গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ১৩

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_১২

তিশা চুপচাপ তাকিয়ে আছে আর চোখ দিয়ে পানি ঝড়াচ্ছে। মাথার কাছে রাহা বসে আছে, আর বাড়ির কয়েকজন মহিলাও বসা। সবার মনে এক প্রশ্ন এই ভরা বাড়িতে এমন কাজ কিভাবে হলো? কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পেল না। এমনকি তিশাও চেঁচামেচি করলো না।
সারা রাতে নির্ঘুমে কাটিয়ে দেয় অনেকে। আশেপাশের বাড়িতেও জানাজানি হয়। রায়হান শুনে অনেকটা ঘাবড়ে যায় প্রথমে, যখন জানতে পারে রাহা ঠিক আছে তখন নিশ্চিন্ত হলেও তিশার জন্য খারাপ লাগে। কিন্তু পরবর্তীতে ভাবে তিশাই কেন এসবে জড়ালো! কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু চোর /ডাকাত হলে তো অন্য কথা।

তাসলিমা বেগম ও তাঁর বোন সকালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। কোনোরকমের রাত কাটিয়েই সকালে আলো দেখার মধ্যেই বাড়িতে আসেন। কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা, এই এতিম মেয়েটার সাথেই এসব হয় কেন? বাবা-মা নেই, খালার বাড়িতে বড় হয়েছে। এই এতিম মেয়েটিরই সবকিছু শেষ হতে হল!

তাসলিমা বেগমের ছোট বোনের মেয়ে তিশা। বোনের জামাই মারা যাওয়ার দুই বছর পরেই তার বোনও মারা যায়। তার বোনের মৃত্যুর পরে তিনিই তিশার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। তাসলিমা বেগম নিজের মেয়ের মতোই তিশাকে রাখেন। কিছুদিন পরে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝতে পারেন রোহানের সাথে হয়তো তিশার কিছু আছে। কারণ রোহানকে দেখলেই তিশার অন্যরকম পরিবর্তন, চলাফেরা সবকিছু আলাদা। নিজেরও সম্মতি ছিল তিশাকে নিজের ঘরেই রাখবে। নিজের হাতে, নিজের মনের মতো করে গুছিয়ে রাখবে। কিন্তু তাঁর সমস্ত ধারণা, ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো রোহান। তিশার এমন ঢলাঢলি রোহানের মোটেই পছন্দ ছিল না, কথায় কথায় ধমক দিতো। এমনকি শেষ পর্যন্ত বাপ-ছেলের পছন্দ মতো অন্য মেয়েকে ঘরের বউ করে এনেছে।

বাড়িতে এসে এসব কান্ড দেখে রোহানও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তাসলিমা বেগম ও মাহতাব খন্দকারের সাথে এই প্রথম সম্মুখে রেগে কথা বলে রোহান। এই দু’টো মেয়েকে রাতে একা ঘরে রেখে তাঁরা অন্যের বাড়িতে গেছে! রোহানের কথার জবাবে তাসলিমা বেগম কিছু বললেন না। তিনি তিশার পাশে বসে কান্না করছেন, মেয়েটার কিসব সর্বনাশ হয়ে গেল।
ঘরের কয়েকটি জিনিস এলোমেলো, হয়তো চুরির ধান্দায় আসছিল এবং সাথে তিশাকে একা পেয়ে এমন কান্ড ঘটিয়েছে।
এবারে রাহা’র সাথে রাগারাগি শুরু হলো, তিশাকে একা রেখে অন্য ঘরে এত রাতে গিয়েছিল কেন! তাসলিমা বেগম চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেন। তখনি সাহেলের মা সবকিছু বলেন। রাহাও বলে তিশাকে ঘরে দেখেনি তখন। রাহার কথা কে কতটুকু বিশ্বাস করলো জানা নেই। তবে তাসলিমা বেগম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
সবকিছু রাহার বুদ্ধি। তিশার ক্ষতি করার জন্য রাহা ওর নাগরদের ভাড়া করে এনেছে।
এবারে রোহান প্রতিবাদ করলো,
সমস্যা কি তোমার মা? সবকিছুতেই রাহাকে টানতে ইচ্ছা করে? তোমার তিশার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আগে দেখো তারপরে অন্যকে দোষ দিয়ো। তাছাড়া তিশার কথার জন্যই তো হঠাৎ বেড়াতে গেলে। এত ভাল কিভাবে হয় একজন মানুষ রাতারাতি? যে কিনা কখনো রাহাকে সহ্যই করতে পারেনা, সে যখন বললো রাহার সাথে থাকতে পারবে তুমি অন্য বাড়িতে যাও, সবকিছু বিশ্বাস করে চলেও গেলে?
তাহলে সবকিছুর যোজন-বিয়োজন কেন করছো না? তাছাড়া সবাইকে তিশা নিজেই পাঠালো, আবার তিশার নিজেরই ক্ষতি হয়ে গেল। ব্যাপারটা অন্যরকম লাগছে না?

রোহানের কথাশুনে তাসলিমা বেগম বললেন,
এই সময়েও তোর বউয়ের গুণ গাইছো? এই মাইয়ায় সবকিছুতে আছে।তোরে তাবিজও করছে এই মাইয়ায়। আমার তিশার সর্বনাশও এই মাইয়ায় করাইছে। তাসলিমা বেগমের কথায় রোহানের জবাব,
রাহা! জামা-কাপড় যা আছে সবকিছু গুছিয়ে রাখ। সবকিছুর তদন্ত হলে এই বাড়ির সীমানায় যেন তোর চিহ্ন মাত্র না থাকে। সত্য-মিথ্যা যাচাই হলেও এই বাড়ির সীমানায় তোর চিহ্ন রাখবো না।
রোহানের কথাশুনে কয়েকজন মুরব্বি বললেন,
কি কইতেছো এসব? বউর তো কোনো দোষ নাই।
রোহান বলে,
বউর দোষ গুণ পরে দেখা যাবে। কিন্তু এ বাড়িতে ও থাকার যোগ্য না। আমার মায়ের শান্তি তো দেখা লাগবে। রাহা এ বাড়িতে না থাকলেই আমার মায় সুখী থাকে, আমিও আমার মায়ের সুখে সুখী।
রোহানের কথা শুনে তাসলিমা বেগম কিছু বললেন না। এ অবস্থায় তাঁর খুশীর বিষয়টি বুঝা যাচ্ছেনা, সে তিশাতে ব্যস্ত।
রোহানের মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাহা পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আবারো রোহানের ধমক শুনে সবকিছু গোছানোর জন্য পা বাড়ায় রাহা।

কিছুক্ষণ পরে পুলিশ আসে তদন্তের জন্য। এতক্ষণ তিশা মুখ না খুললেও এবারে ভয়ে ভয়ে খুলে। কারণ রোহান প্রথম থেকে সবকিছু পুলিশদের কাছে বলছিল, সাথে বাড়ির কয়েকজনও সাক্ষী দিছিলো। তাসলিমা বেগম কয়েকবার বলেন, মেয়েটার এই অবস্থা হয়েছে এখনো মেয়েটিকে কথা শুনানো উচিত! তাসলিমা বেগমের কথার গ্রাহ্য না করে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। রোহানের এক কথা সত্য-মিথ্যা যাচাই তো হবেই, চিন্তার কিছু নাই রাহা নির্দোষ হলেও এ বাড়িতে রাহা থাকবে না। কোনো কারণেই না।

রাহাকে পুকুরপাড়ে ভেজা অবস্থায় দেখে তুহিনের মধ্যে অন্যরকমের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। যার সবটাই এক হিংস্রতার রূপ নেয়। কথায় আছে, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। তুহিনও সেই দলের। প্রথম প্রথম নিজেকে ঠিক রাখলেও, পরবর্তীতে রাহাকে পাওয়ার নেশা জেগে যায়। তিশাকে শর্ত দেয়, যদি রাহাকে একবারের জন্যও কাছে পায় তাহলে তিশাকে বিয়ে করবে। আর কেউ কিছু জানতে না পারলে রাহা এমনিতেই কলঙ্কিনী হয়ে যাবে, তখন তিশারও শান্তি। প্রথমে তিশা এ ব্যাপারে ভয় পেলেও পরবর্তীতে সে রাজী হয়। এবং তিশার কথা ছিল তুহিন যেন আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আসে। তাহলে সবকিছু চুরি /ডাকাতি বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। তাই সবকিছু প্লানমাফিকই করতে থাকে। এবং আগেই ওর বড় খালাকে কল দিয়ে বলে, তাসলিমা বেগম আর মাহতাব খন্দকারের মধ্যে ঝগড়া হইছে তাই যেন মিথ্যা বলে হলেও তাদেরকে একসাথে নিয়ে যায়। তাছাড়া বোনের সাথেও সময় কাটাতে পারবে। এবং তাসলিমা বেগমকে বলে তাঁর বড় বোন অসুস্থ। তাসলিমা বেগমও বোনের অসুখের কথা শুনে মাহতাব খন্দকারকে সাথে নিয়ে যায়।
রাতে যখন রাহা নিজের ঘরে শুয়ে ছিল তখন তিশা ভাবছিল হয়তো রাহা ঘুমিয়ে গেছে। তাই সেই সুযোগে তুহিনকে ঘরে আনার উদ্দেশ্যে রাস্তায় যায়।
কিন্তু রোহানের কলে রাহা উঠে রোহানের সাথে কথা বলে, তার পরপরই সাহেলের বউয়ের ব্যাথা শুরু হয়ে যায় এবং সাহেলের মায়ের ডাক পরে তাই রাহা দরজা চাপিয়েই ওই ঘরে চলে যায়।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুহিনের সাথে কথা বলে তিশা। তাঁর থেকে একটু দূরেই আরও তিনজন ছিল। তখনও তিশার একটু-আধটু ভয় লাগলেও মনে মনে শয়তানি হাসি ঠিকই দেয়। তুহিনও তো কম যায়না। একজনকে তিশার অজান্তেই পাঠালো রাহা সত্যি সত্যিই ঘরে আছে কিনা। বাগানের দিকটার দরজা তিশা খুলে রেখেছিল সেখান থেকেই ঘরের ভেতরে ঢুকে কাউকে না দেখে তুহিনকে মেসেজ দেয় সেই লোকটি। রাহাকে পেয়েও না পাওয়ার জন্য মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তুহিনের। সেই মুহুর্তে সবকিছুর প্রমাণ আড়ালে রেখে করবে নাকি সম্মুখে রাখবে মাথায় আসেনি তুহিনের। সে তিশার উপরে রাগ ও চাহিদা ঝাড়তে ব্যস্ত। সঙ্গে থাকা ছেলেগুলোও জেকে ধরলো তিশাকে। অজ্ঞান প্রায় তিশা, কোনোরকমে বাগানের দরজা দিয়েই ঘরে রেখে গেল। সাথে ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো করে গেল। যেন সবাই বুঝে চুরি/ডাকাতির উদ্দেশ্যে আসছিল তখন এই অঘটন ঘটেছে। কিন্তু তখনি সাহেলের বাবাও বাগানে কয়েকজনের উপস্থিতি টের পায়, এবং সবাই সেখানে উপস্থিত হওয়ার আগেই ওরা দৌঁড়ে চলে যায়।

সবকিছু জানার পরে তাসলিমা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। রাগে রোহানের রগগুলো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, রাহা নিজের ঘরে বসেই সবকিছু শুনে কান্নায় ভেঙে পরলো। মানুষের মধ্যে কতটুকু মনুষ্যত্বের অভাব হলে এমন চিন্তাভাবনা করে থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাশে থাকলে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।
তুহিনের বাড়িতে খোঁজ গেল কিন্তু তুহিন উধাও। সাথে যারা যারা ছিল তারাও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আশেপাশের সবার বাড়িতেই জানাজানি হয়। সবকিছু জানার পরে রায়হানও বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

তিশা পা ধরে কান্না করে রাহার। যেন ক্ষমা করে দেয়, ওর শাস্তি তো নিজেই পাইছে। রাহা শুধু এতটুকুই বলে,
আমি কি ক্ষতি করেছিলাম তিশা? যার জন্য এতবড় ক্ষতির মুখোমুখি করতে চেয়েছিলে তুমি। তখন বাড়ির একজন বয়স্ক মহিলা বলে এমন মাইয়াগো ক্ষতি করন লাগে না। পোলাগো লগে ঢলাঢলি করা মাইয়ারা কোনোসময়ে চাইবে? যে অন্য মাইয়ারা যেন জামাইর লগে খুশিতে থাকুক। রোহানরে তো বিয়া করতে চাইছিল কিন্তু তুমি আইছো বউ, দেহো দোষটা ওই জায়গায় নাকি।
রাহা অবাক হয়ে বলে, রোহান তো ভাই হয়। তখন আবারো সেই বৃদ্ধ বলে,
খালাতো ভাই হয়। রোহানের খালার মাইয়া। যারা লালনপালন করে তাদেরই বুকে ছুড়ি দেয়।
বয়স্ক মহিলার কথাশুনে সবকিছু ক্যালকুলেশন করে অনেককিছুই বুঝতে পারে রাহা।
সবকিছু শোনার পরেও তাসলিমা বেগম রাহা’র দোষ দিয়ে যাচ্ছেন। রাহা না থাকলে হয়তো এসব কিছুই হতো না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here