গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ৬

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৬

কি হয়েছে রাহা? শরীর খারাপ লাগছে? এভাবে কাঁদছো কেন?
রোহানের কথায় কোনো জবাব দিচ্ছেনা রাহা। রাহা’কে খাটে বসিয়ে রোহানও ওর পাশে বসলো। রাহা চুপচাপ রোহানের কাঁধে মাথা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রোহানও আর কিছু জিজ্ঞেস করছেনা, রাহা শান্ত হলে জিজ্ঞেস করবে।
কিছুক্ষণ পরে রাহা নিজ থেকেই বললো,
সবাই এভাবে পর করে দিচ্ছে কেন? আমি কি অনেক খারাপ একজন? কেউ সহ্য করতে পারেনা। একজন হলেও কথা ছিল, একে একে সবাই দেখতে পারেনা আমাকে। তারমানে দোষ আমার’ই এতগুলো মানুষের তো দোষ হতে পারেনা। তাইনা রোহান?
রাহা’র মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে বিষ্ময়কর ভাবে তাকালো রোহান। রাহা শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। রোহান কিছু না বলে রাহা’র মাথা বুকে চেপে রেখে বললো, দোষ তো তোমার’ই বউ। কত কষ্ট করে ঢাকা থেকে আসলাম। তারপরে একটু আদর – যত্ন করবে তা নয়, সে কান্না করছে। কান্না করে করে সমুদ্র বানিয়ে দিচ্ছে। বলি এভাবে কি দিন যায়! না-কি রাত যায়!

এরমধ্যেই তিশার আগমন ঘটলো। দরজার পাশ থেকে উচ্চস্বরে বলছে,
ভাবি! আম্মায় ডাকছে।
রাহা উঠে দাঁড়ালো। একটু দেরী করলেই কথা শুনতে হবে, মরা মা’কে নিয়েও। রোহান কিছু বললো না।
তাসলিমা বেগমের কাছে যেতেই তিনি উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন।
এত কাজকর্ম কে করবে শুনি? তোর মা’য় কইররা দিয়ে যাইবে? সারাদিন ঘরের মধ্যে থাইক্কা আমার পোলাডারে কান পরামিশ (পরামর্শ) দিস? অর্ধেক তো লইয়া গেছো নিজের দিকে, এখন পুরোপুরি আমার পোলারে আমার কাছ দিয়া সরাইতে চাও?
তারমধ্যে তিশা বললো,
সাবধানে বইলো আম্মা। পরে আবার রোহান ভাইয়ার ধারে বিচার দিয়া আরও দূরে সরাইবে। সারাদিন তো বিচারে বিচারেই যায়।

এখানে কথা শোনানোর জন্য নিয়ে আসছো তিশা?
তিশা তেড়ে বললো,
তোমায় কথা শোনানোর সাহস আছে? দলে দলে সবাইকেই তো নিজের পক্ষে হাত করে নিচ্ছো। তাহলে লিডারকে কথা শোনানো যায়?
রাহা বলল,
ভালভাবে কথা বলো তিশা। রোহানের কাছে বিচার দিলাম কখন?
তিশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
এই যে একটু আগেই তো দিলা। ও বুঝছি ওটা বিচার না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে হয়তো অন্যকোনো ছেলের হাত ধরছো। তাই শান্ত মাথায় রোহান ভাইয়া বুঝাইছে, অন্য ছেলের হাত ধরবানা।

তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,
এই অপয়া, অলুক্ষুণে মেয়ের জন্য ঘরে একটার পর একটা অশান্তি লেগেই থাকবে। এখন লোকসমাজেও মুখ দেখাতে দিবিনা? রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার কি আছে? দরকার হইলে আমার পোলারে ছাইড়ড়া তোর নাগরের লগে যাইস।

তাসলিমা বেগম আর তিশার কথা শুনে অনবরত চোখের পানি ফেলছে রাহা। মুখ থেকে কোনো কথা আসছে না। এতক্ষণ যে তিশা ভালোভাবে কান পরামর্শ করছে তা বুঝা যাচ্ছে।
তাসলিমা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকালো। তিশা গালে হাত দিয়ে চোখমুখ দিয়ে অগ্নি নিক্ষেপ করছে।
রোহান ইতিমধ্যে সম্মুখে প্রবেশ করে বললো,
সারাদিন রাহা’র পিছু ছাড়া আর কোনো কাজ নাই তোমাদের?
সারাদিন এই মেয়েটার পিছনে লেগে থাকো কেন? শুধুমাত্র তোমার ছেলের বউ, এই জন্য শাশুড়ি আর বউয়ের পার্থক্য বজায় রাখছো? মা-মেয়ের মতো সম্পর্ক করতে পারছো না কেন?

তাসলিমা বেগম উচ্চস্বরে বললেন,
আবারো এই মেয়ের গুণ গাইছো? এই মেয়ের জন্য তিশার গায়ে হাত তুললি তুই?

রোহান উচ্চস্বরে বললো,
ছোট’রা অতিরিক্ত মাথায় উঠে নাচলে শাসন তো করতেই হয়। রাহা সম্পর্কে ভাবি হয়, তাহলে রাহা’র পিছনে এই মেয়ে লাগছে কেন এত? রাহা ওর বিচার নিয়ে কি সারাদিন ঘুরে বেড়ায়? তাহলে এই মেয়ের সমস্যা কি? সারাদিন লেগে থাকবে। এমন নয় এর সাথে আগে কোনো ঝামেলা ছিল রাহা’র। পরের বারে যদি একই কাহিনী রটে তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।

তাসলিমা বেগম ক্রোধের সাথে বললেন,
তিশা ছোট। ওর সাথে এমন করিস কেন তুই?

রোহান বললো,
তিশা ছোট আর রাহা বড়? তাহলে তোমার ছোট তিশাকে বলে দিয়ো রাহা’র পিছু যেন না লাগে। কারণ ছোট’রা তেড়ামি করলে কিন্তু বড়’রা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলতে বাধ্য।

তিশা রেগেমেগে স্থান ত্যাগ করলো। রাহা’কে নিয়ে রোহানও চলে আসলো। তাসলিমা বেগম বসে বিরবির করছে।
মাহতাব খন্দকার রোয়াকে বসে সবকিছু শুনছিলেন কিন্তু ঘরের ভেতরে আসেননি। নিত্যদিনের ঘটনা একই। আজকে রোহান ছিল বিধায় মেয়েটার উপরে মানসিক নির্যাতন কম হইছে। রোহান না থাকলে মাহতাব খন্দকার সামাল দিতো,তাও হিমশিম খেতে হতো। তাসলিমা বেগমের সাথে কোনোকালেই কারো যুক্তির সাথে মিলতো না। সে নিজের যুক্তিতে নিজে অনড় থাকে।
এই নিয়ে এককাল কেটে গেল, এখন বুড়ো বয়সেও ঝগড়া-ঝামেলা করতে ইচ্ছা করেনা।

_______

সন্ধ্যার পরে রেহেনা বেগম কয়েকবার রায়হানকে কল দিলেন। কিন্তু একবারের জন্যও রায়হানেক পাচ্ছেন না তিনি। রাত ৮ টা নাগাদ ঘরে ফিরে রায়হান। রেহেনা বেগমের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ওর রুমে যেয়ে খাটে শুয়ে পরে। রেহেনা বেগম চেয়ার টেনে রায়হানের পাশে বসলেন।
“ভাত খাবিনা? বাবা!”
‘দাও’
‘তুই আয়, আমি খাওন দিতেছি।’
বাবা! ঢাকা যাবি কবে?

কেন? বাড়িতে থাকলে সমস্যা হচ্ছে? তাহলে কালকেই চলে যাবো(রেগে)।

এভাবে কথা কও ক্যান? বাড়িতে কয়দিন থাহো আমি জানি? পিঠা বানাইয়া খাওয়ামু তাই জিগাইলাম। কি কি পিঠা খাবি? বাবা।

যা ইচ্ছা করো।

রেহেনা বেগম আর কিছু বললেন না। কারণ রায়হানের থেকে ভাল কোনো উত্তর আশা করেন না।

_____

পরের দিন দেখা মিলে তুহিনের। রোয়াকে বসে আড্ডা দিচ্ছে মাহতাব খন্দকারের সাথে। রোহান এসেও যোগ দেয় । তাসলিমা বেগম চা করার জন্য রান্না ঘরে যেতে নিলেই রাহা বাঁধা দিয়ে নিজে যায়। এদিকে উঠোন দিয়ে দৌঁড়ে ঘরে প্রবেশ করে তিশা। তুহিনকে তার আগের থেকেই চেনা-যানা। রোহানের মাধ্যমে বহুবার আসছিল এই ঘরে। তখন থেকেই পরিচয় তাঁদের। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করা মাত্র’ই ফোনে মেসেজ আসে। লজ্জামাখা মুখে মেসেজের উত্তর দেয় তিশা। এদিকে তুহিন মনে মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে চা হাতে উপস্থিত হয় রাহা। বিয়ের সময়ে আসতে পারেনি তুহিন। তাই এই মুহুর্তে রোহানের বউকে দেখে অনেকটা চমকে উঠে তুহিন। লজ্জায় নিচে তাকায় তুহিন, এদিকে রাহাও খানিকটা চমকে উঠে।
এই মেয়েই তো বছরখানেক আগে স্কুলের পশ্চিমে, নদীর পাশ ঘেঁষে রাস্তায় কতগুলো মানুষের সামনে অপমান করে তুহিনকে। প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল বিধায় অপমানিত হতে হয়। তারপরে দীর্ঘদিন দেখা মিলেনি। হঠাৎ আজকে এই মুহুর্তে দেখে পুনরায় লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে তুহিনের। রাহা তড়িঘড়ি করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো।
খোলা আকাশের নিচে হাঁটছে আর জল্পনা কল্পনা করছে সবকিছু। বন্ধুর জন্য কিছুটা হলেও স্যাক্রিফাইস করা উচিত। পুরনো শত্রুতার জেদ ধরে এখন এমন কিছু করা উচিত না যার জন্য বন্ধুত্বের অমর্যাদা ঘটে। রোহানের বাড়ির আশেপাশে তো সারাক্ষণ থাকবো না তাহলে এসব না ভাবাই ভাল। কিন্তু তিশা! গার্লফ্রেন্ড থাকলেই তো আর সে বউ হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই বাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তুহিন।

খাটে আধশোয়া হয়ে একেরপর এক কল লাগায় তিশা। একবার তুহিনকে, একবার রায়হানকে। কারোই কোনো হদিস পাচ্ছেনা। মেজাজ তীব্র করে ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলে তিশা।

_______

ফোন রিসিভ করা মাতই কর্কশ কন্ঠ ভেসে আসে অপরপাশ থেকে। রাহা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। রাহা’র মা বলে যাচ্ছেন,
ঘরে বাজার নাই, তোর বাপের ঔষধ নাই। এরমধ্যে তুই আইস না, খাবি কি?
আর আইলে বাজারসদয় নিয়ে আইস। জামাইরেও তো একবার আনোন লাগে বাড়িতে।

রাহা’র মায়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাচ্ছে রাহা। কিছু বলতেও পারছেনা রোহান পাশে বসা আছে।
এই ছয়মাস ধরে একটা কথাই শুনতে হইছে রাহা’র। যখনি ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা উঠছে বারবার এমন কথা শোনা লাগছে। এই নাই, সেই নাই। তাই ইচ্ছা থাকলেও বাড়িতে পা রাখতো না রাহা। কিন্তু ইদানীং বাল্যকালে বেড়ে ওঠা বাড়িটার অাঙ্গিনা দেখতে ইচ্ছা করে রাহার। রাহা’র কোনো জবাব না পেয়ে ওর সৎ মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
বাজারের কথা কইছি তাই কথা বন্ধ হইয়া গেছে?
তার কথার উত্তর না দিয়ে,রোহানের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে কল কেটে দেয় রাহা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here