কৃষ্ণবেণী পর্ব -০৫

#কৃষ্ণবেণী
#পর্ব_৫
#নন্দিনী_নীলা

লিয়া যখন তৃষ্ণা কে নিয়ে ড্রইং রুমে আসলো। তখন আবার তৃষ্ণা দেখতে পেল জায়ান সেই মেয়েটার সাথে বসে আছে গা ঘেঁষে। তৃষ্ণা রাগে মুখ ফিরিয়ে নিতেই দেখতে পেল ওর পাশে জায়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে ছোট একটা পার্স ছিল। চমকে সেটা হাত থেকে ফেলে দেয়। ও চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নেয় বিষ্ময়ে। আল্লাহ, আমি এক মানুষ দুই জায়গায় দেখছি কি করে? বন্ধ চোখের পাতা কুঁচকে ভাবল তৃষ্ণা। অতঃপর ভুল দেখেছে ভেবে পিটপিট নজরে তাকাল। ভুল দেখছে এমন একটা ভাব করে আবার সোফার দিকে দৃষ্টি ফেলল। জায়ান বসে আছে ওইতো। কত বড়ো খারাপ লোক। ভাবা যায়? এক ব‌উয়ের সামনে আরেক ব‌উয়ের গা ঘেঁষে বসে আছে। উনার সাথে এখন আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
ভাবতেই হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে।

তখনই পাশ থেকে ভরাট কন্ঠস্বর ভেসে এলো। তিনি উঠলেন,”থম মেরে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো।”
জায়ানের কন্ঠ পাশ থেকে আসতেই তৃষ্ণা আবার তাকাল চক্ষু কপালে তুলে। সামনে ও পাশে কয়েক পলক চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে থমকে গেল তৃষ্ণা।
তোতলাতে তোতলাতে বলল,” ওইটা কে?”
জায়ান বললেন,”আমার এক মিনিটের ছোট ভাই‌। পাশে ওর ওয়াইফ।”
তৃষ্ণা চক্ষু ভরা বিষ্ময় নিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মিল! ওর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ও আর প্রশ্ন করতে পারল না। যেতেও পারছে না। জায়ান ওর অবস্থা দেখে নিজেই হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো।
তৃষ্ণা গাড়িতে বসে বলল,,”আপনার যে জমজ আরেকটা ভাই আছে জানতাম না তো।”‌বিষ্ময় ভরা কন্ঠস্বর ওর।
জায়ান বললেন,” এখন তো জানলে। শ্বশুর বাড়ি আসার ২-৩ দিনেই আর কত কিছুই বা জানতে চাও? একদিনে সব জানলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আস্তে ধীরে জানো মজা পাবে।”
তৃষ্ণা বোকা চোখে তাকিয়ে র‌‌ইল। কিসের মজা? তারা কি মজা দেখানোর কাজ করে নাকি! মুখটা ভোঁতা করে বসে র‌ইল।

গ্রামে পৌঁছাতেই পারা প্রতিবেশীর সবাই ওদের দেখতে চলে আসলো। এতো ধনী পরিবারের বিয়ে দিয়েছে মেয়ে। মেয়ের জামাই কি নিয়ে আসছে দেখার জন্য সবাই হা করে তাকিয়ে আছে।
তৃষ্ণা গাড়ি থেকে নেমে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই এমন ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে যেন ও এখন নিজের গ্রামের মহারানী। সবাই প্রজা ওকে আমন্ত্রণ জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। ও নিজের পরিবারের মানুষ ও আপনদের খুঁজছে। কিন্তু ওর চোখে শুধু যারা ওকে অপছন্দ করতো। তাদের দেখা যাচ্ছে। ভীড় ঠেলে তৃষ্ণার বাবা এসে দুজনকে নিয়ে গেল।
ওরা খালি হাতে চলে গেল ভেতরে, তা দেখে পারা প্রতিবেশীর সবাই ফিসফিস করতে লাগল। এত ধনী বাড়িতে বিয়ে দিলো তারা কিনা খালি হাতে এসেছে? এর থেকে তো পাশের বাড়ির রুমার জামাই ভালো ভ্যান চালায় তাও শ্বশুরবাড়ি আসলে জিলাপি নিয়ে আসে। সবাই এসব লেখিকা নন্দিনী নীলা বলছিল তখনই গাড়ি থেকে ড্রাইভার বেরিয়ে আসে তার হাতে দুইটা বড়ো সড়ো ব্যাগ। একটায় মিষ্টির প্যাকেট অনেক গুলো। এতো যে ড্রাইভার একা নিয়ে যেতে পারছে না। এতো মিষ্টি এনেছে যে মনে হচ্ছে সারা এলাকার মানুষকে খাওয়াবে। সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। একজন এগিয়ে সাহায্য করল তাকে।

বকুল বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে সবার দিকে। ওর খুব আনন্দ হচ্ছে সবাই কেমন ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে আছে। ও দেখতে পেল সত্যি সুজন এসেছে ওকে আর পায় কে ছুটে সুজনের কাছে গিয়ে ভেতরে আসতে বলল।
সুজন কে দূরে বসা কাঠের চেয়ারে থাকা জায়ান কে দেখালো। জায়ান খুব রাজকীয় স্টাইলে বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে। মুখশ্রী যথেষ্ট গম্ভীর করে। কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক দুই একবার তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে ফোন হাতে।
” দেখেন বুবুর জামাই। আমার দুলাভাই সুন্দর কত।” গর্ববোধ করে বলল।
সুজন বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,” হ রে ঠিক ক‌ইছিস। তৃষ্ণা অনেক সুন্দর জামাই পাইছে। আমারে একটু তৃষ্ণার লগে কথা বলিয়া দিবি?”
” ক্যান আমার বুবুর লগে আপনের কি কথা?”
” ও তো আবার শহরে চ‌ইলা যাইবো গা।‌ তাই কথা বলতেই চাইছিলাম একটু । আবার কবে আসবে দেখা তো আর হ‌ইবো না মনে হয়।”
” আইচ্ছা দেখি বুবুরে বলবো নি। যদি দেখা করতে চায় তাইলে দেখা ক‌ইরেন।”
সুজন চলে যেতে ধরল বকুল বাধা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল মিষ্টি আনতে। সুজনের হাতে মিষ্টি দিয়ে হাসলো। আর বলল,” আমার দুলাভাইয়ের আনা মিষ্টি খান।”
সুজন নিবে না বলেও নিল।
তারপর চলে গেল যাওয়ার আগে আরেকবার জায়ানের দিকে চেয়ে ছিল। জায়ান তখন চোখে সানগ্লাস পরে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল।

তৃষ্ণা রাগ করে চলে গেছিলো তাই এখন মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে। এই তিনদিন কি কষ্টে ওর কেটেছে ও বুঝাতে পারবে না। তৃষ্ণার মা মেয়েকে শান্ত করে মেয়ের জামাইকে ঘরে নিয়ে এলো। জায়ান কে তৃষ্ণার রুমে বসিয়ে পিঠা এনে দিলো তৃষ্ণার হাতে। তৃষ্ণা পিঠা হাতে আসল। জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে পিঠার দিকে।
” কি হয়েছে ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?”
” এগুলো কি?”
তৃষ্ণা চোখ বড়ো করে বলল,” আপনি পিঠা চিনেন না?”
” পিঠা চিনব না কেন?”
” তাহলে এগুলো কি বলছেন কেন?”
” আমি এই পিঠা আগে কখনো খাইনি।”
” ওহ।” বলেই তৃষ্ণা হাতের তিন পদের পিঠার নাম বলল জায়ান কে। জায়ান নারিকেল দিয়ে বানানো পাকন পিঠা হাতে নিল। তৃষ্ণা তাকিয়ে ছিল ওর কেন জানি মনে হচ্ছে জায়ান পিঠা খেতে চাচ্ছে না। কিন্তু ওর সামনে সেটা বলতে পারছে না। ও ঠোঁটে হাসি টেনে কামড় বসালো।
” কেমন?”
” ভালোই।”
” আরেকটা খান।”
” ভালো লাগবে না ভেবেছিলাম কিন্তু ভালোই‌ কিন্তু আর খাব না। কারণ আমি তৈলাক্ত খাবার খাবার কম খাই।”
” আমরা গরীব বলে। আমাদের বানানো পিঠা খেতে আপনার ঘৃণা করছে?”
তৃষ্ণার কথা শুনে জায়ান চমকিত চোখে তাকাল।
” আমি এটা কখন বললাম?”
” মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। খেতে কত অস্বস্তি বোধ করছেন। যেন নর্দমার ময়লা এনে দিয়েছি।”
” বেশি বুঝ।”
তৃষ্ণা প্লেট হাতে চলে গেল।

তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পারে। বকুল ওকে নিয়ে এসেছে। তৃষ্ণা সুজনের কথা শুনেই রাজি হয়ে গেছে। এলাকার ভাই আগে দেখা হলেই সুজন ওর খোঁজ খবর নিতো। সেই সুবাদে রাজি হয়েছে ও তো আর জানে না সুজনের মনে ওর জন্য ভালোবাসা আছে। ও সাদা মনেই এসেছে। কিন্তু কে জানতো এখানে আসা ওর জন্য বিপজ্জনক হবে। বকুল তৃষ্ণা কে আর সুজন কে কথা বলতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল ঢেড়শ ক্ষেতে। মা নিতে বলেছিল।
তৃষ্ণা কে দেখে সুজন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণার গলায় স্বর্ণের গহনা, গায়ে দামী শাড়ি। কি সুন্দর লাগছে তৃষ্ণা কে। লম্বা চুল বেনি করে পিঠে ফেলে রেখেছে।
তৃষ্ণা হাসি মুখে বলল,” কেমন আছো সুজন ভাই?”
সুজনের বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করল না‌। বুকের চাপা ব্যথা বুকেই চেপে রেখে মুখে জোর পূর্বক হাসি এনে বললেন,” আছি। তুমি খুব সুখেই আছো তাই না? কত বড়লোক বাড়ি বিয়ে হয়েছে। সুখে তো থাকবেই।”
” আমার ভাবনার থেকেও তারা বেশি ধনী জানো সুজন ভাই। কিন্তু তারা আমার মতো গরীব মেয়েকে কেন ব‌উ করল?”
” তোমার সৌন্দর্যের সামনে ধনীর দুলালি মেয়েরা ও হার মানবে। তোমার রুপ তোমাকে রাণী করল তৃষ্ণা।”
” সুজন ভাই তোমার কথা কেমন জানি লাগছে। আগে তো আমার এত প্রশংসা করোনি কখনো।”
“অন্যের বউ হয়েছো বলে কি এখন আর প্রশংসা করা যাবে না?”
“সেটা কখন বললাম। আগে তো কখনো আমাকে সুন্দর বলে নি তাই বললাম। আমি তাহলে আসি ভালো থেকো।”
বলেই তৃষ্ণা চলে যাবার জন্য পেছন ঘুরতে যাবে। তখনি সুজন তৃষ্ণার হাত ধরে ফেলে ফট করে। তৃষ্ণা চমকে সুজনের দিকে তাকায়। সুজনের চোখ ছল ছল করছে। অসহায় মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা সুজনের এমন ব্যবহার দেখে হতভম্ব। চোখ কপালে তুলে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

” কি করছো সুজন ভাই। হাত ছাড়ো।”
সুজন হাত ছাড়ল না। উল্টো শক্ত করে ধরে বলল,” তোমারে ছাড়া আমি খুব কষ্ট আছি তৃষ্ণা। তোমার বিয়ে হ‌ইছে তারপর থেকে আমি এক রাত ও ঘুমাতে পারি নাই। ওই বড়লোক স্বামী পেয়ে এই গরীব সুজন রে ভুলে গেলে এই ভাবে?”
তৃষ্ণার চক্ষুদ্বয় বিষ্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে গেল। কি বলছে এসব সুজন ভাই?
কেন বলছে? পাগল হলো নাকি?
” তুমি কি বলছো এসব?”
” আমি তোরে খুব ভালোবাসি রে তৃষ্ণা। তুই ও তো আমারে ভালো বাসতি। তাইলে কেন বড়লোক বাড়ি পেয়ে আমারে ভুলে গেলি?”
“সুজন ভাই তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। কি সব বলছো? তুমি আমায় ভালবাসতে? কই আগে তো কখনো বলোনি! আর আমি তোমারে ভালবাসি কবে বলেছি? কেন এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছো? হাত ছাড়ো আমার।”
সুজন হাত না ছেড়ে ভালোবাসার কথা বলে যাচ্ছে। তৃষ্ণা ছটফট করছে ছাড়াতে। কি বিপদে পরল! কেন যে আসতে গেল!
সুজন ভাই এমন পাগলামী করবে জানলে কখনো আসতো না তার সাথে দেখা করতে।
দুজনে দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের তর্ক বিতর্ক নিয়ে। তখন সেখানে আগমন ঘটে জায়ান এর। জায়ান এক টানে সুজনের থেকে তৃষ্ণার হাত ছাড়িয়ে নেয়। তৃষ্ণার কাঁধে এক হাত রেখে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে সুজনের দিকে তাকায় রাগী চক্ষে। সুজন জায়ানের রাগী দৃষ্টি দেখে ভয়ে চুপসে গেছে।
তৃষ্ণা কিছু বলতে যাবে তার আগেই জায়ান সুজনের হাত ধরে টেনে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দেয়। হতভম্ব তৃষ্ণা একবার জায়ান ও একবার সুজনের দিকে তাকায় বোকা চক্ষে। অতঃপর ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠে,,”এটা কি করলেন? সুজন ভাই তো সাঁতার জানে না। তিনি পানিকে ভয় পায়। তাড়াতাড়ি তাকে উঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে নাহলে তো মারা যাবে।”

জায়ান বললেন,”চুপ।”
বলেই টেনে তৃষ্ণা কে টেনে বাড়ি নিয়ে এলো। টিউবলের কাছে বালতি ভর্তি পানি ছিল। সেই পানিতে তৃষ্ণার যে হাত সুজন ধরেছিল সেই হাত ডুবিয়ে ধরে ঘষতে লাগল।
“এসব কি করছেন? হাত জ্বলছে। ওদিকে সুজন ভাই মরণাপন্ন। তাকে কি মেরে ফেলতে চান?”
জায়ান নিষ্ঠুর গলায় বললেন,” সে মরে গেলে আমার কি? বিপদজনক মানুষ বেঁচে না থাকায় বেটার।”

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here