গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ৮

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৮

“রাহা!”
“জ্বী বলেন।”
“কেমন আছো?”
“আল্লাহর রহমতে খুব ভাল আছি। রোহান থাকতে খারাপ থাকার কারণ’ই হয়না। ”

‘রাহা’র কথা শুনে মুখমণ্ডল গম্ভীর করে ফেলে রায়হান।’

‘রোহানকে এগিয়ে দিতে রাস্তায় আসে রাহা। যতক্ষণ অবধি রোহানকে দেখা যাচ্ছিল দাঁড়িয়ে থাকে রাহা। রোহান আড়াল হওয়ার পরেই বাড়ির দিকে আসবে তখনি রায়হানের ডাক। রাহা পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে রায়হান আসছে। যে মানুষটির সাথে এক মুহুর্ত দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে যেতো রাহা, আজকে এক সেকেন্ডও দেখতে ইচ্ছা করছেনা। যে মানুষটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করতো, আজকে তেমন কোনো অনূভুতি নেই রাহা’র। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আবারো রায়হানের ডাক, ফিরে তাকায় রাহা। ’

“ একটু কথা বলার সময় হবে? রাহা।”

“আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। তাই সময় হওয়ারও প্রয়োজন নেই রায়হান। তাছাড়া এক বাড়ির বউ, অন্য বাড়ির ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোন কারণে কথা বলবে? আশেপাশের মানুষজন কি ভাববে বুঝতে পারছেন? ”

“ভাবলে ভাবুক। একটু কথা বলবা রাহা? আগে তো কথা বলতা। তখন তো এভাবে বলতে না, অন্যরা কি ভাববে।”

“আগে নিশ্চয়ই আমি অন্য কারো বউ ছিলাম না। এখন আমার স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্য ছেলের সাথে কথা বলে, আর পাঁচটা মেয়ের মতো হবো? স্যরি রায়হান! এমন মেয়ে আমি নই। যে আমার বিশ্বাস রাখে, আমিও তাঁর বিশ্বাস রাখি। অবশ্যই রোহান আপনার মতো বিশ্বাসঘাতক নয়। তাই আমিও তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারিনা। ”

‘রাহা’র কথা শুনে ছলছল নয়নে তাকায় রায়হান। রাহা হেসে বলে,
এটাও কি নাটকের এক অংশ?’

“রাহা! তুমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছো।”

“মানুষ তো সারাজীবন এক থাকেনা। পরিবর্তন হতেই হবে। কেউ নিজ থেকে, কেউ প্রতারিত হয়ে। যেমন; আপনার প্রতারণার জন্য আমি পরিবর্তন হয়ে গেছি। আর এখন রোহানের ভালবাসার জন্য পরিবর্তন হয়েছি। ”
‘কথাটি বলেই রাহা চলে আসলো।’

বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে না পেরোতেই তিশার ঝাঁঝালো কণ্ঠ ভেসে আসলো। আম্মা দেখো তোমার ছেলে যেতে না যেতেই অন্য ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে। বাইরের মানুষজন কি ভাববে? এর জন্য ঘরে শান্তি পাইনা, এখন বাইরেও অশান্তি হবে?

মুখ সামলে কথা বল তিশা। আমি এমন কিছুই করিনি যার জন্য কেউ বাইরে মুখ দেখাতে পারবেনা।

কিছু করোনি তুমি? রায়হানের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে না? রোহান ভাইয়া যেতে না যেতেই অন্য ছেলেদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলো, সত্যি কথা বললেই মুখ সামলে কথা বলতে বলছো!
তিশার কথা শুনে তাসলিমা বেগমও সামনে আসলেন।
তাসলিমা বেগমকে দেখে রাহা চুপচাপ ঘরের ভেতরে যায়। রোহান বারবার বলে গেছে ওর মায়ের সাথে যেন তর্ক না করে। কিন্তু এখানে এক সেকেন্ড থাকলেই কথাকথি হবে, তাই রাহা চুপচাপ নিজের রুমে যায়। কিন্তু তাসলিমা বেগম একেরপর কথা বলেই যাচ্ছেন শুনিয়ে শুনিয়ে। রাহা কোনো জবাব দিচ্ছেনা।

এই কুদৃষ্টির মেয়ের জন্য আমার পোলার না কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। বউ যদি পরপুরুষের লগে এমন ফুসুরফাসুর করে তাইলে স্বামীর যে ক্ষতি হয়, তা কি এই মাইয়ায় জানে? জানলে তো আরও খুশি হইবে, তাইলে ওর নাগরের লগে যাইতে পারবে।

তাসলিমা বেগমের এমন কথা শুনে জবাব না দিয়ে পারলো না রাহা। শান্তভাবেই বললো,
আম্মা! আপনি মা হয়ে ছেলের জন্য এমন আশংকা করছেন? আপনি জানেন না? আজকে আপনার ছেলে পথে আছে, এখন দোয়া করবেন। তা না করে আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছেন?

রাহা’র কথা শুনে তাসলিমা বেগম আরও ঝাঁঝালো ভাবে বিশ্রী কথা শুনাতে লাগলো।

ওই ছেড়ি, তোর কাছ দিয়া কথা শেখোন লাগবে আমার? পোলা কি তোর না-কি আমার? আমার পোলার ভাল আমি বুঝমু।

তাসলিমা বেগমের এমন কটুকথা শুনে রাহা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
আম্মা! মুখের ভাষা ভাল করেন। আপনার কথাগুলো বাইরের মানুষ শুনলে, আপনাকে কেমন ধরণের মানুষ ভাববে বুঝতে পারছেন?

রাহা’র কথা শুনে তাসলিমা বেগম সামনের বারান্দায় যেয়েই চিল্লাপাল্লা শুরু করলেন।
ও রোহানের বাপ! হুনো। তোমার পোলার বউ আমারে জ্ঞান দিতে আইছে। পোলা যাইতে না যাইতেই এই মাইয়ায় ওর রূপ দেহানো শুরু করছে। আমারে পাগল কয় এই মাইয়ায়। এহনো কবা আমার দোষ? এই মাইয়ার কোনো দোষ নাই?

মাহতাম খন্দকার উত্তর পাশের ঘরের বৈঠকখানায় বসা ছিল। তাসলিমা বেগমের চেঁচামেচি শুনে ফিরে তাকায়।
– দোষগুণ ভালোই জানি। রোহান যেতে না যেতেই মেয়েটার উপরে নির্যাতন শুরু করে দিলা? তাইলে মেয়েটা পাগল কইবে না তো কি কইবে?

তাসলিমা বেগম রেগে বললেন,
সবাইরে জাদু কইরা নিজের করছে। এহন আমার কথা গায়ে লাগবে কারো? ভাল কইলেও খারাপ হুনাইবে।

মাহতাব খন্দকার ব্যাঙ্গ করে বললো,
তুমি তো আজীবন’ই ভাল কইয়া আইছো। তাই কওন লাগবে না, সবাই জানে তুমি কতটা ভাল।

তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
গাও গুণ, পরে টের পাবা।

মাহতাব খন্দকার বললেন,
টের আমরা পামুনা। তুমি পাবা, কপাল চাপড়াবা তখন।

মাহতাব খন্দকারের কথা হজম করতে না পেরে তাসলিমা বেগম বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে অন্য ঘরে গেল। সেখানে যেয়ে একেরপর রাহা’র দোষগুণ গাইছে, অন্য ঘরের মানুষের সাথে। তাঁরাও তাসলিমা বেগমের সাথে তাল মিলিয়ে বলছে।

দক্ষিণের খোলা জানালার কাছে যেয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রাহা। কিছুক্ষণ আগেও রোহান ছিল, এখন এই ঘর রোহানের শূণ্যতায় ভুগছে। মনে মনে ভাবছে রাহা, কত বড় ভুল করেছিল জীবনে। মানুষ হয়ে জন্মালে যে সে ভুল করবে না এমন নয়। মানুষ মাত্রই ভুলের ছড়াছড়ি। রাহা’র জীবনের প্রথম ভুল ছিল হয়তো রায়হানের সাথে সম্পর্কে জড়ানো। দ্বিতীয় ভুল তিশাকে বন্ধু ভাবা। এবং তৃতীয় ভুল রোহানকে প্রথম থেকেই দূরে সরিয়ে দেয়া। পরমুহূর্তেই রাহা’র মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
হয়তো কোনো একসময়ে ভাল কাজ করেছিল। যার জন্য রোহান নামক এক অস্তিত্বের সাথে দেখা মিলে। চোখ দুটো ভিজে উঠে রাহার। রোহান বলেছিল, ওয়ালেটে করে নিয়ে যাবে সাথেসাথে রাখবে। সত্যিই যদি ওয়ালেটে করে যেতে পারতো তাহলে রোহান নামক অস্তিত্বের সাথে দেখা মিলতো প্রতি মুহুর্তে।
এরমধ্যেই ফোনের রিংটোনে বাস্তবে ফিরে আসে রাহা।
– বউ! গাড়িতে উঠছি। আশেপাশে সুন্দরী মেয়েরাও আছে। এখন আমি কি করবো?

রোহানের কথাশুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো রাহা। রোহান হেসে হেসে বললো,
– বউউউউ! তোমার কি খুব রাগ হচ্ছে?

রাহা অভিমানের সুরে বললো,
– নাহ! আমার রাগ হচ্ছেনা। আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন। রাখছি।

সত্যিই তোমার রাগ হচ্ছেনা? তাহলে ঠিক আছে। আমি তাকাচ্ছি। শুনছো বউ?

রাহা রেগে বললো,
– তাকান। চোখ থাকবে না। চোখ দিয়ে মারবেল খেলবো আমি। বুঝতে পারছেন?

ভয় পেয়েছি। এভাবে কেউ ধমক দেয়?

হ্যাঁ! আমি দেই। এমন কথা বললে ধমক না মাইরও দেবো। বুঝছো জামাই?

রাহা ঔষধ দিয়ে মাইর দিবে? তাইলে রাজী আমি। বুঝতে পেরেছো বউ! (হেসে)

রোহানের কথাশুনে রাহাও হেসে দেয়।
সাবধানে যেয়ো।

হুম। তুমিও খেয়াল রেখো। কেউ কি কিছু বলছে আর? রাহা।

নাহ। কে কি বলবে।

মা কোথায়?

পাশের ঘরে গেছেন। আব্বাও উঠোনে আছে।

আচ্ছা! নিজের খেয়াল রেখো বউ।

উহু

_______

রায়হান! গতকাল কতগুলো কল দিলাম। একবারও কল ব্যাক করতে পারলেনা। অথচ রাহার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছো।

তিশার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে রায়হান হেসে বলে,
ওটা তো সিমপ্যাথি ছিল। এখন বল তোমার কি খবর?

আমার খবর তো একটাই , রাহার সাথে এক ছাদের নিচে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যায়।

তিশার কথা শুনে রায়হান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
বন্ধু থেকে হঠাৎ শত্রুতে পরিণত হলে কেন? তিশা। তাছাড়া বিয়ে করো, তাহলেই আর রাহার সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে হবে না।

রায়হানের কথা শুনে তিশা রেগে বললো,
রায়হান! তুমি কি আমার পক্ষে? না-কি রাহা’র পক্ষে?

এখানে পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে না তিশা। রাহা’র সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে ভাল লাগেনা তাই বললাম বিয়ে করে অন্য বাড়িতে যাও। তাহলেই ভাল লাগবে।
আমার বাড়ি থেকে প্রস্তাব পাঠাবো তিশা?

রায়হানের কথা শুনে তিশা তুতলিয়ে বললো,
তোমার মাথা ঠিক আছে রায়হান?

রায়হান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
আমার সাথে সম্পর্ক করো। বিয়ে তো করতেই পারি আমরা। তাইনা তিশা?

আম্মা ডাকছে আমায়। পরে কথা বলছি রায়হান।

তিশার কথা শুনে রায়হান হেসে দিল।

মেজাজ কটমট করে বাগানে আম গাছের শিকড়ে বসে আছে তিশা।ছোট গাছের পাতা একেরপর ছিড়ে ফেলে দিচ্ছে। রায়হানের সাথে দুইদিন আগেও তো অন্যরকমের কথা হল। তাহলে এখন এমন কথা বলছে কেন?
রায়হানের সাথে সম্পর্কটা যে মন থেকে ছিল না, তা আকারে ইঙ্গিতে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হইছে। কিন্তু রায়হান এখন এমন করছে কেন?
তাছাড়া ওর বাড়ি থেকে যে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেনা, তাও জানে তিশা। কিন্তু রায়হানের পাগলামোর জন্য সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মেজাজ খারাপ করে তুহিনকে কল দিল তিশা। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছেনা।
বেশ কিছুক্ষণ পরে তুহিনের হদিস পেল।

পরে কথা বলবো তিশা। এখন ব্যস্ত আছি।

তুহিনের কথায় মেজাজ দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেল তিশার৷ সারাক্ষণ ব্যস্ততা। গতকাল রাত থেকে আর কথাই হয়নি তুহিনের সাথে, অথচ এখনো ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
এত কিসের ব্যস্ততা তোমার?

তুহিন আমতা-আমতা করে বললো,
মেয়ে দেখতে আসছি, পরে কথা বলবো।

#চলবে

(গল্পের এন্ডিং কেমন চাই সবার? হ্যাপি না-কি স্যাড?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here