#কালো_রাত্রির_খামে (০২)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________
“শ্রাবণী, ভাত খেতে এসো।” প্রিয়ারা ডাকলেন।
শ্রাবণী স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এসময় প্রিয়ারা বেগমের আগমন তার ভালো লাগলো না। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে জানতে চাইলো,
“কী রান্না করেছেন?”
“ভাত আর আলু ভর্তা বানিয়েছি।”
শ্রাবণী মুখ বিকৃত করলো। রাতে পটল আর ঝিঙা ভাজি, আর এখন আলু ভর্তা!
“আমি খাবো না, আপনারা খান।”
“রাতেও তো কিছু খাওনি। এখন তোমার অবশ্যই কিছু খাওয়া উচিত।”
“খাবো না আমি। আপনার কী তাতে? আপনি কি আমার মা? মা সাজার চেষ্টা করবেন না।”
শ্রাবণীর কথায় দৃষ্টি নত হয়ে যায় প্রিয়ারার। হৃদয়ের কোথাও খারাপ লাগার তীব্র গুঞ্জন টের পেলেন। যদিও এটা নব্য ঘটনা নয়। শ্রাবণী তাকে কখনোই পছন্দ করতো না।
অয়ন শ্রাবণীর কথার ক্ষুদ্রাংশ শুনে এ ঘরে এলো।
“কী বললি তুই?”
“কী বলেছি?”
“ভাত খাবি না?”
“না।”
“তুই তো ভালো, তোর বড়োটাও খাবে। চল।”
“আমার বড়োটা তো তুমি। তাহলে তুমি খেয়ে নাও।”
“চুপ। মুখে মুখে কথা?”
অয়ন টেনে ওকে রুম থেকে বের করলো। শ্রাবণী কিছুদূর যেতেই অয়ন প্রিয়ারার দিকে ফিরে বললো,
“ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। জানেনই তো ও এরকম।”
প্রিয়ারা এ ব্যাপারে কোনো কথা না বলে বললেন,
“চলো খাবার বেড়ে দিই।”
ছয় সদস্যের পরিবার। তবে টেবিলটা ছয়জন মানুষের বসে খাওয়ার চেয়ে ছোটো। তবুও ছয়জন মানুষ গাদাগাদি করে কোনো রকম বসা যায়। তবে প্রিয়ারা সকলের সঙ্গে খান না। তিনি পরে খান। সবাইকে খাওয়ানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তাই খান, তবে কখনও কোনো অভিযোগ নেই তার। ইদানীং অবশ্য রাত্রিও তার সঙ্গে খায়। সকলের সাথে বসে খায় না।
“টাকা লাগবে বাবা।” খেতে খেতে বললো শ্রাবণী।
এনামুল শিকদার শ্রাবণীর দিকে তাকালেন।
“কীসের জন্য?”
“টিফিনের জন্য।”
“তোমাকে তো টিফিন বানিয়ে দেওয়া হয়।”
“কী টিফিন বানিয়ে দেওয়া হয়? ওসব টিফিন মানুষের সামনে বসে খাওয়া যায়? সবাই ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খায়। শুধু আমিই একজন যে ওরকম পচা টিফিন নিয়ে স্কুলে যাই।”
মিথিলা বললো,
“তো নিয়ো না। না খেয়ে থেকো। বাজে ছেলেমেয়েদের মতো খামখেয়ালি করো না টাকার জন্য। টাকা গাছে ধরে না।”
শ্রাবণী নিজের বড়ো বোনকেও তেমন পছন্দ করে না। একমাত্র তার এরকম কথাবার্তার জন্য। সে বিরক্ত হয়ে বললো,
“তোমার কাছে তো টাকা চাইছি না, তুমি কথা বলছো কেন?”
মিথিলা রাগান্বিত হলো,
“কী বললে তুমি? বড়োদের যে নূন্যতম সম্মান করতে হয় জানো না? রাত্রির সঙ্গে থেকে থেকেই বেয়াদবি শিখেছো, না? রাত্রিও তো ছোটোবেলায় এমনই বদমাইশ ছিল।”
অয়ন বিরক্ত হলো। বললো,
“কথা হচ্ছে তোমাদের মাঝে, সেখানে আরেকজনকে না টানলেই কি নয়?”
মিথিলা কড়া গলায় বলে উঠলো,
“তুমি কথা বলবে না। আমি ভাবতে পারছি না এ ঘরের একটা ছেলেমেয়েও ভালো না হয়ে পারলো কী করে!”
“তুমিই তো বড়ো। তুমিই যখন ভালো হওনি আমরা কী করে ভালো হই। বড়োদের দেখেই তো ছোটোরা শেখে।” অয়ন জবাব দিলো।
মিথিলা বাবার দিকে তাকালো,
“বাবা তুমি কিছু বলবে না?”
এনামুল শিকদার যেন এতক্ষণ ধরে কিছু শুনতেই পাননি। তিনি আগেও যেমন খাচ্ছিলেন এখনও তেমনই খাচ্ছেন।
মিথিলার খুব রাগ হলো। রাগ করে না খেয়েই চলে গেল সে। প্রিয়ারা ডাকলেন, তবে সে ফিরলো না।
খাওয়ার পাট শেষে শ্রাবণী টাকা আনতে বাবার কাছে গেল। এনামুল শিকদার দশ টাকা বের করে দিলেন তার শার্টের পকেট খুঁজে।
“দশ টাকা? দশ টাকায় আজকাল কিছু হয়?”
“ভাংতি নেই, আজ এটাই নাও।”
শ্রাবণীর অভিমান হয়। সে কখনও টাকা চায় না। আজ এতদিন পর টাকা চাইতে এলো, তাও কি না দশ টাকা দিচ্ছে। শ্রাবণী তীব্র অভিমানে টাকাটা বিছানায় ফেলে বললো,
“লাগবে না টাকা, আমি না খেয়ে থাকবো। আর একদিন না খেয়েই মরবো।”
শ্রাবণী হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।
এনামুল শিকদার পিছন থেকে ডাকলেন,
“ঠিক আছে তাহলে পনেরো টাকা নাও।”
কিন্তু শ্রাবণী তার কথা শুনলো না। স্কুল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে। তার চোখে জল।
_________________
নিজেকে আর পাঁচটা মানুষের থেকে গুটিয়ে নেওয়া খুব কষ্টের, আবার তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাও কষ্টের। অয়ন মনে করে দরিদ্র আর বিত্তবানদের মধ্যে বন্ধুত্ব হওয়া উচিত না। অথচ তার সব বন্ধুদেরই ভালোই টাকাপয়সা। ওদের মাঝে নিজেকে খুব বেমানান লাগে। সব বন্ধুদেরই সমান খরচ করার মতো সামর্থ্য থাকা বাঞ্ছনীয়। না হলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হয়। দেখা যাচ্ছে কোথাও খেতে গেলে কিংবা ঘুরতে গেলে অয়নের টাকা অন্য বন্ধুরা মিলে দিয়ে দিচ্ছে। অয়ন খুব লজ্জিত বোধ করে। ইদানীং তাই সে আর বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে কিংবা খেতে যায় না। বন্ধুদের সাথে কোথাও খেতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে এড়িয়ে যায়। আজও এড়িয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরছিল। পাশের বাড়ির গেটের সামনে একটা ট্রাক দাঁড় করানো। ট্রাকে নানান মালপত্র। শুনেছিল বাড়িটা বিক্রি হয়েছে। এরা হয়তো সেই নতুন মালিক।
তারা যে বিল্ডিংয়ে থাকে বিল্ডিংটা খুব পুরোনো। মোট তিনটা পরিবার থাকে ওই বিল্ডিংয়ে। তারা সহ সকলেই নিম্নবিত্ত। অমন পুরোনো, ক্ষয়প্রাপ্ত বাড়ির পাশে একটা ভালো সুন্দর বাড়ি খুবই দৃষ্টিকটু লাগে দেখতে।
হঠাৎ ট্রাকের পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্য বয়স্ক লোক অয়নকে ডাকলো,
“এই যে ছেলে, শোনো।”
অয়ন শুনেও সাড়া দিতে চাইলো না। বিত্তবানদের এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে সে। অয়ন শুনতে পায়নি ভেবে লোকটা আবারও ডাকলো,
“এই যে, তোমাকে বলছি।”
এবারও না শোনার ভঙ্গি করাটা বেয়াদবির কাতারে পড়ে যাবে বিধায় অয়ন দাঁড়ালো। কিছুটা এগিয়ে এলে লোকটা বললো,
“এই জিনিসপত্র গুলো ভিতরে নিতে আমাদের একটু সাহায্য করবে?”
“না।” অয়ন মুখের উপর উত্তর প্রদান করলো, “আমি কুলি নই। এখানে অনেকে আছে যারা টাকার বিনিময়ে আপনার জিনিসপত্র ভিতরে দিয়ে আসবে। তাদের সাহায্য নিন।”
অয়ন চলে গেল। ফারুকী সাহেব বিস্ময়পূর্ণ চোখে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে আছেন। রোশনি বাবার বিস্মিত আঁখি জোড়া লক্ষ করে বললো,
“বেয়াদব ছেলেপুলেদের কাছে সাহায্য চাও কোন আক্কেলে?”
ফারুকী সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
“বুঝবো কী করে কে বেয়াদব আর কে সভ্য?”
“একটা মানুষকে দেখলেই বোঝা যায় সে কী রকম।”
“কীভাবে?”
“দেখোনি ছেলেটার চোখ ছোটো ছোটো।”
“তো?”
“এরকম চোখের ছেলেরা সাধারণত বেয়াদব হয়।”
“কে বলেছে তোকে?”
“দাদি বলেছে।”
“দাদি? আর মানুষ পেলি না!”
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করবে?” শায়লা বেগম স্বামী ও মেয়ের কথায় বিরক্ত হয়ে বললেন, “যাও দেখো গিয়ে কোনো মানুষ পাও কি না।”
__________________
কলিং বেলের শব্দ হচ্ছে। মালিহা দৌড়ে এসে দরজা খুললো। মাথায় ওড়না দেওয়া মেরুন রঙের থ্রি-পিস পরা একজন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মালিহা সালাম দিলো। দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটি সালাম গ্রহণ করে ভিতরে ঢুকলো।
“কাল যে ভয়েস চেঞ্জগুলো দিয়েছিলাম সবগুলো করেছো?”
“জি না ম্যাডাম।”
রাত্রির কিঞ্চিৎ মেজাজ খারাপ হলো। মেয়েটাকে কোনো কাজ দিলে কখনও সেই কাজ ঠিকঠাকভাবে করে না। তবুও মুখে সে কিছুই বললো না। মালিহার রুমে ঢুকে যারপরনাই অবাক হতে হলো তাকে। আদিল বসে আছে মালিহার টেবিলের সামনে। ওখানে আগে দুটো চেয়ার ছিল। এখন আরও একটা বাড়তি চেয়ার দেখা যাচ্ছে। যেটা দখল করে বসে আছে আদিল।
রাত্রি মালিহার দিকে তাকালো। ফিসফিস করে জানতে চাইলো,
“তোমার ভাই এখানে কেন?”
মালিহা মুখ টিপে হাসলো। যা দেখে আরও অবাক হলো রাত্রি।
আদিল বললো,
“কী ফিসফিস করছেন?”
রাত্রি আদিলের দিকে ফিরলো। খুব কষ্টে ঠোঁটে হাসি এনে বললো,
“কিছু না।”
“আপনি এখনও ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” আদিল হাতের ঘড়ি দেখে বললো,
“চারটা পাঁচ বেজে গেছে। পাঁচ মিনিট এমনিতেই লেট করেছেন। তাড়াতাড়ি পড়াতে বসুন।”
“সেটা তো ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এখানে কেন?”
আদিল এবার খুব চমৎকার ভাবে হাসলো। বললো,
“কারণ আজ থেকে আমিও আপনার কাছে পড়বো।”
রাত্রির চোখ কপালে উঠলো।
“মানে?”
“মানে আজ থেকে আমি আপনার স্টুডেন্ট, আর আপনি আমার ম্যাডাম।”
রাত্রির মনে হলো আদিল মজা করছে। কিন্তু একজন মানসিক রোগী মজা করতে পারে কি না সেটা তার জানা নেই। রাত্রি আবারও হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এসব কী বলছেন? আপনি তো হাই স্কুলের বা কলেজের ছাত্র না, আমি আপনাকে কীভাবে পড়াবো? তাছাড়া আপনি আমার থেকে বেশি লেখাপড়া করেছেন। দয়া করে আপনি এখান থেকে চলে গেলে খুশি হতাম। আপনি এখানে থাকলে আমার পড়াতে সমস্যা হবে।”
“উহ আপনি বুঝতে পারছেন না রাত্রি। আমি এমনি এমনি আপনার কাছে পড়তে চাইছি না। আমি লেখাপড়া ভুলে যাচ্ছি। তাহলে শুনুন ঘটনাটা। গত রাতে আমি ইংরেজি বর্ণমালা লিখতে বসলাম। লিখলামও। লেখার পর গুনে দেখি বাইশটা বর্ণ। বাকি চারটা কোথায় গেল? এখন আপনিই বলুন, আমার লেখাপড়া শেখার দরকার আছে কি না?”
রাত্রি বুঝতে পারলো আদিলকে বলে লাভ নেই, তাই সে আবারও মালিহার দিকে ফিরলো। এবং আবারও সেই ফিসফিসানি,
“তোমার ভাইকে চলে যেতে বলো।”
“কেন ম্যাডাম? একটু পড়ান না আমার ভাইকে। আমার ভাই লেখাপড়া ভুলে যাচ্ছে।” মালিহার চোখে-মুখে করুণ আকুতি।
রাত্রির মনে হলো শুধু আদিল না, মালিহাও পাগল।
রাত্রি এখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আদিলের রাগ হলো। রুক্ষ হলো তার গলার স্বর। বললো,
“আপনি আসবেন? না কি আপনাকে তুলে আনতে হবে? আসুন।”
আসুন শব্দটা প্রায় ধমকে বলে উঠলো। যাতে ভয় পেয়ে গেল রাত্রি। দ্রুত পায়ে এসে নিজের নির্ধারিত চেয়ারটায় বসে পড়লো। বুক ধুকপুক করছে। এ কেমন কঠিন পরীক্ষা শুরু হলো তার সঙ্গে!
“পড়ান।”
“কী পড়াবো?”
“ওকে যা পড়ান আমাকেও তাই পড়াবেন।”
রাত্রি দুই ভাই-বোনকে আলাদা ভাবে দশটা ভয়েস চেঞ্জ করতে দিলো।
পাঁচ মিনিটের মাথায়ই আদিল বললো,
“নিন।”
এরই মধ্যে করা শেষ? রাত্রি অবাক হলো। এর চেয়েও বেশি অবাক হলো যখন দেখলো উত্তর গুলো সঠিক। রাত্রি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। একজন পাগল কী করে…কীভাবে সম্ভব এটা?
“তোমার করা হয়েছে?” মালিহাকে বললো রাত্রি, “দেখি।”
মালিহা তিনটা করেছে। এর মধ্যে দুটোই ভুল।
“তোমাকে এই শিখিয়েছিলাম?”
আদিল বললো,
“পারেনি? বেতটা কোথায়?”
আদিল বেত খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু সারা রুম খুঁজেও বেত পাওয়া গেল না।
“বেত কোথায়?” গরম চোখে মালিহার কাছে জানতে চাইলো আদিল।
মালিহা বেতটা ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সে কথা আদিলকে বললে আদিল ভীষণ রেগে যাবে। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিলো,
“সোহাগি চাচি ময়লা ভেবে ফেলে দিয়েছে।”
“তাই? আচ্ছা, কোনো ব্যাপার না।”
আদিল টেবিলের কাছে ফেরত এলো। স্টিলের একটা স্কেল রাত্রির হাতে দিয়ে বললো,
“এটা দিয়ে মা’রুন।”
মালিহা কেঁদে দিলো। এটা তার আপন ভাই?
রাত্রি বললো,
“কেঁদো না, মা’রবো না তোমাকে।”
“মা’রবেন না মানে? মা’রতে হবে।” জোর গলায় বলে উঠলো আদিল।
রাত্রি খুব বিরক্ত, রাগান্বিতও। তাই এবার সে ভয় ফেলে বলে উঠলো,
“টিচার আমি না আপনি?”
এ প্রশ্নে আদিল শান্ত হলো। চেয়ারে বসে পড়লো ধপ করে। মালিহাকে বললো,
“যা পানি খেয়ে আয়।”
মালিহা বাধ্য মেয়ের মতো উঠে গেল। মালিহা যেতেই আদিল বললো,
“কাল রাতে আপনি আমার কল কেটেছেন কেন?”
“কল কেটেছি মানে? আপনি কি আমাকে কল দিয়েছিলেন?” রাত্রি পুরোটা না জানার ভাণ করলো।
আদিল হেসে ফেললো। যা দেখে ঘাবড়ে গেল রাত্রি। আদিল বললো,
“আদিলের বউ হবেন, অথচ কি না ভালো মিথ্যা বলতে পারেন না? কাল থেকে আমি আপনাকে মিথ্যা বলা শেখাবো। ফুল কোর্স পাঁচশ টাকা। শিখবেন?”
রাত্রি জবাব দিলো না। আদিল বললো,
“আজই ব্লক খুলবেন।”
রাত্রি নিশ্চুপ। তার নিশ্চুপতা ভালো লাগছে না আদিলের। সে স্কেল দিয়ে জোরে টেবিলে আ’ঘাত করে রাগত স্বরে বললো,
“খুলবেন কি না?”
“হ্যাঁ, খুলবো।” আদিলের রাগান্বিত রূপে আবারও ভয় পেল রাত্রি।
“আদিল!” দরজা থেকে ডাকটা ভেসে এলো।
পারভীন দাঁড়িয়ে আছেন। আদিল তাকে দেখা মাত্রই হাত নেড়ে বললো,
“হাই মা!”
“এখানে কী করছো তুমি?”
“লেখাপড়া শিখছি।”
“লেখাপড়া শিখছো মানে?”
“গতরাতে আমি ইংরেজি বর্ণমালা লিখেছিলাম। কিন্তু লেখার পর গুনে দেখি বাইশটা। বাকি চারটা কোথায় গেল?”
“ম্যাডামের পড়ানোতে ডিস্টার্ব করো না। আমার সাথে এসো। দেখছি বাকি চারটা অক্ষর কোথায় গেল। এসো।”
আদিল চলে গেল মায়ের সাথে।
রাত্রির মনে হলো সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
__________________
হাতে বাজারের ব্যাগ। বাড়ি ফিরছে রাত্রি। আর ভাবছে আদিলের কথা। খুব কষ্টে সে টিউশনিটা জোগাড় করেছিল, কিন্তু আদিল যা শুরু করেছে তাতে মনে হয় না এটা বেশিদিন থাকবে। পারলে সে এখনই টিউশনিটা ছেড়ে দিতো, কিন্তু টাকারও খুব প্রয়োজন। এই টিউশনির টাকাও একটু হলেও পরিবারের উপকারে আসে। এই টিউশনিটা ছেড়ে দিলে পরবর্তীতে টিউশনি আবার পাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব না। কিন্তু আদিলের আচরণও সহ্য করা সম্ভব নয়। কী করবে? পারভীন আন্টিকে বলবে? রাত্রি সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। পারভীন আন্টিকে বললে হয়তো তিনিই টিউশনি পড়াতে যেতে নিষেধ করবেন। রাত্রি খুব অসহায় বোধ করছে। অভাবীদের এক দিক ভাবলে চলে না, সব দিক ভাবতে হয়। আর সব দিক ভাবতে গিয়েই তারা আটকা পড়ে যায়।
রাত্রি গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পথ এগোচ্ছিল। সামনেই রয়েছে বাঁক। আর সেই বাঁক নিতে গিয়েই তাকে সম্মুখীন হতে হলো ভয়ংকর কিছুর। সে সবে বাঁক নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিতে পারলো না। ভয়ে প্রায় ছিটকে পড়লো রাস্তায়। তার হাতের সবজিও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়লো। কিছু সবজি গড়িয়ে গেল দূরে। তার দু চোখে রাজ্য জোড়া ভয়। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা কয়েক সেকেন্ড থেমে থেকে গলা কা’টা মুরগির মতো লাফাতে শুরু করলো।
(চলবে)