কৃষ্ণচূড়ার রং লাল পর্ব ২+৩

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-২.🎈
@হাফসা আলম

“ আমার মাঝে নতুন করে কিসের কমতি খুঁজে পেয়েছেন আপনি ইয়াজ??”
“ কমতি নতুন করে খুঁজে পেতে হবে কেনো??তোমার মাঝে অনেক কমতি এমনেই রয়েছে।”

তুতুল আঘাত প্রাপ্ত মানুষের মত ঝুঁকে তাকায়।বলে,
“ মিফতা আপু আমার চাইতে ভালো হলে তাকে আগে পছন্দ করলেন না কেনো??আমার সাথে এতো দিন আপনি নাটক করেছেন??”

ইয়াজ চোখ সামনে রাখে।ফঁস করে এক শ্বাস ফেলে বলে,
“ সেটাই তো ভুল।আমি আগে তুলনা করি নি।এখন যখন করলাম তখন বুঝতে পারলাম তুমি নও ওই বেষ্ট।নিজেকে আয়নায় দেখেছো??না তা দেখবে কেনো??নিজের কেমন হুলিয়া করে ঘুরে বেরাও তুমি জানো??না তাও জানো না।মেয়েদের যে একটু সাজতে হয়ে জানো??না সেগুলো তোমার মাঝে কেনো থাকবে??তুমি তো স্কার্ট,আর ফতুয়া একটা পড়ে গলায় উড়না ঝুঁলিয়ে হাটতেই ভালোবাসো।না একটু সাজ ,না একটু চোখে কাজল দেওয়া।শুধু চুড়ি আর বড় বড় কানের ঝুমকা পড়ে ঘুরে বেড়াও।চুলগুলো এতো এতো কোঁকড়া তবুও সোজা করার ইচ্ছে নেই।মুখে কিছু দিয়েছ কখন??আর ঠোঁট তো খালি খালি।তোমার মাঝে এত এত কমতি আমি কোনটা রেখে কোনটা বলবো খুঁজেই পাচ্ছি না।এতো কমতি নিয়ে তুমি কিভাবে চলো আই ডোন্ট নো।কিন্তু আমি চলতে পারবো না।স্যরি।চোখ গুলো দেখো কত বড়।একটু কাজল দিলে কি জাত চলে যায়??তাও দিবে না।তুমি আসলে কি??আই ডোন্ট নো।আয়নায় নিজেকে দেখ।তবে বুঝবে তুমি কেমন।”

এত এত কমতি কি সত্যি আছে তার মাঝে??তুতুল নিচের দিকে তাকায়।মাটিতে নিজের পায়ের নখ খোঁচাতে থাকে।ভাবে,সত্যি কি সে এত বাজে দেখতে??তবে ইয়াজ আগে কেনো বলেনি??আগে কেনো নিজে পিছনে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার মানে বুঝিয়েছে??কেনো??তুতুল এবার দু’হাতে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কাঁদে।ইয়াজ চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে।গলার স্বর অনেকটা নিচে নামিয়ে বলে,

“ সমস্যা কি তোমার??কাঁদছ কেনো? মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম ব্রেকাপ হচ্ছে তাও তোমার??এসব নাটক দেখার সময় নেই আমার।”

তুতুল থামে।চোখের পানি মুছে নেয়।রাগী লাল চোখে তাকায়।বলে,

“ আগে আমার এত কমতি নজরে আসে নি কেনো??এখন কেনো আসছে??কেনো??”

“ কারন আগে আমি তুলনা করিনি।আর তোমার কমতি শুধু এগুলোও না আরো হাজারটা আছে।সবার আগে তো হচ্ছে তোমার এই কান্না।কথায় কথায় কান্না ওহ গড!!আর নিজেকে কি প্রেমিকা মনে করো??মোটেও তুমি তেমন নও।প্রেমিকা মানে কি জানো??কেয়ারি,গুরুত্ববাদী,যত্নবান,খবর রাখা কারী।তুমি কোনটা করো বলবে??একটাও না।কখনো কল করো??না।কখনো খবর নেও??কখনো কল তো করই না কল করলেও পাওয়া যায় না।হাত ধরলে থরথর করে কাঁপ।আশ্চর্য!!তোমার মাঝে আমি সাত আট বছর আগের তুতুল ছাড়া কিছুই দেখি না।বাচ্চাদের মত তুমি এখনো।তাই তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে জীবন চলে না।স্যরি।আর বলতে পারছি না।আমি বিরক্ত সাথে টায়ার্ডও।সো আংটিটা দেও।”

তুতুল শক্ত।কঠিন।নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।কাঁদছে না সে।চোখের পানিও পড়ছে না তার।দৃষ্টি শূন্যে ভাসছে।ইয়াজ হাত বাড়িয়ে এক টানে অংটিটা খুলে নেয়।তুতুলের ব্যথা লাগে।কিন্তু কিছুই বলে না সে।চুপ করে বসে আছে।ইয়াজ হাতটা আবার তুতুলের কোলে রেখে দেয়।উঠে যেতে গিয়ে আবার বসে পড়ে।তুতুলের দিকে তাকিয়ে অনেক অবাক সে।যে মেয়ের কথায় কথায় কান্না সে এত চুপ??এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো এতো কিছু বললো কিন্তু তুতুল এখনো চুপ??ইয়াজ কিছু একটা বলতে চাইলো।তুতুল কঠিন গলায় বললো,

“ আপনি আমার সামনে থেকে যান ইয়াজ।তা না হলে আমি এই মুহূর্তে আপনার সাথে কিছু একটা করে ফেলবো।”

ইয়াজ চমকিত চোখে তাকিয়ে থাকে।তুতুল লাল লাল চোখ বড় করে কঠিন চাহনী দিয়ে তাকায়।কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইয়াজ নিজেও ভড়কে যায়।ভয় পায়।একটু পিছিয়ে বসে।তুতুল কোনো দিকে পাত্তা দেয় না।চোয়াল শক্ত করে বলে,
“ কি হলো বসে আছেন কেনো??আপনি মুক্ত।যা খুশি ,যাকে খুশি বিয়ে করে নিন।আপনার মনের মত কাউকে।স্যরি।আপনার মন তো খনে খনে পরিবর্তন হয়।তাই আমি বলবো আপনার মনের মত নয় আপনার যেমন খুশি তেমন বিয়ে করেন।আপাততো এখান থেকে যান।”

“ তুমি এতো সহজে সব মেনে নিলে??আচ্ছা ভালোই হয়েছে। তোমাকে আমি বাসায় দিয়ে আসি??না মানে তুমি তো একা যেতে পারবে না।তাই বললাম।”

তুতুল রক্ত বর্ণ চোখে ইয়াজের চোখের দিকে তাকালো।কালো মেঘ যেমন আকাশের রং ধূসর করে ফেলে তুতুলের মুখের সব লাল গোড়া রং উড়ে যেয়ে এখন তেমন রূপ নিয়েছে।ইয়াজ এই রূপ আগে দেখেনি।তুতুল চিৎকার করে বলে,
“ সম্পর্কের মূলে ছিলো আপনার ভালোবাসা।স্যরি মিথ্যা ভালোবাসা।তা যখন নেই আপনার মত লোকের সাথে সম্পর্ক আকড়ে কি হবে?মেনে নেওয়াই উত্তম তাই না ইয়াজ আহমেদ??

ইয়াজ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে।যা দেখে তুতুল চেঁচিয়ে আবার বললো,
“ আমার সামনে থেকে যান।”

ইয়াজ উঠে দাড়ায়।তুতুল মাটির দিকে তাকায়।ইয়াজ যেতে যেতে পিছনে তাকিয়ে বলে,
“ ভালো থেকো।”

তুতুলের রাগ বাড়ে।মাটিতে নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল চেপে ধরে।হাত দিয়ে চেপে ধরে বেঞ্চি।নিচের দিকে তাকিয়ে বললে,

“ আপনি পর পর মেয়ে পরিবর্তন না করলে আমি কেনো সব মেয়ে ভালো থাকবে।”

ইয়াজ চলে যায় দ্রুত হেঁটে।তুতুল নিচের দিকে কঠিন চোখে তাকাতে তাকাতেই চিৎকার করে উঠে।গুমট ধরে বৃষ্টি নামে।বৃষ্টির পানিতে তুতুলের চোখের পানি ভিজে।নিজের কান্না থামাতে চায় সে।মুখ চেপে ধরে দু’হাতে।কিন্তু কান্না থামছে না।কিছুতেই না!তুতুলের চিৎকার বাড়ে।ভেতর থেকে আসছে চিৎকার।আশেপাশের মানুষ ছুটাছুটি করতে করতেই দুই একজন দাড়িয়ে পরে।বাচ্চারাও এসে দেখে।তুতুল চিৎকার করে কাদঁতে কাদঁতে নিচে বসে পরে।মাটিতে নিজের হাত থাবড়ে বেড়ায়।চুলের খোঁপা খুলে যায়।কোঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে চোখে,মুখে এসে পড়ে।তুতুল নিজের শরীরে আঘাত করে।হাঁটুতে জোড়ে জোড়ে নিজের হাতে থাপড়ায়।নিজের গালে নিজে থাপড়ায়।নিজের হাতে নিজে অসংখ্য খামছি দেয়।উম্মাদের মত চিৎকার করে কাঁদছে সে।মাঝে মাঝে ঠোঁট চেপে ধরছে।নিজের ঠোঁট নিজে থাপড়ে ফাঁটিয়ে ফেলেছে।নিজের চুল নিজে টানছে।নিজের বুকে বাহুতে অসংখ্য ঘুঁষি দিচ্ছে।চিৎকার করে বলছে,
“ আমার সাথে কেনো এমন হলো??এতো সহজ!!সব এতো সহজ!!কিভাবে একটা কথায় সব শেষ??কিভাবে??”

পৃথিবী বিচিত্র।এই বিচিত্র পৃথিবীর সবচাইতে বিচিত্র জিনিস মানুষের মন।একটা সময় ছিলো,যখন ইয়াজ নামক ব্যক্তি তুতুল বলতে পাগল ছিলো।পাগলের মত ছয়টা বছর ঘুরেছে।কত আকঁতিমিনতি করেছে।তুতুল এড়িয়ে চলেছে।কিন্তু আজ যখন তুতুল একটু একটু করে তার প্রতি দুর্বল হচ্ছে তখন পছন্দ না,ভালো লাগে না,কমতির থাব্বা গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছে। কিছু মানুষ আছে, যারা নিজে থেকেই কাছে আসে।কেয়ার নেওয়ার ট্রাই করে৷ভালোবাসি বলে বলে দুনিয়া দারি এক করে ফেলে।পাত্তা না দিলেও এরা ভালোবাসা ছাড়ে না।এত এত ভালোবাসা দেয়ে যে পাথরের মত মনও বদলায়।কিন্তু সমস্যাটা ঠিক অন্য জায়গায় হয়। আস্তে আস্তে যখন তার প্রতি মানুষটা উইক হওয়া শুরু করে!ঠিক তখনই মাঝ পথে ফেলে চলে যায়।তুতুলের সাথে কোনো ভাবে যেন তাই হয়েছে।

নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে কাঁদছে তুতুল।তার এত এত কষ্ট এই জীবনে কখনই হয় নি।কখনও না।নিচে মাটি খুবঁড়ে খুবঁড়ে তুলছে সে।তাকে দেখে পাগল মনে হচ্ছে সবার কাছে।বাচ্চারা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে।বৃষ্টি বাড়ে।অনেকেই চলে যায়।কেউ তাকিয়ে থাকে।তুতুল নিজের শরীরে আঘাত করছে যা ভয়ংকর।নিজের প্রতি যেনো সে রেগে আছে।হাতের যে আঙ্গুলে আংটি ছিলো সেই আঙ্গুল ভালো করে খামছি দিছে।রক্তে লাল হয়ে উঠে হাতের আঙ্গুল।ঠোঁট ফেঁটে রক্ত ঝড়ছে।গালে নিজের চার আঙ্গুলের লাল ছাপ পড়েছে।মাটিতে থাপড়ে হাত লাল হয়েছে।কাঁদায় জামা ভরে গেছে।সামনে কেউ এসে দাড়ায়।তুতুল কান্না থামায় না।এলোমেলো হয়ে নিজের গালে চড় মারছে সে।সামনের ব্যক্তি হাঁটু গেড়ে বসে।তুতুল কাঁদতে কাঁদতেই তাকায়।একটি পরিচিত মুখ।চোখে গোল চশমা পড়া সে।বৃষ্টির কারনে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।গায়ে ফুল হাতা কালো টি-শার্ট পরা একজন সুদর্শন ভদ্রলোক বলা চলে।মুখে অবাক হওয়ার ভাবটা আঁকা।মানুষের চেহারার মাঝেও যে শিল্প থাকে এই সুপুরুষকে একনজর দেখলেই বুঝা যাবে।ছেলেটা যেন তুতুলকে এভাবে দেখে আকাশ থেকে পড়ল।বললো,
“ তুতুল!!!”

তুতুল আরো শব্দ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠে।ফুঁফানো গলায় বলে,
“ রিঝ ভাই!!

তুতুল নিজের গালে আবার আঘাত করে।রিঝ দ্রুত হাত ধরে।তুতুলকে সামলানো যাচ্ছে না।এলোমেলো হয়ে সে হাত নাচাচ্ছে।রিঝের বুকে কিল ঘুষি মারছে।রিঝ কিছুই বুঝতে পারছে না।থামাতে থামাতে বললো,
“ হয়েছেটা কি তুতুল??তুমি এখানে কি করছ??”
“ আমি বাবা মায়ের সামনে কিভাবে দাড়াবো রিঝ ভাই??কিভাবে??”

রিঝ অবাক হয়ে বললো,
“ কি সব এলোমেলো কথা বলছ??কিভাবে দাড়াবে মানে??”
“ ইয়াজ বিয়েটা করবে না।বাবা বলেছিলো ইয়াজ বড় লোক বাবার ছেলে সে ভালো না আমি শুনিনি।এখন সে বললো তার আমাকে পছন্দ না।বিয়ে করতে সে পারবে না।”

রিঝ কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো,
“ ও তো তোমাকে ভালোবাসে তাই না??”

তুতুল কাঁদছে।খুব করে কাঁদছে।কথাই বলতে পারছে না কান্নার জন্যে।রিঝ জানে তুতুলের চোখে একটা কান্নার সাগর আছে।কিন্তু এভাবে সে আগে কখন কাঁদতে দেখেনি।তুতুল থামে।দীর্ঘ করে শ্বাস নিয়ে ভাঙ্গা কন্ঠে বলে,
“ ভালোবাসা!!সব গল্প কবিতায় সুন্দর হয় রিঝ ভাই।বাস্তব জীবনে এসব হয় না ।কিছুই হয় না।সব মিথ্যা।আমি ঘৃন্না কি ভালোবাসা শব্দ কে আজ এই মুহূর্ত থেকে।ভালোবাসার রংই লাল।কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার মত এর রং লাল হয় না।এরও পরিবর্তন হয়।হ্যাঁ ভালোবাসার রং পরিবর্তন হয়।”
_______________________
রহমান ভিলায় একটা হট্টগোল চলছে।আয়শা রহমান খুবই ক্লান্ত।নিজের ছোট নাতীর পিছনে দৌড়ে তিনি খুব ক্লান্ত।ছোট নাতী নয় সে সবাই বলে আরকি ছোট।আসলে তো পাঁচ বছরের বড় ছোট মিলিয়ে রায়হান।অনেক দিন পরে নানুর বাড়ি এসেছে সে।তাই তো নানু নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে তাকে।কিন্তু সে চো বিচ্ছু।বাচ্চাদের সবাই যতই ভালোবাসা,যত্ন ,শিক্ষা দেকনা কেনো এরা প্রকৃত পক্ষে বিচ্ছু।আয়শা রহমান হাঁপিয়ে উঠে সোফায় বসে পরে।তারপর মৃদু আর্তনাদ করে বলে,
“ আদ্রি আমি পারবো না আর।তোর ছেলে আসলেই শয়তানি বেশি করে।”

আদ্রি হাসে।টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“ আম্মু তুমি তো জানো ও শুধু রিঝরেই একটু ভয় পায়।আর কাউরে না।”

কথাটা আনাসের খুব গায়ে লাগলো।সবার বড় সে।সেখানে কেউই তাকে ভয় পায় না।ব্যাপারটা সে মানতে পারে না মোটেও।তাই বললো,
“ ওই রিঝরে তো ভয় পাইবোই শালা ভয়ংকর প্রানী।সব সময় এত চুপ থাকে আমিই মাঝে মাঝে ভাবি ও সত্যি তোর জমজ তো??না তুই সেই ছোট থেকেই এত বকবক করছ।আর ও!!শুধু ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকে।আল্লাহ্।”

আদ্রি রাগি চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়।সোফার বালিশ ছুড়ে মারে।আনাস সরে যায় সে বালিশ পরে সোফার কোনায় বসে থাকা শাহ আলম রহমানের খবরের কাগজের উপরে।কাগজ থেকে মাথা কাত করে তিনি দেখে কার দ্বারা ভুল হয়েছে।মেয়েকে দেখে তিনি আবার খবরের কাগজে মুখ ডুবায়।আয়শা রহমান বুঝে না এই বিকেলে কাগজ পড়ার মাঝে কি মজা।কিন্তু তিনি স্বামীর কোনো সীদ্ধান্তের উপরে কথা বলেন না।তাই চুপ থাকেন।আনাস রেগে বলে,
“ বাবা আজ তোমার মেয়ে মেরেছে বলে মাফ না??আমি হলে নিশ্চিত লাল চোখে তাকাতা??”

আনাস আরো কিছু বলতে চায়।কিন্তু তার আগেই তার ফোন বেজে উঠে।আদ্রি উঁকি দিতে চায়।আনাস দ্রুত সরিয়ে নেয় ফোন।তার গার্লফ্রেন্ডের কল।আনাস কাচুমাচু করে।আদ্রি জোড়ে হেসে উঠে।আয়শাও হাসে সেই তালে।শাহ আলম বললো,
“ কলটা ধরো।গুরুত্বপূর্ন হবে।মেয়েরা দ্রুত কল রিসিভ করা পছন্দ করে।অপেক্ষা করা এদের জন্য কঠিন কাজ।”

বাড়ি জুড়ে হাসির ঝড় নামে।বাহিরে যেমন বৃষ্টি ঠিক তেমন।আয়শা রহমানের মনটা খারাপ হয়।ছোট ছেলের জন্য তিনি দরজায় উঁকি দেয়।তার বড্ড বেশি আদরের ছেলে।যেমনই হোক তার কাছে সেরা।হ্যাঁ একটু রাগি,একটু গম্ভীর,একটু চুপচাপ,আর প্রচুর পড়ুয়া।তবে তার কাজে আছে চমৎকার একটা হাসি।যা দিয়ে সে সবার মন মুহূর্তেই কাড়তে পারে।
_____________
তুতুল উঠে দাড়াতে চায়।রিঝ হা করে তাকিয়ে আছে।এত কঠিন কথা তুতুল বলতে পারে না।এটাই সে জানে।এত পরিবর্তন ছয় মাসে!!না কি আজই??তুতুল ধপ করে রিঝের পায়ের কাছে পড়ে যায়।রিঝ ধরতে চায়।তুতুল হাত দিয়ে ইশারা করে।সে উঠে দাড়ায় নিজে নিজে।তার এখন কিছুই ভালো লাগছে না।কিছু না।রিঝ তুতুলের বাবার বন্ধুর ছেলে।সম্পর্ক দুই পরিবারের গভীর।সামনা সামনি বাড়ি তাদের।পেশায় একজন আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ার সে।আজ ছয় মাস পরে রিঝের তুতুলের সাথে দেখা।পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা ছেলের হাতে তুতুলের ব্যাগ দেখেই চিনতে পারে সে।নিজের গিফট করা ব্যাগ সেটা।তাই চিনতে অসুবিধা হলোনা তার।ব্যাগের পিছনে দৌড়ে ছেলেটাকে ধরতে পারে।সেই বলেছে এক মেয়ে মাঠে বসে পাগলের মত কাঁদছে।তাই তো ছুটে আসা।কিন্তু এসে এসব দেখবে ভাবতে পারেনি সে।কি হয়েছে??কিছুই জানে না সে??জানতেও চায় না সে।কিন্তু তুতুল কেনো কাঁদছে??রিঝ তুতুলকে থামাতে তার পিছনে দৌড় লাগায়।হাত টেনে ধরে।তুতুলের চোখ লাল হয়ে আছে।তুতুলের এত ভয়ংকর অবস্থা সে আগে কখন দেখেনি।ঠোঁট ফাঁটা,গালে লাল লাল নখের দাগ।হাতটা পর্যন্ত ছিঁড়ে গেছে।নখের অসংখ্য আচড়ের দাগ তার হাতে।রিঝ মনে মনে ফুঁসে উঠে।বলে,
“ পাগল না কি??এসব কি??কে করেছে??”

তুতুল চোখ বুজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে।শুকনো গলায় বললো,
“ আমি নিজে করেছি।”

রিঝ বিস্মিত।তুতুল হ্ত ছাড়িয়ে সামনে হাঁটে।এলোমেলো হয়ে হাঁটছে সে।রিঝ হাতটা শক্ত করে টেনে ধরে বলে,
“ আমার সাথে চল।আমিও বাসায় যাচ্ছি।”

তুতুল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকায়।নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলে,
“ কেনো??আমি নিজে চলাফেরা করতে পারি না??আমি কি সত্যি বাচ্চা??আমি সব পারি।পারতেই হবে।আপনি একদিন দয়া করবেন।দু দিন করবেন।তিন নাম্বারে এসে আমাকেই নিজের কাজ করতে হবে।তাই হাত ছাড়েন।ছয় মাসে তো একবারো দেখলাম না।ডাকলেও পিছনে ফিরে তাকাননি।তবে আজ কেনো এতো দরদ দেখাচ্ছেন??অবলা লাগছে দেখে??তাই সাহায্য করতে এসেছেন??আচ্ছা করেন।চলেন।কোথায় আপনার গাড়ি??চলেন।”

তুতুল নিজেই হেঁটে যায়।পার্ক থেকে বেরিয়ে সে রিঝের কালো গাড়ির সামনে দাঁড়ায়।রিঝ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছে।গাড়ির দরজা খুলে দেয় সে।তুতুল ভেতরে বসে।একটাও কথা বলে না।রিঝ গাড়ি ড্রাইভ করছে।প্রশ্ন করা এবং বেহুদা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া রিঝের কাছে সবচাইতে বিরক্তির কাজ।খুব অপছন্দ করে সে তাই সেও চুপ।তুতুলের ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে রক্ত পড়ছে।সামনের গ্লাসে রিঝ দেখে সেই দৃশ্য।তুতুলের মাথা কাত হয়ে আছে।জানালার বাহিরে তার চোখ।মুখের উপরে পড়ে আছে কোঁকড়া চুলগুলো।রিঝ চোখ ফিরিয়ে নেয়।এই চুল যে তার কঠিন দুর্বলতা।তার গোপন রহস্যের চাবী।জীবনের একটা ভয়ানক রং।সে রং সত্যি কারের কৃষ্ণচূড়ার রং।যাকে বলে কৃষ্ণচূড়ার রং লাল।টকটকে লাল সত্য।
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৩.🎈
@হাফসা আলম
_____________________________
বৃষ্টি যখন পুরো শহরকে ভিজিয়ে দিতে ব্যস্ত ,তুতুলের চোখও তখন বৃষ্টিতে স্তব্ধ।গাড়িটা থামে ঠিক দুই বাড়ির মাঝে।দুটি বড় বড় দালানের বাড়ি দু’পাশে।মাঝে ছোট মাঝারি সাইজের পিছঢালা বাস্তা।দু’বাড়িতে বড় বড় দেয়ালের সাথে পথের দুরত্ব কম না।যদিও অল্প।তবুও দূরত্ব তো দূরত্বই।তুতুল অপেক্ষা করে না।রিঝ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তুতুল নেমে পড়ে।দ্রুত নামতে গিয়ে নিজের উড়না ছিড়ে ফেলে সে।রিঝ নামে।তুতুল হাঁটে এলোমেলো হয়ে।হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে।হাতের কব্জির কিছু অংশ ছিলে যায়।রিঝ স্তব্ধ।তুতুল হাত ঝাড়ে।উঠে দাড়াতে চায়।রিঝ একটা হাত শক্ত করে ধরে।তুতুল মুখ তুলে তাকায়।চোখ লাল,মুখের অবস্থা খারাপ।রিঝের টি-শার্টে কাঁদার দাগ।তুতুল একপলক দেখে নেয়।কি মনে করে হাত ছাড়াতে চায়।রিঝ হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল,
“ উঠো।”

তুতুল উড়না ঠিক করে উঠে দাড়ায়।রিঝ তুতুলের সামনাসামনি দাড়িয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
“ এতো এলোমেলো হয়ে হাঁটছ কেনো??”
“ জানি না।”
“ সব খুলে বলো।কিভাবে কি হয়েছে??”

তুতুল এক ঝাটকায় হাত টেনে নেয়।নিজের মত সামনে হেঁটে যেতে যেতে না তাকিয়ে বলল,
“ আপনি আপনার মত থাকেন আমি আমার মত।ধন্যবাদ সাহায্যের জন্য।”

তুতুল সিঁড়ি বেয়ে উঠে।রিঝ কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়ে কাঁটিয়ে দিলো।নিজের বাড়ির দিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও বাড়ালো না।তুতুলের পিছনে পিছনে গেলো।তুতুল মাঝ সিঁড়িতে বসে পরে।নিজের মত দু’হাতে চোখ মুছে নেয়।তারপর উঠে আবার হাঁটে।রিঝ গোপনে সাবধানে সিঁড়ি বায়।

তুতুল কলিং বেল দেয়।আলভী দরজা খুলে।তুতুলের বড় ভাই সে।তুতুলকে এতো এলোমেলো কাঁদায় মাখামাখি শরীরে দেখে আলভী চমকায়।কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।তুতুল দরজার কাছ থেকে সরে ভেতরে ঢুকে।আলভী এখনও তাকিয়ে আছে।বোনের মুখের খামচির দাগ দেখে সে আরো অবাক।দ্রুত দরজা খোলা রেখেই বোনের কাছে যায়।দু’হাতে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে,
“ কিভাবে হয়েছে??কে করেছে এগুলো??কোন জানোয়ার আমার বোনের গায়ে হাত দিয়েছে??তুল??আমি খুন করে দিবো।কে করেছে ভাইয়ারে বল??”

আলভীর চিৎকার শুনে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে হোসাইন আর আমিনা।মেয়েকে এমন এলোমেলো দেখে তারাও ভয় পেয়ে যায়।আলভী অনেক কিছু বলেই চলেছে।শেষে রেগে তুতুলকে ছেড়ে দরজার দিকে যেতে চায়।তুতুল ভাইয়ের হাত ধরে টেনে বলে,
“ ভাইয়া এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবি প্লিজ??”

আলভী ঝড়ের গতিতে ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ডালে।অনেক পানি নিচে পড়ে।আবার পূর্বের মত দৌড়ে এসে পানি দেয়।হোসাইন মেয়েকে সোফায় বসায়।তুতুল এক নিঃশ্বাসে সব পানি শেষ করে।সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে।আমিনা কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের ঠোঁটের রক্ত আঁচল দিয়ে মুছে দেয়।যে মেয়ের শরীরে আজ পর্যন্ত হাত তুলেনি বাসার কেউ তার মুখে এতো দাগ??হাতে দাগ??আলভী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ কে এমন করেছে তুতুল??শুধু একবার বল???”

তুতুল শান্ত চোখে তাকায় সবার দিকে।নিজের খোলা চুলগুলো খোঁপা করে নিয়ে বলে,
“ ভাইয়া এতো উত্তেজিত কেনো হচ্ছো??এগুলো আমি নিজেই করেছি অন্য কেউ নয়।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে তাকিয়ে আছে বাসা ভর্তি সবাই।বাহিরে দাড়িয়ে রিঝ সব শুনছে।সে এগুলো শুনতে আসেনি।শুধু তুতুল ঠিক মত বাসায় যাচ্ছে কি না তাই দেখতে এসেছে সে।রিঝ যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।ভেতর থেকে কথা ভেসে আসে,
তুতুল পানির গ্লাস টেবিলের উপরে রেখে সবার দিকে মুখ করে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ বাবা তুমি ঠিক বলেছো।আমি জীবনের সবচাইতে বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছি।তুমি বলেছিলে ছেলেটাকে তোমার কেমন জানি লাগে।তবুও আমি তোমার কথা না শুনে বলেছিলাম বাবা উনি ভালো।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।সে আজ বিয়ের সাপ্তাহ খানেক আগেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।বলেছে আমার মত মেয়েকে তার আর পছন্দ না।তাই সে বিয়ে করতে পারবে না।আমি মস্ত বড় ভুল করেছি।ভুল করলে তো শাস্তি পেতেই হয়।এগুলো আমি নিজেকে নিজেকে শাস্তি দিয়েছি।বাবা ভাইয়া তোমরা যদি চাও আরো শাস্তি দিবা তবে দেও।অনেক অনেক শাস্তি দেও।যাতে আমি আর কখন ভুল না করি।”

তুতুল আচমকা নিজের বাবার আর ভাইয়ের দু’জনের দু’টি করে হাত নিয়ে এলোমেলো ভাবে নিজের গালে চড় মারতে থাকে।ব্যাপারটা বুঝতেই তাদের সময় লাগে।বুঝতে পেরেই হাত টেনে নেয়।হোসাইন মেয়েকে টেনে বুকে নেয়।ভাইও উঠে বোন আর বাবাকে জড়িয়ে ধরে।আমিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“ ওই ছেলে খারাপ আমি আগেই জানতাম।আমার ভোলা ভালা মেয়েটারে নিয়া সে মজা করছে সবার সাথে ??আলভী এখনি যা।ওর বাবা মায়ের সাথে কথা বল।বিয়ে ভাঙ্গবো বললেই হলো??আমিও যাবো।”

তুতুল থামিয়ে দেয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ জোড় করে সব হয় ভালোবাসা আর ভালো থাকা হয় না আম্মু।আঁকড়ে থেকে লাভ কি আম্মু??আমি এসব চাইনা।নিজের মত থাকতে চাই।আমাকে একা থাকতে দেও।”

তুতুল উঠে দাড়ায়।নিস্তেজ একটা অঙ্গ নিয়ে সে নিজের রুমে যায়।কাঁদে না।তুতুল এতো কিছুর পরেও চোখের পানি ফেললো না এতেই যেনো তার বাপ ভাইয়ের কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট।আলভী অনেক সময় নিয়ে দাড়িয়ে থাকে।তারপর বোনকে ডাকে।ভেতর থেকে কোন শব্দ আসে না।চিন্তিত মুখে সবাই দরজার সামনে বসে পরে।বার বার ডাকে।
________________
রহমান বাড়ির দরজাটা খুলেছে কাজের মেয়ে ঝর্ণা।রিঝের কাঁদা মাখা জামা দেখে আকাশ থেকে পড়ল সে।চোখ কচলাতে কচলাতে বলল,
“ ছোড ভাই আপনি কি বাইচ্ছা গো লগে খেলছেন??”

রিঝ চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে ভেতরে ঢুকলো।বিরক্তিতে মুখটা কঠিন করে বলল,
“ আমাকে কি তোর বাচ্চা মনে হয়??”

ঝর্ণা এক গাল হেসে বলল,
“ আরে না ভাইজান।কিন্তু আপনি গায়ে কাঁদা মাখছেন তাই ভাবছি মনে হয়ে আপনি খেলছেন।আসলে আমগো গেরামে বড় বড় পোলারাও ফুটবল খেলে।কাঁদায় কি যে মাখামাখি করে।”

রিঝের মন চায় একটা ধমক দিয়ে মেয়েটাকে চুপ করিয়ে দিতে।কিন্তু উচ্চ শব্দে কাউকে কিছু বলা তার স্বভাবে নেই।মেয়েটা তার ছোট।অনেক বছর থেকে কাজ করে তাদের বাড়িতে।তাই সে জানে এই মেয়ে অনেক কথা বলে।তাই চুপ করে থাকাই ভালো।কিছু একটা বললে সেটা নিয়ে আবার শুরু করবে।তার গ্রামে কি হয়েছে।না হয়েছে।এগুলো নিয়ে।আয়েশা ছেলেকে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে আসে।রিঝের হাতের ল্যাপটপের ব্যাগ নিজের হাতে নিতে নিতে বলল,
“ বাবা তোর গায়ে কাঁদা কেনো??”

রিঝ নিজের টি-শার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড।তুতুলের অসংখ্য মারের কথা মনে পরে।ভাবে,তুতুল খুব ভেঙে পড়েছে।তাই তো কঠিন হয়ে আছে।কিন্তু সে কি করতে পারে??মাঝের দেয়াল গুলো অনেক বড়।নিজেকে সামলাতে তার অনেক সময় লেগেছে এখনো লাগছে।হয় তো সারা জীবন লেগে যাবে।কিন্তু এই অসুখ থেকে সেরে উঠা হবে না।এ যে ভয়ংকর অসুখ।রিঝের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।আয়শা বুঝে ছেলের মন খারাপ তাই বলে,
“ ফ্রেশ হয়ে আয় ।”

রিঝ সিড়ি ভেঙ্গে যেতে যেতে বলল,
“ আম্মু একটু পরে আমার রুমে আসবা??”

আয়শা অবাক চোখে তাকায়।কিছু ভেবে বলে,
“ আচ্ছা।”

রিঝ বিছানার উপরে শুয়ে আছে।গোসল করেছে মাত্র সে।আয়শা ছেলের রুমে আসে।বিছানায় ছেলের পাশে বসে।মা এসেছে বুঝতে পেরে রিঝ নিজের মাথাটা মায়ের কোলে তুলে দেয়।আয়শা রহমান ছেলের মাথার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলে,
“ কি হইছে আমার বাপের??”

রিঝ কিছুসময় চুপ থেকে বলল,
“ আম্মু ইয়াজ তুতুলকে ধোঁকা দিয়েছে।বিয়েটা সে করবে না বলেছে।তুতুল পাগলের মত কেঁদেছে।কিন্তু হঠাৎ”

রিঝ থামে।আয়শার কৌতুহল বাড়ে।উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে।রিঝ চোখ বন্ধ করে ছিলো।হঠাৎ চোখ খুলে বলে,
“ তুতুল অনেক বড় শক্ট পেয়েছে আম্মু।আচ্ছা আম্মু তুতুলের দুঃখে কি আমার দুঃখি হওয়া উঁচিত??”

আয়শার তুতুলকে নিজের হাতে বড় করেছে।তুতুলের তো বরাবর দুই মা।কিন্তু ছয় মাস আগের ঘটনায় তিনি খুদ্ধ।তাই তুতুলের সাথে একটু রেগেই ছিলো তিনি।তবে খুব ভালোবাসেন তুতুলকে।তার কষ্টের কথা শুনে মায়া হয় আয়শার।রিঝ ধপ করে বসে বলল,
“ না কি নতুন করে একটা সুযোগের জন্য উপরের উনার কাছে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত???”

আয়শা কিছুসময় মৌন থেকে বলল,
“ ভাঙ্গা মন জোড়া লাগানো কঠিন।খুব কঠিন।”
_______________
আকাশ জুড়ে আলো।সূর্যের প্রখর রোদে চকচক করছে রাস্তা,গাছ পালা।কিন্তু সকলের অগচরে যে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে সেটা অনেকেই দেখছে না।এক কথায় তারা খেয়ালই করছে না।মেঘ যখন চারপাশ থেকে গুটিয়ে আসবে তখন বুঝবে আসলে বৃষ্টি এই বুঝি নামলো।আজকের দিনের সাথে একমাস আগের দিনের খুব মিল রয়েছে।সেদিও পার্কে খুব রোদ ছিলো।কিন্তু হুট করেই বৃষ্টি নেমেছিলো।তুতুল নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।একা একা থাকতে সে পছন্দ করে।কম কথা বলে।সবার থেকে দূরে থাকে।নিজের থেকেও তার নিজের দূরত্ব অনেক।সারা দিন চুপচাপ বসে থাকে।এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়ায়।যদিও সে রুমের বাহিরে কম আসে।তার সব যত্ন নেয় তার মা।আজ অনেক দিন পরে তুতুল বারান্দায় এসেছে।চোখে আলো লাগতেই অদ্ভুত ভাবে জ্বলে উঠে তার চোখ।বিশাল বারান্দা তার।এক কোণে গোল হালকা গোলাপী সাদার মিশ্রনে দোলনা।সেখানেই বসে বসে ঘুমাতো সে।একমাস হয়েছে সে দোলনায় বসে না।তুতুল বারান্দায় আসার সাথে সাথে যেন মেঘ আকাশে ছড়িয়ে পরেছে।তুতুল দোলনায় পা গুটিয়ে বসে।দৃষ্টি রাখে শূন্যে।

তুতুলের বারান্দা আর রিঝের বারান্দা অদ্ভুত ভাবে সামনা সামনি।তাই দু’জনের বারান্দা থেকে সব দেখা যায়।রিঝ আজ ছুটিতে আছে।তাই সে বাসায়।বৃষ্টি যখন নামবে নামবে রিঝ কফির মগ হাতে বারান্দায় দাড়ায় তখন।ডান হাতে ভায়োলিন।আজ অনেক মাস পরে তার ভায়োলিন বাজাতে ইচ্ছে করছে।রিঝ খুব ভালো ভায়োলিন বাজায়।শিল্পী বলা চলে।এটা তার সখ।তুতুলের খুব প্রিয়।রিঝের সব কাজের মাঝে এই একটা জিনিসই তুতুলের পছন্দের।রিঝ যখন কাঁধে রেখে ভায়োলিন বাজাতো তুতুল চোখ বুঝে শান্ত মেয়ের মত শুনতো।রিঝ বারান্দায় এসে সামনে তাকায়।তখন দেখে তুতুল উদাসীন চোখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।আজ অনেক দিন পরে বারান্দায় দেখছে তুতুলকে সে।এই একমাসে তুতুলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।যা কল্পনার বাহিরে।রিঝ চেয়েও দেখা করতে পারেনি।কোথাও একটা বাঁধা কাজ করে।আর তুতুলও তার সাথে কথা বলে না।ডাক্তারও বলেছে তুতুলকে তার নিজের মত থাকতে দিতে।রিঝ পাশে থাকা নিজের গোল দোলনার দিকে তাকায়।পাখির বাসার মত গোল কালো দোলনা।একুই রকম দু’টি দোলনা দুই বারান্দায় আছে তবুও তুতুলের পছন্দের দোলনা হচ্ছে রিঝের দোলনা।কালো রঙের দোলনায় তুতুল প্লাস্টিকের লতাপাতা,ফুল জড়িয়ে দিয়েছে।এই দোলনায় সে ঘুমাতে খুব পছন্দ করতো।
দিনটি ছিলো শুক্রবার।সেদিনটি ও ছিলো বৃষ্টির দিন।তখন নতুন দোলনাটা কিনা হয়েছে।তুতুলই কিনতে বাদ্ধ করেছে।তা না হলে এসবে রিঝের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে।
__________
যদি মেঘমালাদের মত
মেঘ হয়ে ,আকাশে ভাসতে পারতাম,
তাহলে বৃষ্টির নেয়
তোমার কোমল হৃৎপিন্ডের
শব্দ ভান্ডারের বদলে
আমি নিজেই বর্ষণ হতাম।

রিঝ গুন গুন করে কথা গুলো বলে।বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিতেই একটা অদ্ভুত শব্দ হলো।পিছন থেকে কেউ আওয়াজ দেয়,
“ ভাউ!!”

রিঝ চমকায় না।সে জানে এই কাজ কার।তুতুল পিছন থেকে সামনে এসে রাগি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ একটু ভয় পাইলে কি হয় রিঝ ভাই??”

নিজের ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিঝ বলল,
“ আমি ভয় পাই না সো ভয় দেখিয়ে লাভ কি??”
“ মাঝে মাঝে একটু অভিনয় করলে কি হয়??”
“ আমি এসব নাটক অভিনয় করতে পারি না।আর পারলে অবশ্যই নায়ক হতে পারতাম।”

তুতুল মুখটা বাঁকা করে বলল,
“ আপনি আর নায়ক??নায়ক হতে হলে অনেক গুন লাগে।আর আপনি তো ঢেঁড়স।”

রিঝ ভ্রু কুঁচকে এতক্ষণে তুতুলের দিকে তাকায়।তুতুল ভিঁজে চুপচুপ।মাথা ভর্তি পানি।হাতে আঁচারের ছোট বয়াম।তুতুল আঁচার খাচ্ছে।আয়শা রহমান মারাত্নক আঁচার তৈরি করতে পারে।তুতুল তো সে আঁচারের পাগল।রিঝ জানে।আর এই জন্যই তাদের বাসায় আসার আরো প্রয়োজন পরে তুতুলের।রিঝ খোঁচা মেরে বলল,
“ ও এই কারনেই আসা??আমি তো জানি তুমি কেনো আমাদের বাসায় আসো।বাট এই বিশ্রী জিনিস নিয়ে এখান থেকে দাফা হও।”

তুতুল তীর্যক চোখে তাকায়।রিঝকে দেখিয়ে দেখিয়ে খায়।রিঝ নাক ছিটকে বয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকে।তুতুল মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে রিঝকে আরো বিরক্ত করে।রিঝ তুতুলের সামনের কিছু চুল টেনে দেয়।তুতুল চেতে যায়।চিৎকার করে ডাকে,
“ কাকি আম্মু,ও কাকি আম্মু,”

রিঝ কাঁটা ভ্রু জোড়া কুঁচকিত করে বলল,
“ আম্মুরে ডাকার কারন কি??”
“ আপনার নামে বিচার দিমু।”
“ তাই না কি??আমার মায়ের কাছে আমার নামে বিচার??তবে যানো তো কেউ বিশ্বাসই করবে না।”

রিঝ মুচকি মুচকি হাসে।সবার সামনে রিঝ ভদ্র,পড়ুয়া,রাগি,চুপচাপ ছেলে।তাই তুতুল যতই কিছু বলুক না কেনো।শুনে তো সবাই কিন্তু বিশ্বাস করে না।তুতুল ফঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বড় করে বলল,
“ আপনার মত একটা বদ ছেলের নামে বিচার দেওয়াই উচিত।যদিও সবাইরে যাদু করছেন।খারাপ লোক একটা।”

রিঝ হু হা করে একটু শব্দ করে হাসে।তারপর বলে,
“ সে তুমি যাই বলো বাট আমার রুম থেকে বাহিরে যাও।আউট।আমি এসব ফালতু খাবার দেখতে পারিনা।ছিঃ।দেখতে কেমন??তৈলাক্ত।”

তুতুল নাক ফুলিয়ে বলে,
“ এটা আপনার রুম না।এটা বারান্দা।আর আমি এখন আমার দোলনায় বসবো।”

রিঝ আকাশ থেকে পড়ার মত ভাব নিয়ে বলে,
“ তোমার দোলনা??কোথায়??সেটা তো তোমার বারান্দায়।যাও নিজের বাসায়।”

তুতুল রিঝের সামনে থেকে সরে যায়।কালো দোলনায় উঠতে যেয়ে পারে না।হাতের জিনিসের জন্য।রিঝের কাছে আবার এসে বলে,
“ ভাইয়া এইটা ধরেন।”

রিঝ রাগি চোখে তাকিয়ে বলে,
“ হোয়াট??”
“ আরে খাইতে তো বলি নাই।সেটা বলবো ও না।ধরতে বলছি।নাইলে আমি আমার দোলনায় উঠতে পারমু না।”

রিঝ বয়াম হাতে নেয়।নাকটা কিঞ্চিৎ উপরে উঠিয়ে হাত দূরে রাখে।তুতুল লাফিয়ে দোলনায় বসে পরে।বয়াম টেনে নেয়।রিঝ বলে,
“ তুমি আমার দোলনাকে নিজের নামে চালিয়ে দেও কেনো??মতলব কি??”

তুতুল হেসে উঠে বলে,
“ আপনি আসলেই বোকা।নকল করেই বুয়েটে চান্স পাইছেন।তা না হলে আপনারে কেউ বুয়েটে চান্স দেয়??আমি হলে তো জীবনেও দিতাম না।”

রিঝ চুপ করে তাকিয়ে থাকে।এই মেয়ে এতো কথা বলে যে সে নিজেও এর পাল্লায় পরে যায় অনেক সময়।তুতুল আঁচার খেতে খেতে বলে,
“ দেখেন এই দোলনাটা তো আপনি কিনতেন না।আমি জোড় করে কিনাইছি।তো এটা আমার।আর যদি কখনো দাবি করেন??তাবলে বেশি কিছু না আঁচারের সব তেল আপনার মাথায় ডেলে দিবো।হিহি।”
তুতুল থেমে আবার বলে,
“ তবে বোকা হলেও কবিতা ভালো লেখেন।আমি কিন্তু শুনে ফেলছি।হিহি।বোকা একটা।হা হু হা।

রিঝ বুকে হাত গুজে নেয়।বৃষ্টি বাড়ে।তুতুল নিজের খাওয়াতে ব্যস্ত।রিঝ বৃষ্টি দেখে।হঠাৎ রুমে ডুকে একটা বই হাতে নিয়ে এসে তুতুলের কোলে দেয়।তুতুল হা করে তাকায়।রিঝ মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
“ এবার এটা পড়া শেষ করো।”
“ মানে কি??” তুতুল অবাক!
“ মানে সহজ।অনেক তো আঁচার খাওয়া হয়েছে।আমার সাথে তর্কও হয়েছে।নিচে ফ্লোরেও কি সব ফেলেছো।এবার তোমার শাস্তি হচ্ছে এই বই শেষ করো।তা না হলে বাসায় যেতে দিবো না।”

তুতুল কিছু বলবে তার আগেই রিঝ তুতুলের হাতের বয়াম নিয়ে বারান্দার কাঁচের দরজা বন্ধ করে দেয়।তুতুল কাঁদো কাঁদো চোখে তাকায়।রিঝ ভাইয়ের দেওয়া বই মানেই ভয়ংকর।নিশ্চুয়ই গলমাল আছে।

রিঝ দরজা খুলে ঠিক দশমিনিট পরে।হাতে তোয়ালে নিয়ে এসেছে সে।কিন্তু এসেই দেখে তুতুল ঘুম।দোলনায় গোল হয়ে ঘুমাচ্ছে সে।রিঝ অবাক হয় না।পৃথিবীতে সবচাইতে কম সময়ে ঘুমাতে পারার রেকর্ড তুতুলই করতে পারবে এটা সে জানে।রিঝ তুতুলের সামনে এসে দাড়ায়।চুল খুলে দেয়।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দেয়।মুখ মুছে দেয়।রুম থেকে চাদর নিয়ে এসে গায়ের উপরে দিয়ে দেয়।তুতুল বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলেছে।কুঁচি কুঁচি করে নিচে ফেলে রেখেছে।রিঝ যানতো এমন হবে।তুতুল তার কত শত বইয়ের যে প্রথম পৃষ্ঠা ছিড়েছে বলার বাহিরে।তার অপছন্দ বইগুলোর প্রথম পৃষ্ঠা সে এভাবেই ছিড়ে।রিঝ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।বাঁকা বাঁকা ঢেউ খেলানো চুলের কিছু গুচ্ছ মুখের উপরে পরে।রিঝ হাটু গেড়ে দোলনার পাশে বসে।নিজের থুতনিতে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে।চুল কানের কাছে গুজে গেয় না।শুধু মুখ থেকে সরিয়ে দেয়।ঠোঁটের পাশের তিলটা নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়।শরীর কাঁপিয়ে একটা অনুভুতি হয়।তুতুল নড়েচড়ে বাচ্চাদের মত আবার ঘুমায়।রিঝ থুতনিতে আগের মত হাত রেখে তাকিয়ে থাকে।
_______________
পৃথিবীর কিছু অনুভুতির নাম হয় না।কিছু ভালো লাগার কারণ হয় না।
রিঝ আজও মনে প্রানে তাই বিশ্বাস করে।পুরানো স্মৃতি গুলো ফিরে পেতে চায় সে।অনুভুতির নাম বা ভালো লাগার কারন জানার প্রয়োজন নেই তার।রিঝ দোলনায় বসে পা গুটিয়ে নেয়।কাঁধে ভায়োলিন বসায়।সুর তুলে।চোখ বুজে নেয়।বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের সাথে মিশে অদ্ভুত শব্দ তৈরি করে সেই সুর।তুতুল নিজের বারান্দা থেকে শুনতে পায়। মাথা উঠিয়ে তাকায়।একটু দূরে বারান্দায় রিঝ বসে বসে বাজাচ্ছে।তুতুল মনোযোগ দিয়ে শুনে।বিড়বিড় করে বলে,
“ ভাইয়া এই একটা কাজই ভালো পারে।সুর তুলতে।”

তুতুল গভীর মনোযোগ দিয়ে সুর শুনে।রিঝের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে,লোকটা এতো অদ্ভুত কেনো??এতো এতো বছরেও বুঝতে পারেনি সে।তুতুল হঠাৎ নিজের চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে দেয়।ছেলেদের সে বুঝতেই চায় না।এদের বুঝে কি আর হবে।শুধু কষ্ট বাড়বে।সবারই পছন্দ শুধু পরিবর্তন হয়।আজ ওকে কাল ওকে।তুতুল ইয়াজের বলা শেষ কথা গুলো ভাবে।মনটা আবার বিষাক্ত হয়ে উঠে।তুতুল রিঝের দিকেই তাকিয়ে আছে।রিঝ হঠাৎ ভায়োলিন বাজানো বন্ধ করে দেয়।ঠাস করে চোখ জোড়া খুলে।তুতুল রিঝের বন্ধ করা চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।চোখ খুলতেই দু’জনের চোখা চোখি হলো।রিঝ স্থির দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।দূরত্ব অনেক।তুতুলের মনে একটা দুরত্বের দেয়াল আছে।তার সামনে একটা বাড়ির দেয়াল আছে।দু’বাড়ির দেয়াল অনেক।মাঝে বৃষ্টির তৈরি দেয়াল।রিঝ সব টপকাতে পারবে।কিন্তু মনেরটা!!!

#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…….
গল্পের নাম নিয়ে যাদের সমস্যা তাদের বলছি,এই সমস্যাটা আর ভালো লাগছে না।প্রতি গল্পে একুই অবস্থা,সত্যি আমি বিরক্ত।শুনা নাম সব সময় শুনতে চান কেনো??ভিন্ন কিছু যে কেনো মানতে পারেন না?আমি জানি না।তুতুল তার পরিবারের খুব আদরের।তাই তাকে এই নাম দেওয়া হয়েছে।গল্পে কিছু লেখা হলে অবশ্যই এর গুরুত্ব আছে বুঝতে হবে।এমনে এমনে কিছু লেখা হয় না।এটা প্রকৃত পাঠকরা বুঝতে পারবে আশা করি।
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
@হাফসা……………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here