গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ৭

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৭

সকাল ৮ টা বেজে ৩০ মিনিট,
বাড়ি থেকে রাস্তার পথ ধরে হেঁটে যায় রোহান। সকালে খাওয়া-দাওয়া ছাড়াই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। প্রায় দীর্ঘসময় পরে বাড়িতে ফেরে রোহান। রাহা ঘরোয়া কাজে ব্যস্ত, রোহানকে দেখা মাত্র’ই ছুটে আসে। রোহান হাসি দিয়ে রাহা’র কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে।
খাবেনা?
উহু!
রোহান! এত সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে?

ভ্রমণে গিয়েছিলাম। বউ তো যাচ্ছেনা কোথাও তাই কি করার! একা একাই যেতে হচ্ছে। ঘুরতে যাবে বউ?

এখন ভ্রমণের সময়? কাজ আছে অনেক, খেতে চলো।

আগে বলো যাবে। তারপরে খাবো।

রোহান! এখন কোথাও যাওয়ার সময়?

তাহলে এখন খাওয়ার সময়ও না।

আচ্ছা যাবো। খুশি?

রোহান তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। রাহা’র গালে চুমু খেয়ে বলে,
জ্বী বেগম সাহেবা।

রাহা হেসে দেয়। সাথে রোহানও।

১১টা বেজে ২ মিনিট
ঘর থেকে দু’জন নেমেছে। তাসলিমা বেগম কিছু বললেন না। মাহতাব খন্দকার দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সাবধানে যেতে।
বাড়ির সীমানা পেরিয়ে পাকা রাস্তার কাছে আসলো দু’জন। রাহা অবুঝের মতো দেখছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
রাস্তার ওপারে রেন্ট্রি গাছের মুড়-এ রায়হান বসে আছে। চোখাচোখি হয় রোহান, রাহা’র সাথে। মাথা নিচু করে মোবাইলে মনযোগ দেয় রায়হান।

রোহানের ঠিক করা অটোরিকশার পাশে এসে দাঁড়ালো ওরা। রিকশাচালককে দেখা যাচ্ছেনা।
রোহান ইশারা করে রাহা’কে রিকশায় বসতে বলে অপেক্ষা করতে থাকে। রাহা তীব্র মেজাজ দেখিয়ে বলে,
তুমি এতটা উদাসীন কেন রোহান?
তোমার বাচ্চার মা আমি, অথচ রিকশায় একা একা উঠতে বলছো? যদি পরে যাই তখন কি হবে?
রোহান অবাক হয়ে রাহা’র দিকে তাকিয়ে আছে। রাহা উচ্চস্বরে বললো,
রোহান! আমার ছেলেকে কিন্তু ইচ্ছামতো নালিশ দেবো। তখন বুঝবা! এখনো হা করে তাকিয়ে আছো কেন? হাত ধরো। অনেক ক্লান্ত লাগছে, এই অবস্থায় বাইরে ঘুরাঘুরি করা উচিত? যেহেতু স্বামী ভালবেসে নিয়ে আসছে তাই নাও করতে পারিনা। কিন্তু তুমি দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাবা? একদম না। রিকশায় উঠে আমার মাথা কাঁধে রাখো। না’হলে কিন্তু আবার বমি করে দেবো।
রাহা’র কথা আর ধমক শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় রোহান। তড়িঘড়ি করে রাহা’র কথামতো উঠে বসে রিকশায়। রায়হানও আঁড়চোখে তাকায়, চোখমুখ শক্ত করে পায়ের কাছে থাকা ইটের খোয়া’কে রাস্তার বাইরে ফেলে দেয়।
সেই শব্দ রাহা, রোহানের কান পর্যন্ত আসলেও ফিরে তাকায়নি কেউ।
কিছুক্ষণ পরে দেখা মিলে রিকশাচালকের। তাকে দেখেই মাথা তুলে স্বাভাবিক হয়ে বসে রাহা। রোহান এখনো অবাক হয়ে বসে আছে, মুখ থেকে কোনো কথা আসছেনা। একবার রাহা’র দিকে তাকাচ্ছে আবার নিজে হাসছে।
এতক্ষণে খেয়ালে আসে রাহা’র। রিকশা ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। অবাক হয়ে রোহানের দিকে তাকায়। রাহা’র হাত মুঠোয় ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
এত বড় সুখবর দিলা আর আমি কোনো গিফট দেবোনা, তা হতে পারে!
রোহানের কথাশুনে কপাল কুঁচকে তাকালো রাহা। পরক্ষণেই নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেই লজ্জায় পরে গেল। এতক্ষণ যে রায়হানকে শোনানোর জন্য এমন কথা বলছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রোহান।

মিনিট দশেক পরে নিজ বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেমে যায়। রাহা’র মা খুশি মনে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। রাহা অবাক হলেও কিছু বললো না। ওর মায়ের মনমতো কিছু হলেই যে এমন আদিক্ষেতা করবে, তা জানা আছে রাহা’র। বাড়ির মুরব্বিদের সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দু’জনে।
দোচালা ঘর। ছোটখাটো তিনটা চৌকি। সামনের বারান্দার চৌকিতে শুয়ে আছে রাহা’র বাবা। রোহান যেয়ে পাশের চেয়ারে বসলো, রাহা ওর বাবার সাথে কথা বলে ঘরের চারপাশে ঘুরে দেখলো।
ওর মা বাড়ির ও আশেপাশের ঘটে যাওয়া সবকিছুর জমায়েত কাহিনী বলছে, রাহার সেদিকে হুশ নেই। এত আদিক্ষেতার কারণ জানা নেই রাহার। হঠাৎ কি হল! যে মহিলা গতকাল রাতেও ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথা বলছে। আজকে এত খাতিরদারি কোথায় পাইছে জানা নেই রাহার।

কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পরে সন্ধান পায় সবকিছুর। বাজার-সদয় সবকিছু করে রাখা, এতকিছুর আয়োজনে রোহানের হাত আছে বুঝতে পারে রাহা। এজন্যই হয়তো এত আমোদ-প্রমোদ ওর মায়ের।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে গা এলিয়ে দেয় রোহান।
রোহান তীব্র মেজাজে বললো,
রাহা! তুমি এতটা কেয়ারলেস কেন?

রোহানের রাগের কারণ বুঝতে না পেরে করুণভাবে তাকায় রাহা। রোহান আবারো বলে,
আমার মেয়েকে কিন্তু ইচ্ছামতো নালিশ দেবো। এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? এই অবস্থায় এত কম কম খাওয়া উচিত? যেহেতু আমার বউ ছোট, তাই আদর করে খাওয়ানোর দায়িত্বও আমার। তাই বলে তুমি নিজে এত কেয়ারলেস হবা? চুপচাপ সবকিছুর দায়িত্ব আমায় দিবা নাহলে কিন্তু বারবার বমি করানোর দায়িত্ব আমার। বুঝলা বউ?

রাহাকে হুবহু কপি করছে রোহান। রাহা বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। রোহান হেসে দেয়।

রোহান কয়েকবার রাহাকে থাকতে বলে। তবে রাহা একবারের জন্যও হ্যাঁ বলেনি। বাপের বাড়ি দেখতে ইচ্ছা করছিল সেকেন্ডের জন্য হলেও আসতে পারছে এটাই অনেক। যে বাড়িতে নিজ থেকে সবকিছু দায়িত্ব নেয়ার পরে এত আমোদ-প্রমোদ হয়, সে বাড়িতে প্রয়োজন শেষ হলেই আগের রূপ দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই রাহা আর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছুক নয়।
রোহানও জোর করেনি। রাহার মা কয়েকবার বলেন, কিন্তু রাহা থাকবে না। ওর বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। এখন আর আগের মতো রাগ দেখতে পায়না রাহা। যে বাবা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই রাহাকে মারতো,কথা শুনাতো। আজকে সে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে ছিল রাহা’র দিকে। আজকে চোখে কোনো রাগ দেখতে পায়না রাহা। সে ছোটদের মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে, যেন মা দূরে সরে যাচ্ছে। আর বাচ্চা বিছানায় সরোদনে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রাহা। ওর বাবা চোখের পানি ফেলে দেয়, রাহাও কেঁদে ফেলে।
হাসিমুখেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে রাহা।

________

ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে রাহা’কে জড়িয়ে ধরে রোহান। রাহা কেঁদে দেয়, কান্নার কারণ বুঝতে পারেনা রোহান।
স্বামীর জন্য এত ভালবাসা? বউ।

রোহানের কথা শুনে মুখ তুলে তাকায় রাহা। তবে চোখমুখ লাল হয়ে আছে। রোহান আলতোভাবে কপালে ভালবাসার স্পর্শ দেয়।
আমার সাথে যাবে বউ? রাহা ঔষধ প্রয়োজন হলে কোথায় পাবো? ফোনে ঔষধ দিয়ে দিবে কিন্তু। মনে থাকে যেন বউ।
রোহানের কথা শুনে শার্ট খামচে ধরে রাহা।

রোহান হেসে দেয়। দু’গালে হাত দিয়ে ওষ্ঠ নিজের করে নেয় রোহান।
রাহা ঔষধ! পেয়ে গেছি আমি। এখন সারাটা পথ ভাল যাবে বউ।
বউ! আবারো বলছি, তিশার সাথে থাকার দরকার নেই। মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ারও দরকার নেই। মায়ের পক্ষে যাওয়ারও দরকার নেই। ঘরের কাজ করার পরে নিজ কক্ষে থাকবা। আল্লাহকে ডাকবা, যেন সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়। অবসরে আমার সাথে কথা বলবা।
রোহানের কথা শুনে মাথা নাড়ায় রাহা।
বাচ্চার দেখাশোনা করবা। ভালভাবে বাচ্চার মায়ের যত্ন নেবা। বাচ্চার বাবারও ঔষধ সময়মতো দিয়ে দেবা। বুঝলা বউ?(চোখ টিপ দিয়ে)।
রোহানের কথায় লজ্জামাখা হাসি দেয় রাহা।
বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় রোহান। রাস্তা অবধি পৌঁছে দেয় রাহা। মুখে কোনো কথা নেই তাঁর। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বিদায় জানায় রোহানকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here