বিষবৃক্ষ পর্ব -০১

#বিষবৃক্ষ ❤️
#সাদিয়া


রাগে সুঠামদেহের পুরুষটির চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। এই প্রথম কোনো নারীর এত সংস্পর্শে এসেছে সে। রোষে মূর্ছা অবস্থা। দুনিয়াতে যদি কোনো জিনিসে তার অনীহা থেকে থাকে তবে তা নারীলোভ। বিচ্ছিরি জঘন্য এক ব্যাপার! কিন্তু এই মুহূর্তে ভেতরে এতটা দাউদাউ করে জ্বলা ক্রোধের কারণ ঠাউর করতে পারছে না সে। নারী সংস্পর্শ নাকি বিপক্ষ দল? দাঁত কেটে চোখ বন্ধ করে আনে সে।

রাজকুমারী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। চোখ কোঠার থেকে বের হয়ে আসার জোগাড়। অথচ কথা বলতে পারছে না সে। মুখের উপর থাকা হাতটায় কামোড় বসাতেও ব্যর্থ সে। বেগানা কোনো পুরুষের স্পর্শ তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শুধু কি তাই বস্তার উপর শুয়ে বুকের সাথে চেঁপেও রেখেছে মানুষটা। তার সাহস দেখে রাজকন্যা অবাক না হয়ে পারছে না। কত বড় আস্পর্ধা হলে রাজকন্যার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস দেখায়। তার মুখ থেকে আস্তেআস্তে হাত সরিয়ে নিতেই ফুস করে নিশ্বাস ছাড়ে সে। মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে প্রশ্ন তুলে,
“তোমার সাহস কত সামান্য প্রহরী হয়ে আমায় গুদাম ঘরে টেনে আনলে। তুমি জানো তোমাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিতে পারি। এখনি দূরে সরো আমার থেকে।”
লোকটার হেলদুল না পেয়ে যেই না আবার চিৎকার দিতে যাবে ওমনি তার মুখে একটা রুমাল চেঁপে ধরা হলো। আবার কথা বলতে চেয়েও পারল না। ক্ষনিকের মাঝেই চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল যেন।

—-
রাজা তৈজুল আর তার দুই পুত্র বসে আছে রাজকুমারীর সাথে খাবার খাবে বলে। অথচ এখনো মেয়ের আসার নাম নেই। অনেকক্ষণ বসে থেকে তিনি এবার রুষ্ট হলেন। উচ্চ গলায় ডাকলেন,
“দাসী দাসী।”

নত জানু হয়ে দুই তিন জন দাসী তখনি এসে হাজির হলো। তৈজুল বললেন,
“দেখো রাজকুমারী কোথায় আছে এখনো আসেনি কেন? সে কি জানে না আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি যাও।”
গম্ভীর গলায় আবার তিনি চুপ থাকেন। উনার বড় পুত্র ইলিয়াস বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আব্বাজান শান্ত হোন। চিন্তা করবেন না।”
ছেলের কথায় তিনি কোনো উত্তর দেননি। মেয়েকে বেশি আদর দিতে দিতে আজ এই অবস্থা হবে ভাবেনি।

অল্প সময়ের মাঝে প্রাসাদে হৈহুল্লো শুরু হয়ে গেছে। রাজকন্যা কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাসাদে প্রতিটি কোণায় খুঁজ চালানো হয়েছে ফলাফল শূন্য। অস্থির চিত্তে তৈজুল হায়হুতাশ করতে লাগলেন। একমাত্র মেয়ে উনার। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছেন তিনি। রাজ্যে প্রহরী সৈন্য সবাইকে পাঠানো হলো। ইলিয়াস আর ইয়াকুব দুই ভাই মিলেও খুঁজতে গেল আদরের ছোট্ট বোন কে।

—-
রূপগড় থেকে অনেক দূর এসে গেছে তারা। সুঠাম দেহের মুখে কাপড় পেঁচানো লোকটার বক্ষস্থলে রাজকুমারী মাথা ঠেকিয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে নিষ্প্রাণ ফুলের মতো। যার কারণে এবার আস্তেই অশ্ব এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। গা গুলিয়ে আসছে রাজকুমারীর শরীরের সুঘ্রাণে। এমন সুভাস আগে কখনো সে পায়নি। তবুও শরীর রিরি করে উঠছে তিক্ততায়। আর একটু পথই বাকি তার গন্তব্য স্থলের। তারপর শুরু হবে নতুন অধ্যায়।

আরশিনগর এসে সে রাজপ্রসাদের দিকে এগিয়ে গেল। অশ্ব তার গুটিগুটি পা খটখট আওয়াজে এগিয়ে গেল প্রাসাদের ফটক দরজায়। প্রহরী সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ যেন কিছু বুঝতেই পারছে না। তীক্ষ্ণ চোখ গুলি ছাড়া আগন্তুকের কিছু বুঝতে না পেরে তারা যেতে বাঁধা দিল। মুখের রুমালের আড়ালে বাকা হাসল সে। শান্ত কন্ঠে বলল,
“ভেতরে তোমাদের সম্রাটের সাথে দেখা করব।”
শান্ত কন্ঠ শুনে প্রহরীরা এক অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তাদের কারো বিষয়টা বুঝতে বাকি নেই। সঙ্গেসঙ্গে নতজানু হয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেই নির্দ্বিধায় সে ভেতরে চলল। রুমালের আড়ালে বাঁকা হাসিটা কেউ দেখতে পেলনা।

একদম প্রাসাদের সামনে আসতেই গম্ভীর আর জোরালো গলায় ডাকল,
‘ প্রহরী ‘। অনেক প্রহরী এসে হাজির হয়। কিন্তু চোখ ছোট করে তারা তাকিয়ে আছে। দমকা হাওয়ায় তার মুখ থেকে রুমাল সরে যেতেই একই সঙ্গে সবাই তাজিম করার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আনে। তার সামনে চোখ তুলে দাঁড়ানোর সহস নেই কারো। অদৃশ্য এক হাসি টেনে আনে মনে মনে। তারপর ঘোটকের দিকে চোখ পড়তেই অদেখা হাসিটার উপর ক্রোধের প্রলেপ লাগিয়ে চোখ মুখ গাম্ভীর্য করে আনে। গলা ছেড়ে বলতে লাগে “প্রহরী নাইলা আর তার দাসীদের এখনি আসার খবর পাঠানো হোক। দ্রুত।” শেষের শব্দটা জোরে বলে মেহেরের দিক থেকে চোখ সে ফিরিয়ে আনে।

অল্প সময় ব্যবধানে নাইলা তার কিছু দাসী নিয়ে জলদি নিচে নেমে আসে। পরনের গোল জামাটা হাত দিয়ে উঁচু করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। তবে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বিমূঢ় নয়নে তাকিয়ে থাকে। অবাকে বিস্ময়ে হতবাকের চরম সীমায় সে। বিশ্বাসই করছে না সামনের মানুষটা কি ভাবে একটা মেয়েকে এভাবে বুকের সাথে লাগিয়ে অশ্বের পিঠে আসে আছে। আর এ কি পোশাকআশাক। কপাল কুঁচকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শুকনো ঢোক গিলে আরেকটু এগিয়ে আসে ত্রাসগতিতে। কোমল ঠোঁট ফেটে বলে উঠে “ভাইজান।”

অশ্বের পিঠ থেকে নেমে অতি সাবধানের সহিত রাজকন্যাকে নামিয়ে এক হাতে আগলে ধরল। ধারালো গলায় বলে উঠল,
“নাইলা নিজের দাসীদের বলো উনাকে ধরে আমার কক্ষে যে ছোট্ট বন্দিখানাটা হয়েছে সেখানে গিয়ে রেখে আসতে। জলদি বোন আমার।”
রাজকন্যা নাইলা দাসীদের ইশারা করলে দ্রুত পায়ে অচৈতন্য মেয়েটিকে কয়েকজন মিলে আগলে ধরল। নাইলা অবাক ভঙ্গিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকায় তবে তাকে আরো অবাক করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে। ভুলক্রমেও পিছন ফিরে তাকায় না। যাওয়ার সময় বেগম শতরুপা কে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কি কোন আশ্চর্য ঘটনা এই ছেলে কি করে একটা মেয়েকে তুলে আনতে পারে এটা তিনি কিছুতেই মিলাতে পারছেন না।

নাইলা মুখ হা করে তাকিয় আছে জ্ঞান শূন্য মেয়েটির দিকে। আপাদমস্তক দেখে বুঝায় গেলে কোনো রাজকন্যা কিংবা অভিজাত পরিবারের মেয়ে বটে। তবে ভাইজান কেন তাকে তুলে এনে বন্দিকক্ষে রাখতে বলল তাই মাথায় আসছে না তার। হঠাৎ শতরুপার কাছ থেকে দৌড়ে নাইলার কাছে এগিয়ে এলো ছোট শাহজাদা মাহতি। বোনের হাত টেনে বলল,
“আপা মেয়েটার মুখের পর্দাটা একটু সরা না দেখি।”
ভাইয়ের কথায় হেলদুল আসে তার। মাথা নিচু করে তাকিয়ে বলে “দিব একটা, সর।” মুখ ভেংচিয়ে আবার বলে “আপা মেয়েটার মুখের পর্দা একটি সরা না দেখি। দেখতে আসল কোন শাহজাদা। যা এখান থেকে।” নাইলার এমন কথা শুনে মাহতি কপট রাগ দেখিয়ে বলল “আপা তোমার মুখটা যে বাজে নাক কাটা পেত্নীর মতো লাগছে তা কিন্তু সবাই দেখছে।” নাইলা মাহতির মাথায় মৃদু চড় দিয়ে বলে “তুই যে পাগল ছাগলের মতো চাবলাস তা প্রাসাদের সবাই জানে। নতুন করে ঢোল পিটানোর কি আছে। এখন পথ ছাড়।”

“আমাকে অপমান করছো তুমি। দেখে নিও এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব। শাহজাদা মাহতি বিয়ে করবে এই মেয়েকে। তখন তোমার কথার জবাব ঢিল মেরে নাকের উপর ছুড়ব।”

নাইলা তার কথা শুনে বিস্মিত মুখের ভাবে বলে ফেলল “এই গিরগিটি এখনো কি তোর সুন্নতে খৎনা পালন করছে আম্মাজান যে বিয়ে করবি। পাগলা আসছে একটা নর্দমা থেকে।”

“আমাকে অপমান করার শোধ আমি নিব তোমার উপর দেখে নিও।” তর্জনী আঙ্গুল উঠিয়ে বোনকে শাসিয়ে চলে গেল সে। রাগে যেন ফুসফুস করছে।

নাইলা একবার বিরবির করল “বিচ্ছু একটা।” দুই ভাই বোনের এমন কান্ড সারাদিন চলতে থাকে। আশেপাশের দাসীরা মৃদু হাসতেই নাইলা আদেশ করল মেয়েটাকে যথা স্থানে পৌঁছে দিতে।

—-
তৈজুল হন্নে হয়ে খুঁজেও কোথায় পান নি মেয়েকে। রাজ্যে কিংবা আশেপাশের গ্রামেও নেই মেয়ে। ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে রাজকুমারী কে পেয়ে দিতে পারলে বিশেষ উপহারের সাথে স্বর্ণমুদ্রাও পাবে। এই লোভে রাজ্যের প্রজারাও নিজেদের মতো খুঁজতে লেগেছে। রাগে দুঃখে তিনি যখন ফেটে যাচ্ছেন তখন সেনাপতি প্রবেশ করে কক্ষে। তাজিম করে সম্মান প্রদর্শনের কাজ সেরে সে রাজা তৈজুল কে একটা চিঠির গোলাকার লম্বা আকারের বাক্স এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“মহারাজ একটা চিঠি পাওয়া গেছে বাগানে। প্রহরী দিয়ে গেলো। অনুগ্রহ করে দেখুন।”

“আমার মেয়েকে পাচ্ছি না আর তুমি চিঠি নিয়ে সোহাগ করতে আসছো? চলে যাও এখনি আমার সামনে থেকে।” তৈজুল মেয়ের নিখোঁজের দুঃখে এতই কাতর বাক্স দেখতে তিনি নারাজ। চিৎকার করে আবার যেতে বললেন। সেনাপতি একটু এগিয়ে গিয়ে বাক্সের উপর চিহ্ন টা দেখাতেই কপাল কুঁচকে আনে তৈজুল। তাড়াতাড়ি বাক্স থেকে একটা পত্র বের করে চোখ বুলালেন। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে,

“নিজের রাজ্য থেকে নিজের আদরের ছোট রাজকন্যার নিখোঁজ সংবাদ আশেপাশের রাজ্যে হাওয়ার গতিতে ছড়িয়ে গেলে সকলে আপনার বীরত্বের বাহবা দিবে নিশ্চয়।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here