কাছে দূরে পর্ব ৭

#কাছে_দূরে ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ০৭

ভোরের সচ্ছ আলো চোখে পড়তেই হীরের ঘুম ভাঙল। দুই একবার এপাশ ওপাশ করে ঘাড় ফিরিয়ে চোখের সামনে আড়াআড়ি ভাবে হাত রাখল সূর্যের আলো কে আড়াল করতে। আরও কিছুক্ষণ লেপ্টে রইল বিছানায়। শরীরটা দুর্বল লাগছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। তবুও উঠল। গায়ের উপর থেকে চাঁদর টা সরিয়ে বিছানা ছাড়ল। ওয়াসরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে একেবারে বের হলো। আজকের সকালটা অন্যদিনের তুলনায় একটু ভিন্ন ঠেকছে হীরের কাছে। যদিও সবটা সে তার প্রতিদিনকার নিয়ম মতোই করে যাচ্ছে তবুও মনে হচ্ছে সবটা আলাদা, ভিন্নরকমের। হীর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সবটা পরিপাটি আছে কিনা দেখতেই চোখ গেলো ব্যালকনির দিকে। আর ওমনি কাল রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হুঁট করে মনে পড়ল। মাথার মধ্যে চিনচিনে এক ব্যথার আবির্ভাব ঘটল। কিন্তু এই ঘটনা তো নতুন কিছু নয়! নতুন হলো সাবাবের তাকে উদ্ধার করা। কাল রাতে সাবাব তাকে সেফ করেছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো সাবাব তার বন্ধ রুমে এলো কি করে? তার স্পষ্ট মনে আছে সে দরজা লক করে শুইয়েছিলো। আর যখন তার উপর হামলা হয় তখন সে বেড থেকে দুই কদমের বেশিও এগোতে পারেনি। সেই হিসেবে তার নিজ হাতে দরজা খুলে দেওয়াও সম্ভব ছিলো না। তাহলে?

হীরের দরজায় খটখট আওয়াজ হতেই হীরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। ভাবনার ঘোরে থাকায় সে বুঝে উঠতে পারল না শব্দটা কোথা থেকে এলো। চাতক পাখির মতো দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘোরাতেই মনে হলো দরজায় নেই নক করছে। কথাটা ভাবতে আবারও খটখট শব্দ হলো দরজায়। হীর হাত থেকে চিরুনিটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আছে সানিয়া এবং নাজমা বেগম। হীর দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকে এলো তারা। নাজমা বেগম ঢোক গিলে হীরকে বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। সানিয়াও পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল হীরকে। হীর ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-” আমি একদম ঠিকাছি বড় মা। তুমি এতো কেন টেনশন করো আমায় নিয়ে বলোতো?”

নাজমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হীরের দু’গালে হাত রেখে কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন,

—-” টেনশন করি কি আর সাধে মা? তুমি যে আমার হীরপরি। তোমাকেও যদি রিয়াদ আর কনিকার মতো হারিয়ে ফেলি তাহলে আমরা বাঁচব কি নিয়ে? তোমার বড় মা কি ভালো থাকতে পারে হীরপরি কে ছাড়া?”

হীর হাসল। নাজমা বেগমের হাতদুটো গালের সাথে চেপে ধরে বলল,

—-” হীর এতো সহজে মরবে না বড়মা। মরলে তো সেই কবেই মরে যেতো বলো?”

নাজমা বেগম আঁতকে উঠলেন হীরের কথা শুনে। পাশ থেকে সানিয়া হীরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

—-” তোকে না বলেছি কখনও এমন টাইপের কথা বলবি না তুই! তবুও কেন বলিস সোনা? তুই জানিস না আমরা তোকে কতটা ভালোবাসি?”

সানিয়ার চোখে জল চিকচিক করছে। হীর মুখটা চুপসে নিলো। সানিয়ার গলা জড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” না বলে যে আর থাকতে পারছি না গো আপি। দেখছো না? শত্রুরা কিভাবে পিছু লেগেছে হীরের? নিজের জীবনের ভরসা তো নিজেই দিতে পারছিনা।”

নাজমা বেগম হীরের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—-” ওমন কথা বলে না সোনা মা। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমরা আছি না?”

হীর চোখ ঝাপটে নাজমা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা গলায় বলল,

—-” তোমরা আছো বলেই তো ভরসা বড় মা।”

হুড়মুড় করে রুমের ভেতর ঢুকে এলেন আজিম সাহেব। সেও বাকিদের মতোই অপেক্ষায় ছিলেন হীরের ঘুম ভাঙার। কিন্তু বাকিদের মতোই ঠিক সময় এসে উপস্থিত হতে পারলেন না হীরের কাছে। তা নিয়ে তার ভীষণ আফসোস হচ্ছে। নিজের উপর চরম রাগ হচ্ছে! বাকি সবাই যদি ঠিক টাইমে হীরের কাছে আসতে পারে তবে সে কেন পারে না? বাকিদের থেকে কি সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বলে? তার কি শরীরের শক্তি দিনদিন লোপ পাচ্ছে? তাহলে কি নাজমা বেগম ঠিকই বলেন? সে বুড়ো হয়ে গিয়েছে?

—-” বাবাই! কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”

আজিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন এসব ভেবে। হঠাৎ হীরের ডাক পড়তেই তার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল যেন। ঠোঁটের কোনে দেখা মিলল এক ঝলক হাসির। হাসি মুখেই এগিয়ে এলো সে। হীরকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

—-” আমার মামনিটা এখন কেমন আছে?”

—-” একদম ঝাক্কাস আছে তোমার মামনি। টেনশনের কোনো কারন নেই বাবাই। তোমরা একদম নিশ্চিন্তে থাকো।”

—-” যখন গুলির আওয়াজ ভেসে আসল, আমাদের তো জানই বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিলো মামনি! শুধু উপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছি আমার মামনিটা যেন ঠিক থাকে। সেফ থাকে।”

হীর চমৎকার হেসে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে বলল,

—-” দেখো, হীর কিন্তু একদম বিন্দাস আছে। সত্যি বলছি। তোমরা প্লিজ আর কাল রাতের ঘটনাটা নিয়ে এতো ভেবো না বাবা। এভরিথিং ইজ ফাইন বাবাই।”

—-” ওকে মামনি আমরা আর কাল রাতের ঘটনা নিয়ে ভাববো না প্রমিস। এবার জলদি নীচে চলো খুব ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু। অনেক্ষন ধরে তোমার অপেক্ষা করছিলাম যে। চলো চলো।”

“বাবা।”

আজিম সাহেব হীরেকে নিয়ে নীচে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ভেতরে ঢুকে এলো সাবাব। কালকের পর থেকে আজ প্রথম সূর্য উদয়ের পর তাকে দেখা। সাদা লুজ টি-শার্ট আর কালো একটা ট্রাউজার পড়ে আছে সাবাব। পায়ে বাসায় পড়ার স্যান্ডেল। চোখ মুখ বেশ ক্লান্ত। সারারাত দু’চোখের পাতা যে তার এক করা হয়নি তা হীর প্রথম বারেই বুঝতে পারল। ক্লান্ত মুখেও বেশ মায়া মায়া রশ্মি ছড়াচ্ছে সাবাবের চোহারা থেকে। হীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। টি-শার্টের লম্বা হাতা দুটোর একটা ঝুলে আছে আর অন্যটা গোটানো কনুই অব্দি। মাথার চুলগুলো অগোছালো! মনে হচ্ছে কাজের চাপ মাথায় একবারও হাত রাখতে পারেনি সে। চোখের নীচে লালচে দাগ হয়ে আছে। এটা আরও ভালো করে প্রমান করছে সাবাব সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে।

—-” হ্যাঁ বাবা বলো?”

স্নেহভরা কণ্ঠে জবাব দিলেন আজিম সাহেব। সাবাব ধীরপায়ে এগিয়ে এলো বাবার কাছে। বাইরে ইশারা করে বলল,

—-” সিকিউরিটি গার্ড সবাইকে ছাঁটাই করে আমি নতুন সিকিউরিটি গার্ডদের ব্যাবস্থা করে দিয়ে এলাম। আশাকরি ওরা খুব ভালো সার্ভিস দিবে।”

সাবাবের কথায় ভরসা পেলো সবাই। কিন্তু হীর যেন অস্বস্তিতে পড়ল। তার জন্য বাড়ির লোকগুলোর কতটা হয়রানি হচ্ছে।

—-” গুড জব বাবা। আমিও ভাবছিলাম এই ব্যাপারে তোমার সাথে কথা বলব। কিন্তু আমার ছেলে যে আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে এটা কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি!”

সাবাবের কাঁধ চাপড়ে কথাটা বললেন আজিম সাহেব। নাজমা বেগম ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,

—-” সিকিউরিটি গার্ড যতই ছাঁটাই করিস বাবা ওরা তারপরও ওত পেতে থাকে মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলার। কি করে যেন বারবার ওর উপর হামলা করতে সক্ষম হয়। আমি জানি না কি করে পারে? তাই সিকিউরিটি গার্ডদের উপর নয়! আমার একমাত্র ভরসা তুই! আমি জানি তুই মেয়েটাকে সর্বদা রক্ষা করতে পারবি।”

সাবাব স্মিত হাসল। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে মৃদুস্বরে বলল,

—-” আমি থাকতে তোমাদের কোনো টেনশন নেই মা। কথা দিলাম!”

নাজমা বেগম সাবাবের হাত দুটোতে চুমু খেয়ে বললেন,

—-” আমার জান।”

হীর আঁড়চোখে মা ছেলের মহব্বত দেখতে লাগল। মনে মনে একটু হিংসে হলো বটে তবুও এবেলার জন্য ক্ষমা। সানিয়া ভাইয়ের এক হাত জড়িয়ে ধরে বলল,

—-” এখন তুই-ই একমাত্র ভরসা ভাইয়া।”

সাবাব সানিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,

—-” চিন্তা করিসনা।”

__________________________

হীরের আজ ভার্সিটি যাওয়া হলো না। নাজমা বেগমই যেতে দিলেন না। বিপদ তো মেয়েটার পেছনই ছাড়ছে না! যেহেতু রাতে হামলা করেও হীরের কাছে ঘেঁষতে পারেনি সেহেতু ওরা আরও ক্ষেপে আছে! আর এর পরবর্তী প্ল্যানটা এতো কাঁচা হবে না। হয়তো এর থেকে বেশি ভয়ংকর কিছুর ঘটানোর প্ল্যান করছে তারা।
এসব আন্দাজ করেই নাজমা বেগম হীরকে কড়া আদেশ দিলেন আজ যেন সে বাসা থেকে বের না হয়। হীর কিছুক্ষণ ঠোঁট উল্টে চেয়ে থেকে অবশেষে বড়মার আদেশ শিরোধার্য করল। সে আজ বাড়িতেই থেকে গেলো। আপাতত ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। তবে মনে মনে সাবাবের সাথে কথা বলার ছোট্ট একটা পরিকল্পনা করছে। সানিয়া এবং আজিম সাহেব একসাথে নীচে এলেন বের হবেন বলে। কিন্তু সাবাব কে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেলো সে? আছে নাকি হীরের আড়ালেই বেরিয়ে পড়েছে?

—-” আপি, বাবাই তোমরা দুজন একসাথে কোথাও বের হচ্ছো?”

সানিয়া পার্সের মধ্যে ফোন আর প্রয়োজনীয় কার্ডগুলোর তল্লাশি চালিয়ে বলল,

—-” না রে সোনা। বাবা তো অফিস যাচ্ছে। আর আমি যাচ্ছি আমার একটা কাজ আছে তাই। (হীরের কপালে চুমু খেয়ে) আসছি। মা আমি একটু বের হলাম?”

রান্নাঘর থেকে নাজমা বেগমের গলা ভেসে আসল,

—-” কোথায় যাচ্ছিস? তোকে না বলেছি বিয়ের কনে এভাবে হুট হাঁট বের হবি না! আজ রাতে যে নেহালদের বাড়ির লোক আসবে মনে আছে তোদের বাপবেটির? নাকি ভুলে গেছিস?”

সানিয়া হেসে উঠলো। বলল,

—-” বের হচ্ছি তো তারই আদেশে! আর নয় যেতাম না। আসছি মা!”

—-” এই শোন….”

সানিয়া আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো। নাজমা বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন। সানিয়াকে দেখতে না পেয়ে কপট রাগলেন। স্বামীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,

—-” মেয়েটা বেরিয়ে গেলো? তুমি আটকাতে পারলে না? কি করছিলে এখান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি? কোনো কাজ যদি তোমার দ্বারা হতো! তাহলে ধন্য হয়ে যেতাম আমি।”

আজিম সাহেব মুচকি হাসলেন। যা দেখে নাজমা বেগমের রাগটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। রাগে ফুঁসে উঠে কিছু বলতে নিলেই আজিম সাহেব বলে উঠলেন,

—-” আহা চড়ছো কেন? ও আমাকে বলেছে এক ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে বাসায়। নেহালই ওকে দেখা করতে বলেছে৷ তাই তো বললাম আচ্ছা তুই যা আমি তোর মাকে ম্যানেজ… না না! মানে আমি বলেছি তোর মাকে আমি বুঝিয়ে বলব। তাহলে সে আর রাগ করে থাকতে পারবে না!”

নাজমা বেগম স্বামীর কথায় গললেন না। উল্টে আরও রাগলেন। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

—-” করো তোমাদের যা খুশি। আমি আর কি বলবো? কিছুই বলব না।”

—-” আরে বাবা তুমি এতো রাগছ কেন বলোতো? আচ্ছা আমি সানিকে কল করে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা বলে দেবো। এবার খুশিতো?”

আর কোনো জবাব এলো না রান্নাঘর থেকে। আজিম সাহেব বুঝলেন বিবির রাগটা ভালোই শক্তপোক্ত। এতল সহজে গলবে না। তাই ছেলের কথা বলে দেখা যাক কি হয়।

—-” হ্যাঁ গো শুনছো? তোমার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি না? কোথায় সে? বের হয়েছে? ভাবছিলাম ওকে নিয়ে আজ অফিসে যাবো!”

—-” কোনো দরকার নেই। আমার ছেলেটা সারারাত একফোঁটাও ঘুমোয়নি। তাই এখন ঘুমোতে গিয়েছে। খবরদার যদি ওকে ডেকেছো!”

আজিম সাহেব হাসলেন মনে মনে। আর কিছু না বলে সেও বেরিয়ে পড়লেন অফিসের উদ্দেশ্যে। হীর এতক্ষণে কান খাঁড়া করল সাবাবের নাম শুনে। তার মানে সাবাব নিজের ঘরেই ঘুমচ্ছে।

হীর আশেপাশে তাকিয়ে আস্তেধীরে উঠে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। উপরের তলায় এক সাইডে তিনটা রুম আর এক সাইডে একটা। সেই এক সাইডের একটা রুমই সাবাবের। সাবাব ছোট বেলা থেকে একটা অন্যরকম ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয়েছে। কখনও নিজের কোনো কিছুতে অন্যের দাবী মেনে নেয়নি। সর্বদা নিজেরটা নিজের করেই রেখেছে। সানিয়া আর সে জমজ হলেও না চেহারায় মিল আর না ব্যাক্তিত্বে। সানিয়া সর্বদা নরম মনের মানুষ। তার সবচেয়ে দামী জিনিসটাও যদি কেউ হাসি মুখে একবার চায় সে কোনো রকম শব্দ না করেই চুপচাপ দিয়ে দিবে। কিন্তু সাবাব ব্যাতিক্রম। তার একটা ফালানো জিনিসেও কারোর নজর সে বরদাস্ত করে না।

হীর সাবাবের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। ভেতরে কি যাবে? নাকি যাবেনা? দোটানার মধ্যে পড়ে গেলো সে। কিন্তু সাবাব তাকে কি করে বাঁচালো রাতে সেটা জানাও তো ইম্পরট্যান্ট! এখন বাসায় কেউ নেই। এখন জিজ্ঞেস করতে না পারলে অন্য সময় জিজ্ঞেস করাটা সম্ভব না! মনকে দোটানায় ফেলেই সাবাবের দরজায় নক করল হীর। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না। ঘুমচ্ছে কি কি না দেখার জন্যই দরজাটা আস্তে করে ধাক্কা দিলো। আর অমনি হাট করে খুলে গেলো রুমের দরজা। হীর ভয়ে ভয়ে উঁকি মারল ভেতরে। যা ভেবেছিলো তাই! সাবাবে পরে পরে বেঘোরে ঘুমচ্ছে। সাবাবকে একবার দেখেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মনে পড়ল বড়মার কথা। সাবাব সারারাত একফোঁটাও ঘুমোয়নি! থাক ডাকার দরকার নেই। ঘুমচ্ছে যখন ঘুমোক। হীর নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরতে আবারও দাঁড়িয়ে গেলো। সাবাবকে ঘুমন্ত অবস্থায় কি দারুণ লাগছে। পুরো একদম বাচ্চা। হীরের ইচ্ছে হলো সাবাবকে আরেকবার দেখতে। কিন্তু… মনের মধ্যে কিন্তু কিন্তু করছে। সাবাবকে আরেকবার দেখতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছের কাছে এই কিন্তু কিন্তু ভাবটা বেশিক্ষন টিকতে পারল না। হীর ঘুরে দাঁড়ালো। সাবাবকে আরেকবার দেখেই সে নিজের রুমে চলে যাবে বলে মনস্থির করল। ধীরপায়ে এগিয়ে সাবাবের দরজায় হাত রেখে উঁকি দিলো হীর। তার মনে হলো এখান থেকে সে সাবাবের মুখটা ঠিক করে দেখতে পারছে না৷ তাই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সাবাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। মনে মনে প্রশান্তি নিয়ে ভাবল, হু,এবার পার্ফেক্ট। সাবাব উপুড় হয়ে ঘুমচ্ছে। হাত দুটো মাথার পাশ থেকে উঠানো। ডান পাশের গালটা বালিশের সাথে লেগে অনেকটা চ্যাপ্টা লেগে আছে। যার দরুন ঠোঁটের একপাশ বাচ্চাদের মতো করে লেগে আছে৷ মাথার সিক্লি চুল গুলো সব কপালের সাথে লেপ্টে আছে। তারাও বেঘোরে ঘুমচ্ছে। হীর ভালো করে খেয়াল করল সাবাবের ঠোঁট জোড়া টকটকে লাল। সবসময় এতটা লাল দেখা যায় না। কেবল মাত্র মানুষটা ঘুমলোই বুঝা যায়। হীরের ইচ্ছে হলো সাবাবের পাশে বসে তার অবাধ্য চুলগুলোকে আরেকটু অবাধ্য করে তুলতে। চুল গুলোর মাঝে হাত চালিয়ে সাবাবের চার আঙ্গুল কপালটা ফাঁকা করে দিতে ইচ্ছে করল। আচ্ছা এই যে চুল গুলো দিয়ে সাবাবের কপালটা ঢেকে আছে সেগুলো যদি হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয় তবে সাবাবকে দেখতে কেমন লাগবে? নিজের এই ইচ্ছেটাও হীর দমিয়ে রাখতে পারল না। খুব সাবধানে সাবাবের পাশে বসল। সাবাবের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে তার চুল গুলোর মাঝে হাত রাখল হীর। ভয়ে তার মনের ভেতর হাঁক ডাক পাড়ছে। তবুও সাবাবকে ছেড়ে এখান থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। তার মন বলছে সাবাব কিছুই টের পাচ্ছে না। সে অযথাই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণই হীর মনের উপর চাপ ফেলে বলাচ্ছে। হীর মুগ্ধ হয়ে দেখছে সাবাবকে। বারো বছর বাদে আবারও নতুন করে সাবাবের এতোটা কাছে এসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। হীরের ইচ্ছে হলো সাবাবের আরেকটু কাছে যেতে। সাবাবের ঘুমন্ত চোখে ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু পারল না। ভয় আর জড়তা দুটোই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো হীরের মনকে। তবুও হীর দুঃসাহস করে তার হাতটা সাবাবের গালে রাখল। আলাদা এক অনুভূতিতে হীরের সমস্ত শরীর শীতল হয়ে উঠলো। আরও কিছু করার দুঃসাহস দেখাতে নিলেই আকস্মিক কিছু ভয়ংকর ঘটে গেলো যেন। ভয়ে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিতেই মনে হলো সে লেপ্টে গেলো গরম বিছানায়। যেখানে এক্ষনি সাবাব ঘুমিয়ে ছিলো। তার মানে সাবাব জেগে গেছে? হীরের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। জড়ানো গলায় ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে চোখ জোড়া খুলতেই দেখা মিলল সাবাবের কঠিন দৃষ্টির। হীর কেঁপে উঠলো আরও এক দফা। সাবাব রেগে আছে! ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে। চোখে মুখে ফুটে আছে ভয়ংকর রাগ। হীর ঢোক গিলল। সাবাব হীরের হাত দুটো প্রথমেই চেপে ধরেছে বিছানায়। হীর চাইলেও সাবাবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবেনা। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে এবার। কেন এসেছিলো সে এই ঘরে? আর এতক্ষণ ধরে কি না কি করেছে? সবটাই কি সাবাব টের পেয়েছে? কি লজ্জা!

সাবাব ঘুমঘুম চোখে দেখতে লাগল হীরকে। হীর যে তার রুমে আসবে সেটা তো তার কাছে বরাবরই অকল্পনীয় ছিলো। আজ হঠাৎ হীর তার রুমে এসে তার এতোটা কাছাকাছি কি করে এলো?

—-” স,,,সরি! সরি ভাইয়া। আ,,আমি আ,,সলে…”

হীরের জড়ানো গলায় ঘোর লেগে গেলো সাবাবের। মেয়েটা ভয় পেলে এতোটা মায়াবী হয়ে ওঠে কেন?

—-” আমার রুমে কি কাজ তোর?”

সাবাব ইচ্ছে করেই কড়া গলায় কথা বলতে লাগল হীরের সাথে। হীর আরও ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ার্ত হরিণীর মতো দৃষ্টি ঘুরিয়ে পালানোর পথ খুঁজতে লাগল। সাবাব বুঝতে পেরে মনে মনে হাসল। হীরকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

—-” আমার রুম তো বাদই দিলাম! তুই আমার এতোটা কাছে এসে কি করছিলিস হ্যাঁ? তবে কি আমি যা ভাবছি তাই? তুই আমায় নিয়ে ঐসব ভাবছিস হীর? তুই কি করে পারলি ওসব ভাবতে?”

হীর কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকালো। না সূচক মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টে বলল,

—-” আমি তোমায় নিয়ে কিছুই ভাবছিনা ভাইয়া বিলিভ মি!”

সাবাব সরু চোখে তাকালো। বলল,

—-” সত্যি তো? তুই আমায় নিয়ে ওসব কিছুই ভাবিস নি?”

হীর ঝড়েরবেগে না সূচক মাথা নাড়ল। তা দেখে সাবাব হীরকে ছেড়ে দিয়ে পাশে সরে গিয়ে বলল,

—-” আর ভাববিই বা কেন? আমার মুখে কি ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল ভাব আছে নাকি!”

হীর লাফ মেরে উঠে বসল। এখান থেকে পালানোর পায়তারা করতে নিলেই হঠাৎ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সাবাবের কথায়। সাবাব ভাবছে হীর তাকে ক্রিমিনাল ভেবে এতো কাছে এসে দেখছিলো! আর হীর ভেবেছে অন্যকিছু!

#চলবে____________________

[ বিঃদ্রঃ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত একই অবস্থা। তবুও আপনাদের আজ অপেক্ষা করালাম না৷ কষ্ট হলেও লিখেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here