কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব -০১

সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এমন আবহাওয়ায় গরম গরম এক কাপ চা, উপন্যাসের বই আর কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শোনার মজাই আলাদা। বর্তমানে অর্ঘমা তাই করছে। ব্যালকনির গ্লাস লাগিয়ে পাশের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে মনোযোগ সহকারে একটা রোম্যান্টিক উপন্যাস পড়ছে। ফোনের প্লে লিস্টে বারিস গানটা চলছে। সবকিছুই একদম পারফেক্ট। এখন অভাব শুধু একটা প্রেমিকের। এমন আবহাওয়ায় একটা প্রেমিক থাকা আবশ্যক। যেহেতু অর্ঘমার কোনো প্রেমিক নেই তাই আফসোস করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।

ছোট বোনের সুখ মনে হয় কোনো ভাইদেরই সহ্য হয় না। অর্ঘমার বড় ভাই অভ্রও সেই দলেরই লোক। অর্ঘমাকে এত মনোযোগ দিয়ে উপন্যাস পড়তে দেখে তার হাত বারবার নিসপিস করে উঠছে বোনের মাথায় একটা চাটি মা’রা’র জন্য। নিজের ইচ্ছেকে চেপে না রেখে তৎক্ষনাৎ অর্ঘমার মাথায় চাটি মারল অভ্র। অর্ঘমা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকাল। অভ্র তার চুলে টান দিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে? ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”
-“মারলে কেন?”
-“আমার মন চেয়েছে তাই মেরেছি। তোকে বলতে হবে?”
-“আমার সুখ তোমার কোনোকালেই সহ্য হয় না তাই না?”
-“একদম না। আম্মু ডাকছে কখন থেকে সেই খেয়াল আছে তোর?”
-“তো! তাই বলে তুমি মারবে? ভালো মতো বলা যায় না?”
-“না। ভাগ এখন। আম্মু কি বলে শুনে আয়।”
উঠে দাঁড়িয়ে বই আর ফোন জায়গা মতো রেখে খালি কফির মগটা হাতে নিয়ে ভাইয়ের চুল ধরে জোরে একটা টান দিয়ে দৌড়ে চলে গেল রুম থেকে। অভ্র চোখমুখ কুঁচকে জোরে জোরে হুমকি দিতে লাগল অর্ঘমাকে।

তিন তলার ফ্ল্যাটের সামনে এসে একবার বেল চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে নিজের লম্বা চুলের বেণী ধরে ঘুরাতে লাগল অর্ঘমা। দরজা খুলতেই সামনে বাড়িওয়ালী আন্টিকে দেখে মিষ্টি হেসে সালাম জানিয়ে বলল,
-“মটরে পানি নেই। মটরটা একটু ছাড়লে ভালো হতো।”
-“ওমা! দারোয়ান পানি ছাড়েনি?”
-“না। বিগত একঘন্টা যাবত আম্মু অপেক্ষা করছে পানি ছাড়ার জন্য। এখনো ছাড়ছে না দেখে আমাকে পাঠালো আপনাকে জানাতে।”
-“আচ্ছা, আমি এখনই দারোয়ানকে কল করে বলছি পানি ছাড়তে। তুমি ভেতরে এসো।”
-“না না আন্টি। ভেতরে যাব না। গত দু’দিন বাসা গোছগাছ করে ক্লান্ত সবাই। তাই এখন বাসায় গিয়ে গোসল করে একটু ঘুমাবো।”
-“বাসা গোছানো শেষ হয়েছে?”
-“জি। আজ সকালেই সব শেষ হয়েছে।”
-“ঠিক আছে। তোমার আম্মুকে বলো আমি বিকেলে যাব তোমাদের বাসায় দেখা করতে।”
-“আচ্ছা আন্টি। এখন তাহলে আসি।”
বাড়িওয়ালী আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে উঠে চার তলায় চলে গেল অর্ঘমা।

বিকেলে সাইকেল নিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়েছে অর্ঘমা। অভ্র সামনের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর সাথে চায়ের আড্ডায় মেতে আছে। সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় অর্ঘমা একহাত দিয়ে ভাইয়ের চুল টান দিয়ে চলে গেল। অভ্র রেগে পেছনে তাকিয়ে বোনকে দেখে চোখ রাঙাল। অর্ঘমা কিছু দূর গিয়ে সাইকেল থামিয়ে অভ্রকে ভেঙ্গিয়ে চলে গেল। অভ্রর বন্ধুরা হাসছে। অভ্র আর অর্ঘমার এই স্বভাব সম্পর্কে তারা আগে থেকেই অবগত। কল আসতেই পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার দেখে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল অভ্র।

প্রাইভেট পড়ে অর্ঘমার বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। বাসার গ্যারেজে সাইকেল রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে তিন তলার সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাট থেকে একটি ছেলে বের হচ্ছে। প্রথম দেখায় মোটামুটি ভালো লাগার মতোই দেখতে ছেলেটা। অর্ঘমারও বেশ পছন্দ হলো ছেলেটাকে। যাকে ক্রাশ বললে ভুল হবে না। ছেলেটার চুলগুলো বেশ বড় বড়। গালে হালকা দাঁড়ি। ভীষণ মানিয়েছে ছেলেটাকে এই চুল আর দাঁড়িতে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, ছেলেটা কে? বাড়িওয়ালার কোনো আত্মীয়? ছেলেটা নিচু হয়ে জুতো পড়ছিল। অর্ঘমা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক শুনে থেমে গেল। পেছন ঘুরে দেখে ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। থতমত খেয়ে গেল অর্ঘমা।
-“জি!”
-“আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। কয় তলায় যাবেন?”
-“চার তলায়।”
-“নতুন ভাড়াটিয়া!”
-“জি।”
-“ওহ্ আচ্ছা। না মানে আগে দেখিনি তো এই বাসায় তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না। আসলে দিনকাল তেমন একটা ভালো না। তাই বাসায় এভাবে অপরিচিত একজনকে দেখে আরকি…”
-“বুঝেছি। আমি কিছু মনে করিনি।”
-“ওকে। আসছি তবে।”
-“জি, আল্লাহ্ হাফেজ।”
-“আল্লাহ্ হাফেজ।”
অর্ঘমা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পেছন থেকে একটি মেয়ের গলা শুনতে পেল। সেই ছেলেটার সাথে কথা বলছে। কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল ছেলেটা বাড়িওয়ালার ছেলে।

রাতে খাবার খাওয়ার সময় অর্ঘমা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-“এই বাসার বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়ে কয়জন?”
-“কেন?”
-“প্রাইভেট পড়ে আসার সময় তিন তলায় একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে কথা বলতে শুনলাম। মনে তো হলো ভাইবোন।”
-“বাড়িওয়ালার দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে বড় আর ছেলে ছোট।”
অভ্র খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,
-“কি করে তারা?”
-“মেয়ে ডাক্তার আর ছেলে ম্যাথম্যাটিকস নিয়ে পড়ছে। মেয়েকে দেখেছি আমি। দেখতে শুনতে ভালোই আছে। বিয়ে করেনি এখনো। আর ছেলের সাথে দেখা হয়নি এখনো।”
-“আমি আপুর মুখ দেখিনি। শুধু কণ্ঠ শুনেছি। নাম কী আপুর?”
-“নুসরাত।”
-“আর ভাইয়ার?”
-“নীরদ।”
মনে মনে নামটা দু’বার আওড়াল অর্ঘমা। তার ঠোঁট কোলে সুক্ষ্ম এক হাসির রেখা। অভ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“একদিনেই বাড়িওয়ালী আন্টির সাথে ভালো খাতির জমিয়ে ফেলেছ দেখা যায়। অনেক কিছু জানো তাদের ব্যাপারে।”
-“কথাবার্তার ধরন আর ভালো ব্যবহার দিলে যে কেউ নিজে থেকেই খাতির জমাতে চাইবে।”

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্ঘমা। এমন সময় অভ্র এলো তার রুমে। অর্ঘমা ভাইকে দেখে বলল,
-“কি চাই লাটসাহেবের?”
-“ঢং না করে তুই আসল কথা বল। তখন খেতে বসে এত এত প্রশ্ন শুধুমাত্র বাড়িওয়ালার ছেলের নাম জানার জন্য করেছিস তা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝেছি।”
-“হ্যাঁ, তো! আমার ভালো লেগেছে ছেলেটাকে। হি ইজ মাই ক্রাশ।”
-“বাহ! প্রথম দেখাতেই ক্রাশ?”
-“হ্যাঁ। ছেলেটা অনেক কিউট।”
-“তোর চোখে তো কিউট ছেলের অভাব নেই। আর না অভাব আছে ক্রাশের।”
-“এটা সিরিয়াসওয়ালা ক্রাশ। খোঁজ নিতে হবে গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা। থাকলে ব্রেকআপ করিয়ে দিব। আর না থাকলে আমি তো আছি।”
-“ছেলে ভালো হলে আর তুই সিরিয়াস হলে আমি কিছু বলব না। কিন্তু যদি ছেলের ব্যাপারে উল্টো পাল্টা কিছু জানতে পারি আর ততদিনে যদি তোদের ভেতরে কোনো সম্পর্ক হয়ে যায় তাহলে কিন্তু ওর রক্ষা নেই।”
-“আহ! তোমার মতো ভাই সবার ঘরে ঘরে হোক। ছোট বোনকে প্রেম করতে উৎসাহ দেওয়া একমাত্র ভাই মনে হয় তুমিই আছ এই পৃথিবীতে।”
-“আমার প্রেমে তুই সাহায্য করেছিলি আর এখনো করিস বলেই এত ছাড় দেই তোকে। আর তাছাড়া আমি আমার বোনকে চিনি। আমি জানি তুই কোনো ভুল করবি না।”
-“বাই দ্যা ওয়ে, ভাবীর কী খবর?”
-“ভালোই। শুধু ওর বাসায় একটু প্রবলেম হচ্ছে বিয়ে নিয়ে। ওর পরিবার চায় ও এখনই বিয়ে করুক। আর ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। ওর বাবাকে আমার ব্যাপারে জানিয়েছে। আমি বেকার বলে ওর বাবা তৎক্ষনাৎ মানা করে দিয়েছেন। যদিও এটাই স্বাভাবিক।”
-“চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তুমি হাল ছেড় না। একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে যাও। শেষ পর্যন্ত ভালো ফল পাবে।”

ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় কোনো মতে স্কুল ড্রেস গায়ে জড়িয়ে তৈরি হয়ে বের হতে গেলে বাঁধা দিল অর্ঘমার আম্মু। তার হাতে জ্যাম লাগানো পাউরুটি। অর্ঘমা বুঝতে পারল না খেয়ে গেলে তার নিস্তার নেই। তাই কথা না বাড়িয়ে একটা পাউরুটি নিয়ে মুখে দিয়ে খেতে খেতে দৌড় লাগাল। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় আসতেই দেখা হয়ে গেল বাড়িওয়ালার ছেলে নীরদের সাথে। পরক্ষণেই মনে পড়ল তার স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবারও দৌড় দিল। পেছন থেকে একটা ছেলে কণ্ঠ বলে উঠল,
-“আস্তেধীরে দেখেশুনে নামো। এটা সিঁড়ি। পড়ে গেলে হাত-পা সব যাবে।”
পেছন ঘুরে নীরদকে দেখে জোরপূর্বক হেসে ইতস্তত করে বলল,
-“আসলে স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই আরকি…”
নীরদ এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে বলল,
-“হাতের পাউরুটিটা আগে শেষ করো।”
অর্ঘমা তাড়াতাড়ি পাউরুটিটা মুখে দিয়ে চিবিয়ে গিলে ফেলল। তার ব্যাগের পকেট থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল নীরদ। দুই ঢোক পানি খেয়ে বোতলের মুখ লাগাতেই বোতলটা আবারও ব্যাগের পকেটে গুঁজে দিয়ে টিস্যুটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“কখনো তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে নেই। তাড়াতাড়ির সময় আরও তাড়াতাড়ি করে কোনো কাজ করতে গেলে সেটা খারাপই হয়। তুমি আমার অনেক ছোট। তাই তোমাকে তুমি করে বললাম। এবার সাবধানে দেখে শুনে স্কুলে যাও।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে গেলে পেছন থেকে নীরদ আবারও থামাল তাকে। জিজ্ঞেস করল,
-“কোন স্কুলে পড়?”
অর্ঘমা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জবাব দিতেই নীরদ আবারও জানতে চাইল,
-“নাম কী?”
-“অর্ঘমা।”
-“নামের আগে পিছে কিছু নেই?”
-“সিদরাতুল জান্নাত অর্ঘমা।”
-“ক্লাস কয়টায়?”
অর্ঘমা তৎক্ষনাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,
-“আল্লাহ্! আমার কত্ত দেরি হয়ে গেছে। সব আপনার দোষ। আম্মু…!”
আগে পিছে না তাকিয়ে অর্ঘমা দিল এক দৌড়। পেছন থেকে নীরদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। তাকে আস্তে নামতে বলছে। কিন্তু অর্ঘমা শুনলে তো সেই কথা। সে তার মতোই দৌড়িয়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

স্কুল ছুটির পর বান্ধবী নিধির সাথে গল্প করতে করতে বের হলো অর্ঘমা। বাইরে এসে ঠিক করল ফুচকা খাবে। দুই প্লেট ফুচকা অর্ডার দিয়ে আবারও নিধির সাথে কথা বলায় মশগুল হলো। কথা বলার এক পর্যায়ে নিধি বলল,
-“আজও শাকিল দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য।”
ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার ওপারে তাকাল অর্ঘমা। চায়ের দোকানের সামনে দেখা মিলল ৭-৮ জন ছেলেদের একটা দলের। তার মাঝে শাকিল নামের একটি ছেলে রয়েছে। ছেলেটা দেখতে বখাটে নয়। কিন্তু অর্ঘমার তাকে প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। সব জায়গাতেই এই ছেলেটা এসে হাজির হয়। অর্ঘমার জন্য প্রতিদিন স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কয়েকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল সে অর্ঘমাকে। কিন্তু অর্ঘমা মুহূর্ত ব্যয় না করে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। শাকিলের ব্যাপারে তার নামটা ছাড়া আর কিছুই জানে না অর্ঘমা। জানার আগ্রহও তার নেই। তাকে শাকিল কীভাবে চেনে এই ব্যাপারেও কিছু জানে না। তবে অর্ঘমা আন্দাজ করে নিয়েছে। যে স্যারের বাসায় সে প্রাইভেট পড়তে যায় সেই স্যারের বাসার সামনের বিল্ডিংয়ের দোতলার বারান্দায় একবার শাকিলকে দেখেছিল। খুব সম্ভবত সেটাই শাকিলের বাসা। আর সেখান থেকেই অর্ঘমাকে দেখেছে। এরপর থেকেই তাকে ফলো করে ছেলেটা।

চলবে…

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here