#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৫
.
রোহানের কথা শুনে রাহা’র মুখমণ্ডলে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পরছে। রোহান গভীর মনযোগে দেখছে সেই লজ্জামাখা চাহনি।
—- রাহা!
—- ‘উহু’
—- এভাবে লজ্জাবতী গাছের মতো আছো কেন? এই মারাত্মক নেশায় আসক্ত করতে চাইছো বারবার?
রাহা!
যতোই চেষ্টা করে নেশায় ফেলতে চাও, আমারও কিন্তু নিজের আবিস্কৃত ঔষধ আছে। রাহা ঔষধ। দেখবে তার কার্যকারিতা?
রোহানের কথা শুনে রাহা কাচুমাচু হয়ে রোহানের বক্ষে ঢলে পরলো। রাহা’র এমন কাণ্ড দেখে রোহান হেসে দিল। বুঝতে পারছে রাহা মুখ লুকিয়ে রাখার জন্যই এই বক্ষে আশ্রয় নিয়েছে।
______
গোসল করেই ঘুমের রাজ্যে পা দিয়েছে রায়হান। এখনো উঠার হদিস নেই কোনো। ওর মা রেহেনা বেগম কয়েকবার ডেকে গেছেন। কিন্তু রায়হান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ব্যর্থ হয়ে রেহেনা বেগম বৈঠকখানায় বসে বসে মুখে পান দিলেন আর বিরবির করছেন। বিল্ডিং থাকা সত্ত্বেও তাদের ঘরের টিনের ছাউনি রয়েছে। তাঁর স্বামী মোর্শেদ খান বিল্ডিং তৈরি করার সময়েই বলেছেন, এত কষ্ট করে ছেলেকে বড় করছেন। ছেলে লেখাপড়া করবে, চাকরি করবে তারপরে ৩ তলা ফাউন্ডেশন সম্পুর্ণ করবে। সেভাবেই বিল্ডিংয়ের অর্ধেক কাজ করে রেখেছেন। তাছাড়া ছেলে শহরের কলেজে পড়ে, এখন তাঁদেরকে কে পায়!
রেহেনা বেগম বৈঠকখানায় বসা মাত্রই বাড়ির কয়েকজন বয়স্ক মহিলাও এসে বসছেন।
একজন জিজ্ঞেস করলেন,
রায়হান কোথায় আছে? জবাবে রেহেনা বেগম বললেন, রায়হান ঘুমাচ্ছে এখনো।
পান মুখে দিতে দিতে ঝর্ণার মা বললেন,
—- ওই বাড়ির বউরে দেখছো না রায়হানের মা?
রেহেনা বেগম পানের পিক ফেলে বললেন,
—- কোন বাড়ির বউয়ের কথা কও?
—- ওই যে খন্দকার বাড়ির বউ। মাহতাব খন্দকারের পোলা রোহানের বউ। ওরে দেখছো?
রেহেনা বেগম চোখ-মুখ খিঁচিয়ে জবাব দিলেন,
—- দেখমু না ক্যা! ওই মাইয়ারে তো দেখছিই। এহন কি হইছে? কও দেহি।
—- আজকে ওই দক্ষিনের রাস্তায় আইছিল। ওমন পুতুলের মতোন একটা মাইয়ারেও দেখতে পারেনা রোহানের মায়। মাইয়াডারে দেখলে পরাণ জুড়ায়। দুধবর্ণ গায়ের রঙ, চুলের খোঁপাও কত বড়। আর মাইয়াডাও ভদ্র, এমন মাইয়া যদি ঘরের বউ হইয়া আয় তাইলে আর কিছু লাগে?
ঝর্ণার মায়ের কথা শুনে রেহেনা বেগমের চোখের পাতা ঘনঘন নড়ছে। ঝর্ণার মায়ের কথায় অন্য একজনও সম্মতি দিয়ে বললেন,
—- মানুষ পাইলে তার মর্যাদা দেয় কয়জনে! যদি একখান উড়নচণ্ডী আইতো বউ হইয়া তাইলে বুঝতো। শাশুড়ি আর বউয়ের কাহিনী কারে কয়!
এখন তো বোজেনা রোহানের মায়। রোহানের বউ তো অনেক শান্তশিষ্ট, ভদ্র মাইয়া তাই ওনারে কিছু কয়না। নাইলে বুজতো কত ধানে কত চাউল হইবে।
ঝর্ণার মা বললেন,
—- তালি বাজাইলে কিন্তু শব্দ হয়। এমনে যদি হারাদিন বউ বাজাইতে থাহে তাইলে কোনদিন যেন বউও তাঁর মতো হইয়া যায়। মানুষ কি হারাদিন এমন সহ্য করবে! কিন্তু একদিক দিয়া শান্তি লাগে, রোহান ওর মায়ের মতোন না। যেমন মাইয়া পছন্দ কইরা আনছে ওর মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তেমনি মর্যাদাও করে। মাইয়াডার সবদিকে খেয়াল রাহে। একবারে ওর বাপের মতোনই শান্ত হইছে পোলাডায়।
মাইয়াডা আসলেই পোড়াকপালি। কোনো জায়গায় শান্তি পায়না, দুই একজন ছাড়া কেউ সইতে পারেনা। বাপের বাড়িতেও নাকি সৎ মায় জ্বালায়, বাপেও কোনো প্রতিবাদ করতো না। মানষে হুদাই কয়না, মায় মরলে বাপ খুড়ো হয়ে যায়।
তাঁদের কথা শুনে রেহেনা বেগম চুপচাপ হয়ে গেলেন। আজ রাহা যদি তাঁর ঘরের বউ থাকতো তাহলেও তো সবাই কত প্রশংসা করতো। তিনি মেয়েটিকে ভালভাবে দেখেননি কখনো, দেখলেও ছোটচোখে দেখছেন। মা মরা মেয়ে, মায়ের শাসন ছাড়া ভাল হবে সে মেয়ে! এমন চিন্তাভাবনার জন্য আজকে চুপচাপ হয়ে গেলেন। রায়হানের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে যখন জানতে পারেন তিনি। তখনি রায়হানকে সবকিছু থেকে দূরে নিয়ে আসেন। এমনকি তার কিছুদিন পরেই ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। লেখাপড়া করবে সেখানে, তারপরে চাকরি তখন আর এই মেয়েকে মনে থাকবেনা। তাঁর ছেলের জন্য কত ভালো ঘরের মেয়ে আনতে পারবে, তাহলে শুধু শুধু এই মেয়েরে কেন আনবে!
ঝর্ণার মা বললেন,
—- রায়হানের মা! তুমি চুপচাপ ক্যান এত?
রেহেনা বেগম স্মিত হাসি দিলেন।
রায়হানের মা! মাইয়াডারে একবার সামনা-সামনি দেখবা? তাইলে সময় কইরা একদিন যাইতাম। এমন লক্ষী-মন্ত মাইয়া দেখলেও চোখ জুড়াইবে।
রেহেনা বেগমও সম্মতি দিলেন। এত প্রশংসা শুনে আজকে তাঁর চোখদুটোও রাহা’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা মরা থাকলেই কি সে খারাপ হয়! মায়ের গুন , বৈশিষ্ট্যও তো থাকে। আর সৎ মা তো দোষ খুঁজবেই, তাহলে সেগুলোকেও তো সত্যি বলে মেনে নেয়া ঠিক নয়। রেহেনা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকিয়েই থমকে গেলেন। রায়হান চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনা বেগম ঢোক গিলে রায়হানকে বললেন,
—- কখন আসলি বাবা?
রায়হান কিছু না বলে চুপচাপ বাইরের দিকে বেড়িয়ে গেল। রেহেনা বেগম পিছন থেকে কয়েকবার ডেকে বললেন,
—- খেয়ে যা।
রায়হান কিছু বললো না।
উপস্থিত থাকা প্রতিবেশীরা বললো,
পোলারে বিয়া দিয়া দাও রায়হানের মা। তাইলে কথা শুনবে। তোমার কথা না শুনলেও বউয়ের কথা শুনবে(হেসে হেসে)
রেহেনা বেগম গম্ভীরভাবে বললেন,
—- আমার পোলার বিয়ার বয়স হয়নায়। হইলে বিয়া দিতাম আগেই।
রেহেনা বেগমের কথা শুনে সবাই হাসলো। রেহেনা বেগমের মুখে হাসি নেই। যা বুঝার বুঝে গেছেন সে। রায়হান যে এতক্ষণ সব কথাবার্তা ভালো ভাবেই শুনছে বুঝতে বাকি নেই তাঁর।
_____
রাহা!
আমিতো তিন চার দিন পরেই চলে যাবো ঢাকায়। তখন কি করবো রাহা? ওয়ালেটের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাবো তোমায়? একাএকা তো থাকতে ভাল লাগবেনা। তাছাড়া আমি ঘুমহীন সময় কাটালে রাহা ঔষধ কোথায় পাবো? রাহা ঔষধ যে সব সময়ের জন্য চাই।
রাহা কথা বলছো না কেন? তুমি কথা না বললে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। উফফ কি অসহ্য যন্ত্রণা!
এখন কি হবে রাহা? ব্যথা দিয়ে মুক্তি দিবে আমায়?
রোহানের কথা শুনে রাহা আরও রোহানের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। রোহান খিলখিল করে হাসছে।
হঠাৎ রোহানের হাসি থেমে গেল। মুখমন্ডলে হঠাৎই কালো মেঘ জমে গেছে। রাহা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে রোহান মেঘের ন্যায় মুখ করে আছে। রাহা কিছু বলার আগেই রাহা’র দু’গাল ধরে রোহান বললো,
—- সাবধানে থাকবে।
মায়ের বিরুদ্ধে যেতে হবেনা। তিশার সাথে মিশতে হবেনা। তাছাড়া ঘরের কাজ করার পরে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই রাহা। ঘরেই থাকবে, কারো সাথে মেশারও দরকার নাই। আল্লাহ’কে ডাকবে যেন মায়ের বুঝ দেয় একটু।
রাহা অস্ফুটস্বরে বললো,
—- আচ্ছা।
রোহান কিছু না বলে রাহা’র কপালে ভালবাসার স্পর্শ দিল।
সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
দক্ষিনে মোল্লাবাড়ির মসজিদে গ্রামের সবাই নামাযে যায়। আশেপাশের এই একটা মসজিদ কাছে বিধায় সবাই এখানেই নামায আদায় করে। দেখা-অদেখা প্রায় জনের সাথেই সাক্ষাৎ মিলে এখানে। রোহান নামাযে দাঁড়িয়েছে, পাশে কারো উপস্থিতি মিলছে তাঁর। এই মুহুর্তে কত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হবে, তাই সেদিকে মনযোগ না দিয়ে নামাযে মনযোগ দিলো রোহান। রোহানের ভয় হচ্ছে, মনে কুহু গাইছে তবুও চুপচাপ আছে সে। আল্লাহর কাছে মনপ্রাণে রাহা’র অস্তিত্বের সুরক্ষা চাইছে। তাসলিমা বেগমের মস্তিষ্কের পরিবর্তন চাইছে। মাহতাব খন্দকারের ধৈর্যের বাঁধ এমনি থাকুক সেই প্রার্থনা করছে। সারাজীবন যেন রাহা’র অস্তিত্বে বিলীন হতে পারে সেই প্রার্থনা করছে।
মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময়ে দেখা মিলে পাশের লোকটির সাথে।
তুহিন! এসেই রোহানকে জড়িয়ে ধরলো। তুহিনের পিঠে চাপড় মেরে রোহানও জড়িয়ে ধরলো।
তুহিন হেসে হেসে বললো,
নতুন বিয়ে করে বউকে কাছে পেয়ে বন্ধুদেরকে ভুলে গেছো!
রোহান আবারো চাপড় মেরে বলল,
নামায শেষে এসব কথা মুখে আসছে তোর? ভাল কথা বল। তাছাড়া আমি কিন্তু অনেক ভদ্রলোক। মুখ খুললে কিন্তু থামাতে পারবিনা।
তুহিন মুখ গম্ভীর বললো,
আমি চিনিনা আপনাকে। কে ভাই আপনি?
রোহান বললো,
বলবো আমি কে?
রোহানের মুখ চেপে তুহিন বললো,
ঘরে যা শালা। তোর বউ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।
তুহিনের কথা শুনে রোহান হেসে দেয়। তুহিন বললো,
ভাবিকে দেখা হয়নি। একদিন যাবো দেখতে।
রোহান বলল,
নিজে বিয়ে করে নিজের বউরে দেখিস শালা। তুহিন মুখ গম্ভীর করে বলল,
বিয়ে করলেই ঝামেলা। বউয়ের কথা শোনা লাগে। এমন করবা না, তেমন করবা না। আজাইরা ঝামেলা। তাছাড়া আমার এতগুলো গার্লফ্রেন্ডের কি হবে রে! ওদের জন্য চিন্তা করেই বিয়ে করছিনা আমি।
তুহিনের কথা শুনে রোহান কয়েকটি চাপড় মারলো।
শালা বজ্জাত। নজর ঠিক কর। গার্লফ্রেন্ড কি আর বউ কি বিয়ের পরে বুঝবি। ভালবাসা একজনের জন্য রাখ। জীবনে কোনো কষ্টই কষ্ট লাগবে না আর।
তুহিন হেসে বললো,
বিয়ের পরে তো একবারে মজনু হয়ে গেলি।
তুহিনের কথা শুনে রোহান কপাল কুঁচকে তাকালো। তুহিন দৌঁড়ে চলে গেল। নাহলে কপালে দুঃখ ছিল।
মোনাজাতে পরিবারের সবার সুস্থতা কামনা করলো রাহা। মরার আগ পর্যন্ত একবার হলেও যেন সবার মনে জায়গা করে নিতে পারে। চোখ দুটো ভিজে আসে রাহা’র। এই ইচ্ছাটা হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে। কেউ তো সহ্যই করতে পারেনা, তাহলে মনে জায়গা করবে কিভাবে!
নিজ বাড়িতে কারো সাথেই কথা হয়নি বহুদিন ধরে। তাঁরা একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি, না রাহা করছে। অভিমান করে আছে রাহা। তাঁরাও কি অভিমান করে আছে!
সৎ মা এই জন্য হয়তো সে যোগাযোগ করেনা। তাহলে বাবা যোগাযোগ না করে আছেন কিভাবে? একবারের জন্যও কি মনে পরছেনা আমার কথা!
কেঁদে ফেলে রাহা। রোহান এসে ব্যস্ত হয়ে পরে। হঠাৎ কি হল রাহা’র। শরীর খারাপ লাগছে?
#চলবে