গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ১০

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_১০

বিদ্যুৎ নেই। বৈঠকখানার একপাশে রায়হান বসে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। রায়হানের মা এসে অন্যপাশে বসে। বাড়ির দুইজন মধ্যবয়সী মহিলাও আসে, যারা আজকে রাহাদের বাড়িতে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে তাঁরা তিশার প্রসঙ্গও উঠায়।
– খন্দকার বাড়িতে ওই মেয়েটাকে দেখতেও খারাপ না। লেখাপড়ায়ও নাকি ভাল। এই মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা লাগবেনা।
রেহেনা বেগমও সম্মতি দিলেন কথায়। তখনি রায়হান বলে ,
– এই মেয়ের জন্যই তো বেশি চিন্তা হবে। কারণ মা, বাবা কিছুই নেই। এতিম মেয়ে। এমন মেয়েরে কে বিয়া করবে? মা-বাপ মরা মেয়েরা ভাল হয়না। তাই এই মেয়ের বিয়ে নিয়েও অনেক ঝামেলা আছে।
রায়হানের কথাটা যে রেহেনা বেগমকে ইঙ্গিত করে বলা, তা রেহেনা বেগম বুঝতে পারছেন। রায়হানের কথা শুনে তিনি চুপচাপ হয়ে গেলেন। অন্য একজন বললেন,
– সব মেয়েরাই তো এক হয়না। যারা খারাপ হইবে বাপ-মা থাকলেও খারাপ হয়। আর যারা ভাল হইবে বাপ-মা না থাকলেও ভাল হয়। তিশা মাইয়াডা একটু ফটফট বেশি করে, তবে মাইয়াডা এত খারাপও হইবেনা।
মহিলাটির কথা শুনে রায়হান হেসে দিয়ে বলে,
– সব মেয়েরা যেমন এক হয়না তেমনি সবাই বুঝেওনা।
রায়হানের কথাটি রেহেনা বেগমের গায়ে লাগলেও তিনি চুপ থাকেন।
প্রথম ভালবাসা! এত সহজে চাইলে ভুলে যাওয়া যায় না। সেখানে যদি আশেপাশেই সে অন্যের সাথে সুখের ঘর বাঁধে, তখন যতবার তাকে দেখবে ততবারই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পরে যায়। এই সুখের সংসার তো রায়হানের সাথে বাঁধার কথা ছিল। এখন অন্যের সাথে এভাবে দেখে বারবার সেই দিনগুলোর কথা মনে পরে যায়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে রাস্তার দিকে যায় রায়হান। রেহেনা বেগম বলেন,
এই অন্ধকারে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।
জবাবে রায়হান বলে,
এখন আগের মতো ছোট নেই। নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়ার বয়স হইছে। রায়হানের কথা শুনে রেহেনা বেগম কিছু বললো না।
দক্ষিণ পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো রায়হান। পূর্বদিকে তাকালেই রাহা’র শশুড় বাড়ি দেখা যায়। রাস্তার পাশে ঘাসের উপরে পূর্বদিক হয়ে বসেছে রায়হান। রেহেনা বেগমের জন্য আজ রাহা’কে অন্যের সাথে দেখতে হচ্ছে । এমনকি রায়হানকে প্রতারকও ভাবছে ও বলেছে রাহা। হাত দুটো মুঠো করে রায়হান।
ফোনের গ্যালারি ঘেটে বেশকিছু ছবি সামনে আসে। গভীর মনযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখে রায়হান। রাস্তার পাশে বসা, স্কুলের পিছনে নারিকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একটি হাস্যজ্বল মুখ। রাহা’র এমন হাস্যজ্বল মুখ দেখার অধিকার এখন নেই রায়হানের। যা শুধুমাত্র রোহানেই সীমাবদ্ধ।
খোলা আকাশের নিচে বসে সমস্ত ভাবনা মাথায় নাড়া দিচ্ছে রায়হানের।
ভালোবাসা! নিজে না পেলেও তো তাকে সুখে দেখার থেকে বড় কোনো সুখ নেই পৃথিবীতে। অন্যের সাথে বিয়ে হলে, সেই ভালোবাসার মানুষটির ক্ষতি করার জন্য তাহলে সবাই উঠেপড়ে লাগে কেন! পাঁচ-দশটা মানুষের মতো নিজেকেও কেন তাঁদের দলে ঠেলে দিচ্ছে রায়হান! এর সঠিক উত্তর জানা নেই রায়হানের। সবার সাথে তাল মিলিয়ে তো নিজেও ক্ষতি করতে পারবে না রাহা’র। হোক না কিছুটা গল্প আলাদা ধরণের। মেয়েটা এমনিতেই কষ্টে কষ্টে বড় হয়েছে, এমনকি শশুড় বাড়িতেও দুইজন ছাড়া বাকিদের চোখের হাল্। এখনো কি তাকে জ্বালাতন করা উচিত? তাহলে মেয়েটাকে দূর থেকে দেখারও তো কোনো সুযোগ থাকবে না।
যেই রাহা’র মুখেই প্রতারক ডাক শুনতে হইছে, সেই ডাকের প্রতিবাদ তো করাই উচিত। তবে সবকিছুর প্রতিবাদ তো উল্টাপাল্টা জবাব বা কাজ দিয়ে করা যায়না। এই প্রতারক ডাক মুছেই জবাব দেয়া যাবে।
কিন্তু এই তিশা! যেমন ভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, রায়হানের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে হয়তো এতদিনে রাহা’র অনেক বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেত। এমনকি তিশার বিরুদ্ধে গেলে হয়তো রায়হানকেও দোষী বানিয়ে দিতো এতদিনে। তাই তালে তাল মিলিয়ে পথ চলছে রায়হান। তুহিনের ব্যাপার-স্যাপার জানা নেই রায়হানের, তবে যতটুকু জানে তা হল তুহিন ছেলেটার চালচলন। যে ছেলে হাজারো মেয়ের সংস্পর্শে আসতে পারে, এমনকি তিশারও কাছাকাছি আসতে চাইতেছে। তাও রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে, তাই রাহা’কে এই ঝুঁকির মধ্যে রাখা যায় না। একেকজনের চিন্তাভাবনা একেকরকম থাকে, যেখানে রাহা সবসময় ঝুঁকিতে থাকে তিশার জন্য। সেখানে তুহিনের রিস্ক এড়ানো যায়না।
তাছাড়া রায়হান নিজেকেও রাহা’র জন্য বড় ধরণের ঝুঁকি মনে করে, এটা নিজেকে নিজেই বলে রায়হান। রাহা’কে দেখলে একেকবার মনে হয় রাহা’কে নিজের কাছে এনে অনেক দূরে চলে যাবে। আবার কখনো রাহা’র সুখের শেষ ঠিকানাকেই সমর্থন করে। সবকিছু ভেবেচিন্তে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় রায়হান।

___________

সারাদিনের ব্যস্ততার পরে কল ফ্রেশ হয়ে রাহা’কে বারবার কল দিয়ে যাচ্ছে রোহান। কিন্তু রায়হানকে একবারেও পাচ্ছেনা। চিন্তিত ভঙ্গিতে খাটের উপরেই আধশোয়া হয়ে বসে রোহান।

এই মাইয়া? সারাদিন কি হোয়োন আর বয়োনের লইজ্ঞা তোরে বাড়িতে আনছি? কাম-টাম কেডা করবে? তাও কিছু কইছি কোনোসময়ে তোরে? তারপরেও আমার পোলার ধারে বানাইয়া বানাইয়া কওন লাগে সবকিছু? তোর জন্য আমার পোলায় আমার লগে রাগোইয়া কথা কয়। আমার পোলাডারে পুরোপুরি খাইছো তুই! এহন কি পুরো সংসার খাইলে শান্তি হবি? তাইলে খা, সবাইরে খাইয়া শান্তি হ তুই।
তাসলিমা বেগমের এমন কথাগুলো চুপচাপ শুনে রাহা। মাহতাব খন্দকার রেগে বললেন,
– এমন তুই তুকারি করছো কেন? মেয়েটার সাথে।

মাহতাব খন্দকারের কথা শুনে তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
– ভুল হইছে আমার। ও তো মা লাগে। ওরে তুই ক্যান কমু! ওরে তো আপনি আপনি কইতে হইবো।
আমার মায় নালিশ দিছে আমি কাজ করাই, এটা করাই, ওটা করাই।তার জন্য তোমার পোলায় আমারে মোবাইলে ঝাড়ি দেয়।

তাসলিম বেগমের কথা শুনে রাহা বললো,
– আম্মা! আপনি এত চিল্লাপাল্লা কেন করছেন? আমি কখনো আপনার ছেলেকে নালিশ দিলাম? তাছাড়া যে সংসারে আসছি, সে সংসারের কাজ থাকবেই তার জন্য নালিশ দেয়ার কি আছে?

তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
এই মাইয়ায় কি কয় দেখছো রোহানের বাপ? আমি চিল্লাপাল্লা করি? তোর মরা মায় করে, আমারে কও ক্যান? বাপে একটা বিয়া কইরা লইছে খোঁজ খবর ইচ্ছা হইলে নেয়, না হইলে নেয় না। এহন আইয়া আমাগো মাথার উপরে উঠছে। পুরো সংসার শেষ করবে এই মাইয়ায়।
তুই নালিশ না দিলে রোহান জানলো কেমনে? ও আমারে কল দিয়া কয় ক্যান? এত বিকেলে গোসল করলে অসুস্থ হবি। এত কাজ কিসের ঘরে? সব কাজ তোরে দিয়া করাই আমি? এটাই কইছো?

তাসলিমা বেগমের কথা শুনে রাহা’র মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মানুষ সারাক্ষণ চুপ থাকতে পারে? রাহা জবাবে বললো,
– আম্মা! আপনারে আগেও বলছি এখনো বললাম, আমার মা-বাবারে কথায় কথায় টেনে আনবেন না। তাছাড়া আপনার ছেলে জিজ্ঞেস করছিল এত দেরী করে গোসল করছিলাম কেন! তাই বলছি রান্নাবান্না, ঘর ঝাড়পোঁছ করছি তাই দেরী হয়েছে। তাতে নালিশের কি আছে? তাছাড়া বিয়ের পরে মেয়েরা তো স্বামীর বাড়িতেই উঠবে। তাহলে বাবার বাড়ির কথা কেন উঠছে?

তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
শিক্ষিত বউ আইছে আমার। কি সুন্দর সাজাইয়া গুছাইয়া কথা কয়। ওই ছেড়ি তোর এই মিডা কথায় ভুলমু সবকিছু? এইডা ভাবছো?

রাহা বললো,
আপনার মিঠা কথায় ভুলতে হইবে না। সত্যিটাই মনে রাখেন, তাহলেই হবে।

তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
মুখে মুখে তর্ক করাও শিখছে এই মাইয়ায়ায়।

রাহা শান্তভাবে বললো,
সারাক্ষণ চুপ থাকবো এমন তো কোনো কথা নাই। বারবার উল্টাপাল্টা কথা বললে একবার জবাব দিতেই হয়। নাহলে সেই উল্টাপাল্টা কথা সারাজীবন বহন করতে হয়। আম্মা।

রাহা’র কথা শুনে তাসলিমা বেগম এবারে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছে।
কয়দিন পর এই মাইয়ায় মারতে আইবো আমারে। কইবো এই মহিলা উল্টাপাল্টা কথা কয়, না মারলে আরও শুনতে হইবো।
তাসলিমা বেগমের কথাশুনে মাহতাব খন্দকার বললেন,
রোহানের মা! বউ ভুল কিছু কয়নায়। আর তিল থেকে তাল বানাও ক্যান? মারার কথা কেডা কইলো।

মাহতাব খন্দকারের কথাশুনে তাসলিমা বেগম তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
এই মাইয়ায় আমার সংসার ডারে খাইলো। সবাইরে নিজের দলে নিছে। মুখ খুললেই কথা হুনতে হয়।

মাহতাব খন্দকার বললেন,
তুমিও শশুড় বাড়িতে আসছো, বউও শশুড় বাড়িতে। সংসার দুজনেরই। আর সারাদিন ভুল কথা কইলে কথা তো শুনতেই হইবোই।

মাহতাব খন্দকারের কথাশুনে তুমুল ঝগড়া বাঁধায় তাসলিমা বেগম। মাহতাব খন্দকার চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
রাহা অপরাধীর মতো বসে আছে। ওর জন্য এই বুড়ো বয়সেও ঝগড়া বাঁধছে।

শান্তি তো তুমি? যখন থেকে এই সংসারে আসছো একেরপর এক ঝামেলা বাঁধিয়েই আসছো। শেষ পর্যন্ত শশুড়-শাশুড়ীকেও ছাড়লেনা?
তিশার কথা শুনে রাহা বললো,
তোমার সমস্যা কি? বারবার ঝামেলার মধ্যে তুমি জড়িয়ে যাচ্ছো কেন? আমার সংসার আমি বুঝবো, তুমি মাথা ঘামাচ্ছো কেন এত? তোমার জন্যই তো আম্মা এত রেগে যান। এত ঝামেলা বাঁধিয়ে তোমার লাভ কি তিশা?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here