কৃষ্ণচূড়ার রং লাল পর্ব ৪+৫

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৪.🎈
@হাফসা আলম
_____________________________
পানি ভর্তি জগ তুতুলের মুখের উপরে মারতেই চিৎকার করে উঠে বসে সে।সারা শরীর ভুজে একাকার তার।রাতে ঘুমও হয়েছে দেরিতে।ইদানিং রাতে তেমন ঘুম হয় না তার।তাই সে দেরিতে ঘুমায়।পানির ছিটকায় চোখ খুলতে পারছে না সে।পাশ থেকে একটা পরিচিত পুরুষ কন্ঠ শুনতে পায় সে,
“ শুভ ভোর।”

টিপটিপ করে চোখ খুলে সামনে তাকায় তুতুল।আশ্চর্য চোখে কিছুমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে,
“ রিঝ ভাই আপনি এখানে??তাও এত সকাল সকাল??আমার রুমে??”

হাতের জগটা পাশে রেখে রিঝ চেয়ার টেনে বসে।পায়ের উপরে পা তুলে সাহেবি ভঙ্গিতে বলল,
“ উঠো।আজ এক সাথে জগিং করতে যাবো।”

কথার আগামাথা কিছুই তুতুলের মাথায় ঢুকলো না।তুতুল আহাম্মকের মত তাকিয়ে আছে রিঝের দিকে।তুতুলের চিৎকার শুনে আলভী দৌড়ে আসে।মাত্র মসজিদ থেকে এসেছে সে।তুতুলের রুমে এসে তাকে ভিজে চুপচুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে আলভী বলল,
“ ভিজলি কিভাবে??”

তুতুল রেগে রিঝের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“ উনি ভিজাই দিছে।দেখ ভাইয়া কত খারাপ এই ছেলে।আমার রুমে ঢুকলেন কিভাবে??আপনাকে তো আমি এখনি দাড়ান।”

তুতুল দ্রুত উঠে যায়।চাদর বালিশ সব ফেলে সে দৌড়ে ওয়াসরুমে যায়।মগ ভর্তি পানি নিয়ে এসে রিঝের মাথায় ঢেলে দেয়।রিঝ শান্ত হয়ে বসে আছে।যেনো সে জানতো পরের বার পানি ভর্তি মগ তার মাথায় পড়বে।আলভী অবাক চোখে সব দেখছে।পানি মারামারি উৎসব হচ্ছে যেন।কিন্তু এর জন্য সে অবাক নয়।সে অবাক তুতুলের স্বাভাবিক ব্যবহারে।তুতুল হুট করেই আগের মত হয়েগেছে যেন।তুতুল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বিছানায় বসে।রিঝ তুতুলের মুখের সামনে নিজের চুল ঝাকায়।আলভী রাগী কন্ঠে বলে,
“ ওই তুই আমার বোনের গায়ে পানি ছাটাছ কা??অন্য দিকে চুলের পানি ঝার।”

রিঝ চুল ঝাকাতে ঝাকাতে বলল,
“ তোর বোন আমার সামনে কেন বসে আছে??আমি কি ওর মুখের সামনে নিয়ে ঝাড়ছি না কি??সেই তো সামনে বসে আছে।যত দোষ নন্দ ঘোষ।”

তুতুলের যেন গা জ্বলে উঠলো।শরীর দুলিয়ে বলল,
“ দেখলি ভাইয়া??রিঝ ভাই আমারে কত অত্যাচার করে।বললে তো তুই বিশ্বাসই করছ না।এবার দেখ।”

আলভী মুখ টিপে হাসে।তুতুল আগে সব সময় রিঝের নামে এসে নালিশ করতো।কিন্তু সে তেমন পাত্তা দিতো না।এসব কথা যে এই কয়েক দিনে তুতুল ভুলেনি এই ভেবে তার ভালো লাগছে।তুতুল চিৎকার করে উঠে।বলে,
“ ভাইয়া!!তুই হাসছ ক্যান??”

আলভী মুখে হাত দিয়ে বলে,
“ আমি আর হাসি??নো ইম্পসিবল।আসলে আমার মুখটাই হাসি হাসি তাই তোর সব সময় মনে হয় আমি হাসি।আসলে তো আমি হাসি না।মাঝে মাঝে কাঁদিও।কিন্তু কেউ বুঝে না।তাই সব সময় পাত্তা দেয় না।কি দুঃখ আমার বুঝলি তুলা!!”

“ ভাইয়া তুলা ডাকবি না।আমার নাম তুতুল।আদীভা তুতুল।”

রিঝ তুতুলের লম্বা খোলা চুলে নিজের আঙ্গুল পেচিয়ে একটা টান দেয়।তুতুল চেঁচিয়ে উঠে,
“ আহ্ আমার চুল!!”
“ ৫মিনিট সময় দিলাম যাও রেডি হয়ে আসো।তা না হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
“ আপনার থেকে খারাপ এই পৃথিবীতে কেউ নেই ও।হু”

তুতুল মুখ বাঁকিয়ে বা পাশ ফিরে বসে।রিঝ আবার চুল টানে।তুতুল দ্রুত নিজের চুল খোঁপা করে।হুট করেই নিজের মাঝের পরিবর্তন খেয়াল হয় তার।তুতুল চুপচাপ হয়ে যায়।রিঝ নিজের জামার পানি মুছতে মুছতে বলল,
“ চুপচাপ হয়ে লাভ নেই।ব্রেকাপ শোক একমাসে অনেক হয়েছে।এখন উঠো।তা না হলে বিকেলে রেডি থেকো।”

তুতুল বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“ কেনো??”

রিঝ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলে,
“ তোমার নতুন ফিজিক্স টিচার। আমি।”
“ হোয়াট???”

তুতুল লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়।রিঝ দু’হাতের তালুতে তালু ঘোঁষে।তুতুলের পড়ার টেবিলের বই উল্টে দেখতে গিয়ে দেখে বালি জমে আছে অনেক।রিঝ নিজের চোখা নাক ছিটকে হাত ঝারে।বালি,ফুল,ময়লা জাতীয় জিনিস রিঝের প্রচন্ড অপছন্দ।রিঝ হাত ঝেরে বলল,
“ ছিঃ।এগুলো পরিষ্কারও করা যায় না বুঝি??যাই হোক বিকেলে পরিষ্কার করে রাখবে।তা না হলে শাস্তির জন্য প্রস্তুত থেকো।”

রিঝের শাসনের সুর শুনে তুতুলের এখনই গলা শুকিয়ে কাঠ।রিঝ বই নিয়ে আরো অনেক কথা বলল।তুতুল কান দিয়ে শুধু শুনছে।কপাল খারাপ।রিঝ যদি টিচার হয় কপালে শনি আছে।অনেক অনেক পড়া দিবে।কানে ধরে এক পায়ে দাড় করিয়ে রাখবে।আরো কত শাস্তি!!একবার তো রিঝের প্রিয় একটা বই ছিড়েছে বলে তেলাপোকা দিয়েও ভয় লাগিয়েছে।তুতুল তেলাপোকা খুব ভয় পায়।শুকনো ঢোক গিলে তুতুল বলল,
“ আমার টিচার আছে।আপনার মত জ্ঞানী বাবাকে আমার প্রয়োজন নেই।পড়াতে আসলে আমি কিন্তু আব্বুকে বলে দিবো।”

তুতুলের ধমকিতে রিঝ দুই ভ্রু উল্টে তাকালো।চোখ ছোট করে ডান হাতে নিজের চশমাটা ঠেলে দিয়ে বলল,
“ কি বলে দিবা??”
“ আপনি কিছু পারেন না।আরে আপনি তো ইঞ্জিনিয়ার আমাকে কিভাবে পড়াবেন??আর আমি তো ফিজিক্সের স্টুডেন্ট।”
“ হুম।এটা একটা বড় ব্যাপার।তবে কথা হচ্ছে আমি সাইন্সের স্টুডেন্ট।এর চাইতে বড় কথা আমি কমার্সের সাবজেক্টও পারি।সবচাইতে বড় কথা,কাকায় বলেছে তোমাকে পড়াতে।”

তুতুলের উৎকন্ঠা,” বাবা!!কেনো??মানে কি??”
“ তুল সেট আপ।এতো জোড়ে চিৎকার করো কেনো।” রিঝ নিজের কানে হাত দেয়।বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নেয়।আবার বলে,
“ মানে টানে কিছু না।আমাকে কাকায় বলেছে তোমাকে পড়াতে আসতে।আমি আসবো।যদিও তুমি লেখাপড়ায় গোলা।তবুও চলবে।সো বিকাল থেকে তুমি আমার স্টুডেন্ট।”
“ জীবনেও না।”
“ তাহলে জগিং ড্রেস পরে নিচে আসো।৫মিনিটের এক মিনিটও যদি দেড়ি হয় আমি তোমার টিচার। “

রিঝ উঠে যায়।আলভী মুখ টিপে হেসেই চলেছে।রিঝ আর সে সমবয়সী।ভালো বন্ধুও।কলেজ পর্যন্ত একুই কলেজে পড়েছে তাড়া।ভার্সিটিতে সে ঢাবিতে আর রিঝ বুয়েটে ভর্তি হয়।রিঝকে বন্ধু মহলে সবাই ভয় পায়।অদ্ভুত ব্যাপার!!তবুও সত্যি।রিঝের পার্সোনালিটিই এমন।তার নিজের বোন তো সে হিসেবে অনেক সাহসী।রিঝকে জব্ধ করার নতুন নতুন পদ্ধতি সে অবিষ্কার করে।আলভী বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়।তুতুল ইনোসেন্ট মুখ করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ ভাইয়া আমার কিছু ভালো লাগছে না।তুই উনারে বুঝা না।”
“ স্যরি আমার তুলতুল।এটা বলিস না।রিঝ মানে সিংহ।থাবা খাওয়ার ইচ্ছে নেই।”আলভী দায় সারা ভাব।

“ ভাইয়া তুই এটা বলতে পারলি??উনি না তোর বন্ধু??”
“ বন্ধু হয়েছে তো কি হয়েছে।ভয় তো পাই না কি??একুই জঙ্গলে সিংহ হরিণ একসাথে থাকে।তবুও তো হরিণ ভয় পায় তাই না।”
“ ভাইয়া!!!উনি কি তোরে খাই ফেলবে??”
“ না খাইলেও আমাকে ঘুঁষি টুষি দিলে তো নাক ফেটে যাবে।বিয়ের বয়স হইছে।বুঝছনা কেন??তুই কি চাস তোর ভাই কুমারা থেকে যাক??”

আলভী লাজুক হাসি দেয়।আবার বলে,
“ যা তুলতুল।ঘুরে আয়।”

তুতুল চেঁচিয়ে বলে,
“ কখনো না।উনার সাথে গেলে দৌড়াতে হয় অনেক।”
“ সমস্যা কি দৌড়ালে।”

তুতুল চোখ গরম করে তাকাতেই আলভী নিজের সাদা পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বলল,
“ না মানে ইয়ে,না গেলে না যা।বিকেলে পড়তে হবে একটু এই আর কি।আর মাঝে মাঝে কানে ধরতে হবে।কাঠের স্কেলের বাড়ি খেতে হবে।আর মাঝে মাঝে কলমের চিপা খাবি!আর আর”

তুতুল রাগে ফুঁসে উঠে।চিৎকার করে বলে,
“ ভাইয়া আমার রুম থেকে যা।আমি জামা চেঞ্জ করবো।”

আলভী খুশি মনে বেরিয়ে গেলো।তুতুল রিঝকে গালি দিতে দিতে জামা পড়ে নেয়।কালো ট্রাউজার উপরে ঢোলা সাদা টি-শার্ট।চুলগুলো উপড় করে বেঁধে নেয়।হালকা গোলাপী সাদা মিশানো কনভার্স পড়ে রেডি হয়।
___________________
আলভী দৌড়ে নিচে আসে।রিঝ জগিং ড্রেস পরিবর্তন করে আসে।আলভী হালকা হেসে পিঠ চাপড়ে বলল,
“ ধন্যবাদ।”
“ কেনো??রিঝের অবাক গলা।”
“ আমার বোনকে নিজের বোনের মত সামলে নেওয়ার জন্য।”
রিঝ রাগী চোখে তাকায়।কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে বিরক্ত মুখে বলে,
“ তোর বোন আমার বোন হতে যাবে কোন দুঃখে।শয়তানের নানী ও।আর যাই হোক ও আমার বোন না।”

আলভী ভ্রু কুঁচকে অবুঝের মত তাকিয়ে থাকে।তুতুল দৌড়ে দৌড়ে নিচে নামে।চোখে মুখে তার বিরক্তি।রিঝ ভাইয়াকে তার সবচাইতে অপছন্দ।তার কাছে যদি জাদুর লাঠি থাকতো এই নামের ব্যক্তিকে সে উধাও করে দিতো।রিঝ আগে আগে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়।তুতুল আস্তে আস্তে হাঁটে।রিঝ পিছিয়ে এসে বলল,
“ এতো স্লো কেনো তুমি??”

রিঝের কথায় তুতুল ঠোঁট উল্টে নেয় অনেক খানি।তার খুব ঘুম পাচ্ছে।আর এই অবস্থায় তাকে দৌড়াতে হবে??তুতুল অনেক সময় দাড়িয়ে থেকে কিভেবে দৌড় দেয়।দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,
“ রিঝ ভাই আপনার মত খারাপ মানুষ আমার জীবনে আর কেউ নেই।এতো খারাপ কেনো আপনি বলবেন??শয়তান লোক।দেখিয়েন জীবনেও বউ পাবেন না।এই আমি অভিশাপ দিলাম।”

তুতুলের কথায় রিঝ হাসলো।ঠোঁট কামড়ে দৌড়াতে শুরু করলো।পাশের একটা পার্কে এসে পৌছালো তারা।তুতুল হাপিয়ে উঠেছে।জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।ঘামে ভিজে একাকার সে।রিঝ এখনো দৌড়াচ্ছে।তুতুলের মুখ লাল হয়ে আছে।পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে পরে সে।পার্কে গাছপালা আছে অনেক।অনেকেই দৌড়াচ্ছে।বয়স কারো কম কারো বেশি।অনেকে বাচ্চা।তুতুল হাসে।এই বাচ্চা গুলো না ঘুমিয়ে এতো সকালে দৌড়াতে এসেছে।ব্যাপারটা হাসির মনে হলো তুতুলের।তুতুলের পাশ ঘেঁষে হাঁটে একজোড়া নারী পুরুষ।হাত ধরে হাঁটছে তারা।বয়স্ক দেখতে।তুতুল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে।ইশশশ্ এরা কত সফল।জীবনে অনেক সময় একসাথে কাটিয়েছে।এদের মত হওয়ার ইচ্ছে তারও ছিলো।সব কিছু স্বপ্নের মত ছিলো।আজ সে একা।একদম একা।স্বপ্ন ভেঙে গেলে কষ্ট হয় না কিন্তু বাস্ত স্বপ্ন ভাঙ্গলে হৃদয়ও ভাঙ্গে।তুতুলের চোখ ভিজে উঠে।রাগ নিয়ে সে দৌড়াতে শুরু করে।দৌড়ের গতি অনেক বেশি।রিঝ অবাক হয়।লিমিট ছাড়া দৌড়াচ্ছে তুতুল।রিঝ দ্রুত হাত ধরে।তুতুল হঠাৎ থামতে গিয়ে পরে যেতে নেয়।রিঝ কোমড় পেচিয় দাড় করায়।তুতুল ঝাঁঝালো গলায় বলে,
“ ধরলেন কেনো??আমি জগিং করছি।আপনিই তো নিয়ে এসেছেন।তাহলে থামালেন কেনো??”
“ আজকের জন্য এনাফ।চলো বসবে।”
“ না আমি আরো দৌড়াবো।”
“ শেট আপ।চলো।”
ধমক খেয়ে তুতুল চুপ হয়।রিঝ হাত টেনে নিয়ে আসে তুতুলকে।বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয়।তুতুল ফঁস ফঁস করে শ্বাস নেয়।রিঝের কাছে পানি নেই।পার্কের কর্নারে একটা ছোট দোকান আছে।সেখান থেকে পানির বোতল নিয়ে আসে তুতুলের হাতে পানির বোতল দেয়।তুতুল রাগের জন্য খুলতেও পারেনা।সামান্য পানির বোতল খুলতে না পেরে সে কেঁদে ফেলে।রিঝ যেন তুতুলের আয়না।তার মনের সব কিছুই সে বুঝতে পারে না শুনে।না দেখে।রিঝ তুতুলের হাত থেকে পানির বোতল নেয়।খুলে দেয়।তুতুল কাঁদতে কাঁদতে পানি খায়।কান্না থামছে না তার।রিঝ থামায় না।তুতুল অনেক সময় নিয়ে কাঁদে।রিঝ শুধু সামনে তাকিয়ে থাকে।একটা সময় তুতুলের হাতের উপরে হাত রাখে।তুতুল চমকে কান্না থামিয়ে দেয়।রিঝ বলে,
“ হৃদয়কে শক্ত করো।কিন্তু কঠিন না।পৃথিবীকে তুমি তোমার মত মনে করো না।কিন্তু নিজের মত উড়ো।মনকে সবার কথায় নয় নিজের কথায় চালাও।অন্যের জন্য নয় নিজের জন্য বাঁচতে শিখো।অনেকে তোমার জীবনে আসবে।যাবে।কেউ থেকে যাবে।কিন্তু তুমিই তোমার একমাত্র সঙ্গী হবে যে সঙ্গী সব সময় এক।তাই তুমিটাকে ভালোবাসতে শিখো।নিজেকে চিনতে শিখো।যে নিজেকে চিনি সে যা করতে চায় তা করতে পারে।”

রিঝ থামে।তুতুল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।রিঝ ভাই যে এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে এটা তার এতো বড় জীবনে আজই প্রথম মনে হচ্ছে।কন্ঠে যেনো এক গ্লাস মধু মিশিয়ে নিয়েছে।রিঝ তুতুলের পানির বোতল নিজের হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ ঠোঁট ছুঁয়ে পানি খেয়েছো??”

তুতুল মাথা দলায়।যার অর্থ না।রিঝ হাসে।পানি খেয়ে বলে,
“ ভালোবাসা সবাইকে নিবেদন করো,
তবে তাকে সর্বাধিক ভালোবাসো,
যার অন্তরে তোমার জন্য তোমার চেয়েও
অধিক ভালোবাসা বিদ্যমান।”
উক্তিটি কার বলো তো তুতুল??”

তুতুল হা করে তাকিয়ে থাকে।সে জানে না এটা কার উক্তি।রিঝ নিজের ঠোঁটে হাত বুলিয়ে বলে,
“ হযরত আলী (রাঃ)”

তুতুল হেসে বলল,
“ আমি ভাবছি আপনার।”
“ এতো সুন্দর উক্তি দিতে হলে মানুষ হিসেবেও সুন্দর হতে হয় আমি তা নই।”
“ আপনিও অনেক ভালো উক্তি বলতে পারেন।”

রিঝ ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ চুরি করে আমার ডায়েরি তাহলে তুমি পড়ো??”

তুতুল মাথা নিচু করে।সে লুকে লুকে রিঝের কবিতা,লেখা লেখির ডায়েরি গুলো পড়ে।ভালো লাগে।পরিবেশ ঠান্ডা।সূর্য উঠি উঠি।রিঝ আকাশের দিকে তাকায়।লাল হয়ে সূর্য উঠে।চোখ পাশ ফিরিয়ে তুতুলের দিকে তাকায়।তুতুলও লাল হয়ে আছে।রিঝের মনে হয় তুতুলও সূর্য।যে সূর্য তার চোখেই পড়ে শুধু।রিঝ বলল,
“ তুমি কাকে ভালোবাসো সেটা মনে রেখে কষ্ট পেয়ে কি হবে??তোমাকে যারা তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসে তাদের নিয়ে অনায়াসে একটা সুন্দর জীবন তুমি পার করে দিতে পারবে।তুমি জানো তুমি কাঁদলে সবচাইতে বেশি তোমার ভাইয়ের কষ্ট হয়??”

তুতুল মাথা নিচু করে।রিঝ বলে,
“ তোমার ভাই তোমার জন্য কেঁদেছে।বাবা মা ছেলে মেয়েকে ভালোবাসে স্বাভাবিক।কিন্তু তোমার ভাইয়ের মত ভাই আমি নিজের বোনের জন্যও না।ছোট থেকে দেখছি তুমি ব্যথা পেলে সে কাঁদে।একবার কলেজে থাকতে ওর পা ভেঙে গেছিলো।ও কিন্তু তখন একটুও কাঁদেনি।তুমি ওর ভাঙ্গা পা দেখে কেঁদেছো দেখে সে কেঁদেছে।এটাই প্রকৃত ভালোবাসা।আমি বলছিনা নিজের ভালোবাসার কষ্ট তুমি ভুলে যাও।বা নিজের ভালোবাসাকে ভুলে যাও।আমি বলছি যারা তোমাকে অধিক ভালোবাসে তাদেরও তুমি অধিক ভালোবাসতে শিখো।জীবন কঠিন।এই কঠিন জীবনে তোমার জীবনেও অনেক কঠিন পরিস্থিতি আসবে।সব পরিস্থিতিতে ভেঙে গুড়িয়ে নিজেকে নিয়ে তুমি ভালো থাকতে পারবে না।তাই অতীতকে পাশে রেখে বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে শিখো।নিজের মত উড়তে শিখো।যা খুশি করো।পৃথিবীটা তোমারও।”

তুতুল মুগ্ধ হয়ে শুনে।আসলেই সে ভুল করেছে।কিন্তু একটা না অনেক।বাবা মা ভাইয়ার সাথেও অন্যায় করেছে।এই একমাসে তাদের কারো সাথে ভালো করে কথা বলে নি সে।কত কষ্ট পেয়েছে তারা!!তুতুলের এখন আরো কষ্ট হয়।বাবা-মা-ভাইয়ের জন্য কষ্ট হয়।খুব কষ্ট।রিঝ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
“ পৃথিবীটা তোমার বলতে আবার নিজের সম্পত্তি ভেবে সবার জীবন ভয়ংকর করে ফেলো না।আর উড়তে বলেছি মানে আবার ছাদের উপরে উঠে হাত নাচিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ো না।তাহলে একদম উপরে চলে যাবা।আর লাফালাফি করা শুরু করো না।আর,”

তুতুলের মেজাজ খিঁচে যায়।রাগি চোখে তাকিয়ে বলে,
“ আপনার আর আর আর শেষ হবে??”
“ কিভাবে হবে ,তুমি যে মেয়ে বাপরে!!ভয়ংকর।যদিও মেয়ে জাতিই ভয়ংকর।তবে তুমি আরো একধাপ এগিয়ে।শয়তানের নানী।”

রিঝের কথায় তুতুল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।রিঝের হাত থেকে বোতল নিয়ে রিঝের পিঠে মারতে শুরু করে।রিঝ সটাং হয়ে বসে থাকে।হঠাৎ একটা মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসে।কেউ উত্তেজিত গলায় বলল,
“ মাই জানু ,মাই বেবী,এই মেয়ে আমার বাবুরে মারছ কেনো,??রিঝ বাবু!!”
কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৫.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
তুতুল চোখ তুলে তাকায়।সামনের এই মহান মানবীকে সে চিনতে চেষ্টা করলো।অতিব দুঃখের বিষয় সে চিনতে পারলো না।তবুও চেষ্টা ছাড়লো না।মোটা ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো।পরখ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।অনেক দেখে বুঝতে পারলো আর যাই হোক এতটুকু মেয়ের রিঝ ভাইয়ের মত এত বড় ছেলে থাকা সম্ভব না।গায়ে জগিং ড্রেস।কাঁধ অবদি চুলগুলো পিঠের উপরে পরে আছে।গায়ের রং ধবধবে সাদা।চুল ব্রাউন কালার।এক পলকের জন্য তুতুলের মনে হলো মেয়েটা বোধ হয় বিদেশি।মেয়েটা রিঝের দিকে তাকিয়ে উৎসুক হয়ে বলল,
“ তুমি জানো বাবু আমি তোমাকে দুই বছর কত জায়গায় খুজেছি??”

রিঝ বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে রেখেছে অনেকখানি।চোয়ালটা কঠিন করে সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তুতুল বলল,
“ আপু আপনাকে দেখে তো মনে হয় না রিঝ ভাই আপনার বাচ্চা??উনার তো নিজের মাই আছে।আপনার কি রিঝ ভাইয়ের সমান ছেলে আছে??কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব??”

তুতুল গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো।মেয়েটা কেচকেচ করে বলল,
“ বাচ্চা হতে যাবে কেনো??ও আমার দশ মিনিটের বয়ফ্রেন্ড যাকে আমি সারা জীবনের জন্য বয়ফ্রেন্ড বানাতে চাই।”

মোটা ঠোঁটে মেয়েটার হাসি আঁকা।দেখতে অসাধারন।তুতুল সব বুঝলো।বয়ফ্রেন্ড হতেই পারে।কিন্তু দশ মিনিট!!এটা আবার কেমন নিয়ম??রিঝ শান্ত কন্ঠে বলল,
“ দশ মিনিটের জন্য নাটক করতে বলেছিলাম।বাবু বেবী,জানু এসব রাস্তা ঘাটে যেখানে পাবে ডাকতে বলিনি।কি নাম যেনো তোমার??”

মেয়েটা মুখটা মলিন করে বলল,
“ রেয়ানা।ভুলে গেছো বাবু??”
“ সেট আপ।ফাইজলামি পেয়েছো??বাবু বাবুর মানে কি??কোন দিক দিয়ে বাবু মনে হচ্ছে আমাকে??যাও তো এখান থেকে।”
“ আরে তুমি এমন ধমকাও কেনো??আমি তো আদর করে ডাকছি।আচ্ছা আর ডাকবো না।”
“ সামনে থেকে যাও।”রিঝের কঠিন গলা।

এসবের মাঝে তুতুল বেশ মজা পাচ্ছে।রিঝ বিরক্ত হবে এমন সব কাজ এবং কথা তুতুলের বেশ প্রিয়।তুতুল বলল,
“ ও মা তুমি আমাদের ভাবি??ওয়াও কি সুন্দর দেখতে।রিঝ ভাই বুড়া তো হয়েই গেছেন।এবার বিয়ে করে নেন।অনেক দিন বিয়ে খাই না।”

রেয়ানা লুজুক হেসে উড়ন্ত দুই একটা চুল কানের পাশে গুঁজে দেয়।রিঝ ধমকে উঠে।তুতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ বিয়ে খাওয়াবো তোমাকে।বাসায় চলো।টিচার হয়ে বিয়ে খাওয়াবো।”
“ আরে আমি তো মজা করছি।আপনি চেতেন কেনো??আর উনি তো অনেক সুন্দর।বিয়ে করলে কি হয়??”
“ কি হয় সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না।চলো।”

রিঝ উঠে দাড়ায়।তুতুলের হাত টানতে থাকে।তুতুল পিছনে পিছনে তাকায়।রেয়ানা এগিয়ে আসতেই রিঝ দৌড় লাগায়।তুতুলও সাথে দৌড়ায়।রিঝের দৌড়ের গতি অনেক।তুতুল তো পড়েই যেতো।রিঝ যদি হাত চেপে না ধরে রাখতো।পার্কের গেটের কাছে এসে হাঁপাতে থাকে দু’জনেই।তুতুলের রাগ লাগছে খুব।পায়ে ব্যথা হয়ে আছে।এতো দৌড়েছে যে তার মনে হচ্ছে ওজন কমেছে পাক্কা পাঁচ কেজি।রিঝ চোখের চশমা খুলে হাতে নেয়।মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়।তুতুল ঠোঁট উল্টে বলে,
“ এতো সুন্দর মেয়েটাকে ফেলে চলে আসলেন??এর জন্যই বলি আপনি আর ভাইয়া মেয়ে পাবেন না বিয়ে করার জন্য।”
“ আমার প্রয়োজনও নেই।রিঝের কন্ঠে বিরক্তি।
“ আপনি বিয়ে করবেন না??”

তুতুলের কথায় রিঝ প্রচন্ড বিরক্ত।তাই কথা বলছে না।তুতুল রিঝের চারপাশে ঘুরে ঘুরে বলল,
“ ভাইয়া আপনার কি মেয়েদেরকে পছন্দ না??”

রিঝ চোখ তুলে তুতুলের দিকে তাকালো।তুতুল দু’হাত মুখের উপরে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“ আপনার কি ছেলে পছন্দ??”
“ সেট আপ তুতুল।যখন তখন ফালতু কথা।”
তুতুল মুখ টিপে হাসে।রিঝকে অনুকরন করে বলে,
“ শেট আপ তুতুল।যখন তখন ফালতু কথা।”

রিঝ প্রথম থেকেই বিরক্ত।তুতুল তাকে আরো বিরক্ত করছে।রিঝ সামনে হাঁটে।তুতুল হেলে দুলে বলে,
“ রিঝ ভাই!!”
রিঝ থামে।পিছনে ফিরে বলে,
“ অর্ধেক কথা আমি পছন্দ করি না।আর থেমে থেমে বলা তো আরো না।”
“ স্যরি স্যরি।মানে ওই যে মেয়েটা আছে না উনি আপনার দশ মিনিটের মা স্যরি গার্লফ্রেন্ড কিভাবে হলো যানতে চাওয়া তুতুলের মন।”
“ আরে ভার্সিটির একটা অনুষ্ঠানে নাটকের একজন মিসিং থাকায় আমাকে ওর কাজটা করতে হয়েছে ।সেখানে এই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ছিলাম।ডিজগাস্টিং গার্ল।”
______________
আয়শা রহমান চায়ের কাপ হাতে বড় ছেলের রুমের দিকে যাচ্ছেন।ছোট ছেলে এখনো আসেনি।এতো দেরি তো করে না রিঝ!আয়শা রহমান রুমে ঢুকতেই চমকালেন।আনাস এতো সকালে কার সাথে কথা বলছে??পর পরই মনে পরে তার ছেলে তো প্রেম করে!আয়শা রহমান পা টিপে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে।আনাস আহ্লাদি গলায় বলে,
“ এতো সকালে ঘুমটা নষ্ট করা কি খুব দরকার ছিলো লুচি??”

আনাসের গার্লফ্রেন্ডের নাম রুচিকা।আদর করে সবাই লুচি ডাকে।রুচিকা তুতুলের মামাতো বোন।রুচিকা আর আনাসের প্রেমের কথা মোটামুটি সবাই জানে।রুচিকা বলল,
“ এতো ঘুমাই কি করবা??বেশি তালিমালি করলে ব্রেকাপ করে দিমু।”

আনাস ব্রেকাপ শব্দকে খুবই ভয় পায়।তাই রুচিকা বেশি বেশি বলে।পাঁচ বছরের বেশি সময় তাদের সম্পর্কের।এই পাঁচ বছরে আনাসের হয় তো পাঁচ কোটি বার ব্রেকাপ শব্দ শুনা হয়েগেছে।ইদানিং সে আর ভয় পায় না।সে জানে রুচিকা তাকে অনেক ভালোবাসে।আনাস নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ ওই ওই একদম সব সময় এক কথা বলবা না।আমি এখন আর ঔ কথায় ভয় পাই না।”
“ সত্যি সত্যি করবো কিন্তু।”
“ আমি কি বসে বসে ভাত খাবো??আচ্ছা আচ্ছা সকাল সকাল ঝগড়া করতে চাই না।বলো এতো সকালে কল করেছো কেনো??”
“ এমনেই।আজকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাগছে তাই কথা বলতে ইচ্ছা করছে।”

আনাস শব্দ করে হাসলো।উপুত হয়ে শুয়ে বলল,
“ তাহলে একটা মর্নিং কিস দেও।”

“ মায়ের সামনে এমন লাগাম ছাড়া কথা বলতে তোর লজ্জা করে না বাপ??”
পিছন থেকে কথাটা ভেসে আসতেই লাফিয়ে উঠে আনাস।আয়শা রহমান চোখ ছোট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।আনাস জোড় করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ আম্মু তুমি এখানে??”
“ হুম আমি এখানে।তা আর কত প্রেম করবি??এবার বিয়ে কর।তোদের যুগটাই প্রেমময়।আমাদের যুগে ছেলে মেয়ে এক সাথে হাসা হাসি করলেও লোকে আড়চোখে তাকাতো।”

আয়শা রহমান হাসলো।আনাস রুচিকাকে রাখি বলে ফোনটা কাঁটলো।আয়শা রহমান বিছানার চাদর ঠিক করছে।আনাস পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে বলল,
“ বিয়ে তো করবোই।তবে কবে করবো বলো তো??”
“ চল আগামী সাপ্তাহে যাই দেখতে।রুচিকার বাবা মাকে তো আমরা আগে থেকে চিনি।দেখা মানে বিয়ের তারিখ ঠিক করা।তুই ওকে বলে দিস।আমি তোর আব্বুর সাথে কথা বলবো।”

আনাস খুশিতে লাফিয়ে তার মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে গালে চুমু খায়।ছেলের কান্ডে আয়শা হেসে উঠে।কান মলা দিয়ে বলে,
“ হইছে এতো ভালোবাসা দেখাইতে হবে না।ছোট ভাই কোই??”
“ রিঝ জগিং থেকে আসে নাই??”
“ আরে না।প্রতিদিন তো অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসে।আজকে এত দেরি কেনো হচ্ছে??আমি ভাবছি তোরে বলে গেছে।তাই তো জিজ্ঞেস করলাম।”
“ না আম্মু আমাকে কিছু বলেনি।”
আয়শা রহমান একটু চিন্তিত মুখে বলল,
“ কই যে যায় ছেলেটা?তাও এতো সকালে।”
“ আম্মু চিন্তা কারো কেনো??ও কি বাচ্চা না কি??সরো।আমি চা খাই।”

আয়শা রহমান বিছানা ঠিক করে রুম থেকে চলে গেলেন।রুম থেকে মাকে বাহিরে যেতে দেখে আনাস নিজের গেঞ্জি খুলে উড়াধূনা নাচ শুরু করে।প্রেম করলে যে এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিবে তার পরিবারকে না দেখলে সে বুঝতেই পারতো না।খুব খুশিতে মানুষ পাগল পাগল করে।আনাসের অবস্থা এখন তেমন।রুচিকাকে দ্রুত ফোন করে সব বলে।দু’জনেই খুব খুশি।প্রেমে পূর্নতা পেলে অদ্ভুত আনন্দ হয়।
____________________
যাওয়ার সময় দৌড়ে দৌড়ে গিয়েছিলো তারা।তাই বুঝতেই পারেনি পথটা এতো দীর্ঘ।তুতুল ঘুরে ঘুরে হাঁটছে।ভিজা পিছঢালা রাস্তা দারুন লাগছে।প্রকৃতি সুন্দর।মুগ্ধ কর।বাতাসে কোমল গন্ধ।সব জুড়ে একটা স্নিগ্ধ হাওয়া।তুতুল দু’হাত পিছনে দিয়ে সব দেখছে।আজ একমাসেরও বেশি সময় হয়েছে সে বাহিরে এসেছে।সব যেনো নতুন লাগছে তার।রাস্তার পাশে একটা কাছে হলুদ ফুল ঝুলে আছে।তুতুল ফুল প্রেমি।ফুলের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা আছে তার।ফুল দেখলেই ছুঁয়ে দিতে মন চায়।তুতুল রিঝের পিছন থেকে সরে যায়।গাছের কাছে গিয়ে লাফাতে লাফাতে ফুল ছিড়তে চায়।কিন্তু পাড়ে না।হলুদ ফুল।ঝুমকোর মত ঝুলে আছে।দেখতে মারাত্নক।তুতুল নাম জানে না এই ফুলের।ফুলের নাম সোনালু ফুল।তুতুল গাছে উঠতে যায়।অনেক সময় তুতুলের কোনো কথা কানে আসছে না রিঝের।তুতুলের জন্যেই সে হেঁটে হেঁটে আসছে।তা না হলে দৌড়েই চলে যেতো।তুতুল খুব হাঁপিয়ে উঠেছে।রিঝ জানে তুতুল তেমন হাঁটতে পারে না।অল্প একটু হাঁটলেই তার পায়ে ব্যথা করে।সেখানে আজ সকাল থেকে তাকে দৌড়ে বেড়িয়েছে রিঝ।পা আজ আছে কি না রিঝ তো সেটাই ভাবছে।কোনো শব্দ না পেয়ে রিঝ থমকে দাঁড়ায়।পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে অনেক টুকু চলে এসেছে।তুতুলকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না।রিঝ চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখে।তুতুলকে গাছে উঠতে দেখে রিঝ বিস্মিত।দৌড়ে তার কাছে গিয়ে হাত টেনে নিচে নামিয়ে নেয়।রাগ দেখিয়ে বলে,
“ এভাবে গাছে উঠছো কেনো??পাগল হয়ে গেছো না কি??”

কানের পাশ দিয়ে আসা চুলে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে তুতুল বলল,
“ ফুল নিবো।অনেক সুন্দর ফুল।আমার লাগবে।”

চোখ বুজে রাগ দমিয়ে রিঝ বলল,
“ এই সামান্য ফুলের জন্য গাছে উঠছো??কি এমন সুন্দর??দেখতে একদম বাজে।”
“ মোটেও না।নিবো মানে নিবো।”
“ তুমি এখন আমার হাতে চড় খাবা??”

তুতুল বাচ্চাদের মত মুখ করে বলল,
“ আপনি আমাকে মারবেন রিঝ ভাই??এটা আপনি করতে পারবেন??”
“ আমি এমন অনেককে চড় দিয়েই সোজা করে ফেলেছি।তোমাকেও করতাম।কিন্তু তোমার বাপ আর ভাইয়ের হাতে খুন হতে চাই না।তাই চুপ থাকি।সব সময় এসব বাচ্চামু ভালো লাগে না।চলো বাসায়।”

তুতুলের ভারী মন খারাপ হয়।সোজা হাঁটা শুরু করে।রিঝ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাছে উঠে।উঠতে গিয়ে হাতের অনেক অংশ ছিড়ে যায়।তবুও ফুল ছিঁড়ে।তুতুলের এমন গম্ভীর মুখ তার ভালো লাগে না।কোথাও কষ্ট হয় খুব।রিঝের কিছু অদ্ভুত সমস্যা আছে।যেমন:তরমুজ খেলে তার মাথা ঘুরে,ফুলের গন্ধ তার বিরক্ত লাগে।তাই সে পৃথিবীর সকল ফুলকে অপছন্দ করে।আর সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে তুতুলের সাথে রিঝের কোনো মিল নেই।দু’জন দুই রকম মানুষ।একদম ভিন্ন একে অপরের।রিঝ একমুঠো ফুল নিয়ে তুতুলের পিছন পিছন যায়।তুতুলকে বলে,
“ ফুলের মাঝে কি আছে বলবা??”

তুতুল কথা বলে না।হাঁটে নিজের মত।তার এখন ইচ্ছে করছে রিঝের মাথা ইট দিয়ে ফাটিয়ে একটা আনন্দ উৎসব করতে।কিন্তু জেলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও জেলের ভাত খেতে চায় না সে।তাই চুপ থাকা উত্তম।রিঝ হাতের ফুলগুলো তুতুলে সামনে ধরে।তুতুল অবাক চোখে একবার ফুল দেখে আর একবার রিঝের দিকে তাকায়।রিঝ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল,
“ এই বিশ্রী জিনিস আমার হাত থেকে নেও।তা না হলে ফেলে দিবো।”

তুতুল দ্রুত কেঁড়ে নেয়।লম্বা নখের খামচি লাগে রিঝের হাতে।হালকা চামড়া উঠে।তুতুল জিভ কামড়ে বলে,
“ স্যরি স্যরি।”

রিঝ অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।উদ্বোট চাহনী নিয়ে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়।তুতুল ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে,
“ রিঝ ভাইয়া আপনি ফুল এতো অপছন্দ করেন কেনো??”
“ তুমি ফুল এতো পছন্দ করো কেনো??”
“ আগে আমি প্রশ্ন করেছি।”
“ তোমার উত্তরের মাঝেই আমার উত্তর।”

তুতুল ভারী অবাক হলো।তবুও বলল,
“ কারন ফুল অনেক সুন্দর।এর রূপ,রং খুশবু সবই অসাধারন।”
“ ফুলের রূপ রং ঘ্রাণ কোনোটাই আমার পছন্দ না।তাই ফুল আমার অপছন্দ।”
“ বুঝলাম না।এতো সুন্দর জিনিস আপনার অপছন্দ??”
“ তোমারও তো অনেক কিছু অপছন্দ।সবার সব ভালো লাগবে এমন তো কথা নেই।”

তুতুল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ আপনি আজব মানুষ রিঝ ভাই।পৃথিবীর প্রথম প্রানী যার ফুল পছন্দ না।হাও ফানি।”
“ সবাই একুই রকম হলে তো হয় না।কারো মাঝে ভিন্নতা চাই।”

তুতুল হাঁটতে হাঁটতে আবার থামে।এবার নতুন ভুত মাথায় চেপেছে তার।সে সাইকেল চালাবে।রিঝ খুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তুতুলের দিকে।পাশেই একটা সাইকেলের দোকান।ভাড়া দেওয়া হয় ঘন্টা হিসেব করে।রিঝের ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়ে দিতে।তুতুলের কথায় কথায় কান্না।এখন সাইকেল না দিলে সে রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে কাঁদবে টাইপের অবস্থা।মহা বিপদে পড়ে রিঝ সাইকেল ভাড়া নেয়।তুতুল খুশিতে আপন খেয়ালি হয়ে পরে।রিঝ সাবধানের সুরে বলল,
“ ধীরে চালাবা।তুমি কিন্তু অত ভালো পাড়ো না।”
“ কে বলছে??” তুতুলের রাগি কন্ঠ।
“ আমি নিজেই জানি।”
“ আরে আমি এখন অনেক পাড়ি।ছয়মাস আগে আপনি অর্ধেক শিখাইছেন না।এখন পুরা পারি।”

রিঝ তুতুলের পিছনে পিছনে ঘুরে।কখন যে পড়বে সেটাই ভাবছে।সে জানে তুতুল পড়বেই।ফুলগুলো রেখেছে সাইকেলের সামনের ঝুড়িতে।তুতুল যখন মহা আনন্দে সাইকেল চালাচ্ছিলো তখনই সামনে একটা কুকুরের বাচ্চা এসে হামলে পরে।তুতুল বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে ধপ।হাতের কনুই ছিঁড়ে রক্তাক্ত অবস্থা।রিঝ হতবাক।সে জানতো কিছু একটা হবে।কিন্তু একটু বেশিই হলো।রাগে রিঝের এখন চড় থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে।তুতুলকে টেনে তুলতেই সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়।রিঝ ভাবে,হয় তো অনেক ব্যথা পেয়েছে।তাই উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে,
“ বেশি ব্যথা পেয়েছ??কোথায় কোথায় পেয়েছ??দেখাও।”

তুতুল নিচে বসে পরে।রিঝ চারপাশে চোখ বুলায়।দেখে কেউ আছে কি না।খুব সকাল তাই কেউ নেই।রিঝ নিচে হাঁটু গেড়ে বসে।তুতুলকে বুঝায় কান্না থামাতে।কোথায় ব্যথা পেয়েছে বলতে।তুতুল কাঁদে নিজের মুখ লাল করে ফেলেছে।চোখের ঘন পাপড়ি পানিতে চুপ চুপ।রিঝ খুব উত্তেজিত,চিন্তিত।বুঝেই উঠতে পারছে না ব্যথা কোথায় পেয়েছে।কিছু সময় পরে তুতুল হাত দিয়ে ফুল দেখায়।কিছু ফুল নষ্ট হয়ে গেছে।তুতুল শব্দ করে কেঁদে বলে,
“ রিঝ ভাইয়া আমার ফুল!!”

রিঝ মাথায় হাত দিয়ে বসে।এবার তার মনে প্রানে বিশ্বাস হচ্ছে এই সেই পুরানো তুতুল।ভয়ংকর তুতুল।রিঝ কিছু সময় শুধু তাকিয়েই থাকে তুতুলের মুখের দিকে।তুতুল কান্না থামায়।চোখ মুছতে মুছতে বলে,
“ এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি কান্না করা যায়??অন্যদিকে তাকান আমি কাঁদবো।”

তুতুল নাক টেনে কাঁদে।রিঝ হতাশ গলায় বলল,
“ সামান্য ফুলের জন্য এতো বড় মেয়ে হয়ে তুমি কাঁদছ??আমাদের রায়হান ও তোমার থেকে বড়।বাচ্চামুরও লিমিট থাকে।জীবনেও তুমি বড় হবা না??”

রাগি কন্ঠে তুতুল বললো,
“ আমি আপনার বুকের কাছে পড়ি।আপনি অনেক লম্বা খাম্বা।তা না হলে আমি তো আপনার সমানই হতাম।একদম বাচ্চা বলবেন না।ফুল গুলো কত কষ্ট পাইছে বলেন??”
“ তুতুল তোমার হাত ছিঁড়েছে দেখাও।নিষেধ করলে ওই জিনিস তুমি আরো বেশি করো।থাপড়ে সোজা করে দিতে ইচ্ছে করছে।”

রিঝ হাত টেনে নেয়।কি করবে ভাবে।তুতুল কাঁদে।রিঝ ধমকের সুরে বলে,
“ চুপ।আমার ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় ইট দিয়ে বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলি।কেনো যে তোমাকে একটা চড় মারতে পারি না?”

রিঝ দীর্ঘশ্বাস নেয়।তুতুল নাক টেনে টেনে বলল,
“ রিঝ ভাই ওই দিকে ইট দেখা যাচ্ছে আমি নিয়ে আসি??”

রিঝ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কেনো??”
“ আপনি না বলছেন আপনার ইচ্ছে করছে মাথা ফাটাইতে??তাই নিয়ে আসলে সুবিধা হবে।আপনার কষ্ট করে খুঁজতে হবে না।”

রিঝ চোখ বুজে বসে থাকে।নিজের চুল টেনে ধরে।ইঞ্জিনিয়ার না নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে তার।তুতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।আর ভাবে,সে কি ভুল কিছু বলেছে??

#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here