গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ৯

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৯

তুহিনের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল তিশা। অনেকটা ভীত ভাবে বললো,
কার জন্য মেয়ে দেখতে আসছো তুহিন?

তিশার কথার জবাব না দিয়ে কল কেটে দেয় তুহিন। তিশার শরীর রীতিমতো কাঁপতে লাগলো। মনে শঙ্কা জাগতে লাগলো। তুহিনকে কল দিচ্ছে ফোন সুইচঅফ। রায়হানের কল পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তিশার। মনে মনে হাজারো কথা শুনাচ্ছে রায়হান, তুহিন দুজনকেই। কল রিসিভ করা মাত্র’ই রায়হান বললো,
বাবুসোনা। তখন তো কিছুই বললা না।

রায়হানের এমন আহ্লাদী ডাক শুনে তিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
ঢঙ শুরু করছো রায়হান? এত তাড়াতাড়ি, না তোমায় বিয়ে দিবে, না আমায় বিয়ে দিবে। শুধু শুধুই এমন করছো কেন? তাছাড়া, আমাদের সম্পর্ক কেমন টাইপের তা তুমি ভালোই জানো রায়হান।
রায়হান হেসে হেসে বললো,
তাহলে সেভাবে কিছু করো না। তাহলেই তো মুক্তি দেই তোমায়।
তিশা ঢোক গিলে বললো,
মাথা ঠিক আছে তোমার? সবকিছু চাইলেও তো পাওয়া যায়না রায়হান। সময়, ধৈর্য দুটোই লাগে। তাছাড়া যেটা সম্ভব না তা কিভাবে হবে?
রায়হান উচ্চস্বরে বললো,
সেদিন আমাকে কথা শোনানোর আগে মনে ছিল না তোর?
রায়হানের কথা শুনে তিশা ঢোক গিলে বললো,
রায়হান তুমি ঠিক আছো তো?

রায়হান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
আগে তোমার বাড়িতে মা-বাবাকে সম্বন্ধ নিয়ে পাঠাবো তারপরে ঠিক হবো। বাবুনি।

তিশা মনে মনে হাজারো কথা শুনিয়ে রায়হানকে বললো,
এত ভণিতা না করে কি দরকার সরাসরি বলো রায়হান।

রায়হান খুব শান্তভাবে বললো,
দুজনের ইচ্ছেই পূরণ হোক। সেটা চাই।

তিশা থতমত খেয়ে বললো,
মানে?

রায়হান শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
তুমি তো রাহা’র অশান্তি চাইছো, তাইনা বাবুসোনা? আর আমার তো রাহাকে চাই। দুজনের ইচ্ছেটাই পূরণ হোক।

রায়হানের কথা শুনে তিশার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলেও, মনে প্রশান্তি এসে জমাট বাঁধে।

কি হলো? কথা বলছো না কেন?

রায়হানের কথা শুনে তিশা তুতলিয়ে বললো,
ঠিকাছে। যতটা সম্ভব সাহায্য করবো। রাহা’র সুখ আমার সহ্য হয়না। তাই ওর অশান্তির জন্য সবরকমের চেষ্টা করে যাবো। এখন রাখছি রায়হান। পরে কথা হবে।

রায়হানও হেসে সম্মতি দিলো। বাড়ির কাছাকাছি খালের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে হেসে দিল রায়হান। কিছুটা দূরে বটগাছের সাথে বেঞ্চ বসানো, সেই বেঞ্চে বসে গাছের সাথে মাথা ঠেকিয়ে তুহিনও হাসছে। তিশাকে জ্বালাতন করতে পেরে। একসাথে দুই দুইটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানো। এত সহজে তাকে ছেড়ে দেওয়া যায়? তার মধ্যে দুজনের’ই না পাওয়া রাহা জড়িয়ে আছে এর মধ্যে।
রায়হান মুখে হাসির রেখা টেনে তুহিনের পাশে এসে বসলো। তুহিন রায়হানের কাঁধে চাপড় দিয়ে বললো,
কিরে ছোট ভাই। মানুষ তো ভালোই নাচাতে পারো।
রায়হান হেসে বললো,
ছোট মরিচের তেজ বেশি। তেমনি ছোট মানুষেরও হবে।
তুহিন বললো, তা তো অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিলা ছোট মানুষেরও তেজ বেশি।
রায়হানও হেসে বললো, তুমিও কম যাওনা তুহিন ভাই।
রায়হানের কথা শুনে তুহিন ভাব নিয়ে বললো,
এসব নিয়ে খেলা করতে করতেই এতটা বড় হয়েছি। বেশি ছাড়া কম যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
তুহিনের কথা শুনে রায়হান বললো,
অতিরিক্ত বেশি করলে কিন্তু মাথায় বাঁশও পরে তুহিন ভাই।
রায়হানকে ব্যাঙ্গ করে তুহিন বললো,
তুহিনের মাথায় বাঁশ ভাঙার আগেই বাঁশির শব্দ বেজে উঠে। তখন তুহিনও সজাগ হয়ে যায়। তাই তুহিন বাঁশের ভয় পায়না
তুহিনের কথা শুনে রায়হান হেসে দিলো।
কথার প্রসঙ্গ পাল্টে তুহিন বলল,
মেয়েরা এত বোকা কেন? এক’ই এলাকার দু দুটো ছেলের সাথে লাইন মারে। ধরা খাওয়ার ভয় ছিল না?
কতগুলো বাড়ি মিলিয়েই তো একটা এলাকা হয়। আমার বাড়ি হয়তো ৪-৫ টা বাড়ির পরে, তাই বলে এলাকার কে কি করছে আমি খবর জানবো না? সবকিছুই তো কানে আসে, তাহলে তিশা মেয়েটা এত বোকা কেন? নিজেকে চালাক ভাবে খুব কিন্তু বোকার ভাণ্ডার একটা। কখন কি করে সবটাই জানি, কান পর্যন্ত পৌঁছায় আমার।
তুহিনের কথা শুনে রায়হান বললো,
বোকা যারা তাঁরা নিজেদেরকে নিজেরা জ্ঞানীই ভাবে। কিন্তু পরিশেষে নিজেদের জালে নিজেরাই বেজে পরে। কিন্তু আমাদের ওইসবে কাজ নেই, আমাদের পাওনা পেলেই সবকিছু মিটে যাবে।
রায়হানের কথায় তুহিনও সম্মতি দিলো।

তুহিন বেঞ্চি থেকে উঠতে উঠতে বললো,
অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই মিথ্যা বলে মেয়ে দেখার কথা বলছি এখন না উঠলে পেত্নী দেখা হবে।

তুহিনের কথাশুনে রায়হানও হাসতে হাসতে উঠে গেল।

____________________

ঘটনা – ১

সেদিন রোহানদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পরে বাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তুহিন। নদীর পাশে ৫-৬ গ্রাম মিলিয়ে একটা বড় বাজার। নদীর কিনার ঘেঁষে চায়ের টঙ আছে। মূলত সেখানে বাড়ন্ত বয়সের ছেলেরাই আড্ডা দেয়। সেখানে যেয়ে সিগারেটের আসর মিলায় আর সমস্ত ঘটে যাওয়া কাহিনী বলাবলি করে। ভাগ্যক্রমে তুহিনও সেখানে যায়, চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।
সেখানে উপস্থিত থাকা ছেলে’রা ও চায়ের দোকানী আলোচনা করে গ্রামের ছেলেমেয়ের অবস্থা। যারা যা জানে সবকিছুই প্রতিনিয়ত এভাবেই আলোচিত হয়। কোন কোন ছেলে’রা স্কুল বয়সেই সিগারেট খায়, গাঞ্জা খায়, ইয়াবা খায় সবকিছুই আলোচিত হয়। মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে কিভাবে তাও আলোচনা হয়। এমনকি খন্দকার বাড়িতে আশ্রিতা তিশাকে ছাড় দেয়া হয়নি। খান বাড়ির রায়হানের সাথেও সম্পর্ক আছে তাঁর। কলেজেও না-কি সম্পর্ক আছে। এসব মেয়েদের জন্য ভাল মেয়েদেরও বদনাম ছড়ায়। এসব বলে বলে সবাই হেসে দেয়। তুহিনও কথা দিয়ে কথা জানার চেষ্টা করে এবং সফল হয়।
যে মেয়ের সাথে মন থেকেই সম্পর্ক করেনা, এমনকি সে আশ্রিতা জানার পরে তাঁর সাথে সম্পর্ক রাখার কোনো কথাই না। চরিত্র ভাল হলেও কথা ছিল, তবে এমন চরিত্রের মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানো আর নিজ থেকে খাদে পরা একই কথা।
সেদিন থেকেই তিশাকে ইগ্নোর করে তুহিন।

ঘটনা- ২

বিকেলে খেলার মাঠের পাশে বসে মোবাইল ঘাটছে তুহিন। রায়হান ও অন্যান্য’রা ফুটবল খেলছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রায়হানকে ডাক দেয় তুহিন। রায়হানও এলাকার বড় ভাই ভেবে তুহিনের কাছে আসে। দেড় থেকে দুই বছরের ব্যবধানের বড় হতে পারে তুহিন। খারাপের সঙ্গ যারা নেয় তাদের পক্ষে সবাই থাকে। তাই রায়হানও তুহিনকে মেনে চলে। কিন্তু রোহান তুহিনের ভুলগুলো ধরে। রায়হান যখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ে তখনি সিগারেটের নেশায় আসক্ত হয়। সেটা রোহানের চোখেই পরে, বড় ভাই ভেবে নিজেই রায়হানকে শাসন করে। কিন্তু রায়হানকে একই রকম দেখে ওর বাবার কাছে বলে দেয় রোহান। তখন থেকেই রোহানের সাথে শত্রুতায় মেতে উঠে রায়হান।

তুহিনের পাশে এসে দাঁড়ায় রায়হান। তুহিন ওর পাশেই রায়হানকে বসতে বললো। রায়হানও বসলো। তুহিন হেসে হেসে বলছে, কিরে ছোট ভাই! প্রেম চলে কেমন? তুহিনের কথা শুনে হেসে ফেলে রায়হান।
তুহিন বলে, তা বিয়ে-শাদি কবে?
রায়হান বলে কি যে বলো ভাই। প্রেমলীলা করলেই কি বিয়ে করতে হবে? তাছাড়া বড় ভাইরা না করলে ছোট’রা কেমনে করে!
তুহিনও হেসে বলে, ছোটদেরই আগে সুযোগ দেয়া উচিত সবকিছুতে।
তুহিনের কথা শুনে রায়হান বলে, বুঝলাম না ভাই।
তুহিন হেসে বললো, ওই যে তিশা। তোমার পাশের বাড়ির। ওরেই দিয়া দিলাম আগে। এমনে বিয়াটাও আগে সেরে ফেল।
রায়হান থতমত খেয়ে বলে, তিশার সাথে তো আপনারও চলে ভাই। তাইলে বিয়ে কি খাইতে পারমু?
রায়হানের কথায় মৃদু হেসে তুহিন বললো, তাইলে জানো সবকিছু!
রায়হান গম্ভীরভাবে বলে, জানমুনা ক্যান। এলাকার মানুষ, কে কি করে তা সামনে আসেই।
কিন্তু মেয়ে যদি নিজ থেকে গায়ে পরে, তাইলে ধরমু না ক্যান। ধরতেই হবে তাঁরে।
রায়হানের কথা শুনে তুহিন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
একার কত ক্ষমতা। একসাথে সবাইরে জালে ফালায়। যে উঠে আর যে পরে।
তুহিনের কথায় সম্মতি দিয়ে রায়হান বলে, হ্যাঁ ভাই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তুহিন বললো,
এর একটা হেস্তনেস্ত তো করতেই হয়। শুধু শুধুই কি ছেড়ে দেবো?
রায়হানও হেসে সম্মতি দেয়।
তারপর থেকেই তুহিন তিশাকে মেয়ে দেখার কথা বলে। রায়হান জানে, যে তিশা রায়হানকে বিয়ে করবেনা। তবুও বিয়ে করার কথা বলে বারবার বিরক্ত করে।
তুহিন, রায়হান মনে মনে জল্পনা কল্পনা করে। কিন্তু দুজনের কল্পনা সম্পুর্ন আলাদা ধরণের।
বটগাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে থাকে তুহিন। রায়হান ওর থেকে দূরে যেয়ে কথা বলে তিশার সাথে। তুহিন ভাবছিল তিশাকে জ্বালাতন করতে বারবার বিয়ের কথা বলে যাচ্ছে রায়হান। ওর পাশে বসে বললে হয়তো তিশা ধরে ফেলতে পারে, তাই দূরে গেছে। এদিকে তিশার সাথে নিজের মতো করে বিয়ের কথা ছাড়াও অন্যকথা বলে। যা শুধুমাত্র রায়হানেই বদ্ধ।

___________________

কেবলমাত্র গোসল করেছে রাহা। আজকে সমস্ত ঘর ঝাড়পোঁছ করতে করতে অনেকটা সময় লেগে গেছে। তারপরে রান্নাবান্নার ঝামেলা তো আছেই। গোসল করতে করতে আছরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। গোসল করে নামায আদায় করার পরে রোহানের সাথে কথা বলে রাহা। কয়েকটা ধমকও শুনে ফোনে। এত বেলা করে গোসল করছে তাই। ধমকের পরে আবারো আহ্লাদীভাবে রাহা’কে বুঝায় রোহান। এত বেলা করে গোসল করলে অসুখ বাঁধবে তো। রোহানও কাছে নেই, তখন কষ্ট হবে রাহা’র। তাছাড়া এমন অসুখ বাঁধালে রাহা ঔষধ কোথায় পাবে? উল্টো রোহান ঔষধ আবিষ্কার করতে হবে। রোহানের কথা শুনে হেসে দেয় রাহা। রোহানও হাসে।

তাসলিমা বেগমের ডাক পরে যায় এরমধ্যেই। রাহা তড়িঘড়ি করে ওর রুম থেকে বের হওয়া মাত্রই দেখা মিলে কয়েকজন বয়স্ক মহিলাদের সাথে। একজনকে দেখে থমকে যায় রাহা। তবুও মুখে হাসি রেখে সবাইকে সালাম দেয়। একজন রাহাকে প্রথম থেকেই নজরে রাখছে। ওড়না মাথায় দেয়া, তবুও চুলগুলোর আকার বুঝা যাচ্ছে। কোমড় অবধি ছুঁয়ে আছে, দুধবর্ণ গায়ের রঙ। সবসময়ের জন্য মুখে হাসির রেখা টানাই থাকে। এমন মেয়েকে লক্ষীমন্ত পুতুলের মতো মেয়ে ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না রায়হানের মায়ের কাছে। সত্যি সত্যিই দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। অন্যান্য’রাও রাহাকে পর্যবেক্ষণ করছে। রাহা কিছুটা অস্বস্তিতে পরলেও বুঝতে দেয়না কাউকে। মনে মনে আফসোস করে রায়হানের মা। এমন মেয়েকেও নিজের ছেলের বউ না করে পারলো কীভাবে! তাছাড়া যখন সে টের পায় তখন রায়হানেরও বিয়ের বয়স হয়নি। কিন্তু রাহা’র পরিবারের সাথে খোলাখুলি কথা বললেই হয়তো সবকিছু ঠিক রাখা যেত। তখন এতকিছু বুঝতে চায়নি রায়হানের মা। শুধু একটা কথাই বুঝতো সে, তাঁর ছেলের জন্য কোনো মা মরা এতিম মেয়েকে আনবেনা সে। এখন আফসোস করছে সে।
কিছুক্ষণ পরে উঠোন দিয়ে ঘরে আসে তিশা। রায়হানের মা’কে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় তিশা। তবে মুখে হাসির রেখা টেনে সবার সাথে কথা বলে। তিশাকেও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে সবাই।

#চলবে

(আজকের পর্বে সবার থেকে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। কম-বেশি তথ্য আজকের পর্বে দেয়া হইছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here