কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -০৭

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৭.
রাফসানের প্রশ্নে সাইভিদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল। রাফসান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। রাফসানের গাঢ় নীল চোখগুলো যেন একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। সাইভিদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো,

‘ভাই হিসেবে বোনকে পছন্দ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?’

রাফসান ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। যেন সাইভিদের কথায় সে খুব মজা পেয়েছে। রাফসান উদ্বেলিত কন্ঠে বললো,

‘আমি কোন পছন্দের কথা বলছি সেটা নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন, সাইভিদ।’

সাইভিদের ব্রু কুঁচকে রাফসানের দিকে তাকায়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,

‘আপনি কোন পছন্দের কথা বলছেন মি. রাফসান?’

রাফসান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হেঁয়ালি করে বলে,

‘সাইভিদ জুবায়ের, সুদর্শন একজন যুবক আপনি। আপনাকে দেখলে যেকোনো যুবতীর মনেই প্রেমের বাসনা জাগবে এটাই স্বাভাবিক। আর আপনিও যদি সেক্ষেত্রে সেই মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখান তাহলে তো ব্যাপারটা আর গভীর হয়ে পড়বে,তাই না? তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। আপনি কার সাথে প্রেম করবেন না করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেই ব্যাপারে আমি কথাও বলতে চাই না। আসলে আমি বলতে চাইছি যে আপনার খালাতো বোন মানে ঐচ্ছি সেও আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আর আমার সম্পত্তিতে কেউ ভাগ বসাক সেটাও আমি চাই না। আফটার অল, সম্পত্তি যেহেতু আমার তার রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও তো আমারই, তাই না? তাই এক্ষেত্রে আমি একটু পজেসিভ আরকি।’

রাফসানের কথা শেষ হতেই সাইভিদ তেজ দেখিয়ে বললো,

‘এইসব কথা আপনি আমাকে কেন বলছেন, রাফসান।’

রাফসান মৃদু হেসে বললো,

‘কারণ আমার সম্পত্তিতে আপনি হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন।’

সাইভিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। রাগে তেতিয়ে উঠে বলে,

‘হুয়াট? হুয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট? আপনার সম্পত্তিতে আমি হস্তক্ষেপ করেছি মানে কি?’

‘কুল ডাউট ইয়াং ম্যান। অল্পতেই এত রক্ত গরম করলে চলে? বসুন বসুন। এত উত্তেজিত হবেন না। শরীর খারাপ করবে যে।’

সাইভিদ রাগে ফুঁসছে। চোখ কটমট করে সে রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন, রাফসান।’

রাফসান চোখ মুখ উজ্জ্বল করে সরস গলায় বললো,

‘একদমই না। আপনাকে অপমান করার কোনো ইনটেনশনই আমার মধ্যে নেই। আপনি অযথায় আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি তো জাস্ট আপনাকে আমার সম্পত্তির হিসেব দিচ্ছিলাম। যেন আপনি আগে থেকেই সচেতন হতে পারেন। বলা তো যায় না, পুরুষালী নজর তো ক্রমে ক্রমে বদলে যায়। তাই আগে থেকেই সচেতন করে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ।’

কথাটা বলেই স্মিত হাসে রাফসান। আর সাইভিদের রাগ তখন আকান চুম্বন। রাগে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে সে। তার সাথে ফুলে ফেঁপে উঠছে তার তীক্ষ্ণ নাগের ডগা। সাইভিদের চোখে মুখে এহেন রাগ দেখে রাফসান এক ভুবন ভুলানো হাসি দেয়। তাতেই একদম পুরো দমে জ্বলে উঠে সাইভিদ। ফুঁসে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঐচ্ছি হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে রুমে আসে। ঐচ্ছিকে দেখে নিজের রাগটা কোনোরকমে সংবরণ করে নেয় সাইভিদ। ঐচ্ছি চায়ের ট্রে টা বিছানার উপর দুজনের মাঝ বরাবর রাখে। রাফসান হাসি মুখেই একটা চায়ের কাপ হাতে নেয়। অন্যটা সাইভিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,

‘নিন ধরুন, গরম গরম চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করুন।’

সাইভিদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

‘নো থ্যাংকস।’

রাফসান ফিচেল হেসে চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে বললো,

‘As your wish!’

ঐচ্ছি কৌতুহলী দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে চেয়ে আছে। তার হঠাৎ কি হলো? চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড রেগে আছে সে। এই জ্বীনটা আবার সাইভিদকে উল্টা পাল্টা কিছু বলেনি তো? ঠোঁট কামড়ে গভীর ভাবে কথাগুলো ভাবছে ঐচ্ছি। হঠাৎ করেই সাইভিদের উপর থেকে চোখ সরে রাফসানের দিকে চোখ যেতেই সে খেয়াল করে রাফসান এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। বেখেয়ালী ভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার গাঢ় চোখের অগোছালো দৃষ্টিতে যেন যে কাউকেই সহজে বস করে ফেলা সম্ভব। কি শীতল এই চাহনি! ঐচ্ছির শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। রাফসান যেন শুধু চা খাচ্ছে না, চায়ের সাথে ঐচ্ছিকেও গিলে খাচ্ছে। ঐচ্ছির তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কেন যেন মনে হচ্ছে ঐ চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তার কিছু একটা হয়ে যাবে। ভয়ানক কিছু। ঐচ্ছি জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে। অতঃপর সে গলার স্বর খানিকটা চওড়া করে রাফসানকে বলে,

‘চা খাওয়া হয়ে গিয়ে থাকলে এবার আপনি আসতে পারেন।’

রাফসান কিঞ্চিত হাসে। ঐচ্ছির খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে নিরুত্তাপ গলায় বলে,

‘আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না, ঐচ্ছি। তাতে আপনারই ক্ষতি। ভালোবাসিই বলেই কিন্তু আপনাকে আরো তিন মাস সময় দিয়েছে। আমার এই ভালোবাসাকে অপমান করার দুঃসাহস ভুলেও দেখাবেন না। কারণ তাতে হয়তো আমি নিজেই আপনাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলবো। আর আমি সেটা চাই না।(খানিক চুপ থেকে) আরেকটা কথা, আমি কিন্তু সবসময়ই আপনার কাছাকাছিই আছি। সো, এটা ভাববেন না যে আপনি আমার অগোচরে কিছু করবেন আর সেটা আমি জানতেও পারবো না। আপনার উপর আমার বিশেষ নজর বিরাজমান, ঐচ্ছি। সেই নজরের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আপনার নেই। আশা করি আমার কথাগুলো আপনার মনে থাকবে। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

ঐচ্ছির রুমের দরজার সামনে গিয়ে রাফসান আবারও পেছন ফিরে তাকাল। তবে এবার সাইভিদের দিকে। রাফসান মৃদু হেসে সাইভিদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন, সাইভিদ। আর ভালো থাকবেন। আপনার এই বোনটাকেও একটু চোখে চোখে রাখবেন। বড় ভাই হিসেবে এটা তো আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, তাই না?’

সাইভিদ কিছু বলে না। শুধু অগ্নি দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকায়। রাফসানের বুক চিরে তখন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে মুচকি হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

ঐচ্ছি হতভম্ব। রাফসান তাকে এই কথাগুলো কেন বললো? ঐচ্ছির কেন যেন মনে হচ্ছে রাফসান এই সময় তাদের বাড়ি আসার পেছনে কোনো গুরুতর কারণ আছে। তার উপর আবার হুট করেই সাইভিদের সাথে এমন কথা বলতে চাওয়াটাও তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। আর সাইভিদ ও তখন থেকে চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে। কি হয়েছে কিছুই ঐচ্ছি বুঝতে পারছে না। ঐচ্ছি সাইভিদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘কি হয়েছে, ভাইয়া? তুমি এত রেগে আছো কেন?’

সাইভিদ এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিল। ঐচ্ছির কথা শুনে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। চোখ দিয়ে যেন তার আগুন ঝরছে। ঐচ্ছি ঘাবড়ে যায়। সাইভিদ কোনো কথা না বলেই ক্ষিপ্ত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর ঐচ্ছি বোকার মতো সেদিকে চেয়ে থাকে। বেচারি এখনো কিছু বুঝেই উঠতে পারছে না।

________________________

নিস্তব্ধ রাত। সেই রাতের গম্ভীর নিরবতা কাটিয়ে দূর থেকে কিছু কুকুর কর্কশ গলায় ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে। এই গুমোট অন্ধকার রাতে কুকুরের সেই আর্তনাদ ভীষণ ভয়ানক লাগছে। বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো সুঠাম দেহি পুরুষ মানুষটি খুব মনোযোগ দিয়ে কুকুরের সেই আর্তনাদ শুনে চলছে। সেও এই অন্ধকার রাতের মতো নিরব,নিস্তব্ধ। ক্ষণে ক্ষণে কেবল তার নিঃশ্বাসের শব্দই পাওয়া যাচ্ছে। মানুষটার অক্ষিগোলক জ্বলছে। ভয়ানক রাগে সারা শরীরের শিরা উপশিরা দিয়ে উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এক পর্যায়ে রাগে আর নিজেকে শান্ত রাখতে না পেরে তার পেছনের দেয়ালটাতে সজোরে ঘুষি মারতে থাকে। রাগ যেন তার কমছেই না। হাতের চামড়া ছিড়ে রক্ত পড়ছে তাতেও মানুষটির হুশ নেই। রাগ যেন আরো দ্বিগুণ হারে মাথা চেড়ে উঠেছে। ভয়ানক রকম কাঁপছে মানুষটি। হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়তেই থেমে যায়, সাইভিদ। নিজের ক্ষত বিক্ষত হাতটার দিকে তাকিয়ে সাইভিদ বিভৎস এক হাসি দেয়। তারপর চোখ মুখ কুঁচকে শীতল কন্ঠে বলে,

‘আমি তোমাকে ছাড়বো না মি. রাফসান হোসাইন। আপনার জন্য আমি এত বড় একটা সেক্রিফাইস করতেও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, না এখন মনে হচ্ছে আমি অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। নিজের ভুল তো এবার নিজেকেই শুধরাতে হবে, তাই না?’

কথাটা বলেই অট্টহাসিতে মেতে উঠে সাইভিদ। নিস্তব্ধতার দেয়াল চিরে সাইভিদের এই হাসি কুকুরের সেই আর্তনাদগুলোর চেয়েও ভয়ানক শুনাচ্ছিল।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here