কি করিলে বলো পাইবো তোমারে পর্ব -১৫ ও শেষ

#কি_করিলে_বলো_পাইবো_তোমারে
#পর্বঃ১৫(১ম অংশ)
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রায় ১ মাস পর,

অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকেই অনাকাঙ্ক্ষিত দু’জন মানুষকে দেখে থমকে যায় তাজ।সোফায় বসে আছে আস্থার মা আর বাবা।দু’জনের মুখ কেমন যেন চিন্তা দেখাচ্ছে।তাজ দু’জনকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে হঠাৎ এখানে আসার কারণ।আস্থা মা কান্নার কারণে কিছুই বলতে পারছেনা।আস্থার বাবা তাজের সামনে এসে তার হাত ধরে বলে,

” আমি জানিনা কেন তুমি এরকম করেছো তবে বিশ্বাস করো আমার মেয়েটা খুব ভালো।আমি বাবা বলে বলছিনা আমার মেয়েটা আসলেই খুব ভালো মনের।”

” আপনি কি বলছেন আঙ্কেল?আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা।”

আস্থার বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,

” কথা মামণি আমাকে বলেছে সব।আমি জানিনা কেন তুমি আমার মেয়ের ভালোবাসাটাকে গ্রহণ করলেনা।কিন্তু তোমার রিজেক্ট করার কারণে আমার মেয়েটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।আগে থেকেও বেশি চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে।ঠিকমতো কথা বলেনা,ঠিকমতো খায়না,সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে।তুমি জানো কিনা জানিনা কিন্তু তার এতো অনিয়মের কারণে কিছুদিন আগে তাকে স্যালাইন দিতে হয়েছে।”

” কি বলছেন আঙ্কেল আপনি?স্যালাইন কেন দিতে হয়েছে?”

” পর্যাপ্ত খাবার না খাওয়ার কারণে তার শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো।যার কারণে মাথাঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাজ প্রশ্ন করে,

” আস্থা এখন কোথায়?”

” ওর রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।”

তাজ আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে আসে।

” আস্থা দরজা খোলো।আস্থা?”

আরো দু’তিন দরজায় বারি দিতেই আস্থা দরজা খুলে দেয়।আস্থাকে দেখে তাজ একটা ধাক্কা খায়।এই কয়েকদিনে মেয়েটা নিজের কি অবস্থা করে।আগের থেকেও আরো শুকিয়ে গিয়েছে,চোখের নিচে কালো হয়ে গিয়েছে।আস্থা দরজার সামনে থেকে সরে ভিতরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।তাজ ভিতরে এসে হালকা করে দরজাটা চাপিয়ে দেয়।

” কি সমস্যা তোমার?এরকম কেন করছো তুমি?”গম্ভীর গলায় বলে তাজ।তবে আস্থা কোন উওর দেয় না।

” কি হলো কথা বলছো না কেন?”

” আমার ইচ্ছে আমি কি করবো না করবো।তাতে আপনার কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।” কাঠ কাঠ গলায় উওর দেয় আস্থা।

” অবশ্যই আমার সমস্যা আছে।আঙ্কেল-আন্টি যে এখন আমাদের দোষারোপ করছে।”

” দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।আমি আমার বাবা-মায়ের তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি।আপনাকে আমি আর বিরক্ত করবোনা।আপনাকে আমি আর আমার চেহারাও দেখবোনা,নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।এবার আপনি আসুন।”

আস্থার কথাগুলো তাজের বুকে সুঁচের মতো বিঁধছিল।সে মনের মধ্যে পাথর চাপা রেখে রুম বেরিয়ে পড়ে।

তাজ বেরিয়ে যেতেই আস্থা চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করে।এতোদিনের জমা চোখের জল আজ সে নির্ধায় বিসর্জন দিচ্ছে।কিন্তু এরমাঝে হুট করেই কোথা থেকে তাজ এসে আস্থাকে জরিয়ে ধরে।সেও কান্না করছে।আস্থা তাজকে জরিয়ে ধরে আরো জোরে জোরে কান্না করতে থাকে।

” কি করে আমি আপনাকে পাবো তাজ?কি করলে আপনি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করবেন?” কান্না করতে করতে বলে আস্থা।আস্থার কথা শুনে তাজের ধ্যান ভাঙে।সে নিজেকে শক্ত করে আস্থাকে ছেড়ে দিতে চাইলে আস্থা তাকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে।

” আমাকে ছাড়ো আস্থা।”

” না আমি আপনাকে ছাড়বোনা।আপনাকে বলতেই হবে কেন আপনি আমাকে প্রত্যাখান করছেন?কেন আমার ভালোবাসাকে মেনে নিচ্ছেন না?”

” আমি পারবোনা তোমাকে নিজের জীবনের সাথে জরাতে,আর আমি চায়না তুমি আমার জীবনে আসো,আমার জীবনের সাথে তোমাকে আমি জড়াতে চায়না।”

” কেন চান না বলুন?আপনি কি অন্যকাউকে ভালোবাসেন?” তাজের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আস্থা।

” না।” অন্যদিকে তাকিয়ে উওর দেয় তাজ।

” তাহলে কেন এরকম করছেন বলুন?কেন আমাকে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন?আমি দেখতে সুন্দর নয় বলেই কি আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন?”

” না সেরকম কিছু না।আর আমার কাছে রুপ নয়,গুণটায় বেশি মূল্যবান।”

” তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”

” আমার সাথে থাকলে তুমি কোনদিনও সুখী হতে পারবেনা।তোমার পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে যদি আমি তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়ায়।”

” আপনার ভুল ধারণ এটা।আমার জীবন নষ্ট হবেনা বরং আমি আরো সুখে থাকবো।”

” না যাই হয়ে যাক না কেন আমি তোমাকে নিজের সাথে জরাবোনা।ছাড়ো আমাকে।”

তাজ আস্থাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়।তাজ রুম থেকে বের হতে নেবে কিন্তু আস্থার কথা শুনে থেমে যায়।

” আমাকে বলুন না কেন আপনি এরকম করছেন?আপনার মনে কি আমার জন্য বিন্দুমাত্র জায়গায় নেই।আমি কি করলে আপনাকে পাবো বলুন না,কি করলে আপনি আমাকে মেনে নেবেন।”

তাজ এসে আস্থার পায়ের কাছে বসে।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” তুমি কেন এরকম করছো বলো তো?তুমি এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে আমার মোটেও ভালো লাগছেনা।তোমাকে কষ্ট পেতে দেখে আমারো যে কষ্ট হচ্ছে।বোঝ না কেন তুমি?”

” আপনার কষ্ট হচ্ছে?” হেসে জিজ্ঞেস করে আস্থা।আস্থার হাসির পেছনে তিরস্কারটা তাজ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে।

” আচ্ছা সত্যিই আপনার আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে?আমার তো মনে হয়না সেটা।আপনার যদি আমার জন্য একটু হলেও কষ্ট হতো তাহলে আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিতেন না।”

” তুমি বোঝার চেষ্টা করো।তুমি আমার সাথে থাকলে কখনই সুখি হতে পারবেনা।তোমার পুরো জীবনটা অন্ধকারে ছেয়ে যাবে।”

” কেন?কেন আপনি এরকম বলছেন?”

তাজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

” তুমি জানো তন্বী কেন বিয়ের দিন বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো?”

” না জানিনা,আর জানতেও চায়না।আমার ওসব জানার দরকার নেই।আমার শুধু আপনাকে চায়।”

আস্থার কথা শুনে তাজ হেসে তার দিকে তাকাই।

” কি হলো হাসছেন কেন?”

” এইযে তুমি বলছো তোমার আমাকে চায়,তুমি যেকোন মূল্যে আমাকে পেতে চাও।আমি যদি তন্বীর বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কারণটা বলি তাহলে আমাকে তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে হবেনা,তুমি নিজে থেকেই সরে যাবে আস্থা।”

তাজের কথা শুনে আস্থার মনে ভয় হতে শুরু করে যে কি কথা যেটা জানতে পারলে সে নিজেই তাজকে দূরে সরিয়ে দেবে।

” কিসব বলছেন আপনি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।প্লিজ আমাকে খুলে বলুন।”

” আচ্ছা এটা বলো তুমি কি শুধু আমাকে ভালোই বাসবে নাকি সেটাকে বিয়েতেও রূপ নিবে?”

” অবশ্যই আমি আপনাকে বিয়ে করবো।ভালো তো দূর থেকেও বাসা যায় কিন্তু আমি আমাকে নিজের কাছে রেখে বৈধ ভাবে ভালোবাসতে চায়।”

” কিন্তু আমাকে বিয়ে করলে যে তুমি সুখী হতে পারবে না।আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে তোমার খুব মূল্যবান জিনিস হারাতে হবে।”

” আপনি কি বলছেন দয়া করে একটু খুলে বলুন আমাকে।”

” আমাকে বিয়ে করলে তুমি কখনই মা হতে পারবে না আস্থা।”

তাজের কথা শুনে আস্থার শরীর কেঁপে উঠে।সে কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,

” মানে?”

” মানে আমি কখনই বাবা হতে পারবোনা আস্থা।”

” আপনি আমার সাথে মজা করছেন তাই না?আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিথ্যা বলছেন তাই না?”

” না আস্থা আমি তোমাকে মিথ্যা বলছিনা,এটাই সত্যি।আর এই সত্যিটার কারণেই তন্বী সেদিন বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলো।”

তাজের কথা শুনে আস্থা তাজকে জরিয়ে ধরে তবে কান্না করেনা।কিছুক্ষণ পর সে তাজকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

” আমি বলেছিলাম তোমাকে এই সত্যিটা জানার পর তুমি নিজেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে।অবশ্য ভালোই হয়েছে আমাকে আর কষ্ট করতে হয়নি।আমার জন্য কেন তুমি তোমার মা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।”

আস্থা একবার তাজের দিকে তাকিয়ে রুমে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।বাইরে এসে আস্থা দেখে তার আর তাজের বাবা-মা বাইরে বসে আছে।

” মা-বাবা,আঙ্কেল-আন্টি আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করুন।আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনাকে বিয়ে করতে চায়।”

” আস্থা তুমি এসব কি বলছো?পাগল হয়ে গিয়েছো?এতো বড় কথা জানার পরেও তুমি কেন এমন পাগলামী করছো?”

আস্থা তাজের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।

” আমি যা বলেছি প্লিজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আয়োজন করো তোমরা।”

” প্লিজ তোমরা কেউ ওর কথায় রাজি হয়ও না।আমাকে বিয়ে করলে যে ওর জীবন শেষ হয়ে যাবে।ও কখনোই মা হতে পারবে না আমাকে বিয়ে করলে।”

তাজের কথা শুনে আস্থা বাদে সবাই চমকে যায়।তাজের বাবা-মা নিজেদের ছেলের কথা শোনে প্রচুর ভেঙে পড়ে।আর আস্থার বাবা তো রেগে সরাসরি মানা করে দেন যে তিনি কোনভাবেই আস্থার সাথে তাজের বিয়ে দেবেন না।

” মা-বাবা আমি বিয়ে করলে ওনাকেই করবো,নয়তো সারাজীবন কুমারিই থেকে যাবো।”

কথা বলেই আস্থা রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।তাজ অসহায় চোখে আস্থা যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
#কি_করিলে_বলো_পাইবো_তোমারে
#পর্বঃ১৫ (২য় অংশ)(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

আস্থাদের বিল্ডিংটা আজ আবারো বিভিন্ন রঙের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে।আজ তাজ আর আস্থা গায়ে হলুদ।যেহেতু দু’জন একই জায়গায় থাকে তাই কনের জন্য স্টেজ করা হয়েছে ছাদে আর বরের জন্য স্টেজ করা হয়ে নিচে বাগানে।

সবাই এক এক করে আস্থাকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে।কথা তো খুব খুশি,সে খুশি মনে সব কাজ করছে,সবার সাথে আনন্দ করছে।তবে নাইরা আসেনি,তার নাকি কি যেন একটা কাজ আছে।

ভালোই ভালো আস্থা আর তাজের গায়ে হলুদ মিটে যায়।সবাই কিছুক্ষণ আনন্দ করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যায়।তা না হলে কাল সকালে কেউ ভালো ভাবে কাজ করতে পারবেনা।

ফ্রেশ হয়ে এসে আস্থা মাত্রই বিছানায় বসেছে।হলুদের কারণে তার গায়ের রং হলুদ হয়ে গিয়েছে।আস্থা শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে তখনই তার ফোন বেজে উঠে।ফোন তুলে আস্থা দেখে তাজ ফোন দিয়েছে।এই অসময়ে তাজের ফোন পেয়ে তাজের কপাল কুচকে যায়।

” হ্যালো?”

” ঘুমিয়ে পড়েছো?”

” না।”

” একটু ছাদে আসতে পারবে?”

” কেন?”

” সমস্যা হলে আসার দরকার নেই।”

আস্থা কিছু বলবে তার আগেই তাজ ফোনটা কেটে দেয়।আস্থা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুলে চুপিচুপি ছাদে চলে আসে।

ছাদে লাইট থাকার কারণে আস্থার তাজকে দেখতে অসুবিধে হয়নি।

” কেন ডেকেছেন?”

” বিরক্ত করলাম বুঝি?”

” না কি বলছেন এসব?আমি বিরক্ত কেন হতে যাবো?”

” আস্থা তুমি আরেকবার ভেবে দেখো।এটা একদিনের ব্যপার না,সারাজীবনের ব্যপার।তুমি আরেকবার চিন্তা করে দেখো।তুমি চাইলে এখনো পিছিয়ে যেতে পারো,আমি বা অন্য কেউ তোমাকে আটকাবো না।”

” আর কিছু বলার আছে আপনার?” বিরক্তি নিয়ে বলে আস্থা।

” না এটা বলার জন্য ডেকেছিলাম।আমি চায় না পরবর্তীতে তুমি কোন আফসোস করো।”

” আপনি একটু বেশিই ভাবেন।”

” বেশি তো ভাবতেই হবে,সারাজীবনের ব্যপার।”

” শুনুন তাজ,আমি ভালোভাবেই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি আর আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবো না।”

আস্থা আর কোন কথা না বলে নিচে নেমে যায়।তবে তাজের মনের মধ্যে থাকা সংকোচটা এখনো দূর হয়নি।

রুমে এসে আস্থা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।তাজের কাজে সে প্রচুর রেগে আছে।আস্থা তাজের কথা ভাবছে সেই সময় তার ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়।আস্থা ভ্রু-কুচকে ফোনটা ওপেন করে।

” এই বিয়ে করোনা।তাহলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।”

মেসেজে এটাই লেখা ছিলো আর মেসেজটা এসেছে একটা আননোন নম্বর থেকে।মেসেজটা দেখে আস্থার মাথা গরম হয়ে যায়।সে মনে করে এটা তাজ পাঠিয়েছে তাকে।আস্থা ফোনটা সাইডে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরেরদিন,

সবাই চলে এসেছে।ইতিমধ্যে কাজী সাহেব বিয়ে কার্জক্রম শুরু করে দিয়েছে।

আস্থা আর কথার জোরাজুরিতে নাইরা বিয়েতে আসতে বাধ্য হয়ে।নাইরা দূর থেকেই তাজ আর আস্থার বিয়ে দেখছে।কথা আস্থার কাছে আছে।নাইরা একদম শান্তদৃষ্টিতে তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ করেই ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ নাইরাকে টেনে কমিউনিটি সেন্টার এর ছাদে নিয়ে আসে।নাইরা মাথা তুলে দেখে অগ্নি তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

” আপনি এখানে!”

” তোমার বান্ধবী কথা আমাকে আসতে বলেছে।”

” কথা!কিন্তু কেন?”

” কেন সেটা জানা জরুরি নয়।তুমি আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলবে নাইরা?”

” কি কথা?”

” তুমি তাজকে ভালোবাসো তাই না?”

অগ্নির কথা শুনে নাইরার কেঁপে উঠে।

” কি হলো বলো?আমি ঠিক বলছিনা?”

” কিসব বলছেন আপনি?এরকম কিছু না।”

অগ্নি নাইরারে নিজের দিকে করে বলে,

” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলোতো নাইরা,আমার কথা মিথ্যা নয়।তুমি তাজকে ভালোবাসো না?আর এটাও মিথ্যা যে তুমি তাজকে ভুলে যাওয়ার জন্য আমার সাথে সম্পর্কে এসেছিলে।বলো?”

অগ্নির কথা শুনে নাইরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা,সে কান্না করে দেয়।নাইরার কান্না দেখে অগ্নির চোখেও পানি জমে যায়।কথা যখন তাকে এসব বলেছিলো তখন অগ্নি অনেক কষ্ট করে নিজের চোখের জল আঁটকেছিলো।যদি কেউ জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে এটা কেই বা সহ্য করতে পারবে।

” আমাকে ক্ষমা করে দিন অগ্নি,আমাকে ক্ষমা করে দিন।আমি আপনাকে ব্যবহার করতে চাইনি কিন্তু আমার যে আর উপায় ছিলোনা।নিজের অজান্তেই নিজের বান্ধবীর ভালোবাসার উপর যে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।যখন আমি জানতে পারলাম আস্থা তাজকে আসলেই ভালোবেসে ফেলেছে তখন আমার আর কিছু মাথায় আসেনি।আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে সম্পর্কে গেলে আমি তাজকে ভুলে যাবো।আমি আপনাকে সত্যি কষ্ট দিতে চাইনি।”

অগ্নি জরিয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলে নাইরা।
অগ্নি আর সহ্য করতে পারছেনা,তার মনটা যে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে নাইরার কথা শুনে।অগ্নি নাইরারে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে,নাইরা নিচে বসে আরো জোরে জোরে কান্না করতে করতে বলে,

” আমাকে ছেড়ে যাবেন না অগ্নি,আমাকে ছেড়ে যাবেন না।আমি যে আর কারো উপর ভরসা করতে পারবোনা।আপনি ছাড়া আমি যে আমার এই কষ্টের কথা আর কারো সাথে শেয়ার করতে পারবোনা।আপনি আমাকে প্লিজ ছেড়ে যাবেন না।”

অগ্নি নাইরার কথাগুলো শুনে আরো ভেঙে পড়ে।সে নিজেকে শক্ত করে নাইরার কাছে এসে তাকে জরিয়ে ধরে।

” পারবে তো আমার সাথে সারাজীবন থাকতে?”

নাইরা ভেজা চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলে,

” আমাকে এখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে চলুন অগ্নি,অনেক দূরে।যেখানে এই তিক্ত ঘটনার কোন ছোঁয়া থাকবেনা।”

নাইরার কথা শুনে অগ্নি তাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে।

এদিকে,

কিছুক্ষণ আগেই তাজ আর আস্থার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।এবার সবাই বর আর কনের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্থ।আস্থার এসব মোটেও ভালো লাগছেনা তাও সে চুপচাপ হাসি মুখে বসে এসে।

আস্থার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে।তার কাছে তার মা বা কথা কেউই নেই।আস্থা নিজের ফোনটা হাতে নেয় কথাকে ফোন করার জন্য।কিন্তু ফোন ওপেন করলেই তাতে ভেসে উঠে একটা মেসেজ।

” তোমাকে বারণ করার পরেও তুমি বিয়ে করেছো।এটা তুমি মোটেও ভালো করেনি।এর ফল তোমাকে খুব শীঘ্রই ভুগতে হবে।”

মেসেজটা দেখে আস্থার ভ্রু-কুচকে।সে কিছু ভাববে তার আগেই কথা তাকে নিয়ে চলে যায়।
.
.

আজ তাজ আর আস্থার বউভাত।আস্থা পার্লারে এসেছিলো সাজতে।অন্যরাও আসতে চেয়েছিলো কিন্তু আস্থা বারবার করে দিয়েছে।

হুট করে মাঝরাস্তায় আস্থার গাড়িটা থেমে যায়।

” কি হলো ভাইয়া,গাড়ি থামালেন কেন?”

” ম্যাডাম সামনে কে যেন পড়ে আছে।”

” কি বলছিলেন কি?যান তো গিয়ে একবার দেখে আসুন কি হয়েছে।”

ড্রাইভার বেরিয়ে দেখতে যায় কি হয়েছে।এরমধ্যেই বাড়িতে থেকে ফোন আসে।আস্থা ফোনটা রিসিভ করে বলে সে আসছে।কথা শেষ হলে আস্থা বের হতে নেবে দেখার জন্য যে কি হয়েছে তার আগেই কেউ আমার মুখে রুমাল চেপে ধরে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে।

চোখে মুখে ঠান্ডা কিছু অনুভব করায় আস্থা আস্তে আস্তে নিজের চোখ খুলে।আস্থা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে একটা রুমে চেয়ারের সাথে বাঁধা।আস্থা সামনে তাকিয়ে দেখে একটা লোক উল্টো দিকে মুখ করে কিছু একটা করছে।

” এইযে কে আপনি?আর আমি এখানে কি করছি?কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন?”

” আরে আস্থা ম্যাডাম একসাথে এতোগুলা প্রশ্ন করলে কি করে হবে বলো তো।”

লোকটা ঘুরে আস্থার দিকে তাকাই।ব্যক্তিটাকে দেখে আস্থা চমকে যায় কারণ এটা আর কেউ নয় বরং আবির।

” আবির আপনি!আপনিনআমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?ছেড়ে দিন আমাকে,সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

” আরে আরে এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?তোমাকে ছাড়বো তো কিন্তু সেটা মারা যাওয়ার পরে।”

” কি!কিসব বলছেন আপনি?আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে?কেন করছেন এরকম?আপনি না তাজের বন্ধু?বন্ধু হয়ে কি করে তার বউয়ের সাথে এরকম ব্যবহার করছেন?”

” তোমার এই অবস্থার কারণই কিন্তু তাজ।যদি তোমার সামনে তাজের কোন সম্পর্ক না থাকতো তাহলে আজ তুমি এখানে থাকতে না।”

” মানে?”

” আমি তাজকে ঘৃণা করি,বড্ড ঘৃণা করি।ও সবসময় আমার থেকে এগিয়ে ছিলো আর এখানো এগিয়ে আছে।আমি সবসময় যা পেতে চাইতাম সেটা আমার আগে ওর হয়ে যেতো।এই যেমন দেখো আমার তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিলো কিন্তু আমার কিছু করার আগেই তাজ তোমাকে নিজের করে নিলো।তন্বী আমার কথা শুনে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে বলে বেঁচে গিয়েছে।তোমাকেও আমি বারণ করেছিলাম কিন্তু তুমি শুনলেনা।”

” তার মানে তাজের বিয়ে আপনিই ভেঙেছেন?”

” হুম।আমিই ভেঙেছি।বিয়ের কিছুক্ষণ আগে আমিই তন্বীকে বলেছিলাম যে তাজ কখনোই বাবা হতে পারবেনা।আর সেটা শুনেই তন্বী বিয়েটা ভেঙে দিলো।কিন্তু তুমি তো জানার স্বত্তেও বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে আর করেও নিলে।এবার তোমার এই মহৎ কাজের জন্য পুরুষ্কার হিসেবে তোমাকে আমি মৃত্যু দেবো।”

” আপনি এরকম করতে পারেন না।আপনি এরকম করে আপনার কি লাভ বলুন তো?আপনি আর কিছুই ফিরে পাবেন না।যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।আপনি প্লিজ মাথা ঠান্ডা করে একবার ভাবুন।”

কিন্তু আবির আস্থার কোন কথায় কান দেয় না।সে আস্থার দিকে ছুড়ি হাতে এগিয়ে আসে।আস্থা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।কিন্তু আবির আস্থা মারবে তার আগেই বাইরে থেকে কারো গলা শুনতে পায় তারা দু’জনে।

” মিস্টার আবির,আমরা জানি আস্থা ভিতরেই আছে।আমরা আপনাকে ৩ মিনিট সময় দিচ্ছি।এরমধ্যে আপনি নিজে থেকে সেলেন্ডার না করলে আমরা আমাকে মারতে বাধ্য হবো।”

পুলিশের আওয়াজ শুনে আবির ভয়ে পেয়ে যায়।সে তাড়াতাড়ি আস্থার গলার কাছে এসে ছুড়িটা ধরে।

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন কেউ বের হয়ে আসেনা তখন পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি করে আর দরজাটা ভেঙে ফেলে।তাজ তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে আস্থাকে এভাবে দেখে ভয়ে পেয়ে যায়।

” আবির প্লিজ আস্থাকে ছেড়ে দে।দেখ ও তোর কোন ক্ষতি করেনি।তাহলে ওকে কেন তুই মারতে চাইছিস?আচ্ছা তোর সমস্যা আমাকে নিয়ে তো।তাহলে তুই আমাকে মার তবে তুই আস্থাকে ছেড়ে দে।”

” না…।দূরে যা দূরে যা।আমি ছাড়বোনা ওকে।মেরে ফেলবে ওকে আমি।ও মারা গেলে তুই সারাজীবন আপসোস করবি আর ধুঁকে ধুঁকে মরবি।আমি তো চায় তুই যাতে কষ্ট পাস।তোকে কষ্ট পেতে দেখে…..”

আবির আর কিছু বলবে তার আগেই সে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে।তার হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।পুলিশরা এসে আবিরকে এরেস্ট করে কিন্তু সে যেতে যেতেও তাজকে বলে যায় সে তাজকে শান্তিকে বাঁচতে দেবেনা।

তবে তাজ সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে তাড়াতাড়ি আস্থার কাছে এসে তার হাত খুলে দেয়।

” তুমি ঠিক আছো?”

আস্থা কিছু না বলে তাজকে জরিয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।তাজও আস্থাকে জরিয়ে ধরে।সে বুঝতে পারছে আস্থা আবিরের কাজে খুব ভয় পেয়েছে।
.
.

৮ বছর পর,

” তুমি আজো না খেয়ে বসে আছো?তোমাকে না আমি বলেছিলাম আমার জন্য বসে না থাকতে?” রেগে বলে তাজ।

” আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি বসে ছিলাম।আপনার কোন সমস্যা?যান এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”

তাজ রুমে এসে বিছানার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

” প্রিয় খেয়েছে?”

” হুম ওকে আমি খাইয়ে দিয়ে অনেক আগে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।”

” তোমাকে আমি কতবার বলেছি,প্রিয় এর সাথে খেয়ে নিও কিন্তু তুমি তো আমার কোন কথায় শোন না।একটু বেশিই কথা বলেন আপনি,তাড়াতাড়ি খাবারটা শেষ করুন।”

তাজ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে খাওয়া শুরু করে।

সেইদিনের পর কেটে যায় ৮ বছর।আস্থা আর তাজের বিয়ে হয়ে আজ ৮ বছর চলছে।তাদের একটা মেয়ে আছে,নাম প্রিয়তা।তবে প্রিয়তা তাদের নিজের মেয়ে নয়।তারা প্রিয়তাকে একটা আশ্রম থেকে দত্তক নিয়েছে।তবে নিজের মেয়ে না হলে তারা দুজন প্রিয়তাকে নিজে মেয়ে থেকেও বেশি ভালোবাসে।আবির বর্তমানে একটা এসাইলেমে আছে।কারণ জেলে যাওয়ার কিছু মাস পরেই তার মানসিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়,সেটা দিন দিন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।কথা বিয়ে হয়েছে দেড় বছরের মতো হবে।অগ্নি নাইরাকে বিয়ে করে নিয়েছে আরো ৩ বছর আগে।কথা এই শহরে থাকলেও,নাইরার জোরাজুরিতে অগ্নি নাইরাকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে সিউলে শিফট হয়ে গিয়েছে।তবে এখনো পর্যন্ত তাদের কারোই কারো বাচ্চা হয়নি।

” কি ভাবছো?”

তাজের কথা শুনে আস্থা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।

” ভাবছি,আবিরকে আমরা খারাপ ভাবলেও তার কারণেই আজ আমরা একসাথে আছি।”

” মানে?”

” মানে।মানে হচ্ছে আবির যদি সেদিন আপনার আর তন্বীর বিয়েটা না ভাঙতো তাহলে কি আপনার সাথে আমার বিয়েটা হতো?হতো না।আমাদের এক হওয়ার পেছনে আবিরেরও কিন্তু অনো বড় ভূমিকা আছে।”

” হুম হয়তো তুমি ঠিক।কিন্তু আমার জন্য তুমি কোনদিন মা হতে পারবেনা।”

” আরে ধুর বাদ দিন তো এটা।আর মা হওয়ার কি আছে?আমার অলরেডি একটা মেয়ে আছে।আমার আর কাউকে চায়না।”

আস্থা তাজের কাঁধে মাথা রাখে।এরপর তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ নীরবতা থাকে।

” আচ্ছা আস্থা আমাকে একটা গান শোনাবে?অনেকদিা হলো তোমার কন্ঠে কোন গান শুনিনি।”

” এতোরাতে?”

” কিছু হবেনা।গাও তুমি,তোমার গান শুনলে যদি মনটা ভালো হয়।”

” ওহে কী করিলে বলো, পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে কী করিলে বলো, পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে

ওহে এত প্রেম আমি কোথাও পাব না
এত প্রেম আমি কোথাও পাব না
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে

দয়া না করিলে কে পারে
তুমি আপনি না এলে কে পারে
হৃদয়ে রাখিতে

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না।
………..”

___________________ সমাপ্ত____________________
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here