কৃষ্ণগোলাপ পর্ব -১২

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

১২.
ঐচ্ছির দৃষ্টি যায় রাফসানের প্রাণবন্ত হাসির দিকে। রাফসানের সেই হাসি ক্ষণিকের জন্য ঐচ্ছির বুকে দাগ কাটে। ঐচ্ছি তার দৃষ্টি সরাতে পারেনা। চেয়ে থাকে রাফসানের মুখ পানে। হঠাৎ কি হলো, সে হুট করেই বলে দিল,

‘তোমাকে এসব কে বললো ভাইয়া? রাফসান জ্বীন কেন হতে যাবে? উনিও আমাদের মতই মানুষ।’

সাইভিদ কপাল কুঁচকায়। চোখের ভারি পল্লবে তার কিঞ্চিত রাগ প্রতীয়মান হয়। উদ্ভ্রান্ত গলায় বলে,

‘তাহলে কি সায়মা আমাকে মিথ্যে বলেছে?’

ঐচ্ছির টনক নড়লো। ব্রু কুঁচকে বললো,

‘সায়মা তোমায় কি বলেছে?’

সাইভিদ গম্ভীর স্বরে বললো,

‘সায়মা বলেছে তোর নাকি এই বিয়েতে মত নেই। খালা খালু তোকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। আর তোর বিয়েতে মত না থাকার কারণ হলো রাফসান কোনো মানুষ না ও একটা জ্বীন। আর ঐ রাফসানই নাকি তোর মা বাবাকে দিয়ে তোর উপর প্রেসার ক্রিয়েট করছে ওকে বিয়ে করার জন্য?’

ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে। গলার স্বর খানিকটা চওড়া করে বলে,

‘এসব কিছু মিথ্যে ভাইয়া। সায়মা বোধ হয় তোমার সাথে মজা করেছে। আর তুমি সায়মার সাথে যোগাযোগ করলে কি করে বলোতো?’

‘খালামনির থেকে সায়মার নাম্বার নিয়েছিলাম। সেদিন রাতে রাফসান তোদের বাড়িতে আসাতে আমি স্পষ্ট তোর চোখে মুখে রাগ দেখতে পেয়েছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল তোর এই বিয়েতে মত নেই। তাই তোকে কাল জিগ্যেসও করি। কিন্তু তুই বললি তোর নাকি বিয়েতে মত আছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল তুই মিথ্যা বলছিস। তাই তখন সায়মার সাথে কথা বলি। কারণ আমি জানি একমাত্র সায়মাই তোর ব্যাপারে সব সত্যিটা বলতে পারবে। আর ঐ আমাকে এসব বলেছে।’

ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে মৃদু স্বরে বললো,

‘ও যা বলেছে সব মিথ্যে। তোমার সাথে প্র্যাংক করেছে। আর তুমিই বলো না, কোনো জ্বীন কোন দুঃখে মানুষকে বিয়ে করতে আসবে? আর রাফসানকে কি কোনো দিক দিয়ে জ্বীনের মতো দেখায়? উনি তো তোমার মতোই একজন সাধারণ পুরুষ মানুষ। উনাকে কোন দিক দিয়ে জ্বীনের মতো লাগে বলোতো?’

সাইভিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেয়ালির সুরে বললো,

‘ওর গাঢ় নীল চোখগুলো। আর ওর গায়ের উষ্ণতা, সাধারণ মানুষের গা কি এত গরম হয়?’

ঐচ্ছি ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ফুটিয়ে তুলে। ঝরঝরে গলায় বলে,

‘আরে ভাইয়া উনার চোখ জেনেটিক্যালিই এমন। আর ঐ দিন উনার বোধ হয় একটু জ্বর ছিল তাই শরীরটা একটু গরম ছিল আরকি। এছাড়া আর কিছুই না।’

সাইভিদ তিক্ততা ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঐচ্ছি টের পেল সেই দীর্ঘশ্বাসে মিশ্রিত এক অদ্ভুত হাহাকার। ঐচ্ছির মন খারাপ হলো। সাইভিদ মৃদু সুরে বললো,

‘আচ্ছা তো ভালো থাকিস। আর নতুন জীবনে সুখী হো, দোয়া রইল তোর জন্য।’

ঐচ্ছি কিছু বললো না। সাইভিদও আর ঐচ্ছির জবাবের অপেক্ষা করলো না কলটা কেটে দিল। ঐচ্ছি কান থেকে মোবাইলটা সরিয়ে এক ধ্যানে চেয়ে রইল রাফসানের দিকে। যে এখন তার বাবার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। ঐচ্ছি বিস্মিত। নিজের ব্যাবহারে নিজেই বড্ড অবাক। সে সাইভিদকে এত মিথ্যে কি করে বলতে পারলো। সে তো এই বিয়েটা করতে চাই না। সাইভিদকে সেটা বললেই পারতো। এই বিয়ে ভাঙ্গার অনেক বড় একটা সুযোগ নিজের হাতে ভেস্তে দিল ঐচ্ছি। সাইভিদ সত্যিটা জানলে কখনো এই বিয়েটা হতে দিত না সেটা খুব ভালো করেই ঐচ্ছি জানে। আর ঐচ্ছিও তো চায় না এই বিয়েটা হোক। তবে কেন সে এত মিথ্যে বললো? রাফসানের প্রতি কি তবে সেও দুর্বল? ঐচ্ছির বুক চিরে বেরিয়ে আসে বিশাল দীর্ঘশ্বাস। নিজের উপর নিজেই ভীষণ বিরক্ত সে। ভাগ্য তাকে নিয়ে চরম এক খেলায় মেতেছে। না জানি এই খেলার শেষ পরিণতি কি।

বিড়াল পায়ে এগিয়ে যায় ঐচ্ছি তার বাবা মার কাছে। ধরা গলায় বলে,

‘আজকে কি আর বাড়ি ফিরবে না মা?’

ঐচ্ছির মা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিক্ত সুরে বললেন,

‘দেখনা তোর বাবাকে তো তখন থেকে বাড়ি ফেরার কথা বলছি। কিন্তু উনি এখন রাফসানের সাথে বিষদ আলোচনা জুড়ে বসেছে। কিছুতেই উঠছে না।’

তাহেরা বেগম এবার চোখ রাঙালেন। কর্কশ গলায় ঐচ্ছির বাবাকে বললেন,

‘এই তুমি এবার উঠবে? ছেলেটার মাথা খেয়ে ফেলেছো তোমার এই রাজনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে। এখন দয়া করে উঠো। বাড়ি ফিরতে হবে তো নাকি?’

ঐচ্ছির বাবা আলাউদ্দিন আহমেদ মুখ কাঁচুমাচু করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথে রাফসানও উঠে দাঁড়াল। আলাউদ্দিন সাহেব তখন মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন,

‘আজ তাহলে আসি বাবা। আর খুব তাড়াতাড়িই আমরা তোমার আর ঐচ্ছির এংগেজমেন্টের ব্যবস্থা করবো।’

ঐচ্ছির মুখটা চুপসে যায়। এতক্ষণ তাহলে এই জ্বীনটা তার বাবার মাথায় এসবই ঢুকিয়েছে। ঐচ্ছি তীক্ষ্ণ কন্ঠে তার বাবাকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো।’

ঐচ্ছির মা বাবা দুজনেই কপাল কুঁচকে ঐচ্ছির দিকে তাকালেন। তাহেরা বেগম ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,

‘সেকি কথা তুই কোথায় যাবি?’

ঐচ্ছি বিরক্তির সুরে বলে,

‘কই যাব মানে? তোমাদের সাথে বাড়ি যাবো।’

‘একদম না। তুই এখন এখানেই থাকবি। রাফসানের সঙ্গে। তুই আর রাফসান একটু আলাদা সময় কাটাবি। তাতে তোদের মধ্যে আন্ডারস্টেন্ডিং বাড়বে।’

তাহেরা বেগমের শক্ত গলার কথা শুনে থমকে যায় ঐচ্ছি। চোখ মুখ কুঁচকে তেতো মুখে বলে,

‘কি? তোমরা চলে যাবে আর আমি এখানে উনার সাথে বসে থাকবো? কখনোই না। আমিও বাড়ি যাবো।’

‘চুপ। বেশি কথা বললেন আরেকটা থাপ্পড় খাবি। একদম ভদ্র মেয়ের মতো রাফসানের সাথে থাকবি। যদি ওর সাথে একটুও খারাপ ব্যবহার করেছিস না, তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন। আর বাবা,(রাফসানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে) তোমাদের ঘুরাঘুরি শেষ হলে ঐচ্ছিকে একটু বাড়ি পৌঁছে দিও, কেমন?’

রাফসান অধর জোড়া প্রশ্বস্থ করে হাসলো। তাহেরা বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

‘চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি ঐচ্ছিকে নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিব।’

প্রশ্বস্থ হাসলেন ঐচ্ছির মা বাবা। ঐচ্ছির কোনো কথা কানেই তুললেন না। মেয়েকে সেখানে রেখেই তারা চলে গেলেন। ঐচ্ছির মেজাজ খারাপ হয়। নাক মুখ ফুলিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে,

‘এই সব কিছু আপনার কারসাজি তাই না?’

রাফসান ইনোসেন্ট ফেইস করে বললো,

‘আমি আবার কি করলাম?’

ঐচ্ছি রাফসানের দিকে তেড়ে এসে বললো,

‘ভালো সাজেন তাই না? যেন কিচ্ছু বুঝেন না। মিচকা শয়তান একটা।’

রাফসান চোখ বড় বড় করে বললো,

‘কি, আমি মিচকা শয়তান? এত বড় কথা?’

ঐচ্ছি ভেংচি কেটে বললো,

‘তাই নয়তো কি? আপনার কথাতেই তো আমার বাবা মা সবকিছু করে। উনাদের দিয়ে সবকিছু করিয়ে আপনি একদম ভালো সেজে যান। একেবার নিষ্পাপ বাচ্চা, যেন কিছুই বুঝে না।’

রাফসান ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে। ফিচেল গলায় বলে,

‘আমি তো বরাবরই নিষ্পাপ।’

ঐচ্ছি মুখ বাকিয়ে বললো,

‘এএ, নিষ্পাপ না ছাই! পেটে পেটে সব শয়তানি।’

রাফসান স্মিত হাসে। ঐচ্ছি অন্য দিকে মুখ ঘুরায়। এই হাসির দিকে তাকালে আবারো তার দৃষ্টি আটকে যাবে। রাফসান নরম সুরে বললো,

‘কফি খাবেন?’

‘খাওয়া যেতে পারে।’

রাফসান মৃদু হেসে বললো,

‘চলুন তাহলে।’

______________

কফির কাপে আলতো চুমুক দিল ঐচ্ছি। রাফসান তার মুখোমুখি বসা। সে একটু কফি খাচ্ছে তো আবার হাত দিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে কফির কাপটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ঐচ্ছি কিছুক্ষণ রাফসানের দিকে তাকিয়ে থেকে বেশ কৌতুহল নিয়ে জিগ্যেস করলো,

‘আচ্ছা, আপনি যদি আমায় ভালো না বাসতেন তাহলে কাকে বিয়ে করতেন?’

রাফসান কিঞ্চিত অবাক হয়। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে ঝুলায় তার সেই চমৎকার হাসি। নরম স্বরে বলে,

‘শেহরান কে।’

ঐচ্ছি চোখ ছোট ছোট করে গম্ভীর স্বরে বললো,

‘শেহরান! কে উনি?’

রাফসান কফির কাপে চুমুক দিল। ঐচ্ছির দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘আমার ছোট চাচার মেয়ে। উনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।’

ঐচ্ছি টেবিলের উপর ঝুঁকে এসে বললো,

‘তাহলে উনাকে বিয়ে করলেন না কেন?’

রাফসান শান্ত গলায় জবাব দিল,

‘আপনাকে ভালোবাসি বলে।’

মুখ কালো করে ফেলে ঐচ্ছি। ইশ যদি ঐ শেহরানের সাথে রাফসানের বিয়ে হয়ে যেত তাহলে তাকে আর এই জ্বীনের পাল্লায় পড়তে হতো না। ঐচ্ছি মুখ কালো করে কিছুক্ষণ বসে রইল। হঠাৎই আবার কি মনে করে টেবিলের উপর আগের মতোই ঝুঁকে এসে বললো,

‘আচ্ছা, শেহরান কি আপনাকে ভালোবাসে না?’

রাফসান মৃদু হেসে বললো,

‘সেটা তো আমার জানা নেই। শেহরানের সাথে আমার তেমন কথা হয়না। তাই আমাকে নিয়ে উনার অনুভূতিও আমার জানা নেই। বলতে পারেন জানার ইচ্ছেও নেই। উনি আমার বোন হোন, আর সারাজীবন উনি আমার বোনই থাকবেন। বুঝলেন ম্যাডাম?’

ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টে মন খারাপ করে বললো,

‘হুম বুঝেছি।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here