কাঠপুতুল পর্ব ১২

#কাঠপুতুল
#লেখনীতে-তানভীন শিলা
#পর্ব-১২
.
ষ্টেশনে বসে আছে কুহেলী। চলে যাবে এখান থেকে সে। যে কারণে এসেছিলো সেটাই তো হলোনা, কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে সুমেনের জীবনে? বাঁধা দেয়ার অধিকার নিজের হাতেই সে খুন করেছে। আজ —- হওয়ায় ট্রেন নেই কুহেলী জানেনা।
.
সকাল ৮:৩০মিনিট
সবাই নাস্তা করে বের হবে ঠিক করেছে। নাস্তার টেবিলে সবাই থাকলেও কুহেলী লাপাত্তা। সুমেনের বুঝতে বাকী রইলো না যে কুহেলী তার জন্যই চলে গেছে। পরশ কুহেলীকে নিজের দায়িত্বে এনেছে তাই সে একটু বেশিই চিন্তিত। পরশকে চিন্তিত দেখে মৃদুর রাগ আসমান চুম্বী হয়ে ওঠে। গতকাল রাতেও সত্যিটা বলেনি পরশ। কি এমন বলবে সেটা ভাবতেই মৃদু মাথায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। মৃদুর মনে হচ্ছে কেউ তাকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেছে। আশেপাশের সবার দিকে তাকিয়ে দেখে এমন কেউ নেই।
.
.
.
পাশে এসে বসা লোকটাকে দেখে অবাক হয় কুহেলী। ইচ্ছে করছে সব অভিমান দিয়ে মালা বানিয়ে পরাতে এই বজ্জাত লোকটাকে।
“আপনি এখানে?”
“বউ যেখানে স্বামি সেখানে।”
“বউ কে?”
“কেন তুমি।”
কুহেলী কিছু বলার আগেই খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুমেন। অভিমান মাখা কন্ঠে বলে-
“আমার কি একটু অভিমান করারও অধিকার নেই কুহু? আমি চলে যেতে বললেই চলে যেতে হবে তোমার। আমার মুখে বলা কথা শুনলে কিন্তু না বলা কথাগুলো শুনলে না?”
ঘাড়ে গরম তরল কিছু অনুভব হতেই সুমু কুহেলী ছেড়ে দিয়ে বলে-
“কুহু কান্না করছো কেন? আর কান্না করলে আওয়াজ করে কান্না করো। এভাবে বিনা শব্দের কান্না আমার ভালোলাগেনা।”
সুমেনের কথা শুনে ফিক হেসে দেয় কুহেলী।
“আম সরি সুমু। ওটা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিল।”
“ভুলে যাও। প্রমিস করো আর কখনো ছেড়ে যাওয়ার কল্পনাও করবেনা। একবার মেনে নিয়েছি দিত্বীয়বার হয়তো আমিই থাকবোনা।”
.
.
.
ঘননীল আকাশ। সামনে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের কুন্ডলী। নৈকট্যে গেলে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। মেঘের বুক চিরে নেমে আসা ঝর্ণা। নিচে নেমে জল ও পাথরের সম্পর্কে শাঁ শাঁ শব্দ। সেই জলই আবার মিশে যাচ্ছে পিয়াইনের সাথে। পাথরে পাথরে বন্ধুত্ব। পাথরে ও নদীতে মিতালি। পাথরে মানুষে জীবনযাপনের যুদ্ধ। চারিদিকে বিস্তৃত সবুজ। পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজের জলকেলি। বিস্তির্ণ মাঠে সবুজের চাদর। এগুলো দৃশ্যকল্প নয়, সিলেটের বিছনাকান্দি জুড়ে এমন দৃশ্য যেন সত্যিই কেউ ফ্রেম বন্দি করে লটকে দিয়েছে আকাশের সাথে। দূর থেকে মনে হবে এই মেঘ, এই মানুষ, এই পাহাড়-নদী কিংবা পাথরের স্থিরচিত্রই এগুলো। দুই পাশে আকাশচুম্বী পাহাড়, তার মাঝে বয়ে চলা ঝরনার স্রোত। পানি একেবারে পরিষ্কার, স্বচ্ছ এবং টলমলে। আর ছোট-বড় নানান আকৃতি আর রঙের পাথর তো আছেই। পানি এত স্বচ্ছ যে পানির তলার পাথর কিংবা নিজের ডুবে থাকা পা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
বিছনাকান্দি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বিছনাকান্দি হচ্ছে একটি পাথর কোয়ারী। এরকম আরেকটি পাথর কোয়ারী হল জাফলং। অবশ্য অনিয়ন্ত্রিত পাথর উত্তোলনের ফলে জাফলং এর সৌন্দর্য আজ নষ্টের পথে কিন্তু বিছনাকান্দি তার যৌবন ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের খাসিয়া পাহাড়ের অনেকগুলো দাপ দুই পাশ থেকে এসে এক বিন্দুতে মিলেছে আর পাহাড়ের খাঁজে রয়েছে ভারতে মেঘালয়ের সুউচ্চ ঝর্ণা। পর্যটকদের কাছে বিছানাকান্দির মূল আকর্ষন হচ্ছে পাথরের উপর দিয়ে বলে চলা স্বচ্ছ জলধারা আর পাহাড়ে পাহাড়ে শুভ্র মেঘের উড়াউড়ি। এ যেন পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর পাথর মিলিয়ে প্রাকৃতিক মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছে বিছনাকান্দি।
এতটুকু বলেই থামেন জান্নাত নামের আপুটা। সে নাকি খুব সুন্দর উপস্থাপনা করতে পারে, তাই তাকে যেকোনো ভ্রমণে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়ই। হাই স্কুল লেভেল থেকে সে প্রত্যেক বার্ষিক ক্রীয়া ও ছোটখাটো অনুষ্ঠানে খুব সুন্দর করে উপস্থানের জন্য বেশ কিছু এ্যাওয়ার্ড ও পেয়েছে। পরশের ক্লাস সাথে আসা সবাই। জুনায়েজ বাদে, কারণ সে পরশের থেকে ২বছরের ছোট। একপ্রকার জোড় করেই পরীকে টেনে নিয়ে যায় জুনায়েদ।
“পরী এখানে বসো। এখানে বসে পানিতে পা দিয়ে দেখো তোমার পায়ের রক্ত চলাচলও দেখা যাবে এতটা স্বচ্ছ পানি।”
“তাই বুঝি? আচ্ছা ঠিক আছে যদি পানিতে আমার পায়ের রক্ত চলাচল দেখা যায় তো আমি আপনাকে মাফ করে দিবো।”
জুনায়েদ মনে মনে বলে-
‘ইশ্ নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলাম তো! কি জন্য যে এতবেশিই বলে ফেললাম।’
“পরী ওটা তো এমনি বলেছি গো বউ প্লিজ এমন করোনা। আচ্ছা চলো তোমাকে অন্য কিছু দেখাই।”
.
.
মৃদুলা শতচেষ্টা করেও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাচ্ছেনা। একটা পাথরে বসে পানিতে পা দিয়ে রেখেছে। আশনি পরশকে নিয়ে নানান পোজে ছবি তুলছে। আন্বিষ মৃদুর পাশে বসলে মৃদু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে।
“হাই মৃদুলা।”
“হাই।”
“ভালো লাগতেছে তো তোমার? চলো তোমাকে নিয়ে ঝর্ণার কাছে যাই, ঐ জায়গার দৃশ্যটা অনেক সুন্দর।”
“না ভাইয়া লাগবেনা আপনি যেতে পারেন। ধন্যবাদ।”
“কেনো এভাবে বলছো কেন? চলোই না, আমার সাথে গেলে আমাকে জানতেও পারবে।”
“আপনাকে জেনে আমার কি হবে? যাকে জানার প্রয়োজন তাকে জানলেই হবে।”
আন্বিষ মৃদুর হাত ধরে দাড় করায়। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে-
“তোমাদের ডিভোর্সের পরে যখন পরশ আশনিকে বিয়ে করবে, আমিও তোমায় বিয়ে করবো মৃদুলা। পরশের সাথে কথা বলেছি আমি, চলো আমার সাথে।”
“কিসব বলছেন আমরা ডিভোর্স কেনো নিবো? পরশ কেনো আশনিকে বিয়ে করবে? আর আমিই বা কেন আপনাকে বিয়ে করবো? পরশ আমাকে আর আমি পরশকে ভালোবাসি।”
“পরশ তোমাকে না আশনিকে ভালোবাসে মৃদুলা। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।”
মৃদু আন্বিষের শক্তির কাছে তুচ্ছ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকটা দূরে চলে এসেছে তাই পরশকে দেখা যাচ্ছেনা, মৃদু কি করবে ভাবার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। হুট করেই আন্বিষের সামনে হাজির হয় পরশ।
“এসব কি আন্বিষ? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমার মৃদপাখিকে?
পরশ আন্বিষের হাত থেকে মৃদুর হাত ছাড়ায়।
“এই মৃদপাখিটা আবার কবে থেকে হলো? তুই তো মৃদুপাখি বলতি।”
“হ্যাঁ বলতাম, গতকাল মৃদপাখি বলার অধিকারটা পূনরায় পেয়েছি আমি। মৃদুকে আমি মৃদপাখি বলেই ডাকতাম। ওর বড় আম্মু ওকে মৃদমনি বলতো আর আমি মৃদপাখি। ও আজীবন আমার কাছে আমার ঐ মৃদপাখি-ই থাকবে।”
“পরশ তুই বলেছিলি মৃদুলাকে ডিভোর্স দিবি। আশনি তোকে ভালোবাসে, ওর কি দোষ যে তুই ওকে শাস্তি দিতে চাচ্ছিস?”
“আশনি আমাকে ভালোবাসেনা আন্বিষ। সব সাজানো, আমার ভুলের কারণেই মা সুমেন ভাইয়ের সাথে মৃদুর বিয়ে দিতে চেয়েছিল তাই এইসব করেছি আমি। আশনি প্রথম থেকে সবটা জানে। আশনি নিজের ইচ্ছায় আমার প্ল্যানে সাহায্য করতে চেয়েছে, আমি ওকে বাধ্য করিনি।”
“আশনির যা ইচ্ছে হয় করুক। আমি মৃদুলাকে চাই পরশ।”
“সম্ভব না আন্বিষ। আমি ৯টা খুন করেছি এ যাবত আরো ১টা করতে আমার হাত বিন্দুমাত্র কাঁপবেনা।”
মৃদুলার মাথায় যেনো কেউ বিছনাকান্দির পাথর নিক্ষেপ করতেছে। পরশ ৬জনকে খুন করেছে এটা মৃদু জানে, আরো ৩জন কীভাবে যোগ হলো? আর তারা কারা? এদের সম্পর্কে মৃদু তো কিছুই জানেনা। কারা ঐ ৩জন, তারাও কি মৃদুর সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত?
আন্বিষ কিছু না বলে চলে যায়। পরশ দেখে মৃদু গভীর ভাবনায় মগ্ন।
“মৃদপাখি এতো ভাবতে হবেনা তোমার। আমি আজকেই তোমাকে জানবো। চলো।”
.
পরশের পাশে শুয়ে আছে মৃদুলা। পরশ কখন বলবে সেটাই বুঝতে পাচ্ছেনা মৃদু। এখনো কি সময় হয়নি?
“বলা তো শুরু করো প্লিজ।”
“তোমার লাস্ট এক্সামের দিন সুমেন ভাই যখন তোমার কপালে চুমু দেয়, সেটা আমি দেখেছিলাম মৃদুপাখি।”
“তো? এ্যাজ এ ব্রাদার দিয়েছিল চুমুটা।”
“সেটা থেকেই তো শুরু মৃদুপাখি। তুমি তো জানোনা যে আমি তোমার জন্মের পরই খালামুনি, মানে তোমার বড় আম্মুর থেকে তোমাকে চেয়ে নিয়েছিলাম। তুমি যখন ৪র্থ শ্রেণীতে পড়তে তখন তোমাকে একই শ্রেণির একটা ছেলে ‘আই লাভ ইউ’ বলেছিল। তুমি কান্না করতে করতে আমাকে এসে বলেছিলে, মনে আছে তোমার?”
“হ্যাঁ।”
“তুমিও বাচ্চা আর ঐ ছেলেটাও বাচ্চা। একটা বাচ্চা ছেলেকে কি আর বলতাম, তাই গুরুত্ব দেইনি কিন্তু পরের দিন তোমাকে স্কুলে ড্রপ করে আমি বাড়ি ফিরিনি। ঐ ছেলেটা আবারো তোমাকে একই কথা বলায় তার গালে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলাম। মা আমাকে পুরো ২দিন তোমার সাথে দেখা করতে দেয়নি।”
“এটার জন্যই তুমি সেদিন দেখা হতেই আমাকে চুমু দিয়েছিলে?”
“এটাও মনে আছে? হ্যাঁ মৃদপাখি, এমন কোনো দিন ছিলোনা যেদিনটা আমি তোমাকে ছাড়া কাটাতাম। তোমার জন্য বেড়াতেও যেতাম না, আর গেলেও তোমাকে ছাড়া যেতাম না।”
“হুম এটার জন্যই তো তুমি দেশে নেই এটা আমি ২বছর পর জানতে পারি, আর ২বছর পর এসে বিয়ে করে চলে গেলে ৪বছরের জন্য।”
“বউয়ের অভিমান এখনো ভাঙ্গেনি বুঝি?”
“না কোনো অভিমান নেই।”
.
.
“হেই।”
“আপনি আমার রুমে?”
“বউয়ের রুম, আসতেই পারি।”
“বউয়ের রুম মানে?”
“হবে তো। যখন-ই হওনা কেন আমারি হবে।”
“অসম্ভব। আমি আপনাকে কখনো বিয়ে করবোনা।”
“সেটা তো বললেও হবেনা পরী। তুমি শুধু এই জুনায়েদের-ই হবে। ভালোভাবে রাজি হয়ে যাও এতে তোমারি ভালো হবে, জোর করতে বাধ্য করলে সেটাও করবো।”
“আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই।”
“শুনলে না তো? এরপরে যা হবে তাতে আমাকে দোষ দিবেনা বুঝলে? বাই।”
.
.
.
মৃদুর সামনে কিছু ছবি পরে আছে। মৃদু বেডকম্পন ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো বেডজুড়ে। এইসব কিভাবে সম্ভব? একটা ছবিও এমন নেই যেটা মৃদুকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। পরশকে কিভাবে বুঝাবে সে? পরশ যদি বিশ্বাস না করে?
“পরশ এইসব কী? আমার আর সুমু ভাইয়ের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক ব্যতিত অন্য কিছু নেই পরশ।”
“রিল্যাক্স মৃদপাখি আমি জানি তুমি কিছুই করোনি। তুমি তো শুনলে আমি আরো ৩জনকে খুন করেছি, এখন কি তোমার জানতে ইচ্ছে করছেনা ওরা কারা? এই ৩জনকে আমি আমার কারণেই মেরেছি মৃদপাখি। ওরা আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করেছিল, ওদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
“তারপর কী হয়েছিল?”
“সেদিন সুমেন ভাইয়ের তোমার কপালে চুমু দেয়াটাই আমার চোখে ভাসা শুরু করে। অন্যকিছু ভাবতেই পাচ্ছিলাম না। সেই রাগ থেকেই ঐছেলেগুলোকে মেরে ফেলি আর তোমার উপরে হওয়া রাগের কারণে তোমাকে বিয়ে। যাকে আমি ভালোবাসি তাকে অন্যকেউ চুমু দিবে এটা ‍মেনে নেয়া সম্ভব ছিলোনা মৃদপাখি। সেদিন ওমন কিছু না হলে হয়তো আজ তোমার শরীরে এতো আঘাত থাকতোনা। রুবেলের কথা মনে আছে তোমার? আমি ফিরে যাওয়ার পরে রুবেলকে কল করে বলি তোমার উপরে নজর রাখতে।”
“তারপর?”
“কিউরিয়াস? ভালো। তবে শুনো। রুবেল আমার কথা মতো তোমার গতিবিধি পর্যবেক্ষন করা শুরু করে। প্রথমের কয়েকদিন আমি শান্তিতে ছিলাম মৃদপাখি কিন্তু রুবেলের সেদিনের ছবিটা আমাকে প্রথম কষ্ট দেয়া শুরু করে।”
“রুবেল ভাই কোথায়? তোমরা তো অনেক ভালো বন্ধু ছিলে। আমাদের সাথে আসলোনা যে?”
“বেঁচে থাকলে তো আসবে।”
“মানে?”
“আমাকে ধোঁকা দেয়ার শাস্তি দিয়েছি মৃদপাখি।”
চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here