কালো রাত্রির খামে পর্ব -০৩

#কালো_রাত্রির_খামে (০৩)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________

চোখের সামনে একজনকে মা’র খেতে দেখছে রাত্রি। যার থেকে তার দূরত্ব মাত্র এক হাত। আর একটু হলেই এই মা’র খেতে থাকা ছেলেটার সঙ্গে তার ধাক্কা লাগতো। মূলত ধাক্কা ঠেকাতেই নিজের ছুটন্ত পা জোড়াকে অপ্রস্তুত ভাবে থামাতে গিয়ে ছেলেটা মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়। রাত্রিও আকস্মিক ভাবে তার সামনে পড়ে ভড়কে যায়। তবে আসল ভয়ের ব্যাপার সেটা নয়। ছেলেটার পিছনে যে আরও একদল স’ন্ত্রাসীর মতো ছেলেগুলো ছিল তারাই ভয়ের মূল কারণ। অনবরত চ’ড়-লা’থিতে ছেলেটার নাক, মুখ কে’টে র’ক্ত বের হলো। তারপরও মা’রা থামালো না ছেলেগুলো। এক সময় থামলো তারা। কালো শার্ট পরা একটা ছেলে মা’র খাওয়া ছেলেটার কলার চে’পে ধরলো। তার চোখ ক্রোধে রক্তিম। বললো,
“আমার বোন কোথায়?”

মা’র খাওয়া ছেলেটা কান্না ভাঙা কণ্ঠে বললো,
“বিশ্বাস করুন ভাইয়া, আমি জানি না ও কোথায়।”

“ওহ, তুই জানিস না? মিথ্যা বলবি না। একদম মে’রে পুঁ’তে ফেলবো। আমি জানি ওকে তুই-ই নিয়ে গেছিস। আজ সন্ধ্যার মধ্যে ওকে বাসায় দিয়ে আসবি। বুঝেছিস?”

ছেলেটা কলার ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষণ অবধি সে রাত্রিকে খেয়াল করেনি। এবার তাকালো। এখনও রাস্তায় পড়ে রয়েছে রাত্রি। চোখ-মুখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আতঙ্ক। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে সবজি। ছেলেটার চোখ সরু হলো। কয়েক সেকেন্ড সে দেখলো রাত্রিকে। রাত্রি তার দৃষ্টির সম্মুখে ভয়ে আরও সেটিয়ে যাচ্ছিল। চোখ সরালো ছেলেটা। সাথের ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বললো,
“চল।”

তারা চলে গেলেই রাত্রি এগিয়ে এলো রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে।

“আপনি ঠিক আছেন?”

“জি না, আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে সাহায্য করবেন?”

রাত্রির মনে হলো এই মা’রামারির ভিতরে তার জড়ানো উচিত না। কিন্তু ছেলেটাকে এরকম ফেলে রেখেও তো যাওয়া যায় না। সে একটা রিকশা ডেকে আনলো। এ রাস্তায় সচরাচর কোনো রিকশা কিংবা অন্য যানবাহন চলাচল করে না। সে ছেলেটাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলেই রিকশা চলে গেল। রাত্রি দুর্বল চোখে তাকালো রাস্তায় পড়ে থাকা সবজির দিকে। খুব যত্নে তুলে নিলো সবজিগুলো। এগুলোই তো তাদের রাতের খাবার।
সারা পথে ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখে ভাসলো রাত্রির। এর আগে এমন কিছুর সম্মুখীন সে কখনও হয়নি। ওই ছেলেগুলো কি স’ন্ত্রা’সী ছিল? মা’র খাওয়া ছেলেটার কী দোষ? বোন নিয়ে কিছু একটা বলছিল, কিন্তু কী বলেছিল সে খেয়াল করেনি। সে ছিল ভয়ে তটস্থ। তখন কিছু খেয়াল করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। নানাবিধ দুশ্চিন্তা করতে করতে রাত্রি কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেল টেরই পেল না। গেট খুলতে গিয়ে লক্ষ করলো তার হাতের তালু ছিলে গেছে। অথচ সে কি না যন্ত্রণা অনুভব করেনি। কিন্তু হঠাৎ এখন খেয়াল করায় যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার!

রাত্রি বাজারের ব্যাগ প্রিয়ারার কাছে হস্তান্তর করার সময় প্রিয়ারা তার হাতের ক্ষত লক্ষ করলেন।

“আ’ঘাত পেলে কীভাবে?”

“পড়ে গিয়েছিলাম।”

প্রিয়ারার ইচ্ছা হয় রাত্রির হাত ধরে ক্ষ’তটা ভালোভাবে দেখতে। যত্ন করে আ’ঘাতের স্থানে ব্যথানাশক লাগিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি কিছুই পারেন না। সন্তানদের সামনে কুণ্ঠাবোধ করেন। কারণ তিনি এখনও নিশ্চিত না সন্তানদের মনে তার জন্য কেমন স্থান গঠিত। শুনতে হয়তো অবাক শোনাচ্ছে, নয় বছরে সে এটা কীভাবে নিশ্চিত না হয়ে পারে? অবাক হলেও এটাই সত্যি। সে তো সৎ মা। সৎ মাকে সহজে কেউ আপন ভাবতে পারে না।

বসার অথবা কোনো শোবার ঘর থেকে হঠাৎ বাকবিতণ্ডার আওয়াজ ভেসে এলো। রাত্রি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল সেখানে। শ্রাবণী এবং মিথিলা কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া করছে। কী হয়েছে জানতে চাইলেই মিথিলা বললো,
“কী হবে আবার? তোর সঙ্গে থেকে থেকে বেয়াদবটা আরও বেয়াদবি শিখেছে। ওর ভালো চাইলে তুই আর ও একসঙ্গে এক রুমে থাকিস না।”

“ঠিক আছে, আজ থেকে তাহলে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো।” শ্রাবণী বললো। সে জানে মিথিলা তাকে কখনোই নিজের সঙ্গে থাকতে দেবে না। আর দিলেও সে কখনও থাকবে না কি?

মিথিলা বললো,
“ভাবলি কী করে তোর মতো বেয়াদবকে আমি আমার সাথে রাখবো? বসার ঘরে বিছানা পেতে শুবি তুই।”

শ্রাবণীর ভীষণ রাগ হলো। বললো,
“আমি কোথায় শোবো না শোবো সেটা তুমি বলার কে? নিজের থাকা নিয়ে ভাবো।”

রাত্রি ধমকে উঠলো,
“শ্রাবণী, মুখে মুখে তর্ক করছো কেন?”

মিথিলার চোখে অশ্রু এসে ভিড় জমিয়েছে। কখনো কখনো সে অল্পতেই আবেগী হয়ে ওঠে। কেঁদে ভাসায়। সে হঠাৎ রাত্রির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“ও…তাহলে এইসব শেখাস ওকে?”

রাত্রি অবাক হয়ে গেল। মিথিলা বললো,
“আমি এখানে এসে থাকছি বলে আমি তোদের চোখের বিষ হয়ে গেছি, তাই না? থাকবো না এই বাড়িতে। দেখি আমি মরে যাই কি না।”

মিথিলা দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকালো। সে যে এখন অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে সেটা কারো অজানা নয়।
রাত্রির রাগ হলো শ্রাবণীর উপর। ওর পিঠে একটা থা’প্পড় মে’রে বললো,
“এটা কী করলে তুমি?”

“কী করেছি? সে আসলো কেন শুধু শুধু আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে?”

“সে যে আমাদের বোন সেটা তুমি ভুলে গেছো? কেন শুধু শুধু তর্ক করলে?”

“বোন হয়ে সে পাশের বাসার চাচিদের মতো আচরণ করে। সে আমাকে পছন্দ করে না। কোনো বিষয় উঠলে অযথা তোমার নামে দোষারোপ করে। এগুলো বোনের নমুনা? সে সব সময় এমন ছিল।”

“তবুও সে আমাদের বোন। বোনদের প্রতি বোনদের হৃদয়ে অদৃশ্য একটা টান থাকে। যেটা তারও আছে তোমারও আছে।”

শ্রাবণী ফট করে বললো,
“তার জন্য আমার হৃদয়ে কোনো টান নেই।”

বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

____________________

“এই যে, একটু দাঁড়ান।”

না ছেলেটার মাঝে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। সে হাঁটছে তো হাঁটছেই।
রোশনি এবার আরও জোরে ডাকলো,
“আপনি কানে কম শোনেন? দাঁড়ান।”

আশ্চর্য! ছেলেটা দাঁড়াচ্ছেই না। রোশনির মাঝে জিদ চাপলো। ছেলেটাকে সে দাঁড় করিয়েই ছাড়বে। লিচুর প্যাকেট থেকে একটা লিচু বের করে সে ছেলেটার দিকে ছুঁড়ে মা’রলো। লিচুটা গিয়ে ঠিক ছেলেটার পিঠ বরাবর লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালো ছেলেটা। পিছনে ফিরে পিঠে কী পড়েছে খুঁজলো। দেখতে পেল একটা লিচু পড়ে আছে। সে এবার রোশনির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা আপনি মে’রেছেন?”

রোশনি এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“জি।”

“বেয়াদবের মতো কারো গায়ে লিচু ছুঁড়ে মে’রেছেন, আবার অকপটে বলছেনও?”

রোশনি অয়নের সামনে এসে থামলো। বললো,
“স্যরি! আমি আপনাকে ডাকছিলাম, কিন্তু আপনি শুনতেই পাচ্ছিলেন না। তাই…”

“তাই বলে এমন করবেন? একজন অপরিচিত মানুষের গায়ে লিচু ছুঁড়ে মা’রবেন?”

“স্যরি বললাম তো, এখন কি পা ধরে মাফ চাইতে হবে?” রোশনি রাগলো।

“ডাকছিলেন কেন?”

রোশনি রাগ গুঁড়িয়ে হঠাৎ আবার হাসলো। বললো,
“আমি প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম আপনি একজন বেয়াদব।”

অয়নের চোখ সরু হলো বিস্ময়ে, পরমুহূর্তে রাগ,
“কী বলছেন আপনি?”

“জি, ঠিক বলছি। আপনার চোখ দুটো ছোটো ছোটো। ছোটো চোখের ছেলেরা বেয়াদব হয়। আমার বাবা তো বুঝতে পারেনি, তাই আপনার কাছে সাহায্য চেয়ে বসেছিল।”

অয়নের মনে হচ্ছে তার সামনে কোনো পাগল দাঁড়িয়ে আছে, কিংবা মানুষকে হাসায় এমন কোনো কার্টুন। কথা নেই বার্তা নেই কোত্থেকে এসে বলছে, আপনি বেয়াদব। অয়ন জানতে চাইলো,
“আপনার বাবা কে?”

“আমার বাবাকে আপনার মনে নেই? মি. ফারুকী হাসান। ওই যে আপনাদের পাশের বাড়িতে যারা নতুন এসেছে। আমি সেই পরিবারের একজন।”

অয়নের মনে পড়লো। বললো,
“তাহলে এখন আমি কী করতে পারি?”

“না, আসলে আমি ভাবতেই পারিনি সত্যিই ছোটো চোখের ছেলেরা বেয়াদব হয়। কিন্তু আপনাকে দেখার পর একদম নিশ্চিত হয়ে গেছি।”

অয়ন মনে মনে আওড়ালো,
‘পাগল-ছাগল।’

কিন্তু মুখে কিছু না বলেই যাওয়ার জন্য ঘুরলো। তবে হঠাৎই পিছন ফিরে তাকালো আবার। মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাহলে তো বলতে হয় আপনি আমার চেয়েও বেশি বেয়াদব।”

“আপনি কি এটা আমার চোখ ছোটো সেজন্য বলছেন? যাদের চোখ ছোটো তারা বেয়াদব হয় এই রুলস শুধু ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, মেয়েদের ক্ষেত্রে না।”

অয়ন বুঝতে পারছে না সে একটা পাগলের সঙ্গে কথা বলে কেন সময় নষ্ট করছে। সে আর কিছু বললো না। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
রোশনি মনে মনে ভাবলো, ওয়াও! ছেলেটা তো আসলেই বেয়াদব। কোনো বিদায়ী শব্দ উচ্চারণ না করেই চলে যাচ্ছে।

___________________

এনামুল শিকদার বাড়ি ফিরেছেন। আজ কাজের প্রয়োজনে তাকে দূরে কোথাও যেতে হয়েছিল। তাই ফিরতেও রাত হয়ে গেছে। একটা শাড়ি কিনেছেন তিনি প্রিয়ারার জন্য। প্রিয়ারা শাড়ি দেখে খুশি হওয়ার বদলে চিন্তিত স্বরে বললেন,
“এটা কী করেছেন? শুধু শুধু খরচ করেছেন কেন?”

এনামুল শিকদার প্রিয়ারার পরনের শাড়ির দিকে তাকালেন। রং মলিন হওয়া পাণ্ডুর শাড়ি। কত আগে কিনে দিয়েছিলেন তা আর মনে পড়ে না। তিনি জানেন শাড়িটা দুই জায়গা দিয়ে ছিঁড়ে গেছে। যেটা প্রিয়ারা সেলাই করে পরছেন সেই কবে থেকে। কিন্তু কখনও বলেনি শাড়ি ছিঁড়ে গেছে। এনামুল শিকদার বললেন,
“তোমাকে শেষ কবে শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম মনে পড়ে প্রিয়ারা?”

প্রিয়ারা জবাব দিলেন না। এনামুল শিকদারই বললেন,
“আমার মনে নেই। ছেলেমেয়েদের কিছু কিনে দেওয়া হলেও তোমাকে দেওয়া হয়নি। আসলে তুমি কিছুই পাওনি আমার থেকে, কেবল একটা অভাবী জীবন ছাড়া।”

“না আমি খুব ভালো আছি আপনার সাথে।”

“মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ?”

“না, সত্যি বলছি।”

এনামুল শিকদার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“আমি বুঝি প্রিয়ারা, তোমার কষ্ট হয়, ছেলেমেয়ে গুলোরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবো বলো, আমার সামর্থ্য নেই তোমাদের ভালো রাখার। টাকার অভাবে মেজো মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। ছেলেটার লেখাপড়ার খরচ ঠিকঠাক দিতে পারি না, হাত খরচ দিতে পারি না। আজকালকার দিনের ছেলেদের নিত্য কত হাতখরচ জানো তো? অথচ আমি কী দিই ওকে? ছোটো মেয়েটা খুব অভিমানিনী। এখনও তেমন বড়ো হয়নি তো, সবাই মুখ বুজে সব মেনে নিলেও, ওর মানতে কষ্ট হয়।”

এনামুল শিকদারের চোখে জল। প্রিয়ারা বললেন,
“আজ হঠাৎ আপনি এসব কথা তুলছেন কেন?”

“আজ অফিসে ছোট্টো একটা ভুল করে ফেলেছিলাম, স্যার বললেন, ফিরে যদি আবারও ভুল হয় আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে। তার ওই কথার পর খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবছি, সত্যিই যদি এই কাজটাও ছাড়তে হয় তাহলে কী হবে?” প্রিয়ারার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি জানো প্রিয়ারা তাহলে কী হবে?”

প্রিয়ারার বুক কেঁপে ওঠে। তিনি জানেন কী হবে। হয়তো মাথার উপর থেকে ছাদটাই চলে যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here