কাছে দূরে পর্ব ৬

#কাছে_দূরে ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ০৬

হীরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটি এই ভার্সিটিরই প্রাক্তন ছাত্র। মাস্টার্স শেষ করে সবে সবে বেরিয়েছে। লম্বা চওড়া, গোলগাল মুখ। গাল ভর্তি দাঁড়ি। দেখে বোঝার উপায় নেই সে কি লেটো দলে গান করে নাকি সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ জীবন যাপন করে! নাম রাবিব আলফাজ। সানিয়ার সাথে একই ব্যাচে পড়ত। বন্ধু হিসেবে তাদের সম্পর্ক খারাপ না। কেবল হীরের সাথেই তার উদ্ভট আচরন। হীর অবশ্য রাবিবকে দু’চোখে সহ্য করতে পারেনা। কারন টা রাবিবের এসব উদ্ভট আচরন। সে বলে হীরকে দেখলেই নাকি তার “দিলকি ধারকান” বেড়ে যায়! কিন্তু হীরের কখনও এসব মনে হয়নি। কেননা, হীরের নিজের চোখেই দেখা রাবিবের শুধু হীরকে দেখলেই নয় ভার্সিটিতে এমন অসংখ্য মেয়ে ছিলো যাদের দেখলেই রাবিবের দিলকি ধারকান বেড়ে যেত। মোটকথা কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই রাবিবের হৃদয়ঘটিত সমস্যাবলী দেখা যায়। রাবিবের আরেকটা পরিচয় রয়েছে। সানিয়ার হবু স্বামী নেহাল আলফাজের ছোট ভাই রাবিব। তাই সম্মানের খাতিরেই হীর চুপ করে যায় বরাবর। তবে আজ হয়তো হীর আর চুপ থাকবে না। রাবিবকে আজ এমন কিছু শিক্ষা দিতে হবে যেন সে আর কখনও কোনো মেয়ের সামনে গিয়ে নির্লজ্জের মতো আচরন করতে না পারে।

রাবিব হীরের রাগকে উপেক্ষা করেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। হাত তুলে দাঁড়ি চুলকে বলল,

—-” রাগলে তোমায় কতটা কিউট এন্ড হট… আইমিন তোমার কিউটনেস কতটা গ্লো করে তুমি ভাবতেও পারবে না হীর।”

রাবিবের কথা বাকিদের কানে না পৌঁছলেও তারা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে রাবিবের আচরন। আদ্র হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রাগে ফুঁসে উঠে বলল,

—-” শালার এই রাবিবকে যদি কখনও সুযোগ পাই এমন কেলান কেলাবো না ওর মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করার স্বভাব জন্মের মতো ঘুচে যাবে।”

মিলি আর এশাও ফেটে পড়ল রাগে। মিলি বলল,

—-” আমিও কেলাবো এই লোক কে! কখনও সামনে থেকে কিছু বলতে পারিনা জাস্ট বিকজ অফ সিনিয়র বলে!”

এশা কপাল কুঁচকে বলল,

—-” তবে এবার ঠিক ওকে কেলানোর একটা প্ল্যানিং করে ফেলব। কেননা বেটা আর আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র নয়। এখন হলো প্রাক্তন।”

সামনে থেকে হীর ফুঁসে উঠল রাগে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

—-” মুখে লাগাম টানুন। ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে অনেক সম্মান দেখানো হয়েছে। আর নয়! আপনি হীরকে এখনও ভালো করে চিনতে পারেননি! আমি একবার হাত চালাতে শুরু করলে আপনার এই সুন্দর থোবড়াটা আর দেখতে হবে না।”

রাবিব হা-হুতাশ করে উঠল। বুকে হাত চেপে চাপা স্বরে বলল,

—-” হায়! সুন্দরী মেয়েদের থেকে এমন হুমকি ধামকি শুনলে তো কলিজাটা লক করে যায় পাখি।”

হীর প্রচন্ড রেগে গেলো। রাগে তার হাতজোড়া কাঁপছে। এই এক সমস্যা তার! অতিরিক্ত রাগে হয় কান্না পাবে আর নয়তো হাতজোড়া কাঁপতে থাকবে। তাই কখনও কিছু চাইলেও পিছিয়ে আসতে হয় তাকে। তবে আজ রাগটা মাত্রা ছাড়ালো। হাত জোড়া যতই কাঁপুক আজ সে পিছনে হাঁটবে না। রাবিবের অসভ্যতামির মাত্রা দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতেই হবে।

—-” সুন্দরী মেয়েদের হাতে রাম চড় খেলে কি হয় জানেন তো? ঠিক সুন্দরী মেয়েদের ফেইসের মতো কিউটনেস গ্লো করে। ইউ উ্যড লাইক টু ট্রাই?”

রাবিবের চেহারা ভড়কে গেলো। হীর তাকে ইন্ডাইরেক্টলি চড় মারার কথা বলছে বুঝতেই ভড়কানো চেহারা নিয়েই হাসল। টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

—-” অবভিয়েসলি। হীর যখন বলেছে তখন আমি সরাসরি প্রাকটিস করতে রাজি। এই যেমন তোমার ভালোবাসা পেতে বারবার বেহায়া হতে রাজি। ঠিক তেমনই চড় খেতেও রাজি।”

কথাগুলো বলতে বলতে হীরের দিকে খানিক ঝুঁকে এলো রাবিব। গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

—-” ইউ স্যুড ট্রাই।”

হীর রক্তিম চোখে তাকালো। তার অসহ্য রকমের ঘৃনা হচ্ছে রাবিবের উপর। নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে। ইচ্ছে করছে রাবিবকে মেরে ফেলতে। রাগে তার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রাবিব যেহেতু গালটা এগিয়েই দিলো সেহেতু তাকে চড় মারার সুযোগটা সে কি করে হাত ছাড়া করে? হীর প্রস্তুতি নিলো রাবিবকে চড় মারার আর ওমনি প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠলো ক্যাম্পাস। কেঁপে উঠল হীরও সেই সাথে তার বাকি তিন বন্ধুরাও। আশেপাশের লোকজনের কান সজাগ হতে তারাও চমকে গেলো। দুই পাশ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসতেই মুখে হাত চেপে সামনের দিকে তাকালো হীর। রাবিব গালে হাত চেপে ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কারোর দিকে। হীর পাশে খেয়াল করতেই দেখলে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সাবাব। তার হাবভাবে হীরের মনে হলো ” এই মানুষটা সবে সবে পৃথিবীর বুকে পা রেখেছে। চারপাশের পরিবেশ বা পরিস্থিতি কোনটাই তার মস্তিষ্ককে আঘাত করতে পারেনি। সবটাই তার অজানা।”

—-” হ,,হেই….”

রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রাবিব। তার গালটা জ্বলছে খুব করুন ভাবে। এত জোরে কেউ মারে?

পেছন থেকে চোখ রসগোল্লা পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্র, এশা আর মিলি। হঠাৎই “ইয়েস” বলে চেঁচিয়ে উঠল এশা। সামনে থেকে রাবিব চোখ পাকিয়ে এশার দিকে তাকাতেই স্ব-জোড়ে আবারও এক শব্দে কেঁপে উঠলো চারিপাশ। রাবিব তার অন্য গালেও হাত চেপে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। পেছন থেকে খুশিতে লাফিয়ে উঠল এশা আর মিলি। আদ্রও মনে মনে হাসতে লাগল। হীর এখনও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে সবটাই তার মাথার এক হাত উপর থেকে যাচ্ছে। সাবাব মৃদু হাসল। কদম ফেলে রাবিবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কলার্ট টেনে সোজা করে দাঁড় করালো। এশা, মিলি আর আদ্র টানটান উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে আছে সাবাবের দিকে। এখন কি সাবাব রাবিবের নাক বরাবর ঘুষি মারবে নাকি ল্যাং মেরে নীচে ফেলে ইচ্ছে মতো কেলাবে?

তাদের ভাবনা মোতাবেক সাবাব কোনোটাই করল না। রাবিবের কলার্ট টেনে ঠিক করাই এখন তার মূখ্য উদ্দেশ্য বলে সে বোঝাচ্ছে। রাবিব ছিটকে পড়লো তার কাছ থেকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চারপাশে তাকিয়ে নিজের ঠিক কতটা সম্মান খোয়া গেলো তারই পরিমাপ করছে। রাবিবের কঠিন দৃষ্টিকে ভয় পেয়ে অনেক স্টুডেন্টই কেটে পড়ল। কিন্তু বেশিরভাগ স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে রইল। তারা সাধারণ জনগন হয়ে বিনা টাকায় সিনেমা দেখছে। বেশ মজা পাচ্ছে সেই সাথে যারা এখনও সম্পুর্ণ ব্যাপারটা মগজে ধারন করতে পারেনি তাদেরকেও বুঝিয়ে মজা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ তো ক্যামেরা বন্ধি করছে এমন অসাধারণ দৃশ্য। রাবিব ব্যাপারগুলো মেনে নিতে পারল না যেন। রাগে অপমানে তার চোখ জোড়া লাল হয়ে উঠল। সাবাবের দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই হেসে উঠলো সাবাব। রাবিবের কাঁধ চাপড়ে বলল,

—-” এখনও চিনতে পারিসনি ইডিয়ট?”

রাবিবের রাগান্বিত অবস্থাতেই কপালের মাঝেখানে ফুটে উঠল চিন্তার ভাজ। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কিছু বলতে নিলেই আবারও সাবাব বলে উঠলো,

—-” কি? আরেকটা চড় খাওয়ার পর মনে পড়বে নাকি?”

একই বিস্ময়ে ফেটে পড়ল বাকিরাও। হীর মুখ থেকে হাত নামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো দুজনের দিকে। সাবাব রাবিবকে কি মনে পড়ার কথা বলছে?

পেছন থেকে মিলি আদ্রকে খোঁচা মেরে বলল,

—-” মামা? এই সাবাব ভাই করছেটা কি বলতো? রাবিবকে কি মনে করার কথা বলছে?”

এশা বোকা গলায় বলে উঠলো,

—-” আমিও তো বুঝতে পারছিনা! চল আরেকটু সামনে যাই!”

তিনজনেই হেঁটে গিয়ে হীরের পাশে দাঁড়ালো। রাবিব এখনও ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে। জীবনে হয়তো এই প্রথমবার সে কারোর হাতে রাম চড় খেয়ে ক্যাবলরাম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিছু বলতে পারছে না। কিছু বলবেই না কি করে? ছেলেটা যে তাকে ক্রমশই বিভ্রান্ত করে ফেলছে।

—-” হেয়ার ইজ সাদমান সাবাব। মাত্র বারো বছরেই ফ্রেন্ডশিপ ভুলে গেলি। দিস ইজ নট ডান ইয়ার। আমি তোর থেকে এটা মোটেও এক্সপেক্ট করিনি।”

রাবিব কিছুক্ষণ ভড়কানো চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রইল সাবাবের দিকে। অতঃপর আমতাআমতা করে বলল,

—-” সাবাব!”

সাবাব দাঁত কেলিয়ে হেসে চোখ ঝাপটালো। বুঝতে পারল এই ইডিয়ট এখনও তাকে চিনতে পারিনি। তবুও সম্মানের খাতিরে তাকে এখন চেনার ভান করবে। যাই হোক সেটাও কম মজার নয়। সাবাব মনে মনে হাসল। রাবিবের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

—-” ইয়াদ আয়া কি নেহি?”

রাবিব ঢোক গিলে বোকা গলায় হাসল। সাবাবের সাথে গলা মিলিয়ে বলল,

—-” হ,,হ্যাঁ হ্যাঁ! মনে পড়েছে। কতগুলো বছর তোকে দেখিনা। ভার্সিটিতে কেন আসতিস না?”

ফিক করে হেসে দিলো এশা,মিলি আর আদ্র। সাবাব সরু চোখে তাকিয়ে আবারও এক গাট্টা মারল রাবিবের মাথায়। রাবিব ব্যাথা পেয়ে মাথায় হাত ডলতে ডলতে তাকাতেই সাবাব বলে উঠলো,

—-” আমি কি জন্মের পর থেকেই ভার্সিটিতে পড়তাম নাকি বেটা। ক্লাস ফাইভ অব্দি আমরা একসাথে পড়েছি না? ভুলে গেলি হা? সানি আর আমি একসাথে স্কুলে আসতাম। তখন থেকেই না আমাদের ক্লোজ ফ্রেন্ডশিপ? সব গুলে খেয়ে ফেলেছিস? আচ্ছা ছাড় ওসব কথা, তারপর ক্লাস সিক্সে উঠেই তো আমি আমেরিকায় চলে গেলাম। আমার স্টাডি তো সেখানেই কমপ্লিট করেছি। কিচ্ছু মনে রাখিসনি বেয়াদব।”

রাবিব এখনও বুঝতে পারল না সাবাবের তালগোল পাকানো কথা। তবে এটুকু বুঝতে পারল সাবাব সানিয়ার জমজ ভাই। ছোট বেলায় সানিয়ার থেকে সাবাব সম্মন্ধে রাবিব ভালোই জ্ঞাত হয়েছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে সবটাই অতীতে ফেলে এসেছে। এখন আর অতীতের কথা কিছু মনে নেই বললেই চলে। হয়তো খুব সম্ভবত সাবাব যা বলছে সেটা সত্যি হতেও পারে। কেননা, কোন সেই ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভের কথা এখন মাস্টার্স শেষ করে কে মনে রাখে?

—-” হ্যাঁ তো! আমার সবই মনে আছে দোস্ত। এগুলো কি করে ভুলি বল? তারপর বল? কেমন আছিস? কবে ফিরলি দেশে? জানালি না আমাদের?”

সাবাব মনে মনে হাসল। বলল,

—-” গতকাল ফিরেছি। দেখ ফিরতেই তোদের সাথে মিট করতে চলে এসেছি। তোরা তো ব্যাটা আমার খোঁজও রাখিস না!”

—-” কি যে বলিস না? চল ক্যানটিনে গিয়ে আড্ডা দেই। ওখানে আমাদের অনেকেই আছে। তোর সাথে আলাপ হবে।”

কথা বলতে বলতে তারা হেঁটে গেলো ক্যানটিনের দিকে। সাবাব যেতে যেতে আর তাকালো না হীরদের দিকে। সোজা চলে গেলো রাবিবের সাথে। তারা চলে যেতেই লাফিয়ে পড়ল এশা আর মিলি। হীরের হাত ধরে বলল,

—-” ব্যাপারটা কি হলো বলতো দোস্ত?”

হীর কিছু বলল না। এখনও তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে সে। পাশ থেকে আদ্র বলল,

—-” কি হয়েছে জানিনা৷ তবে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। যা চড় মারল না সাবাব ভাই! রাবিবের মনে থাকলে ভবিষ্যতে আর কোনো মেয়ের সাথে এভাবে কথার বলার দুঃসাহস করবে না।”

মিলি আদ্রর কথায় সায় দিয়ে বলল,

—-” একদম ঠিক বলেছিস তুই। মজা করে হলেও একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে বেটার।”

হীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,

—-” ক্লাসে চল সবাই।”

কথাটা বলে হীর আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। গটগট করে হেঁটে গেলো ক্লাসের দিকে। বাকিরাও আর দাঁড়ালো না। হীরের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে তারাও চলল।

_______________________

রাত এখন খুব সম্ভবত ৩টা ৪৪ মিনিট। বাড়ির প্রত্যেকই এই সময় নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। খুবই স্বাভাবিক। রাতের এই প্রহরে নিশ্চয়ই কেউ জেগে থাকবে না! তবে জেগে আছে হীর। বেশ কয়েকটা রাত তার এভাবেই নির্ঘুম কাটছে। তার কিছুদিন যাবৎ রাতে ঘুমোতে গেলেই ভয়ংকর সব স্বপ্ন আসে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই মনে হয় ঘরের মধ্যে কারা যেন হাঁটাহাঁটি করছে। ঘরের লাইট অফ করে দিচ্ছে। তার উপর হামলা করছে৷ এসব হাবিজাবি স্বপ্নে তার আর ঘুম হয় না। একরাশ তিক্ততা গ্রাস করে তাকে! মাঝেমধ্যে মনে হয় এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে সেদিনই মরে গেলে হয়তো খুব বেশি ভালো হতো!

হীরের অন্ধকারে ভয়। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি আহমেদ ভিলা সর্বক্ষন আলোয় ঝলমল করতে থাকে। কখনও অন্ধকারে এই বাড়ির আলো নিভে না। আহমেদ ভিলার পুরো এরিয়াটা সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে ভরা। বাড়ির মেইন গেট থেকে শুরু করে গার্ডেনেও সিকিউরিটি গার্ডদের পদচারণ। এরা সর্বক্ষণ হীরের রুমে নজর রাখে। চব্বিশ ঘন্টাই হীরের রুমের আশেপাশে তাদের নজর থাকে। একটু এদিক-সেদিক মনে হতেই “রিপোর্ট টু আজিম আহমেদ” এর কাছে চলে যায়। সবটাই হীরের সুরক্ষার জন্য। কারন হীরের বাবা-মায়ের মতো তারা হীরকেও হারাতে চায় না। খুব মায়া জমেছে এই মেয়েটার প্রতি তাদের। নাজমা বেগম তো হীর বলতে পাগল প্রায়। বাকিরাও কিছু কম যায় না।

হীরের বাবা মায়ের মৃত্যুর সময় শত্রুরা হীরের উপরও আক্রমণ করতে ছাড়েনি। তবে সফল হননি কেবল রিয়াদ আহমেদ মানে হীরের বাবার জন্য। হীরকে বাঁচাতেই সে মালির ঘরের পেছনে তার সিক্রেট রুমে সে হীরকে লুকিয়ে রেখে এসেছিলো। চারপাশে ভয়ংকর অন্ধকারের মধ্যে মেয়েকে রেখে যেতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো বটে কিন্তু সে চায়নি তাদের মতো করে তাদের ভালোবাসার ছোট্ট হীরপরিটাও যেন শেষ না হয়ে যায়। রিয়াদ এবং কনিকার ভালোবাসার শেষ চিহ্ন হিসেবে যেন হীর বেঁচে থাকে। তাতেই তারা শান্তি পাবে। মরেও শান্তি পাবে। হীর সেই সিক্রেট রুমেই টানা আটচল্লিশ ঘন্টা আঁটকে ছিলো। রিয়াদ তাকে সেখানে রেখে যাওয়ার ঘন্টা খানিক বাদেই তার জ্ঞান ফিরেছিলো। আর জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো কোনো এক রাক্ষসপুরিতে। যেখানে কেবল অন্ধকারই ছিলো তার সঙ্গী। সেদিনের সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি পারেনি অন্ধকারকে সঙ্গী করতে। পারেনি অন্ধকারের ভয় কাটাতে। ভয়ে বারবার অজ্ঞান হয়েছে আর অসহায়ের মতো পরে পরে বাবা-মাকে ডেকেছে! ঠিক আটচল্লিশ ঘন্টা বাদে যখন তাকে উদ্ধার করা হয় তখন তার বাবা-মায়ের মৃত্যুরও আটচল্লিশ ঘন্টা পেরিয়ে যায়। তাকে পুলিশ সিক্রেট রুম থেকে প্রায় লাশের মতোই উদ্ধার করে। হয়তো রিয়াদ এবং কনিকার শেষ ইচ্ছে ছিলো রবের কাছে যেন তাদের মেয়েটা বেঁচে থাকে! আর সেই দোয়ার জোরেই বেঁচে যায় হীর। সারা শরীরে ঝাকুনি দিয়েই লম্বা শ্বাস টেনে জানান দিয়েছিলো সে বেঁচে আছে। পুলিশ,সিকিউরিটি গার্ড সবাই তাকে নিয়ে ছুটেছিলো হসপিটালে। টানা পঁচিশ দিন একটানা চিকিৎসায় বেঁচে উঠল হীর! হীর বাঁচলেও কাটল না তার ভয়। অন্ধকার আর মৃত্যু দুটোই হীরের কাছে সমান। তাই সেই থেকে এতগুলো বছরেও আহমেদ ভিলা কখনও অন্ধকারে ডুবেনি। সর্বদা আলোয় ঝলমলে থেকেছে।

হীর বিছানা ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে লাগল। যদি এভাবেও ঘুমটা আসে। কিন্তু ঘুমও হলো এক ঘাড়ত্যাড়া! যখন সে বলে আসবে না তার মানে সে সত্যিই আসবে না আর আসেও না! কি আশ্চর্য! একবার এই পাশ তো একবার ঐ পাশ করে হাঁটতে লাগল হীর। হঠাৎই মনে হলো তার ব্যালকনিতে কেউ ধপাস করে পড়ল। কথাটা মনে হতেই হীরের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। হীর পেছন মুড়ে তাকাতেই তার ঘরের আলো নিভে গেলো! আলো নিভে যেতেই হীর আবারও কেঁপে উঠলো। ঘরের অন্ধকারের মধ্যে দৌড় লাগালো সে। কিন্তু পা বেশিদূর ফেলার আগেই সারা শরীর অবস হয়ে পড়ল তার। নীচে বসে পড়েই দু’হাতে মুখ ঢেকে নিয়ে জড়ানো কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো সে। “বড় মা, বড় মা, বাবাই… আমায় বাঁচাও! বাঁচাও” বলে চিৎকার করতে লাগল হীর।

নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে টিম মেম্বারদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মিটিং করছিলো সাবাব। আকষ্মিক ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো তার। মনোযোগ নষ্ট হয়ে যেতেই কানে ভেসে আসল কারোর বিকট চিৎকার। সাবাব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভালো করেই শুনতেই মনে হলো হীরের রুম থেকে কেউ চেঁচাচ্ছে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তার! এটা তো হীরের গলা! ড্রয়ার থেকে রিভলবারটা নিয়েই দৌড়ে গেলো সাবাব। হীরের রুমের সামনে আসতেই মনে হলো দরজাটা ভেতর থেকে লক করা! সাবাব রাগে “শিট” বলে শব্দ করেই হীরের রুমের ডানপাশে চলে গেলো। দেয়ালের সাথে হেলিয়ে থাকা বড় আলমারিটা পাশে ঠেলে সরিয়ে দিতে দেখা মিলল সিক্রেট দরজার। সাবাব ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো পুরো রুম অন্ধকারে খা খা করছে। অন্ধকারে সবটাই আবছা লাগছে! কিছুই দেখার উপায় নেই! তবুও সাবাব আন্দাজ করতে পারল ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তির উপস্থিতি। সাবাব ছুটে গেলো হীরের কাছে। পেছন থেকে হীরকে ধরতেই হীর কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করতে লাগল,

—-” প,,প্লিজ আমায় ছেড়ে দাও! আ,,মার অন্ধকারে কষ্ট হচ্ছে! আ,,আমায় যেতে দাও প্লিজ।”

সাবাবের মনটাও ছটফট করে উঠল হীরের অসহায় গলা শুনে। পেছন থেকে আক্রমণকারীর পায়ের শব্দ ক্রমশই তাদের দিকে ধেয়ে আসছে বুঝতে পেরে সাবাব রিভলবার দিয়ে তার হাঁটু বরাবর সুট করল। লোকটার হাঁটুর মাঝখান থেকে গুলিটা বেরিয়ে যেতেই সে আর এগোতে পারল না এক কদমও। হুমড়ি খেয়ে সাবাবের পাশ থেকেই পরে গেলো। গুলির শব্দে হীর চমকে উঠলো! সাবাবকে আঁকড়ে ধরে গুটিয়ে গেলো!
অন্ধকারে চোখ খুলতে না পারলেও তার পাশে সাবাবের উপস্থিত ঠিকই ধরতে পারল। ভয়ে পুরো শরীর জমে গেছে হীরের। সাবাব তাকে আঁকড়ে ধরে বলল,

—-” কিচ্ছু হয়নি হীরপাখি। আমি আছি তো!”

হীর সাবাবের শেষ কথাটা শুনতে পারেনি। তার আগেই শরীরে ভার ছেড়ে দিলো সাবাবের উপর। সাবাব বুঝতে পারল হীর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। তাই আর দেরি না করে হীরকে পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। হীরের মাথায় কিচ্ছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে আগে নীচে পড়ে থাকা অচেতন ব্যাক্তিটির ব্যাবস্থা করল। কারন সে জানে হীরের আর কিছুক্ষন বাদেই জ্ঞান ফিরে আসবে আর জ্ঞান ফেরার পর সে যদি আবারও একই ঘটনার স্বীকার হয় তবে তার জন্য লাইফ রিস্ক আছে।

বাড়ির ভেতর গুলির আওয়াজ হতেই বাকিদের ঘুম হারাম হয়ে উঠল। গুলির আওয়াজ কোন ঘর থেকে এলো না জানলেও আন্দাজ করতে কারোরই কষ্ট হলো না এটা হীরের রুম থেকে এসেছে। এতো এতো সিকিউরিটি গার্ডের মাঝেও কি করে যে মেয়েটার উপর হামলা হয় আজ পর্যন্ত সেটাই ধরতে পারল না কেউ!
সবাই ছুটে গেলো হীরের রুমে। দরজাতো ভেতর থেকে লক। আজিম সাহেব এবং নাজমা বেগম ভয় জড়িত কন্ঠে বারবার ডাকতে লাগলেন হীরকে। তাদের সংশয় মেয়েটা ঠিক আছে তো?

পেছন থেকে সাবাব এসে দাঁড়ালো। নাজমা বেগম ছেলেকে দেখতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সানিয়াও কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

—-” দেখনা ভাইয়া, হীর গেট খুলছে না!”

সাবাব সবার সংশয় কাটিয়ে বলল,

—-” হীর ঘুমচ্ছে মা। ও একদম ঠিকাছে। তোমরা ওকে এখন আর ডেকো না প্লিজ।”

আজিম সাহেব বললেন,

—-” আমরা যে গুলির শব্দ পেলাম?”

—-” আমি হ্যান্ডেল করে নিয়েছি বাবা। আশাকরি আর কোনো সমস্যা হবেনা। সানি, চিন্তা করিস না! ও একদম ঠিকাছে। মাকে নিয়ে ঘরে যা। বাবা তুমিও যাও। কাল সকালে তোমরা ওর সাথে কথা বলে নিও কেমন?”

—-” বলছিস? তাহলে আমরা যাবো?”

সাবাব ভরসা চোখে বলল,

—-” হু যাও। আমি আছি তোমাদের হীরের কাছে। আমি থাকতে ওর কিচ্ছু হবে না বাবা।”

#চলবে____________________

[ কতবড় লিখে ফেললাম😐]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here