#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০২ ও ০৩/
নিশাদ অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে।
মাথার রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো নিশাদের। হুট করে রিধিশার হাত চেপে ধরে বললো
” আমাকে থাপ্পড় মারো কোন সাহসে তুমি” রিধিশা রেগে বললো
“আমার ওড়না ধরে টেনেছেন কোন সাহসে আপনি ?”
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে ওড়নার দিকে তাকিয়ে দেখে সেটা গাছের একটা ভাঙা ডালের সাথে আটকে রয়েছে।
রিধিশাও সেদিকে তাকায়। ওড়নার অবস্থান দেখে রিধিশার চোখ কপালে উঠে গেলো, ঢোক গিলে নিশাদের দিকে তাকায় রিধিশা। নিশাদের চোখ দেখে মনে হলো, নিশাদ তাকে চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে।
নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” ফিল্মের হিরোইন মনে করে ওড়না নাচিয়ে নাচিয়ে হাটবে আর গাছে আটকে গেলে অন্যদের গালে থাপ্পড় মারবে তাই না ? খুব সাহস তোমার ? এতো সাহস আসে কোথা থেকে ? হাতে গোণা এইটুকু
বয়সে এতো সাহস দেখানোর ইচ্ছা ? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে তোমার ? লাইফ হেল বানিয়ে রাখবো তোমার।” রিধিশা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো
” দেখুন বেশি বেশি করছেন আপনি ! ভুল করেছি তারজন্য সরি। এখন আমার হাত ছাড়ুন।” নিশাদ আরো জোড়ে হাত চেপে ধরে বললো
” তোমার এই সরি আমি এক্সেপ্ট করছি না। যেমনটা আমার সরি তুমি এক্সেপ্ট করোনি। নিজেকে খুব বড় মনে করেছিলে তাই না ? এই সরি আমি অন্যভাবে উশুল করবো।”
রিধিশা রেগে বললো
” যা ইচ্ছে করুন আমার কিছু না। সরুন আমার সামনে থেকে।”
“তোমার এতো ভাব আর সাহস দুটোরই আমি বারোটা বাজাবো।”
নিশাদ রিধিশার হাত ছেড়ে জ্যাকেটের হাতা টানতে টানতে সেখান থেকে চলে যায়।
রিধিশা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার কি কি হবে সেটা দেখা ছাড়া জানার উপায় নেই।
রিধিশা আবার তার আগের জায়গায় গিয়ে দেখে জোতি এখনও কথাই বলছে। এতো কার সাথে কথা বলে এই মেয়ে?
রিধিশা ক্লাসে চলে গেলো।
ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে তীর্ণ আর তারাকে পড়িয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লো রিধিশা। তীর্ণ আর তারা দুই জমজ ভাই বোন দুজন ২য় শ্রেণিতে পড়ে।
এখন আলিফকে পড়াতে যাচ্ছে। আলিফ ক্লাস ফোর এর স্টুডেন্ট। আলিফকে সবসময় একটু বেশি সময় পড়াতে হয়। তারপর সেখান থেকে আবার তানহার বাড়িতে যেতে হয়। এই দুই বাসার দূরত্ব খুব বেশি নয়। আলিফের আম্মুই তানহাকে পড়ানোর জন্য খুঁজে দিয়েছিলো।
সেখান থেকে নিজের বাসার কাছেই আরেকটা মেয়েকে পড়ায়। এই তিনটে টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি যেতে যেতে রাত হয়ে যায়। এখন আবার শীতকাল হওয়ায় দিন ছোট হয়ে এসেছে।
কাঠ পোড়া রোদের জন্য ছাতা নিয়েই বের হয়েছে কিন্তু ছাতা ধরে হাত ব্যাথা করছে তাই বিরক্ততে মুখ কালো করে রেখেছে রিধিশা।
আলিফদের বিল্ডিং এর গলিতে ঢুকতেই রিধিশার চোখ কপালে উঠলো নিশাদকে দেখে। নিশাদের বন্ধুদরা ক্রিকেট খেলছে আর নিশাদ বাইকের সাথে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে গম্ভীর ভাবে । রিধিশা আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। বিরবির করতে থাকে
” এই ছেলে এখানে কি করছে? আগে তো কখনো এখানে দেখিনি। ছেলেটা কি পিছু ছাড়বে না আমার? এখন আমাকে দেখে যদি কিছু করে বসে? কি করবো আমি এখন?”
রিধিশা বিরবির করতে করতে মনে সাহস জোগাতে থাকে। এর মধ্যে কোথা থেকে ক্রিকেটের বল এসে রিধিশার পায়ের কাছে পড়লো। রিধিশা তাকিয়ে দেখে সাদি আসছে বল নিতে। রিধিশা আড়াল থেকে বেরিয়ে ছাতা দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে সোজা হাটা ধরলো।
নিশাদকে পেড়িয়ে রিধিশা আলিফের বাড়িতে ঢুকে শ্বাস নিলো।
দুই ঘন্টা যাবত পড়িয়ে আলিফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
রোদ পড়ে যাওয়ায় ছাতা খোলেনি রিধিশা।
” রিধিশা !” রিধিশা পেছন ঘুরে নিশাদকে দেখতে পেলো। রিধিশা জিভ কাটলো নিশাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। নিশাদ সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিশে এগিয়ে আসলো। রিধিশা ঢোক গিলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে গলিটা পুরোই ফাকা, কাউকে দেখতে পেলো না।
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” এখানে কি করো তুমি? এখানে থাকো নাকি তুমি? আগে তো দেখিনি তোমাকে।”
” আপনাকে কেনো বলবো এখানে থাকি নাকি অন্য কোথাও থাকি!”
” এতো ভাব তোমার আসে কোথা থেকে? তোমার ভাবকে আমি পানিতে চুবিয়ে ভেজা বেড়াল বানাবো। একটা কথা বলো! আমাকে দেখে তোমার ভয় করছে না? এখন যদি তোমার থাপ্পড়ের বদলে তোমাকে থাপ্পড় দেই আমি!” রিধিশা ঢোক গিলে বললো
” দদেখুন আমি ভুল করেছি আমি জানি। তাই বলে কি একটা মেয়েকে থাপ্পড় দেবেন আপনি?”
নিশাদ জ্যাকেটের হাতা টানতে টানতে বললো
” হ্যা, কেনো তুমি ভার্সিটির সিনিয়র স্টুডেন্ট এর গায়ে হাত তুলতে পারো আর আমি জুনিয়রকে তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারবো না?
ভাবছিলাম তোমাকে থাপ্পড় ফিরিয়ে দেয়া যায় কি করে? ভাগ্যটা ভালো তোমাকে এখানেই পেয়েছি। কাজটা সেরে নেওয়া যাবে এখনই।”
রিধিশা চোখ বড়বড় করে তাকালো। নিশাদ দু পা এগিয়ে আসতেই রিধিশা ভয়ে তানহার বাড়ির দিকে দৌঁড় দিলো। নিশাদ রিধিশার যাওয়ার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
______________
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনের মতো রাত হয়ে গিয়েছে রিধিশার। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বাড়ির কথা মনে পরছে তার।
ইন্টারের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষতে উঠেছিলো মাত্র। হুট করে একদিন বাড়িতে এসে শুনে রিধিশার বাবা শফিক উদ্দিন তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। তাও এক ৩৫ বছরের লোকের সাথে কারণ লোকটির টাকার অভাব ছিলো না। রিধিশা খুবই রাগ হয় বাবার প্রতি। টাকার জন্য একমাত্র মেয়েকে বুড়োর সাথে বিয়ে দেবে এটা তো কখনো রিধিশা ভাবেনি।
বাবা,মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলো কিনা !
১মাস পর্যন্ত বিয়ের তোরজোড় অনেক দূড় এগিয়ে যায়। রিধিশার মা লিমা বেগমও এই বিয়েতে সম্মতি দেয়নি। তাই তিনি গায়ের হলুদের আগের দিন রাতে রিধিশার হাতে কিছু টাকা দিয়ে পালিয়ে যেতে বলে গ্রাম থেকে।
রিধিশা তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসে সেই গ্রাম থেকে এক রাতের মধ্যে। জোতি ছিলো রিধিশার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ছোট থেকে বন্ধু হিসেবে তাকেই পেয়েছিলো। জোতি তার মা, বাবা আর ভাইয়ের সাথে ঢাকা থাকতো। রিধিশাকে গ্রাম ছেড়ে জোতির কাছেই আসতে হয়েছিলো। জোতির পরিবারের কেউও এসব নিয়ে কথা বলেনি। তারা নিজেরাও অসন্তুষ্ট ছিলো এই বিয়েতে। সেই বছরই জোতির বড় ভাইয়ের চাকরীর ট্রান্সফার হয়ে যায় তাই জোতির মা,বাবা আর ভাই সেখানে চলে যায়। জোতি আর রিধিশা দুজন এতো বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতো। রিধিশা আত্মসম্মান বজায় রেখে নিজের খরচ চালাতে টিউশনি পড়াতে থাকে।
ফাইনাল এক্সামের সময় বাড়িতে যায় তখন তার বাবা তার সাথে কথাও বলেনি। রিধিশা নিজেও রাগের বশে কথা বলার চেষ্টা করেনি।
তারপর আবার ঢাকা এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। টিউশনি দিয়ে কোনোরকমে চলে যায় মাস। জোতির মাথায় ভূত চাপায় সে হোস্টেলে চলে যায়। বাসায় প্রচণ্ড বকা খেয়েছে তার জন্য।
রিধিশা পুড়নো কথা ভেনে আলতো হাসলো। কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে উঠে পড়লো, টেবিলে বসে বই নিয়ে পড়তে থাকে।
.
নিশাদ একের পর এক সিগারেট টানছে বসে বসে। রিধিশার থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। রাগ আপ ডাউন করছে। ভার্সিটির সব মেয়ে তার জন্য পাগল আর রিধিশা কিনা থাপ্পড় দিয়ে বসলো অকারণে! ভাবা যায় এসব? ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে নিশান।
পাশের রুমে সাদি, সূর্য, রেহান পার্টি করছে ধুমছে। নিশাদের মাথা আরো গরম হয়ে গেলো ওদের গান বাজনা শুনে। একে তো মেজাজ ঠিক নেই তার উপর এসব!
নিশাদ জ্যাকেট খুলে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে
পাশের রুমে গেলো।
তিনজন গানের তালে তালে উল্টা পাল্টা নেচে যাচ্ছে। পাশে দুটো মদের বোতল পড়ে রয়েছে। রেহান নাচতে নাচতে নিশাদকে দেখে হেসে বললো
” আরে নিশাদ ব্রো যে! দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছো? তোমাকে এতো শান্ত দেখতে ভালো লাগছে না আজ?”
সূর্যও বললো
” আচ্ছা নিশাদ তুই কি তোর লায়লাকে পেয়েছিস নাকি? আজকে একদম চুপচাপ শান্ত ছেলে হয়ে গিয়েছিস যে তুই?”
নিশাদ কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনজনকে একে একে গণহারে মারলো।
তিজনকে মেরে ঠাস করে পাশে বসে মদের বোতল হাতে নিয়ে খেতে থাকে। সাদি ব্যাথায় কুঁকড়াতে কুঁকড়াতে বললো
” বুঝলাম না কোথা থেকে এসে তুই এলোপাথাড়ি মারা শুরু করলি। সবসময় হুট করে এসে কারণ ছাড়া মেরে দেস।”
নিশাদ কয়েক ঢোক গিলে মদের বোতলটা খালি করে পাশে ছুড়ে ফেলে। শব্দ হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকে।
নিশাদ মুখ মুছে বড় একটা শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“আজকে রিধিশা আমাকে থাপ্পড় মেরেছে।”
তিনজন চমকে মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো।
রেহান মাতাল গলায় বললো
” কি বললি? ওই মেয়ের এতোবড় সাহস? মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে। তুই কি করেছিস, দুটো থাপ্পড় দিয়েছিস তো?”
কথা শেষ করে রেহান ঢেঁকুর তোলে। নিশাদ মুখ কুঁচকে আরেক ঘা বসিয়ে দেয় রেহানের পিঠে। রেহান চেঁচিয়ে উঠে।
নিশাদ ফুস করে নিশ্বাস ফেলে বললো
” মারতেই তো পারলাম না আবার দুটো থাপ্পড়!”
” হ্যা, আমাদেরই মারতে পারস তুই। কালকেই ওই মেয়েকে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়ে যাবো।”
” না যা করার আমি করবো।” নিশাদ উঠে চলে আসলো তার রুমে। এসি চালু করে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
★★★
আজ ঘুম হয়নি ভালো করে তাই নিশাদ তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে চলে এসেছে। রিধিশার সাথে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না নিশাদ।
“থাপ্পড়ের প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া যায়? আচ্ছা আবার পানি ফেলবো? হ্যা তাই করবো। প্রথমবার ভুলে ফেলেছিলাম এবার ইচ্ছে করে ফেলবো।”
ভেবেই নিশাদ হাসলো। গেটের দিকে চোখ পড়তেই দেখে রিধিশাকে।
রিধিশার ভাবনায় ডুবে আছে। নিশাদ গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। রিধিশা নিশাদকে দেখেই চমকে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। নিশাদ কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। রিধিশা বোকার কতো তাকিয়ে থাকে।
” হুট করে সামনে আসলো আবার চলে গেলো। আসলোই বা কেনো? ভয় দেখাতে! শয়তান ছেলে।”
নিশাদকে বকতে বকতে এগিয়ে যায়।
সামনে জোতিকে দৌঁড়ে আসতে দেখে। একবার হোচটও খেলো মাঝপথে কিন্তু দৌঁড়ে আসা থামালো না মেয়েটা। সামনে এসে থামতেই রিধিধা জিজ্ঞেস করলো
” এভাবে পাগলের মতো দৌঁড়াচ্ছিলি কেনো?”
জোতি হাপাতে হাপাতে বললো
” আর বলিস না। আমি নিশাদ ভাইয়াকে দেখে এসেছি। ভাইয়া কি কিছু বলেছে তোকে?”
রিধিশা ইশারায় না করলো।
“শোন তুই একটু ভালো করে চলিস। ভাইয়া কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস কিন্তু ভালো।”
রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” ডেঞ্জারাস আবার ভালো!” জোতি বিরক্ত গলায় বললো
” ধুর তুই কিছু বুঝিস না। মানে ভাইয়া খুবই ভালো। আর ডেঞ্জারাস মানে হলো ভাইয়া খুবই রাগি। আচ্ছা ভাউয়ার ব্যাপারে সব বলবো কিন্তু তোকে বলে দিচ্ছি। ভাইয়ার থেকে দূড়ে থাকবি আর রাগ বা ভাব দেখাবি না তুই।”
রিধিশা জোতির হাত চেপে কাছে টেনে ফিসফিস করে বললো
” আচ্ছা শোন একটা কথা! আমি কালকে ছেলেটাকে থাপ্পড় মেরেছিলাম।” জোতি মাথায় হাত দিয়ে রিধিশার দিকে তাকালো। মনে হলো খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। জোতি হাত দিয়ে বললো
” রিধি! ধর আমাকে আমার গলা শুকিয়ে গেছে, মাথা ঘুরাচ্ছে পড়ে যাবো এখনই। কি করছিস এটা তুই!”
রিধিশা জোতিকে টেনে নিয়ে ক্লাসে চলে গেলো।
চলবে……….
#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৩ ।
“কিরে নিশাদ! দুই বালতি পানি নিয়ে কই যাস?”
নিশাদ একটা বালতি সূর্য, আরেকটা বালতি রেহানের হাতে দিয়ে হেসে বললো
” আজকে শয়তানের মার মাথা থেকে ভূত তাড়াবো। কালকে যে একটা গলিতে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলি
সেখানে ওই রিধিশাকে দেখেছিলাম।”
” বুঝলাম কিন্তু প্রথম দিন পানি দিয়েছিলি তাতেই কাহিনী এতোদূড়! আবার আজকে পানি দিবি?”
নিশাদ রেহানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললো
” আগেরটা তোর জন্য ছিলো। কিন্তু এবার পুরো নামকরণ করা। এই মেয়ের মাথা থেকে ভাবের ভূত নামাবোই।”
.
ভার্সিটি শেষে প্রতিদিনের মতো তীর্ণ আর তারাকে পড়িয়ে আলিফের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় রিধিশা। মাথার মধ্যে কতোশত চিন্তা ঘুরছে।
“জোতি হোস্টেলে উঠে গিয়েছে এখন পুরো ফ্ল্যাটের ভাড়া আমাকেই দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? ১৫ হাজার টাকা মুখের কথা নয়। জোতি থাকায় আংকেলই সব ভাড়া দিতো কিন্তু এখন তো জোতি নেই। আমি টিউশনি করিয়েই তো ১০ হাজার পেতাম। একটার ফিস বাড়িয়েছে তাই সাড়ে ১০ হাজার। ১৫ হাজার কিভাবে দেবো? আমার হাত পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে বাসাটা ছাড়তে হবে। জোতির সাথে কথা বলতে হবে আজ।”
আজও রাস্তায় নিশাদকে দেখতে পেয়ে রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আলিফের বাসা থেকে কিছুটা আগেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিশাদ তার বন্ধুদের কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে বললো
” শুরু কর।” সূর্য এগিয়ে এসে রিধিশার মাথায় পানি ঢেলে দেয় তারপর রেহানও তার বালতি খালি করলো রিধিশার মাথায় ঢেলে। রিধিশা চিৎকার করে উঠে।
মুখের পানি সরিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে নিশাদের দিকে তাকিয়ে রেগে বললো
” আপনি মানুষ না অন্যকিছু? মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের গায়ে পানি ঢেলে আপনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন?”
নিশাদ রিধিশার কথা কানেই তুললো না। শিষ বাজাতে বাজাতে বাইক নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। রিধিশা বুঝতে পারে না কি করবে। এখন বাসায় গেলে আবার আসতে অনেক সময় পেড়িয়ে যাবে। নিশ্বাস ফেলে আলিফের বাসায় চলে গেলো।
বাসার দরজা খুলে আলিফের মা রিধিশাকে ভেজা অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বললো
” রিধিশা এই অবস্থা কেনো তোমার?” রিধিশা মুখ কালো করে বললো
” আন্টি, আসার সময় উপর থেকে কারা যেনো পানি ফেলে ভিজিয়ে দিয়েছে।” আলিফের মা তাড়া দিয়ে বললো
” আচ্ছা ভেতরে গিয়ে বসো আমি টাওয়াল দিচ্ছি।”
রিধিশা আলিফের রুমে চলে গেলো। সোফায় বা বসে ভেজা কাপড় নিয়ে চেয়ারে বসে।
” সেইদিন এক বালতি ঢেলেছিলো আর আজকে দুই বালতি! এই ছেলেটার কি পানিতে জন্ম হয়েছে নাকি? সব সময় পানি এনে ঢেলে দেয়! আজকে তো কাপড়ই শুকাবে না।” আলিফ ওয়াসরুম থেকে এসে রিধিশাকে দেখে হেসে বললো
” ম্যাম তুমি গোসল করে জামা চেঞ্জ করোনি?”
রিধিশা হেসে বললো
” করেছিলাম তবে কয়েকটা বজ্জাত ছেলে আবার ভিজিয়ে দিয়েছে।”
” ওওও!” আলিফের মা রিধিশাকে টাওয়াল দিয়ে যায়। রিধিশা মাথা মুছে নেয় ভালো করে কিছুক্ষণ পর এসে গরম আদা চা দিয়ে বললো
” চা খাও। ভেজা কাপড়ে বসে থাকলে জ্বর না আবার এসে যায়!” রিধিশা আলতো হেসে চা খেয়ে থাকে আর আলিফকে পড়াতে থাকে।
আলিফকে পড়িয়ে ভাবলো তানহার বাসায় ছুটলো রিধিশা। কাপড়ও শুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু ঘুমের জন্য চোখ খুলে রাখতে পারছে না। তানহাকে কিছুক্ষণ পড়িয়ে বাসায় চলে আসে। আরেকটা টিউশনি আছে তবে কল করে সেটায় আজ যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দিলো।
রিধিশা তার ড্রেস চেঞ্জ করে আরেক কাপ চা খেলো।
রাতের রান্না করতে হবে কিন্তু শরীর সায় দিলো না আর। চা বিস্কিট খেয়ে পড়তে বসলো। ১২টা পর্যন্ত পড়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গেলো।
★★
নিশাদ তার রুমে বসে একটা গিফট বক্স খুলছে। রিধিশার উপর পানি ঢালার কিছুক্ষণ পর কুরিয়ার থেকে ফোন দিয়ে বলে পার্সেল এসেছে। তখনই নিয়ে এসেছিলো কিন্তু খোলা হয়নি।
ড্রইংরুমে বসে সূর্য, রেহান, সাদি রিধিশাকে নিয়ে গবেষণা করছে। তাদের কলিজার গায়ে হাত দিছিলো এসব নিয়েই।
গিফট বক্স খুলে একটা শো পিছ পেলো। শো পিছ দেখে নিশাদ মুখ বাকিয়ে বিরবির করে
” আমার কি বউ আছে নাকি যে এসব ঘরে সাজাবো? এসব কে দিয়েছে ফালতু জিনিস?” নিশাদ উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে খেয়াল করলো একটা সো পিছের ভেতরে একজোড়া কাপলের মূর্তি আর পুরোটা পানি দিয়ে ভরস। ভেতরের গুঁড়োগুঁড়ো কাগজের মতো কি যেনো বিভিন্ন রং দিচ্ছে।
কাপলের মূর্তিটা দেঝে রিধিশার কথা খেয়াল আসলো। নিশাদ চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো। প্রথম কোনো মেয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলো। প্রতিশোধ নেওয়ার পরও মন থেকে শান্তি পাচ্ছে না নিশাদ।
________
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মাথা ভার অনুভব করে রিধিশা। রিধিশা মাথা ব্যাথা নিয়ে উঠে বসে। “কালকের দুই বালতি পানির জন্য হয়তো মাথা ব্যাথা করছে। চা খেয়েছিলাম তাই জ্বর আসেনি বোধয়।”
রিধিশা হাত মুখ ধুয়ে তীর্ণ আর তারার বাসায় গেলো। তার মার সাথে কথা বলে দুজনের পড়ার টাইম রাতে নিয়ে আসে। দুজনকে রাতে পড়ালে বাকিদের একঘন্টা আগে আগে পড়িয়ে বাড়িতে ফিরে আসবে এখন থেকে। রিধিশা খুশি মনে বাসায় এসে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে গেলো।
হেটে হেটে ভার্সিটিতে এসে ক্লাসে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর জোতিও আসলো। রিধিশা জোতির হাত চেপে বললো
” শোন আমার তোর সাথে কথা ছিলো।”
” হ্যা তো বল!”
রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” আমি বলছিলাম যে এই বাসাটা আমি ছেড়ে দেবো। এখন তো তুই থাকিস না তাই পুরো ফ্ল্যাটের ভাড়া আমার দেওয়া সম্ভব না। আমি একা থাকার জন্য নাহয় একটা বাসা খুঁজে নেবো!”
জোতি কিছুক্ষণ ভেবে বললো
” ঠিকাছে তাহলে তুই বাসা দেখ। ভাইয়ার সাথে কথা বললো আমি।” রিধিশা মাথা নাড়ালো।
ক্লাস শুরু হতেই টিচারের সাথে কিছু সিনিয়র স্টুডেন্ট এসে পিকনিক এর কথা জানিয়ে গেলো। ভার্সিটি থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। যারা নাম দিয়েছে তাদের সবাইকে পরশু সকাল ৮তার মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলেছে।
রিধিশা আর জোতি দুজনই নাম দিয়েছিলো। রিধিশা মুখ কালো করে বললো
” ট্যুরের টাকা না দিলেই ভালো হতো। একটা দিন টিউশনি পড়াতে পারবো না সেখানে গেলে।”
জোতি বিরক্ত হয়ে বললো
” তুই এমন কেনো হয়ে গিয়েছিস? আগে তো এমন ছিলি না। সব সময় সবার আগে তোর নাম থাকতো আর এখন শুধু এটা নয় ওটা করলে ভালো হতো এসব বলিস। আগের তুই আর এখনের তুই এর মধ্যে কতো পার্থক্য জানিস?”
রিধিশা শান্ত গলায় বললো
” আগের পরিস্থিতি আর এখনের পরিস্থিতিও এক নয়।”
” তোর বাবার একটা সিদ্ধান্তের জন্য কি এখন পুরো লাইফ নষ্ট করবি? তুই এখন আর তোর বাবার কাছে নেই তাই এখন সেসব আগের কথা চিন্তা করে নিজের আনন্দ উল্লাস নষ্ট করিস না। সেই এক ফালতু ঘটনার পর তুই কোনো আনন্দ উল্লাসে মেতেছিলি বলে আমার আর মনে হচ্ছে না। এখন আর ফালতু কথা বলে আমাকে রাগাবি না।”
রিধিশা মুখ কালো করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাইরে তাকানোয় নিশাদের দিকে গিয়ে চোখ পড়লো। বাইকে হেলান দিয়ে সানগ্লাস পড়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে তবে তার দিকেই তাকিয়ে আছে কিনা জানে না। রিধিশা চোখ সরিয়ে নিলো।
.
নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে ভেবে যাচ্ছে মেয়েটাকে কিভাবে টাইট দেওয়া যায়। একটা থাপ্পড়ে তার জীবন হারাম করে দিয়েছে রিধিশা।
নিশাদের ভাবনার মাঝে তার ডিপার্টমেন্টের একজন ক্লাসমেট এসে তাকে ডাকলো।
নিশাদ তার কাছে যেতে বললো ম্যাম নাকি ডাকছে।
নিশাদ ম্যামের কাছে গেলে ম্যাম বললো
” যারা যারা ট্যুরে যাচ্ছে মেয়েদের একটা টি-শার্ট বা ক্যাপ দিয়ে দেবে। সেগুলোতে ভার্সিটির নাম লিখা থাকবে।”
ব্রেক টাইমে সব স্টুডেন্টকে জড়ো করে সবাইকে একটা করে টি-শার্ট আর ক্যাপ দেওয়া হয়। বেশিরভাগ মেয়েই টি-শার্ট নিয়েছে জিন্স এর সাথে পরবে বলে। রিধিশার হাতে টি-শার্ট দিতেই রিধিশা মুখ ফিরিয়ে অন্য হাতে থেকে ক্যাপ নিয়ে নিলো একটা।
” বেয়াদব মেয়ে একটা!” নিশাদ নাক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
.
ভার্সিটি ছুটি হলে রিধিশা ভার্সিটির থেকে অনেকটা এগিয়ে একটা পুকুর পার রয়েছে সেখানে গিয়ে বসে পরে। বিরক্ত লাগছে তার কাছে। রিধিশা মুখ এগিয়ে পানির উপর নিজের মুখটা দেখতে পেলো।
আগে গ্রামের বড় পুকুরপাড়টায় বসে ছেলে, মেয়েদের সাথে কতো হাসি মজা করতো আজ মনে পরছে অনেক।
রিধিশা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জায়গাটা দেখতে থাকে।
অনেক গাছের মধ্যে দুটো ফুল গাছ খুব চোখ পড়লো।
একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ আরেকটা দূড়ে লাল কাঠ গোপালের গাছ। রিধিশা কিছুক্ষণ বসে থেকে দুই গাছের নিচ থেকে ফুল কুড়িয়ে বাসায় জাওয়ার পথে হাটতে হয়।
হঠাৎ তার হাটার মাঝে একটা বাইক এসে থাকে। রিধিশা তাকিয়ে দেখে নিশাদের বাইক। রিধিশা চোয়াল শক্ত করে তাকায়।
” শোনো মেয়ে বেশি ভাব দেখাবে না আমাকে ঠিকাছে? বেয়াদব মেয়ে একটা।”
” আর আপনি তো বেয়াদব ছেলে। মেয়েদের সম্মান দিতে জানেন না। ছোট বোন হিসেবেও তো একটু শান্তি দিতে পারেন!”
“কেনো তুমি কি আমার বোন হও নাকি? তুমি তো একটা বেয়াদব মেয়ে। বেয়াদব মেয়েদের বোনের মতো ট্রিট করতে নেই। আর কখনো আমার সামনে আসবে না।”
রিধিশা ভেঙিয়ে বললো
” আমি তো আপনার সামনে আসার জন্য মরে যাচ্ছি তাই না? বারবার রো ভূতের মতো আপনিই আমার সামনে আসছেন। বদ ছেলে, আপনি খুবই খারাপ।”
নিশাদক চোখ গরম করে বাইক নিয়ে চলে গেলো।
রিধিশা মুখ ফুলিয়ে হাটতে থাকে।
চলবে…….