#কুয়াশা মন
পর্ব ৯..
সামিরা আগেই বুঝেছে, মিহির আর তার মায়ের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার জন্মের বিষয় নিয়ে বিচলিত হয়ে আছে সে। ভাবছে, নাকি মোড় পালটেছিল? কেবল বুয়ার যাবার অপেক্ষা।
তার আজকাল মন কেমন যেন করছে। ইচ্ছে করছে দেশের বাড়িতে ছুটে যায় সে। ওখানে দাদু, নানু হয়তো সকলেই আছে। আর তাঁরা তো খুব ভালো। নিশ্চয় তাঁরাও সামিরার কথা ভাবে, সামিরাকে মনে করে। তার ভেতর খুব খারাপ লাগা কাজ করছে। এতটা বছর সে স্বার্থপরের মতো আপন-পর কারও কথাই জিজ্ঞেস করেনি। কেবল ভেবে এসেছে, কেউই ভালো নয়। বুয়া কাপড় ধুয়ে যেতেই সে চট করে তার মায়ের ডায়েরি নিয়ে বসে পড়েছে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়ে আসা রাতের আঁধার আমার মনকে নিস্তব্ধ করে তুলছে। তিনি সাধারণত বাহিরে থাকলে মনটা খামোখাই ভয়ভীতিতে থাকে অঘটনের ভয়ে। তার ওপর আজ মেজাজ খারাপ করে গিয়েছেন বিধায় মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা হচ্ছে। বাসায় সচরাচর মঈন ভাইয়া থাকেন না। তিনি থাকলে না হয় মিহিরকে আনতে পাঠাতাম। কিন্তু বাবাকে কী করে বলব মাথায় আসছে না।
ক্ষণকাল গত হলো, রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে দেখে এসেছি মিহির এলো কিনা। কিন্তু যা হয়েছে তাতে আমার মনে হয় না, তিনি সহজেই এসব মামলা ভুলে যাবেন। তিনি ভেবেছিলেন বাবাকে বোঝালে তিনি সব বুঝে যাবেন। ঘটনার আকস্মিকতায় এমনটা হলো না দেখে উনার রাগ প্রচণ্ড হওয়াটা স্বাভাবিক।
তিনি এখন পাশেই ঘুমোচ্ছেন। ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সেই ফাঁকে আমি পাশে চার্জলাইট জ্বালিয়ে তার আলোয় ডায়েরিতে লিখছি।
সন্ধ্যার শেষে ডায়েরিতে লেখা বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম। কলিং বেলটা বেজে উঠল এগারোটা নাগাদ। তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাবা মিহিরের হাত ধরে তাকে ঢুকাচ্ছেন ভেতরে। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, বাবা কবে বাহির থেকে তাকে আনতে গিয়েছিলেন।
“বৌমা, ওকে কিছু খাইয়ে দাও। আর হ্যাঁ, নিজেও খেয়ে নাও।”
আমি নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বাবারা সবাই শুয়ে পড়লেন। আমি তাকে টেবিলে ভাত বেড়ে দিলাম। চুপটি করে তিনি খেয়ে রুমে চলে এলেন। কী হলো বা হতে চলেছে তার চিন্তায় মগ্ন আমি, তেমন খেলাম না। এসে দেখি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আমি ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানার অন্য পাশে বসলাম। বললাম, “আমি বুঝেছি এখন আমার ভুল। আমার কারণে আপনি নিজেকে এভাবে শাস্তি দেবেন না। আপনি না তালাক দেবেন বলেছিলেন, ঠিক আছে, তাই হবে। আমি ভাবলাম, বাবা সবই যখন জেনে ফেলেছেন তখন তালাকটা হয়ে গেলে মন্দ হবে না। আপনি, ফুফি নির্বিশেষে সকলেই রক্ষা পাবেন আমার কাছ থেকে।” তিনি নিশ্চুপ রইলেন দেখে আমি আবার শোধালাম, “কী হলো? কিছু বলছেন না!”
তিনি একবার আমার দিকে মেজাজ শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। এই দৃষ্টি আমার খুব একটা চেনা নয়, নম্র, শীতল এক চাহনি যেন আজ কিছু হয়নিই।
“তুমি কী বলেছিলে যেন? কী কী যেন করবে বা করা থেকে বিরত থাকবে বলেছিলে, যদি তালাক না দিই?”
“বলেছিলাম, আমি আমার মতো করে থাকার চেষ্টা করব। বিরক্ত করব না আপনাকে। আপনি যাই বলেন তাই হবে। স্ত্রীত্ব খাটাতে আসব না। আপনি কেবল সব কথা ভুলে যান। আমাকে তালাক দেয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন।”
তিনি ভ্রূদ্বয়কে কিছুটা কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকালেন। আমি হুবহুই কথাগুলো বলে দেবো তা হয়তো তার কল্পনাতীত ছিল। যাইহোক, আমি যে আজকের দিনের কিছুই ভুলতে পারব না। সবচেয়ে খারাপ দিন হিসেবে আমার জীবনে আওতাভুক্ত হওয়ায় তার প্রতিটা সেকেন্ডের নিষ্ঠুরতা স্মৃতির দৃষ্টে গেঁথে আছে।
“হ্যাঁ, তাই। এখন থেকে তাই করবে। তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমাদের তালাকে বাবার ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে। তাই তোমাকে তালাক দেবো না। পরিবর্তে তুমি এসব করবে। আমার কাছে ঘেঁষার প্রয়াস করবে না। আমার সাথে ছাড়া বাসার বাকি সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখলেই হলো।”
আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এতেই মহাখুশী আমি। তার ভালোবাসা না পেলেও, তার আশেপাশে থাকা থেকে বঞ্চিত হব না। তিনি শুয়ে পড়লেন। এই একটু আগে তিনি ঘুমে তলিয়েছেন। সেই ফাঁকে ডায়েরিতে লিখছি যাবতীয় কথা। কী হয়েছে বিগত সময়ে? তাকে এতো শান্তশিষ্ট কেন দেখাচ্ছে? একপ্রকার খুশিই হওয়া যায় এদিক থেকে। ভেবেছিলাম আমার সাথে আরও খারাপভাবে আচরণ করবেন এবং শেষে তালাকের কাজ শুরু করবেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তালাকটা আর হবে না। এখন থেকে আমার কাছেই সন্তর্পণে চলতে হবে। তার মেজাজ বিগড়ে যাবে, এরূপ কাজ স্বপ্নেও করতে পারব না। তবে তার এই নীরবতা কারণ? জানতে হবে আমায়।
বাবার সাথে কথা বলে একটু-আধটু আঁচ করেছি , মিহিরের এই পরিবর্তনের কারণ। মিহিরের চিন্তায় বাবা মঈন ভাইয়ার আসার অপেক্ষা না করে নিজেই চলে গিয়েছিলেন। তিনি কোথায় থাকবেন বাবার ভালো জানা আছে। গিয়ে তিনি মিহিরকে আমাদের সম্বন্ধে বুঝালেন, আমাদের যে তিনি ভুল বুঝছেন। আর বাবা তালাকটা তাকে না নিতে বাধ্য করেছেন। বলেছেন, আমাদের বিচ্ছেদ তাঁর ওপর অনেক প্রভাব ফেলবে। সেই সাথে মিহিরকে ছেলে বলতে অস্বীকার করে দেবেন। মিহির এসব শর্তের ভয়ে বলে দিয়েছেন, বাবার অনিষ্ট তিনি মোটেও চান না। এই তালাক তিনি নেবেন না, যদি বাবার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়। এভাবেই কালরাত সবকিছু ঠিক হয়েছে।
বেশ পৃষ্টা কয়েক পর।
ঠিক এক বছর পার হয়েছে। সবকিছু ঠিকই চলছে বলতে গেলে। আমারও আর তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। ভালো একটা সংসার পেলাম এতেই মহানন্দ। প্রত্যাশা কেবল আছে একটা, আমারও যদি একটি ফুটফুটে মেয়ে হতো! আমার সকল মানসিক চাহিদা গুছত। কিন্তু আমি শর্তে বন্দি। মিহিরের বাহুর পাশ দিয়েও ঘেঁষি না। এতেই যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তবে আমি চিরজীবন নিঃসন্তান থাকতে রাজি আছি।
গেল বছরে আমার সাথে তার তেমন কোনো বিবাদই বাঁধেনি। দুজন সবসময় দুই জায়গায় ছিলাম। কথাবার্তা যাও হতো, স্রেফ প্রয়োজনীয়ই। তিনিও আমার কাজে বাধা দিতে আসতেন না। ফুফির সাথে হাবভাব একটু-আধটু ভালো জমছে। বাবা অনেক সাধনার পরই ফুফির মুখে আমাকে বৌমা ডাকাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এখন হয়তো আমাকে আর অপছন্দ করেন না। এটাই স্বাভাবিক, দুই জীবের সহাবস্থানে তারা অতি নিকটে আসে। পাশে থাকলে মন পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। বছরটায় ফুফির নিকটেই ছিলাম। তার কিছুর প্রয়োজন হলে আগেভাগে দৌড়েছি। আমি এই বাড়িতে আসার পর থেকে ফুফিকে এক-পাও নড়তে দিইনি। ফুফা-ফুফির মাঝে এখনও ভুল বোঝাবুঝি হয়। তখন তাদের মাঝের ঝগড়াটা আমাকেই প্রভাবিত করে বেশি। আমি তাঁদের ঝগড়াগুলো মোটেও সইতে পারি না। তাই গিয়ে মাঝে-মধ্যে ফুফির দোষগুলো নিজেই বহন করে নিই। এতে ফুফা আর তাঁর সাথে ঝগড়া করতে যান না। আমাকেও তেমন কিছু বলেন না। ফুফিকে প্রতিবার প্রতিরক্ষা করার কারণেই হয়তো তিনি এখন আমাকে অপছন্দ করেন না। সবকিছুই মানিয়ে নিয়েছি আমি বিগত সময়ে। শুধু ভালো কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলাম না বড় জায়ের সাথে। কেমন একঘেয়েমিজনিত রোগ আছে যেন উনার। রুম থেকে সহজেই বের হন না। কাজ যে প্রায় সব আমার আর বুয়ার একার করতে হয় তা নিয়ে ভাবীর বিশেষ মাথা ব্যথা করতে দেখিনি। নিজের মতো করে চলতেই তিনি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বরং কারও সাথেই তার বড় ভাব নেই। মাঝে মাঝে তো বোধ হয় নিজের ভাগের সম্পত্তিগুলো নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে পারলেই তিনি সুখী।
এরই মধ্যে মায়া আপু মাঝে মাঝে বেড়িয়ে গেলেও মুক্তা একবারও আসেনি। সেদিন একটু বেশিই শুনিয়েছি তাকে। অভিমান করে আছে এখনও। আমিও ওকে আসতে বলিনি, তার সাথে যে আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। কিন্তু বেশ কয়েকবার কল করেছি। রিসিভ করেনি সে।
এছাড়া বাকি সবকিছু ঠিক আছে। আজকাল আমার জীবনের স্বাদ কমে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন প্রতিটা ধাপে রোমাঞ্চকর কিছু ঘটে যেত। প্রতিটি ঘটনার সংলাপ অনেক বড় ছিল আকারে। যেমন, আমার প্রথম বিয়ে ভাঙার কাহিনি, মিহিরের সাথে বিয়ের প্রেক্ষাপট। সবই ছিল রোমাঞ্চকর। তখন জীবনের রস হিসেবে সুখ-দুঃখ সবই উপভোগ করেছি একসাথে। এখন ঐরূপ তেমন কিছুই ঘটে না। এখন দিনগুলো এদিকে শুরু হয়, ওদিকে যেন শেষ হয়। মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাই পাশের বাসার ভাবীগুলোর সাথে। বাকিটা সময় বাসায় কাটাই বড় ভাইয়ার মেয়ে মিতুকে নিয়ে। ডায়েরিটাও এযাবৎ পাঁচ কী ছয়বারের বেশি ধরা হয়নি। একসময় এতে প্রতিটা দিন ভরপুর করে লিখতাম। স্মৃতি কেবল। এখন লিখি কম, ওইগুলোই পড়ে সময় কাটাই। এভাবেই দিন যায়।
শেষের লেখাগুলো সাবিহা নিজ মন থেকে লিখলেও অন্যজনের কাছে বিরক্তিকর ঠেকার কথা। সামিরার হালও তাই। এই অংশ পড়তে পড়তে ঝিমুতে শুরু করেছে। তবুও পড়া এগিয়ে নেপয়ার কৌতূহল তার যাচ্ছে না। ঝিমুনির চোখে সে হঠাৎ পরবর্তী পৃষ্টার তারিখ দেখে চমকে উঠল। দুইমাস পরের তারিখ! শেষ যে লেখাগুলো সামিরা পড়েছিল, তা লেখা হয়েছিল ফেব্রুয়ারিতে। আর এই পৃষ্টার উপরের তারিখ দেখে বোঝা যায় নিম্নে বর্ণিত লেখাগুলো নিশ্চয় দুইমাস পর মে মাসে লেখা হয়েছে। সামিরার কিছুটা খটকা লাগল এতে। তার মা সাধারণত ডায়েরিতে এতো দীর্ঘ সময় না লিখে থাকেনি। মুহূর্তেই তার ঘুমঘুম ভাব উধাও হয়ে গেল। পড়ায় সে মনোযোগী হলো।
কী অপরাধ করলাম আমি যে, এমন এক আপনকেই হারাতে হলো? বিয়ের পর থেকে তিনিই তো সর্বদা আমার সঙ্গী ছিলেন। কী এমন পাপ করেছি, যার দরুন অচিরেই তাঁকে হারালাম? কেন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন?
পরবর্তী পৃষ্টায়। এক বৃষ্টির দিনে আমি বাবার মাথায় তেল মালিশ শেষে রুমে চলে এসেছিলাম। তিনি মালিশ করার সময় মুক্তাকে খুব করে মনে করলেন। আমাকে বারবার তার কথাই বলে গেলেন। সন্ধ্যার দিকে উনাকে না পেয়ে যখন কল করলাম, তখন তিনি ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে বললেন, তিনি মুক্তাকে দেখতে গিয়েছেন। আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। এভাবে না বলেই বাসা থেকে বাইরে যাওয়া স্বভাব হয়ে গেছে উনার, তা জানা আছে। রাগ দমিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন আসছেন? তখন মিহির পাশে এসে দাঁড়ালেন এবং আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিলেন।
“বাবা, আপনি কাউকে বলে যেতে পারেন না? আচ্ছা, কখন আসছেন?.. ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি মানে এখনই চলে আসুন। বাহিরের অবস্থা খুব খারাপ।”
উনি ফোন রেখে দিলেন। আমরা যথাযথ নিজের কাজে মশগুল হয়ে গেলাম। একসময় আমার পিলে চমকে উঠল। দেখলাম রাত দশটা বাজে। খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বাবার ফেরার কথা সন্ধ্যার দিকে। মুক্তার শ্বশুরঘর এখান থেকে গাড়িতে করে গেলে দশ মিনিটের দূরত্বে। উনি গাড়ি ছাড়া কোনোদিকেই যান না। আমি মিহিরের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালাম। তিনিও অনুরূপ আমার দিকে তাকালেন। তারপর তড়িঘড়ি করে ড্রাইভারের ফোনে ফোন লাগালেন বেশ কয়েকবার।
আমিও এমতাবস্থায় উনার পাশে গিয়ে বসলাম। একসময় কল রিসিভ হলো ওপাশে। আমি কান প্রায় লাগিয়ে দিলাম ফোনের সাথে। ওপাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসছে। ড্রাইভার সেলিম চাচার নয় এই আওয়াজ।
“আপনি কে বলছেন?” মিহির বলল।
“আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি এখন হাসপাতালে। আপনি যাকে কল করেছেন তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে কথা বলছি। আপনার কে হন দুজন?”
আমরা একে অপরকে চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। হৃদপিণ্ড প্রবলভাবে যেন উঠানামা শুরু করছে।
“হ্যালো, কথা বলছেন না কেন? শীঘ্র চলে আসুন। দুজনের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সাংঘাতিক অবস্থা।”
আমরা দুজন বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ঝড়ের বেগে উক্ত হাসপাতালে চলে গেলাম। বাসায় ফেরার সময় বাবা আর সেলিম চাচার লাশকে নিয়ে ফিরলাম।
এই দুটো মাস উনার শোকেই কেটেছে। আমরা যেন আমাদের মধ্যেই ছিলাম না। বাবাকে সবথেকে বেশি ভালবাসত মিহির। সে এখন ভেঙে একাকার। দুটো মাস হলো, তার খাওয়া-দাওয়ায় তেমন একটা মন নেই। মুখখানা অনুজ্জ্বলতায় ভরেছে। দুটো মাস উনার মুখের একটা শব্দও কর্ণগোচর হলো না, বোবা হয়ে গিয়েছেন যেন। যেখানে বসেন, সেখানেই অবিরাম বসে থাকেন।
বাবার মৃত্যুর খবরে বাসায় ছুটে এসেছিল মুক্তা। সে বজ্রাহতের মতো মাটিতেই গেঁড়ে পড়ল যেন। কাঁদতে পারছিল না, তার অনুভূতিও প্রকাশ পাচ্ছিল না। যখন তার হুঁশ হয়েছে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে সে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিল, “বাবা, যখন আপনি গিয়েছিলেন আমায় দেখতে, তখন আপনার সাথে কেন কথা বললাম না ভালো করে?”
ডায়েরির পাতা ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে ভিজে যাচ্ছে দেখে সামিরা ডায়েরি বন্ধ করে ফেলল। নিরিবিলিতে কাঁদতে লাগল। এই না ভাবছিলাম? দাদারা হয়তো আমার কথা মনে করছে? দাদা এখন কোথায়? দাদা নেই পৃথিবীতে? তিনি মারা গেছেন?
ডায়েরি পড়ে সে তার দাদার প্রতিবিম্ব সৃষ্টি না করতেই দেখার আয়নাটিই ভেঙে চুরমার হয়েছে।
এখন আমি আর মিহির দুবাইয়ে থাকছি। বাবা গত হওয়ার বছরখানেক ঘুরে গেছে, মিহির এখনও স্বাভাবিক হচ্ছেন না। মিহিরের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে দিন কিছু হলো, সবাই বলল, দেশের বাইরে গেলে ভালো লাগবে তার। তাছাড়া আমাদের বিবাহিত জীবনের স্বাদের কথা কখনও উঠেনি। বিয়ের পর আমরা কোথাও যাইনি দেখে মাও আমাদের এখানে দুবাইয়ে বছরখানেক বেড়িয়ে যেতে বললেন। মঈন ভাইয়া, বাবার মৃত্যুর পাঁচ-ছয়মাস গত না হতেই তাঁদের ভাগের সম্পত্তি সাথে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। নতুন এক জায়গায় সংসার জীবন শুরু করলেন। মিহিরের আমার সাথে থাকা বা না থাকা নিয়ে তেমন একটা সায় ছিল না। তবে একটা সুবিধা, বাবা মিহির সকলেই আগেকার যাবজ্জীবনে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। আজ উনার বেঁহুশি অবস্থায় খুব কাজে আসছে তা। তিনি বলতে গেলে সবকিছুতে অপারগ হয়ে পড়েছেন। কথার মাঝে জোর দেখি না, চাহনিতে কোনো গাম্ভীর্যভাব নেই, অপলক একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন একদিকে, কোনোকিছু বললে তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই। উনার মাঝেই উনি নেই যেন।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার