#কালো_রাত্রির_খামে (০৪)
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________________
মাঝে মাঝে আদিলের পাগলামি বেড়ে যায়। আজ তার পাগলামি বেড়ে গেছে। দুপুর থেকে একটা মস্ত বড়ো কাজ করে চলেছে সে। প্রথমে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢালছে, তারপর গ্লাসের পানি বালতিতে। জগ খালি হয়ে গেলে জগে আরও পানি ভরে আনছে ট্যাপ থেকে। বালতি পূর্ণ হয়ে গেলে বালতির পানি বাথরুমে গিয়ে ঢেলে আবারও একই কাজ করছে। আর মুখে বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলছে। কোনো কথাই স্পষ্ট না। রাত্রি যখন পড়াতে এলো তখনও আদিল এই কাজটা করছে। রাত্রি অবাক হয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আদিলের কাজ কারবার দেখলো। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পাছে আদিল আবার তাকে দেখে ফেলে তাই মালিহার রুমে ঢুকে পড়লো তাড়াতাড়ি।
“তোমার ভাই কতক্ষণ ধরে ওরকম করছে?” রাত্রি জানার আগ্রহবোধ করলো।
“দুপুর থেকে ম্যাডাম।”
“ওহ।”
আদিলকে এর চেয়েও অদ্ভুত কাজ এর আগে করতে দেখেছে রাত্রি। একবার আদিল নিজের সব জামাকাপড় কাঁচি দিয়ে কে’টে ফেলেছিল। কিছুদিন আগে ফ্রিজের মাছ-গোশত বের করে টেবিলের নিচে রেখে দিয়েছিল। যার ফলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাছ-মাংস গুলো। তবে আদিল আজ যা করছে তাতে তারই ভালো হবে। এরকম করতে থাকলে আর বিরক্ত করতে আসবে না।
আজকে মালিহাকে পড়িয়ে শান্তি পাওয়া গেল। আদিল একবারও আসেনি। পানি ঢালার কাজেই ব্যস্ত ছিল। রাত্রি মালিহার রুম থেকে যখন বের হলো তখনও আদিলের পানি ঢালার কাজটি অব্যাহত রয়েছে। রাত্রির হঠাৎ দুঃখবোধ হলো। এরকম ভাবে মানসিক রোগী হয়ে গেল ছেলেটা! রাত্রি ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগোলো। মালিহা দরজা খুলে দিলেই আদিল হঠাৎ বলে উঠলো,
“দাঁড়ান।”
রাত্রি আশা করেনি আদিল তাকে লক্ষ করবে। এই শেষ মুহূর্তে ছেলেটার দৃষ্টি গোচর না হলেই কি হতো না? পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, আদিল এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে আসছে। রাত্রি বুঝতে পারছে না আদিল কী করবে। গ্লাসের পানি কি তার মুখে ছুঁড়ে মারবে? পাগল তো, যা খুশি করতে পারে। রাত্রি মনে মনে সতর্ক হলো।
আদিল পানির গ্লাস রাত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“পান করুন।”
“আমার তেষ্টা পায়নি।”
“পেয়েছে। আপনি বুঝতে পারছেন না। খান।”
এই পানি খেতে রাত্রির মন সায় দিচ্ছে না। কোথাকার কোন পানি কে জানে। সে বললো,
“না ভাইয়া সত্যিই আমার তেষ্টা পায়নি।”
আদিল অদ্ভুত একটা কাজ করলো হঠাৎ, গ্লাসের পানি টুকু নিজের মাথায় ঢাললো। তারপর এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে অতিরিক্ত পানি ঝাড়ার চেষ্টা করলো। যে পানি কিছুটা রাত্রির মুখে এসে লাগলো। হাত দিয়ে মুখ মুছে নিলো সে।
আদিল বললো,
“আপনি কি সেই মিসিং হওয়া চারটা অক্ষর খুঁজে পেয়েছেন রাত্রি?”
“আপনি তো আমাকে খাতা দেখাননি। কীভাবে বুঝবো কোন অক্ষরগুলো মিসিং?”
“আমি জানি কোন অক্ষরগুলো মিসিং। আসেন, কানে কানে বলি।”
আদিল রাত্রির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
“L-O-V-E.”
রাত্রি প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না। তার কাছে অক্ষরগুলো কেবলই অক্ষর মনে হলো। কিন্তু হঠাৎ অক্ষর গুলোর পরম্পরা সাজানোর দিক খেয়াল করলেই সে চমকে তাকালো আদিলের দিকে। আদিল মৃদু হাসলো। ছেলেটা হাসলে খুব নিষ্পাপ দেখায়। কিন্তু তবুও সে একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ। রাত্রি আর দাঁড়িয়ে রইল না। যত দ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে নেমে গেল। শেষ সিঁড়িতে পারভীনের সঙ্গে দেখা হলো তার। আজ পারভীন কিছুটা দেরি করে ফিরেছেন। রাত্রি সালাম জানালো। পারভীন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”
“জি বলুন না।”
পারভীন জড়তা ভরা কণ্ঠে বললেন,
“আমি জানি, আদিলকে হয়তো তোমার ভালো লাগে না। যখনতখন তোমার পড়ানোতেও ডিস্টার্ব করে। মানসিক দিক থেকে ও একটু অন্যরকম তো, তাই চাইলেই ওকে কিছু বলে বোঝানো যায় না। আশা করছি তুমি একটু মানিয়ে নেবে।”
রাত্রি পারভীনের এমন কথায় কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। পারভীনের জানা নেই তার ছেলে আসলে কতটা পাগলামি করছে। আদিলকে নিয়ে এর আগে তেমন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যেদিন থেকে সে বললো, ‘আমাকে বিয়ে করবেন?’ সেদিন থেকে সমস্যাটা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। রাত্রি ইতস্তত করে বললো,
“না আসলে তেমন ব্যাপার নয়। আমি বুঝি আপনাদের ব্যাপারটা। উনি তো এরকম সুস্থ মস্তিষ্কে করছেন না, উনি সমস্যাগ্রস্ত। আমার তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।”
পারভীনের চোখে জল চিকচিক করে উঠলো। বললেন,
“আমাদের যে কী কষ্ট সেটা আসলে মানুষকে বোঝাতে পারি না। ওর বাবা মারা গেছে। ওকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম লেখাপড়া করতে। পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষ করে ফিরলোও। আর ফেরার দিনই কোত্থেকে কী যে হয়ে গেল! ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নগুলো পূরণ হলো না!”
পারভীন ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন।
পারভীনের কথা শুনে রাত্রিরও খুব খারাপ লাগছে। তার মনে হলো পৃথিবীতে কষ্টের বিভিন্ন ধরন আছে। তারা আর্থিক কষ্টে আছে, কিন্তু পারভীনের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্যেও তার জীবনেও আছে বড়ো একটা দুঃখ। রাত্রি সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললো,
“ভেঙে পড়বেন না আন্টি। ইনশাআল্লাহ আপনার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। উনি তো অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছেন। ইনশাআল্লাহ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন।”
“দোয়া কোরো। যে সময়গুলো ও জীবন থেকে হারিয়েছে সেগুলো যেন পুষিয়ে নিতে পারে।”
“অবশ্যই দোয়া করি।”
“আচ্ছা যাও, তোমার সময় নষ্ট করলাম।”
“এটা কী বলছেন? আপনার সাথে কথা বললে আমার সময় নষ্ট হবে?”
পারভীন হাসলেন। রাত্রিও প্রত্যুত্তরে হাসলো।
রাস্তায় বেরিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল রাত্রির। মানুষের জীবনে নানা পরিমাপের নানা প্রকারের কষ্ট। আদিল কি সত্যিই ভালো হবে? যখন সে ভালো হয়ে যাবে তখন কি রাত্রির সামনে পড়তে লজ্জাবোধ করবে না? না কি এসব সে ভুলে যাবে? ভুলে গেলেই ভালো হয়।
“এই যে মিস!”
পিছন থেকে শব্দটা এলো। রাত্রি পিছন ফিরে দেখতে পেল একজন বাইকে বসা যুবক তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারলো এই যুবকই তাকে ডেকেছে। রাত্রি চমকে উঠলো। এটা তো সেই ছেলেটা, যে কি না গতকাল তার সামনে একটা মানুষকে অন্যায়ভাবে মে’রেছে! রাত্রির হঠাৎ ভয় ভয় করতে শুরু করলো। গতকালকের ঘটনা থেকে সে এটুকু নিশ্চিত হয়েছে যে, এই ছেলে নির্ঘাত কোনো স’ন্ত্রাসী-টন্ত্রাসী হবে। স’ন্ত্রাসীদের খুব ভয় পায় সে। স’ন্ত্রাসীরা তো ভংয়করই হয়। কিন্তু এই স’ন্ত্রাসী তাকে কেন ডাকলো? হু’মকি দিতে এসেছে? সে গতকালকের ঘটনাটা দেখেছিল বলে কি মুখ বন্ধ রাখতে হু’মকি দিতে এসেছে? রাত্রির বুকের ভিতরটা ঠকঠক করতে লাগলো ভয়ে। ছেলেটা ততক্ষণে বাইক থেকে নেমে রাত্রির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখের রোদ চশমা খুলে কিঞ্চিৎ অবাক কণ্ঠে শুধালো,
“আপনি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছেন?”
রাত্রি টের পাচ্ছে তার হাত-পা অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু সে ঘামছে। মনে মনে চাইছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু সেটা সে পারবে না। কারণ স’ন্ত্রাসী তার উপর অসন্তোষ হতে পারে। আর স’ন্ত্রাসীরা কারো প্রতি অসন্তোষ হলে সেই ব্যক্তির জীবন পর্যন্ত ধ্বংস করে দিতে পারে! রাত্রি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো,
“না তো, ভয় কেন পাবো?”
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভয় পাচ্ছেন।”
রাত্রি হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো,
“না, আমি ঠিক আছি।”
“গতকাল কি ভয় পেয়েছিলেন?”
“গতকাল? গতকাল কি আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিল কোনো কারণে?” রাত্রি বিষয়টা ভুলে যাওয়ার ভাণ করলো। যদিও তাতে খুব একটা লাভ হলো না।
ছেলেটা ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হেসে বললো,
“গতকাল তো ভয় পাওয়ার কারণ ছিলই বটে। কিন্তু এখন ভয় পাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
ছেলেটা সুন্দর করে কথা বলছে। স’ন্ত্রাসীরা কি এভাবে সুন্দর করে কথা বলে? দেখেও ভদ্র ধরনেরই মনে হচ্ছে। হয়তো ভদ্রবেশী স’ন্ত্রাসী! রাত্রি নিজের অভিনয়টা বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারলো না। বললো,
“দেখুন, আমি এ ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলবো না।”
“কোন ব্যাপারে?”
“কাল যে আপনি ওই ছেলেটাকে মে’রেছেন সে ব্যাপারে।”
ছেলেটা এবার মৃদু হেসে বললো,
“আপনার ইচ্ছা হলে এটা আপনি মানুষজনকে বলতে পারেন।”
রাত্রি অবাক হয়ে গেল। ছেলেটা কি তাকে হু’মকি দিতে আসেনি? তাহলে কেন এসেছে?
“আমার নাম জানেন?” সহসা প্রশ্ন করলো ছেলেটা।
রাত্রির মাথায় এবার আকাশ ভেঙে পড়লো। এই ছেলে কি ফেমাস কেউ? স’ন্ত্রাসীরা অবশ্য ফেমাসই হয়। অনেক মানুষজন তাদের চেনে। কিন্তু রাত্রি এবার কী করবে? সে তো এই ফেমাস স’ন্ত্রাসীর নাম জানে না। ছেলেটা নিশ্চয়ই এখন তার উপর রেগে যাবে। রাত্রি না বোধক মাথা নাড়লো।
কিন্তু ছেলেটা রাগলো না। নিজের পরিচয় দিতে বললো,
“আমি তানবীন খন্দকার।”
রাত্রি একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“ও আচ্ছা।”
“কীসের আচ্ছা? কেউ নিজের নাম বললে নিজের নামটাও যে তাকে বলতে হয় জানেন না?”
“আমার নাম রাত্রি।”
“শুধু রাত্রি? রাত্রির আশেপাশে আর কিছু নেই?”
“জি না।”
“এত ছোটো নাম?” তানবীন এমনভাবে বললো যেন রাত্রির আশেপাশে আর কিছু না থাকা বিরাট বিস্ময়কর ঘটনা। অবাধে তার বিস্মিত চেহারায় হাসি ফুটলো। এক পা নিকটস্থ হয়ে দাঁড়ালো সে। চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বললো,
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!”
রাত্রির শান্ত চোখের তারায় হঠাৎ বিস্ময়ের ঘনঘটা হলো। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল তানবীনের দিকে। তানবীন দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরালো। চোখে রোদ চশমা পরে নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের বাইকের দিকে। বাইক স্টার্ট করে হঠাৎ মনে পড়া গলায় বললো,
“আর হ্যাঁ, আমি ভয়ংকর কেউ নই। আমাকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।”
(চলবে)
/