ব মানুষ বাধ্যবাধকতা থেকে নেয়। আর ভালোবাসা, সে তে কেবল মন থেকেই আসে। তাহলে কি বাবাই আমায় কোনোদিনও ভালোবাসতে পারেনি মা? নিজের মেয়ের জায়গায় একটুও ভাগ দিতে পারেনি?কেন পারেনি মা? আমি তো বাবাইকে খুব ভালোবাসি। আমি তো পেরেছি বাবার শূন্য জায়গাটা বাবাইকে দিতে। তাহলে বাবাই কেন পালরো না মা? কেন পারলো না?’

নাজমা বেগম বুঝতে পারলেন হীরের মনের অবস্থা। আজিম সাহেবের কথা গুলো মেয়েটাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। সত্যিইতো সে তার বাবার শূন্য জায়গাটায় ঐ মানুষটা বসিয়েছে। নিজের বাবার থেকেও বেশি ভালোবেসেছে।

—-‘ হীরপরী! বাবাইয়ের উপর খুব অভিমান হয়েছে? বাবাইয়ের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে হীরপরী? বাবাইকে ডেকে কি বকে দিবে মা? কেন এতো কষ্ট দিলো হীরপরি টা কে? খুব করে বকতে হবে তো বাবাইকে। বাবাইটা দিনদিন বড্ড পঁচা হয়ে যাচ্ছে তাই না সোনা মা?’

—-‘ না মা। বাবাইয়ের উপর আমার কোনো অভিমান হয়নি। না আমি বাবাইয়ের কথায় কষ্ট পেয়েছি। বাবাই আমাকে নিয়ে যা ভাবে বাবাই সেটাই বলেছে। এখানে বাবাইয়ের কোনো দোষ নেই। আমিই হলাম এমন হতভাগী যে….’

নাজমা বেগম হীরের মুখে হাত চেপে তার কথা থামিয়ে দিলেন। হীরের সামনে বসে বকার সুরে বললেন,

—-‘ একদম নিজেকে হতভাগী বলবি না বলে দিলাম। তুই আমার মেয়ে। আর আমার মেয়ে কখনো হতভাগী নয়। তোকে আমি এই দুই হাতে লালনপালন করে বড় করে তুলেছি। তুই আমার কনিকা আর রিয়াদের শেষ স্মৃতিরে মা৷ সোনার খনি তুই আমার। যাকে তার বড় মা নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। নিজের সবটা দিয়ে তার বড় মা তাকে আগলে রেখেছে। সেখানে দুই একজন লোক কি বলল বা না বলল তাতে কি আসে যায় বলতো? বড় মা আছে না তোর পাশে। আগলে রাখবো সব শকুনের নজর থেকে। তবুও বলবি তুই হতভাগী?’

হীর ফুঁপিয়ে উঠলো। বড় মাকে ভুল করে মা ভেবে অনেক কথা বলে ফেলেছে সে। খারাপ লাগাটা একধাপ বেড়ে গেলো যেন। মাথা নীচু করে নিজেকে সামালনোর বৃথা চেষ্টা করতেই নাজমা বেগম আবারও বলে উঠলেন,

—-‘ বাবাইকে বাবার জায়গায় বসাতে পারলে বড় মাকে কি মায়ের জায়গায় বসানো যায় না?’

হীর মুখ উঁচিয়ে তাকালো। চোখ ভর্তি জল। ঠোঁট খানা কাঁপছে কান্নার বেগে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্নার বেগটা সামলাতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ঝাপটে ধরলো বড় মাকে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না হীর। ভেতরটা বড্ড বেশিই ছটফট করছে অসহনীয় যন্ত্রণায়।

#চলবে_ 🤍

[ বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here