খেসারত পর্ব ৩

#খেসারত #তৃতীয়_প্রহর
#Yasira_Abisha #Fatha

“বিয়ের আগে আমি একটা সন্তান পেটে ধরেছিলাম,, নিজের বয়ফ্রেন্ডের ভালোবাসা পাওয়ার আশায় তার অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছিলাম”
এইসব কথা অন্য একটা ছেলে কে বলতে হবে নিজের মুখে,, যে কি না আমারই বোনের দেবর হয়,
এগুলো কতটা বেশি লজ্জাজনক তা শুধু মাত্র আমিই জানি,
কারণ যে এইসব পরিস্থিতির মধ্যে না পরে সে মেয়ে এগুলো বুঝতে পারবে না,
আমি এত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধু মাত্র নিজের বোন আর পরিবারের সম্মান টুকু ঠিক রাখার জন্য,
এগুলো ভাবতে ভাবতেই ছাদের দিকে যাচ্ছিলাম,,
এমন সময় দরজা খুলে আমি কিছুক্ষনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাই,
কারন আমি চোখে যা দেখছিলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, দরজা খোলার সাথে সাথে সামনে দেখি রিশাদ ভাই এর সাথে আমার বয়ফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে আছে,, এবং তারা হেসে হেসে কথা বলছে,,
আমাকে দেখে রিশাদ ভাই হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
– ভালো আছো রুহি?
আমার মুখে তো কোনো কথাই আসছে না,, ভয়ে কলিজা পর্যন্ত কেপে উঠছে,, ইরাদ কেন এসছে এখানে? ও কি চায়? আজ তো আমাকে ফিরিয়েই দিয়েছে যখন বলেছিলাম বাবা মা আমাকে রিশাদ ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায়,, তখন ওরকম করে,, আজ এখানে কেন? আর রিশাদ ভাইয়ের সাথেই বা কেন? ও কি চায়? আর আমার বাসায়ই বা কেন এসেছে?
এত গুলো কথা আমার মাথায় ঘুরছে,, এমন সময় আমার মুখে কোনো উত্তর না পেয়ে রিশাদ ভাই আবার বললেন,,
– উত্তর দিবে না?
আমার তো ভেতর থেকে কোনো ধরনের আওয়াজই বেড় হতে চাচ্ছেনা এমন লাগছে, মনে হচ্ছে বাক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি,
কিছুক্ষন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে খুব কষ্টে গলায় চাপ দিয়ে উত্তর দিলাম
-জ… জ্বি ভাইয়া ভালো,
ইরাদ সেখানে চুপচাপ করেই দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে চোখ তুলে দেখেও নি একবার, আর কোনো কথা ও বলছেনা,,
রিশাদ ভাই বললেন,,
-এসো ভিতরে বসেই কথা বলি সবাই,
আমু ভাবছি বাবা মা ইরাদকে দেখলে কি বলবে?
কি বলে পরিচয় করাবো ওকে?
আর রিশাদ ভাই ওকে কেন নিয়ে আসছে এখানে?
আমি গেইটে দাঁড়িয়ে আছি দেখে রিশাদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
-কি বেয়াইন সাহেবা ভেতরে আসতে দিবেন না আমাদের??

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালাম এরপর সরে গেলাম দরজা ছেড়ে,,
ইরাদ- রিশাদ ভাই তুমি যাও মা বাবা এসে পরেছে নিচে মনে হয়,, আমি একবারে নিয়ে আসি,,
আমি একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম,,
হচ্ছে কি আমার সাথে?
রিশাদ- আচ্ছা,,
এই বলেই ইরাদ নিচে নেমে গেলো,,
রিশাদ ভাই ভিতরে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন,,
-বেয়াইন আজকে তো আপনার খুশির দিন, হাসি খুশি থাকবেন
আমি মনে মনে বললাম
-আল্লাহই জানে কি হতে যাচ্ছে, কিসের খুশি হবো আবার আজকে,

কিছুক্ষণের মধ্যে ইরাদের মা বাবা ও আসলেন,,
তাদের দেখে আমি সালাম দেই,
এমন সময় মা বাবা ভেতরের ঘর থেকে বাইরে আসে,,
এমন সময় ইরাদের মা আমাকে দেখে বলেন
-মাশআল্লাহ! মেয়ে ভারী মিষ্টি,,
-দেখতে হবে না পছন্দ কে করেছে??
আর এদিকে আমার বাবা মা আর আমি, আমরা কেউ কিছুই বুঝতে পারলাম না কি হচ্ছে,,
ইরাদ এসে মা বাবাকে পায়ে ধরে সালাম করলো,
মা বাবা তাদের সবাইকে বসতে বললেন,
সবাই চুপচাপ করে সোফায় বসে আছে, আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে একদম,
নিরবতা ভেঙে ইরাদের বাবা আমার বাবাকে বললেন,,
– ভাই আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি, তাই ভণিতা না করে, আমি কথা গুলো আপনাকে বলে দেই, আমাদের ছেলে মেয়ে নাকি একে অপরকে ভালোবাসে,, তাই আপনার মেয়ের হাতটা চাইতে এসেছি আমার ছেলের জন্য,,

বাবা প্রথমেই আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,
– উনারা যা বলছেন এগুলো কি সত্যি??
আমার খুব ভয় লাগলো তারপর ও সাহস হলে ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,,
-হুম
মা বাবা রিশাদের দিকে তাকিয়ে আছে,, রিশাদ ভাই তখন বললেন,,
– আংকেল ইরাদ অনেক ভালো একটা ছেলে রুহির কলেজ যেখানে ছিলো ওখানেই ওদের বাড়ি,, ওর নিজের ব্যাবসা আছে এবং আমাদের অনেক আগে থেকেই ব্যাবসার ম্যাধমে পরিচয়,, আপনি নিশ্চিত হয়ে রুহিকে ওদের ঘরে বউ করে দিতে পারেন,
মা বাবা তো অবাকের ওপরে অবাক হচ্ছে,
ইরাদের বাবা একটা বায়োডাটা এগিয়ে দিলেন আমার বাবার দিকে,,
এবং আবারো বললেন,
– আমার ছেলের সব কিছু এইখানে লিখা আছে ভাই,আপনি পড়ে দেখেন ভালো লাগলে অবশ্যই জানাবেন,
বাবা মায়ের কাছে তাদের হাসিমুখে কথা বলাটা খুব ভালো লাগলো যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে,
মা এর মাঝে আপুকে ফোন করে দিলো, আপুর বাসা অনেক কাছে হওয়ার কারণে তারা মিনিট পাচেক এর ভিতর চলে আসলেন,,
ইরাদের মা আমাকে ডেকে তার পাশে বসালেন,, টুকটাক কথা বললেন
মা সবাইকে নাস্তা দিয়ে ঘরে গেলেন,,
কিছুক্ষণ পরে বাবা বললেন সবাইকে বসতে এবং উনি আপু ঘরে গেলেন,,
তাদের পিছু পিছু আবার রিশাদ ভাই ও চলে গেলেন,,
আমি শুধু ভাবছি ওই ঘরে কি হচ্ছে,,
ভয়ে আমার যায় যায় অবস্থা হয়ে গেছে,,
এসি চলছে এর মধ্যেও ঘেমে একাকার অবস্থা আমার,,
বাবা ঘর থেকে প্রসস্থ একটা হাসি দিয়ে বেড় হলেন,,
এবং এসে বললেন,,
– ভাই আমরা এই প্রস্তাবে রাজি,,
ইরাদের বাবা মা আলহামদুলিল্লাহ বললেন,,
ইরাদের মা বললেন,,
– ভাই তাহলে আগামী সপ্তাহে কি আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারি?
আমার মা বললেন,,
– আপা এত তাড়াতাড়ি?
– জ্বি আপা,, আমার কোনো মেয়ে নেই বউ মা ঘরে এলে,, মেয়ের অভাব ঘুচবে আমার।
এভাবে কথা বলে ফাইনাল হলো সামনের সপ্তাহে বিয়ে হবে,,
এসব ঘটনা ঘটে গেলো মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টার মধ্যে, কথা পাকা হওয়ার পরে তারা চলে গেলেন,
মা বাবা অনেক বলেছিলেন একসাথে খাওয়া দাওয়া করার জন্য কিছু ইরাদের ফ্যামিলির কেউ রাজি হয়নি, তাদের একটাই কথা বিয়ের সময় সব হবে, এসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার আমি খুব খুশি হলাম,, মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি,, এত দিন পরে খুশি লাগতে শুরু করলো,, এত বছর পর মনে হচ্ছে আমার হৃদপিণ্ডটা আমারো চলতে শুরু করেছে, আমিও মানুষ, আবেগ গুলো আবারো উকি দিচ্ছে মনের গহীনে,
ভেবেছিলাম হয়তোবা মা বাবা বকা দিবে,
কিন্ত তারা কিছুই বললেন না,, বরং সবাই অনেক খুশি,,
রিশাদ ভাই অনেক বেশি উপকার করেছেন তা মানতে হবে,, উনিই সবাইকে ম্যানেজ করেছেন,,
আর ইরাদের সাথে যে উনার আগে থেকেই পরিচয় সেটা ইরাদ আমাকে বলেনি,, কেন বলেনি জানিনা,
এটা অবশ্য পরে জানলেও হবে তবে রিশাদ ভাইকে একটা ধন্যবাদ না দিলে হবেনা,
আপুরা এখনো যায়নি
রিশাদ ভাই বারান্দায় বসে আছে
ভাবছি আমি গিয়ে একটা ধন্যবাদ তো জানাতেই পারি।
যেই কথা সেই কাজ, চলে গেলাম উনাকে ধন্যবাদ জানাতে,,
-আসতে পারি?
– হ্যাঁ আসো,
– কংগ্রাচুলেশনস
– থ্যাংকস টু ইউ, আসলে আপনি না থাকলে…
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি তুমি এখন বলবা আমি না থাকলে এগুলো হতো না, অনেক উপকার করেছি তোমার যা তুমি জীবনেও ভুলতে পারবেনা, কিন্তু আমাকে এত মহান বানানোর কোনো দরকার নেই, কারণ এসবই আমি নিজের স্বার্থে করেছি,
– আপনার স্বার্থ?
– হুম, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি অনেক, আমার তোমাকে বিয়ে করা আমার সম্ভব না এটাই আজকে বলতে আসছিলাম, পথেই ইরাদের সাথে দেখা ও তখন আমাকে বলে যে আমি কোথায় যাচ্ছি, আমার বাসায়ই নাকি যাচ্ছিলো আমাকে খুজতে আমার সাথে জরুরি কথা বলার আছে,,
তখন কথায় কথায় সব কথা এসে গেলো আর আমি চিন্তা করলাম,, যেহেতু ইরাদকে আমি চিনি ও কেমন আর তোমাকেও চিনি তাহলে তো তোমাদের এক হওয়ায় একটা ছোট সাহায্য করতে পারি, ব্যাস বাকি ঘটনা তোমার সামনেই।

সব গুলো কথা শুনে ভালো লাগলো অন্তত পক্ষে ইরাদ আমাকে ভালোবাসে এটা বুঝতে পারলাম,আমাকে নিয়ে ওর চিন্তা হয় তাও বুঝতে পারলাম।

.

আরো অবাক হলাম যখন ইরাদ বাসায় গিয়ে একটা মেসেজ দিলো আমি যেন তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পরি,, খুব ভালো লাগলো ওর এই যত্নটা,,
আজকের রাতটা অনেক দিন পর এলো আমার জীবনে, কত রাত ঠিক মত ঘুমাইনি,, আজ একটা আনন্দের অনুভূতি নিয়ে ঘুম দিলাম।
ঘুম ভাংলো ১১টায়, একটু বেশিই ঘুমিয়ে পরেছি ক্লাসেও আজ আর যাওয়া হলো না,

আমাকে উঠতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,
– উঠেছিস?
– হ্যাঁ মা, আজকে দেরি হয়ে গেলো। ক্লাসেও গেলাম না,,
– কিছু হবেনা রে মা আর মাত্র কয়েক টা দিন বাসায় আছিস ঘুমিয়ে নে ক্লাস পরে,
বাবা পাশ থেকে বললেন,
– শুনো আমাদের মেয়ের ভাগ্য ভালো, কাল দেখলে না ওর হবু শাশুড়ী ওকে কত আদর করলো, তোমার মেয়েকে না ঘুম পাড়িয়ে রাখবে না তারা,
মা তখন বললেন,
– নিজের পেটে ধরেছি মেয়েকে আমার চিন্তা কি আর আপনি বুঝবেন?
অনেক মমতা মাখা কন্ঠে কথাটা বললেন মা,
-কেন মেয়ে কি আমার না?
– আপনার ও অবশ্যই, কিন্তু একটা মা বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে, কত রকম পরিকল্পনা করে, নাড়ির ছেরা ধন এরা, মায়ের ভালোবাসা আর চিন্তা বাবারা কি আর বুঝবে? সন্তান পেটে থাকার সময় ওকে আগলে রাখার একটা টেনশন কাজ করে, এটা মায়েদের বেশি হয় বাবাদের থেকে,
প্রতিত্তোরে বাবা বললেন মা কে,,
-আচ্ছা আচ্ছা আপনি জিতলেন আমি হারলাম,,

কথা গুলো কেমন যেন আমার কলিজায় লাগছে, সেখানে আর বসে থাকতে পারলাম না আমি
আমার চোখে পানি চলে এলো,
তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে চলে এলাম,,
দরজা আটকে খুব কান্না করলাম,,
কানের কাছে সব গুলো কথা বারবার বারি খাচ্ছে, অনেক খারাপ লাগছে আমার
এভাবে আমার চোখে পানিটা কেন এলো বুঝলাম না, বাচ্চাটাকে আমি এই দুনিয়ার আলো দেখার আগেই শেষ করে দিয়েছি দেখে একটা অপরাধবোধ থেকে এমন হলো?
নাকি মায়ের প্রতি ভালোবাসায় কান্না চলে এলো?
ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি,

( চলবে..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here