কুঁড়েঘর পর্ব -০৮+৯

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৮ ।

নিশাদ কিছু জায়গা চক্কর দিয়ে তারপর বাড়িতে আসলো। এসে দেখে বুয়া খাবার রান্না করে চলে গিয়েছে। নিশাদ সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে।
সূর্য, সাদি আরো আগেই এসেছে তবে রেহানের খোঁজ নেই। মহারাজ এখনও আসেনি।
নিশাদ জ্যাকেট খুলতে খুলতে বলে
“রেহানের আজকাল কোনো কিছুই ঠিক লাগছে না। না জানি কোনো মেয়ের পেছনে পড়েছে কিনা!”

সূর্য শুনতে পেয়ে রুম থেকেই বললো
” আরে আজকাল তোর শত্রু রিধিশার সাথে যে মেয়েটা থাকে সেই মেয়ের সাথে দেখা যায় মাঝে মাঝে। রাতে তো কথাও বলে একটু একটু।”
নিশাদ কোমড়ে হাত দিয়ে মুখ কুঁচকে বললো
” শেষে কিনা আমার শত্রুকে বেয়াইন বানানোর প্ল্যান করছে? এটা আসলেই আমার বন্ধু তো!”
সূর্য হেসে দেয় নিশাদের কথায়।

নিশাদ ওয়াসরুমে ঢুকে যায় গোসল করতে। মারাত্মক গরম পড়ছে কয়েকদিন ধরে।
একঘন্টা সময় লাগিয়ে গোসল শেষ করে বের হলো।
চুল মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে দেখে রেহান মাত্র এসেছে। ঢুকে জুতা খুলতে ব্যস্ত। নিশাদ টাওয়ালটা সোফার উপর রেখে বললো
” কিরে এতো সময় পর কোথা থেকে এলি?”
.

হুট করে পেছন নিশাদের কথা শুনে রেহান ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে। নিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। রেহান দাঁত কেলিয়ে হাসলো তাতেও নিশাদের চাহনির পরিবর্তন হয়নি। রেহান মাথা চুলকে বললো
” জোতির সাথে একটু কফি শপে গিয়েছিলাম।”
নিশাদ খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললো
” ১০ মিনিটের ভেতর টেবিলে এসে বসবি নাহলে!”
নিশাদ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। রেহান দৌঁড়ে রুমে চলে যায়। সাদি আর সূর্য এসে টেবিলে বসে নিজেদের প্লেটে খাবার নিতে থাকে।
.

টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরে রিধিশা ফ্রেশ হয়ে বসে। এই বাসার ভাড়া দিতে হবে তাই টাকা বের করলো। একজন বাদে সবাই এই মাসের টিউশনির বেতন দিয়ে দিয়েছে। এখানে ৮হাজার টাকা।
রিধিশা লাগেজ থেকে ১০হাজার টাজা বের করে চুপচাপ টাকার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

কয়েক মাস আগে ঢাকায় আসার সময় লিমা বেগম ১০ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলো
” এখন তো আর আমার কাছে থাকিস না তাই চাইলেও তোকে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি না। এই টাকাগুলো রেখে দিবি খুব বেশি দরকার পড়লে বা বিপদে পড়লে খরচ করবি। তোর বাবার থেকে লুকিয়ে এই কয়টা টাকাই রাখতে পেড়েছি। আরও যদি দরকার হয় আমাকে বলবি, আমি যেভাবেই পারি সাহায্য করার চেষ্টা করবো। এই সময়টাতে মা হয়েও তোকে আগলে রাখতে পারছি না।”
রিধিশা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলো
” আমার কোনো সাহায্যই চাই না। তুমি শুধু বাবার মতো হয়ে যেও না। তুমি সব সময় এই রকম থেকো।”

রিধিশার গাল গড়িয়ে চোখে পানি পড়ে কয়েক ফোটা। রিধিশা নাক টেনে চোখ মুছে নেয়।
সব টাকা মিলিয়ে ১৮হাজার হয়েছে। ১৫ হাজার ভাড়া দিয়ে বাকি ৩হাজার থেকে যাবে। রিধিশা আলতো হাসলো। মাথার উপর থেকে ভাড়ার বোঝাটা নামাতে পাড়লেই চলবে বাকি মাস নাহয় কোনোরকমে চালিয়ে দেবে।
.
কলিংবেল বেজে উঠতেই রিধিশা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তীর্ণ আর তারা দৌঁড়ে এসে তাদের জায়গায় বসে পড়ে। রিধিশা হেসে দুজনের কাছে এসে বসতেই তীর্ণ মন খারাপ করে বললো
” ম্যামাপু কালকে তুমি চলে যাবে? তোমাকে অনেক মিস করবো।”
রিধিশা তীর্ণর গাল টেনে বললো
” আমি তো প্রতিদিনই আসবো তোমাদের পড়াতে তখন তো দেখবেই।”

তারা উৎসুক হয়ে বলে
” ম্যাম’আপু জানো আজকে তীর্ণ ক্লাসে গিয়ে একটু একটু কেঁদেছে আর সব্বাইকে বলেছে আমার ম্যাম’আপু চলে যাবে।”
রিধিশা তীর্ণর দিযে তাকিয়ে হেসে দেয়। তীর্ণ লজ্জা পায় কিছুটা। রিধিশা দুজনকে পড়তে বলে উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে।
আজকে বাসায় আসার সময় দুজনের জন্য কয়েকটা চকলেট কিনেছিলো। এই বাড়িতে আসার পর থেকে দুজনের থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছে রিধিশা তাই দুজনের জন্য খারাপ লাগছে, চলে যাবে বলে। দুজনকে চকলেট দিতে দুজন খুশি হয়ে রিধিশার গালে চুমু দিলো।
রিধিশা দুজনকে পড়াতে থাকে।
.

নিশাদ রুমে বসে হাতে বল নিয়ে খেলছে। একদমই ভালো লাগছে না তার। ফোনের শব্দে নিশাদ হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে দেখে মিলি কল দিয়েছে। নিশাদ ফোন সাইলেন্ট করে সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো। সিগারেট হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলো।
বাসায় কেউ নেই এখন। সূর্যরা ক্লাবে গিয়েছে কারণ আজকে মিলির জন্মদিন। নিশাদকেই সবার আগে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিলো কিন্তু নিশাদ তো নিশাদই। রেহানরা কেউ যেতে না চাইলেও জোড় করে পাঠিয়েছে আর নিজে ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। কেউই না গেলে মিলি বাড়ি খুঁজে বের করে ঠিকই চলে আসতো। রেহানরা মিলিকে আটকে রাখতে পারবে তাই পাঠিয়েছে।

হাতের সিগারেট শেষ করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ব্যালকনির ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখের সামনে মায়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। নিশাদ কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো লাইট অফ করে।
.

রাত ১০টা বাজে…
রিধিশা ফ্যালফ্যাল করে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে বিস্ময়ের রেশ। তার বিকাশে টাকা এসেছে! তাকে টাকা কে পাঠালো? অতি বিস্ময়ে কোন নাম্বার থেকে এসেছে সেটাও দেখেনি এখনও।
” এতো টাকা আমাকে কে পাঠালো?”
রিধিশার কথা শেষ হতেই ফোন বেজে উঠে। জোয়ান কল করেছে। রিধিশা রিসিভ করে
” আসসালাম ওয়ালাইকুম ভাইয়া। কেমন আছো?”

” ওয়াকাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুই কেমন আছিস?”
রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” জি ভাইয়া ভালো।” জোয়ান গম্ভীর গলায় বললো
” মা কথা বলবে তোর সাথে।”
রিধিশা সস্তির নিশ্বাস ফেলে। ভেবেছিলো জোয়ান বকাঝকা দেবে।
” হ্যা দাও খালামনির কাছে।”
.
“কিরে মা কেমন আছিস?” রিধিশা খুশি মনে বলে
” ভালো আছি খালামনি তুমি কেমন আছো?”
” তুই কি আর খোঁজ খবর রাখিস নাকি? আচ্ছা শোন তোকে টাকা পাঠিয়েছি কিছু সেটা দিয়ে ভাড়াটা দিয়ে দিস।”
রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” তুমি টাকা পাঠিয়েছো? কিন্তু কেনো? ভাড়া তো আমিই দেবো!”
জোতির মা কড়া গলায় বললো
“বেশি পাকামো করিস না। যা বলবো তাই করবি। তোর আত্মসম্মানবোধ তো বেশি তাই তুই আমাদের থেকে টাকা নিবি না। কিন্তু এটা তোকে টাকা দিচ্ছি না। এটা জোতি এই মাসে যতোদিন এই বাসায় থেকেছে সেটার জন্য, অর্ধেকই দিয়েছি আবার ভাবিস না তোকে দয়া করছি।”
.
“খালামনি জোতি তো তেমন বেশিদিন থাকেনি যে সেটার জন্য টাকা দেবে। আর আমি টাকা জোগাড় করে ফেলেছি।”
জোয়ান মায়ের কান থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে রাগি গলায় বললো
” ছোট ছোটর মতো থাকবি! তোদের দুজনকে আমি সামনে পেলে যে কি করবো সেটাই ভাবছি। তোর মা তোর দায়িত্ব আমাদের কাধে দিয়েছে। এখন তোর গার্জিয়ান আমরা তাই যা বলবো তাই করবি আর তোর এখনও বিয়ে হয়ে যায়নি যে সব কিছু তোর কথায় চলবে। তুই এখনও আমাদের দায়িত্বে রয়েছিস।”
রিধিশাকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দিলো জোয়ান।
রিধিশা মন খারাপ করে ফেলে।

________

আজকে রিধিশা ভার্সিটিতে যাবে না। সকালে চা বিস্কুট খেয়ে তীর্ণ, তারাকে তাদের স্কুলে যাওয়ার আগে পড়িয়ে দিলো।
তারপর দোকানে গিয়ে বিকাশ থেকে টাকা তুললো। আট হাজার টাকা পাঠিয়েছে। একটা ভেন গাড়ি ঠিক করে বাসায় ফিরলো। বাসায় মোটামুটি ভালোই জিনিসপত্র রয়েছে। বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে কারেন্ট বিল, ভাড়া সহ মোট সাড়ে ১৫ হাজার ভাড়া দিয়ে আসে।

ভেন ওয়ালা আসতেই রিধিশা সব জিনিস পত্র দেখিয়ে দেয় আর লোক দুটো জিনিস নিয়ে একে একে বেধে ফেলে।
আগের বাসা থেকে খুব বেশি দূড়ে নিয় এখনের নতুন বাসাটা।
সব জিনিস রেখে আর খাটও সেট করে দিয়ে যায় ভেন গাড়ির লোক দুটো।
একটা খাট, ওয়ারড্রব আর সব রান্নাঘরে কিছু জিনিসপত্র। এগুলোই রুমে সেট করে যায়। দুজনকে পাঁচশ টাকা দিতে হয়।
রিধিশা রুমের সব কিছু ধীরেধীরে গুছিয়ে নিতে থাকে।
.

নিশাদ ভার্সিটিতে আসার পর থেকে মিলি তার পিছনে পড়ে আছে। মিলি ন্যাকা স্বরে বললো
” বেবি কালকে তুমি আমার birthday celebration এ আসোনি! তোমার জন্য কতো কিছু এরেঞ্জ করেছিলাম you have no idea. রেহানদের জিজ্ঞেস করে দেখো! তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ৯টায় কেক কাট করেছি আমি। কতো ফোন দিয়েছি তুমি রিসিভ করোনি।”

নিশাদ রেহানদের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনজন হাসি আটকে রেখে একসাথে সায় জানায়। নিশাদ বিরক্তকর গলায় বললো
” প্লিজ মিলি এসব ভালো লাগছে না আমার! তুমি যাবে এখন!”
” তুমি এভাবে বলছো কেনো বেবি?”
নিশাদ রেগে ধমকে বলে উঠে
” মিলি! আর একবার বেবি, বেবি বললে তোমাকে কি করবো আমি জানি না। তোমাকে আগে কতোবার বলেছি আমাকে এসব বলে ডাকবে না! তোমার মাথায় ঢোকেনা আমার স্পষ্ট কথা? এসব উল্টো পাল্টা নামে ডাকলে খুব খারাপ হবে। আমার একটা ভালো নাম আছে সেটায় ডাকলে ডাকবে নাহলে আমার কাছেও যেনো না দেখি তোমাকে!”

মিলি নিশাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মিলি নিচু স্বরে বলল
” তুমি এভাবে রাগছো কেনো? সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।”
নিশাদ সবার দিকে একবার তাকিয়ে রেহানকে ইশারা করে। রেহানরা গিয়ে সবাইকে ধমক দিয়ে বলে নিজেদের কাজ করতে।

” শোনো মিলি আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যার জন্য তুমি এভাবে আমার সাথে লেপ্টে থাকো বা এসব বলে ডাকো আমাকে। আমি কখনো তোমাকে বলিনি আমি তোমাকে লাইক করি বা ভালোবাসি।” মিলি জোড় গলায় বললো
” তোমার করা না করা দিয়ে আমি কিছু করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই আমার জন্য এনাফ। আমাদের বিয়েও হবে দেখে নিও।” নিশাদ অগ্নিদৃষ্টিতে মিলির দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
.

কিছুটা ফুরফুরে মুডে বসে আছে নিশাদ। বট গাছের নিচে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সূর্য নিশাদের সামনে বসে বললো
” কই তাকাস? কারে খুঁছো ভাই?” নিশাদ একবার সূর্যর দিকে তাকিয়ে আবার আকাশে দিকে তাকিয়ে বললো
” কারে খুঁজি? কাউকে না। দেখতেছি আজকে মনে বৃষ্টি পরবে।”
সূর্য আর সাদি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।

” তাই নাকি ভাই? তা বৃষ্টিটা কি আকাশ থেকে পরবে
নাকি তোমার চোখ থেকে?” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
“মানে? আমার চোখ থেকে কেনো পরবে?”
সাদি মাথা চুলকে বললো
” ওই আরকি ফকফকা রোদ উঠা আকাশ থেকে তো বৃষ্টি পড়ে নাই কখনো তাই আমরা ভাবলাম আমাদে৪ নিশাদ ভাইয়ের চোখ থেকে বৃষ্টি পরবে নাকি!”
নিশাদ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। সূর্য সাদিকে চোখ টিপ দিয়ে বললো
” আজকে কেমন নিরব নিরব লাগতেছে না সব?”

নিশাদ আনমনা হয়ে বিষাদের গলায় বললো
” হ্যা, আজকে চারপাশটা নিরব লাগছে একদম।”
সূর্য আর সাদি মুখ টিপে হাসলো। এরমধ্যে রেহান এসে বসে। সাদি জিজ্ঞেস করে
” কিরে রেহান? আজকে রিধিশা আসে নাই ভার্সিটিতে? না মানে চোখে পড়লো না আজ একবারও।”
” হ্যা, জোতিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললো কি নাকি কাজ আছে তাই আসেনি।”

নিশাদ কিছুটা রাগের সাথে বলে উঠে
” এমন কি কাজ যে ভার্সিটি বন্ধ করে করতে হবে? এতো কাজ থাকলে তাহলে পড়াশোনা করার কি দরকার?” রেহান চোখ বাঁকিয়ে বললো
” সেটা তো রিধিশাই জানে। পার্সোনাল কাজও থাকতে পারে কিন্তু তোর এতো রাগ কিসের?”
নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” আমার কিসের রাগ? আমি কেনো রাগবো?”
রেহানরা মুখ টিপে হাসলো। ব্রেকটাইম শেষ হতেই সবাই ক্লাসে চলে যায়।
.

আলিফের বাসা থেকে তানিহার বাসায় যাওয়ার পথে ফুটবল মাঠ পড়ে। সেখান দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় হুট করে একটা ফুটবল পায়ের কাছে গড়িয়ে আসে।
রিধিশা খেয়াল না করেই তার উপর দিয়ে হাটায় উল্টে পড়ে গেলো। রিধিশা কোমড় ধরে চেঁচিয়ে উঠে
” মা গো মা পা’টা গেলো আমার!”
নিশাদ মাঠ থেকে দৌঁড়ে এসে রিধিশাকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ধমকে বললো
” এই মেয়ে এখানে বসে বসে কি করো?”

নিশাদকে স্পোর্ট ড্রেসে দেখে রিধিশা কোনো রকমে দাঁড়িয়ে ক্ষেপে বলে
” বসে বসে মশা মারি। বেয়াদব ছেলে! ফুটবলও খেলতে জানেন না নাকি? ফুটবল মাঠ থেকে রাস্তায় আসে কি করে? এভাবেই মানুষ মারেন?”
নিশাদ রিধিশার দিকে এগিয়ে যেতেই রিধিশা পিছিয়ে যায়। নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” তোমাকে তো থাপড়ে গাল ফাটিয়ে দেবো। বড়দের সাথে কথা বলতে জানো না? আমাকে বেয়াদব বলো! ভালোই হয়েছে ব্যাথা পেয়েছো। ভার্সিটিতে না গিয়ে রাস্তায় টো টো করলে তো এমন হবেই।”

রিধিশা রেগে বললো
” এই! এই! আপনি দেখেছেন আমি টো টো করেছি? ফালতু ছেলে একটা। আপনার আর কোনো কাজ নেই? যেখানেই যাই আপনার সাথেই দেখা হতে হয়?”
নিশাদ রিধিশার চুলগুলো জোড়ে টান দিয়ে ফুটবল নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো।
রিধিশা মাথায় দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
পড়ে বকতে বকতে চলে যায়।

চলবে……

[কালকে দেইনি তাই আজকের পর্ব একটু বড় করে দিয়েছি। ]#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ০৯।

ভার্সিটিতে এসে রিধিশা ক্লাসে না গিয়ে হোস্টেলে জোতির কাছে চলে গেলো। আজকে অনেকটা তাড়াতাড়িই এসেছে।
এসে দেখে জোতির রুমমেট তৈরি হচ্ছে আর জোতি উল্টো পিঠ হয়ে শুয়ে আছে। এখনও শুয়ে থাকতে দেখে রিধিশা অবাক হয় কিছুটা। রিধিশা জোতির কাছে বসেই গরম তাপ অনুভব করে। জোতির কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়ের।
রিধিশা অবাক গলায় বলে
” কিরে তোর দেখি জ্বর! এতো জ্বর কখন আসলো? আমাকে জানালি না একবার।”
জোতি উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বলে
” আরে রাতে একটু জ্বর এসেছিলো।”

রিধিশা রাগি গলায় বললো
” হোস্টেলে থাকার বেশি শখ না তোর? এবার শখ মিটিয়ে নে। এই হোস্টেলে বাপ,দাদা ত দূড় চৌদ্দ পুরুষের কেউ নেই। মরে গেলেও কেউ বাড়ির লোকের মতো এসে একটু যত্ন করবে না। থাক, থাক আরো থাক আমিও ভাইয়ার কাছে আজকে ফোন দিয়ে সব জানাবো।”
জোতি অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো
” এমন করিস কেনো? তুইও তো আমি হোস্টেলে আসার কয়েকদিন আগে অসুস্থ হয়েছিলি আমি কি কিছু বলেছিলাম? অসুস্থতা কি আর আমি ডেকে আনি?”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমার সাথে তোর কিসের তুলনা? আমি অসুস্থ হয়েছিলাম তখন যত্ন করার জন্য তুই ছিলি কিন্তু এখানে তোর কে আছে বল আমায়।” জোতি মুখ বাঁকিয়ে বসে থাকে। রিধিশা কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করে
” ঔষধ, খাবার কিছু খেয়েছিস?”

জোতি তার রুমমেটের দিকে একবার তাকিয়ে বললো
” আরে হ্যা বাবা, সবই খেয়েছি। এই যে মেয়েটা আমার জ্বর দেখে রাতেই ঔষধ দিয়েছিলো। যাই হোক মেয়েটা ফোনে ডুবে থাকলেও আমার একটু খেয়াল রেখেছে।” শেষের কথাটা রিধিশার কানে ফিসফিস করে বলে।

রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিতেই মেয়েটা মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।
রিধিশা জোতির দিকে তাকিয়ে বললো
” ভালো করেছে। এখন রেস্ট কর ক্লাসে যেতে হবে না আজ।”
জোতি কাথা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুড়িয়ে বললো
” সে তো আজকে আমি যাবোই না। যাহ বান্ধুপী ভালো করে ক্লাস করে আয়। আর ইম্পরট্যান্ট ক্লাসের নোট গুলো দিয়ে দিস আমায়।”
রিধিশা আলতো হেসে বেরিয়ে গেলো।
.

ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ বই বের করে পড়তে থাকে। মাস্টার্স ফার্স্ট ইয়ারদের সেমিস্টার এক্সাম শুরু হবে আগামীকাল থেকে তাই ভার্সিটির মাঠে মানুষের সমাগম কম বললেই চলে।
রিধিশা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ খাচ্ছে, কেউ গল্প করছে আবার অনেকেই নোট লিখছে।

রিধিশার ক্লাসে মন বসলো না। জোতি ছাড়া ক্লাসে কারোর সাথেই পরিচিত না সে। নিজেই সেচ্ছায় পরিচিত হতে যায়নি।
বট গাছের দিকে তাকিয়ে দেখে গাছের নিচে আজকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এক দুজন লোক দেখা যাচ্ছে অপরিচিত।
রিধিশার ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্তি এসে পড়লো।
রিধিশা ব্যাগ নিয়ে লাইব্রেরিতে চলে আসলো। দুটো বই নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

টেবিলের উপর জোড়ে শব্দ শুনেই রিধিশা চমকে মাথা তুলে তাকায়।
মিলি রাগি দৃষ্টিতে রিধিধাকে দেখে যাচ্ছে। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে পিকনিকে দেখেছিলো, নিশাদের সাথে ছিলো সব সময়।
মিলি রিধিশার হাত চেপে লাইব্রেরির বাইরে নিয়ে আসে।

বারান্দায় এনে রিধিশার হাত ছেড়ে দেয়। রিধিশা অবাক স্বরে বললো
” আরে কে আপনি? এভাবে হাত ধরে এনেছেন কেনো?”
মিলি রাগি গলায় বললো
” কেনো এনেছি বুঝতে পারছো না বুঝি? নিশাদের সাথে কি সম্পর্ক তোমার?”

রিধিশা রেগে গেলো মিলির কথায়।
” অদ্ভুত তো! ওই ছেলের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক থাকবে?” মিলি তেড়ে এসে বললো
” কচি খুকি তুমি? বোঝনা কি বলছি আমি? আমাকে কি বোকা পেয়েছো? আমি সব শুনেছি। আসার পর থেকে তুমি আমার নিশাদের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছো। থার্ডক্লাস মেয়ে! আমার নিশাদের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস আসে কোথা থেকে?”
রাগে রিধিশার মাথার রগ তরতর করে ছিড়ছে
কিন্তু চুপ করে থাকে রিধিশা। মিলিকে দেখেই বুঝতে পারছে এই মেয়ে সুবিধার না তার জন্য।

রিধিশা রাগ কন্ট্রোল করে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো
” দেখুন তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম দিন একটু ঝামেলা হয়েছিলো এরপর আর এমন কিছুই হয়নি যার জন্য আপনি এসব কথা শোনাচ্ছেন। আর কিছু জানার বা বলার থাকলে আমাকে বলবেন না। আপনার নিশাদকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন।”
হনহন পায়ে লাইব্রেরিতে এসে আগের জায়গায় বসে পড়ে রিধিশা।
মিলি রাগে ফুঁসছে। রিধিশার কথা একদমই হজম করতে পারছে না। মিলি ফ্রেন্ডরা তাকে জোড় করে নিয়ে গেলো এখান থেকে।

রিধিশা বসে বসে বই এর ভেতর মুখ ডুবিয়ে রেখে কেঁদে যাচ্ছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
” ওই বজ্জার ছেলের জন্য আমি কেনো কথা শুনবো? এতই যখন ভালোবাসা তাহলে কোলে বসিয়ে রাখে না কেনো?” এসব বলে বলে কেঁদে যাচ্ছে।
লাইব্রেরির অনেকেই ক্লাসে চলে গিয়েছে। এখন লাইব্রেরি ফাকাই বলা চলে। রিধিশা একা একা কেঁদে যাচ্ছে।

নিশাদ রিধিশার সামনের চেয়ারে বসে শব্দহীন ভাবে। রিধিশার কান্না শুনে অবাক হয়। মুখের সামনে বই দিয়ে রাখায় চেহারাটা দেখতে সক্ষম হলো না। নিশাদ এদিক ওদিক তাকিয়ে রিধিশার মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়ে দিলো।
রিধিশা কান্নার মাঝে সামনে নিশাদকে বসে থাকতে দেখে কান্না থামিয়ে ফেললো। হাত দিয়ে চোখ মুছে নেয়। নিশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” কাঁদছিলে কেনো?”

নিশাদের কথায় রিধিশার আবারও কান্না পেলো কিন্তু কান্না করলো না। ভাঙ্গা গলায় বললো
” আপনি অযথা আমার পেছনে পড়ে আছেন কেনো? আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই তাও শুধু শুধু আপনার গার্লফ্রেন্ডের থেকে কথা শুনবো আমি?”
নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” গার্লফ্রেন্ড? আমার গার্লফ্রেন্ড কে?”

রিধিশা নিশাদের দিকে চোখ বড়বড় তাকিয়ে বললো
“এমন ভাব করছেন যেনো বিশুদ্ধ ছেলে আপনি? আপনার গার্লফ্রেন্ড না থাকলে আমার নিশাদ নিশাদ বলে আমাকে এতো কথা শুনিয়ে গেলো কে?”
নিশাদ বুঝতে পারলো মিলি ছাড়া আর কেউ না। নিশাদ বিরক্ত গলায় বললো
” আরে ওইটা গার্লফ্রেন্ড না। ছাড় ওর কথা, মেয়েটা পাগল। আচ্ছা ওর হয়ে আমি সরি বলছি।”

” আপনি সরি বললেই তো আর আমার অপমানের ঘা ফুরাবে না! আপনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না প্লিজ! অনুরোধ করছি আমি।”
রিধিশা দুটো বই নিয়ে বেরিয়ে গেলো লাইব্রেরি থেকে। নিশাদ রিধিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল টানতে থাকে।
দাঁতে দাঁত চেওএ বিড়বিড় করে বলে
“মিলি জ্বালায় আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলো। এই মেয়েকে কিভাবে আমার পিছু ছাড়াবো?”

ব্রেক টাইমের আগের ক্লাসে ভার্সিটির নবীন বরণের উৎসবের কথা জানায় সবাইকে। দুদিন পর নবীন বরণের অনুষ্ঠান হবে। সবাইকেই থাকতে হবে বলে জানিয়ে দেয়।
রিধিশা ব্রেক টাইমে জোতির কাছে চলে গেলো। জোতি শুয়ে আছে এখনও। রিধিশা পাশে বসে বললো
” কিছু খাবি?” জোতি মাথা নেড়ে হ্যা বললো।
রিধিশা জিজ্ঞেস করলো কি খাবে।
জোতি হেসে বললো
” পাস্তা আর বার্গার খাবো।”

বিধিশা বিরক্তকর চাহনি দিয়ে তাকায়।
” জ্বর উঠেছে এসব আনছি না। এগুলো ছাড়া অন্যকিছু খেলে বল।” জোতি জেদ ধরে বলে
” এগুলোই খাবো নাহলে খাবো না।” জোতি রিধিশার হাতে টাকা দিয়ে ধাক্কিয়ে পাঠিয়ে দিলো। রিধিশা ক্যান্টিন থেকে পার্সেল করে নিয়ে আসে।
রিধিশা প্যাকেট থেকে খুলতে খুলতে বললো
” দুদিন পর নবীন বরণের অনুষ্ঠান হবে আজ বলেছে।”

জোতি অবাক হয়ে পড়ে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে। জোতি খুশি হয়ে বলে
” হায়! বান্ধুপ্পী, আমার কতো দিনের ইচ্ছা ছিলো বলতো, কলেজে নিজেদের নবীন বরণ দেখার। ইশশ অবশেষে ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। আচ্ছা শোন আমরা দুজন শাড়ী পড়বো ঠিকাছে?”
রিধিশা মন খারাপ করে ফেলে।
” আমি তো শাড়ি পড়িনি আগে কখনো। আম্মু তো আমাকে কখনো শাড়ি কিনে দেয়নি তাই কোনো শাড়ি নেই আমার।”

জোতি শান্তনা দিয়ে বললো
” আরে এতো চিন্তা কিসের? মে হু না! আমারও শাড়ি নেই। আমরা দুটো শাড়ি কিনে নেবো।” রিধিশা কিছু বললো না। শাড়ি কিনতে গেলেই আরো কতো টাকা খরচ হবে!
রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” আচ্ছা পড়ে দেখা যাবে। এখন খাওয়া শুরু কর।”
জোতি পাস্তা’টা রিধিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
” নে খা।”
রিধিধা মুখ কুঁচকে বললো
” নাহ ইচ্ছে করছে না তুই খা। আমি নাস্তা করেই এসেছি।”

জোতি মুখ ফুলিয়ে বললো
” তুই জানিস না আমি পাস্তা খাই না! আমি তোর জন্যই আনিয়েছি। চুপচাপ খেয়ে নে এটা ফেলবো নাকি এখন?”
রিধিশা কিছুটা খেয়ে বাকিটা রেখে দিলো। দু দিন ধরে
কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। পছন্দের খাবারও না।

_________

প্রতিদিনের মতো আজও টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। আনমনা হয়ে হেটে হেটে আসতেই খেয়াল করলো রাস্তা কেমন যেনো। গতকাল ভার্সিটিতে না যাওয়ায় সব টিউশনি তাড়াতাড়ি শেষ করায় রাত হয়নি কিন্তু আজ রাত হয়েছে যেটা প্রতিদিনই হয়।
রিধিশার কেমন ভয় ভয় করতে থাকে। বিড়বিড় করে বললো
” এই কোন জায়গায় এসে পড়লাম? আমার আগে খোঁজ নেওয়া দরকার ছিলো।”

বাসায় যাওয়ার আগেই দোকান পড়লো একটা। আগেও দেখেছে তবে আগে বন্ধ দেখতো। দোকানের কাছে আসতেই দোকানে বসা ছেলেগুলো ওর দিকে তাকায়। রিধিশা বুঝতে পারলো ছেলেগুলো সুবিধার নয়। রিধিশা দ্রুত পা বাড়িয়ে দোকান পার করলো কিন্তু বিপদ যেনো পিছু ছাড়ে না। পেছন থেকে এক লোক ডেকে উঠে। রিধিশা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।
” এই যে সুন্দরী এদিকে এসো তো।”

রিধিশা ভয়ে কাবু হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। রিধিশা দোয়া দুরূদ পড়ে দুই পা এগোতেই পেছন থেকে কয়েকজন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিধিশা ভয়ে ঢোক গিললো।
“এই যে ডাক কি শুনতে পাও নাই? কি নাম?” ছেলেটা কেমন করে তাকিয়ে হাসলো।
.
রিধিশা মুখ কুঁচকে নেয় ওদের দেখে। হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই রিধিশা ভয় পেয়ে পাশে তাকায়। কিন্তু পাশে তাকিয়ে নিশাদকে দেখে চমকে গেলো। জানে পানি ফিরে পেলো। রিধিশা কোনোদিকে খেয়াল না করেই ভয়ে ভুল ঠিকে জ্ঞান হারিয়ে নিশাদের বাহু খামছে পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here