গহন_রাতে_শ্রাবণধারা পর্ব ৪

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৪

তিশার এমন আচরণ ভাবাচ্ছে রাহাকে। মানুষ রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায়। কেউ কারণ ছাড়া, আবার কেউ কারণে। ঠিক তেমনি কেউ কারণ ধরতে পারে, কেউ পারেনা। কিন্তু এই মুহুর্তে তিশার পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পায়নি রাহা। এইতো যখন মাধ্যমিকে একসাথে যেতো তখন অন্যসবার মতো তিশাও রাহার কাছের একজন ছিল। সবকিছুই শেয়ার করতো একজন অন্যজনকে। সেই সুবাদেই রাহার অতীত সম্পর্কে জানতে পারে তিশা। এমনকি রায়হান সম্বন্ধে সবকিছু জানা আছে তিশার। তিশার কিছু জানেনা এমনও নয়। তিশাও বলেছিল, সে কাউকে পছন্দ করে। শুধুমাত্র আত্নীয়তার জন্য সবকিছু এলোমেলো। যদি একতরফা না হতো তাহলে ওর সম্পর্কের সূচনা ঘটতো। কিন্তু যাকে পছন্দ করে কখনো বলতেই পারেনি মুখ ফুটে। তখন এ কথাগুলো বলার সময়ে তিশার মুখের ভাব-ভঙ্গি অনেকটা অন্যরকম ছিল। লজ্জামাখা চাহনি থাকতো তার। কিন্তু আজকের তিশা সম্পুর্ণ আলাদা একজন। যার প্রতিটি কথায় আলাদাভাবে অর্থের প্রকাশ ঘটে।

_________

—- আমার বউ কি করে এখন?
—- মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল তাই ঠান্ডা করছি।
—- কেন? কি হয়েছে?
—- কি আর হবে তোমার ‘রাহা’ আমার উপরে খবরদারী করতে আসছিল।
তিশার ঝাঁঝালো কন্ঠে রাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে একটুও অবাক হয়নি রায়হান। যখন থেকে তিশার সাথে সম্পর্কে যুক্ত তখন থেকেই এই অভিযোগ শুনতে হয়। মূলত রায়হান গ্রামে এসে যখন জানতে পারে রাহার বিয়ে হয়েছে। রোহানের সাথেই বিয়ের সম্পর্কে বাঁধা পরেছে তখন থেকেই রায়হানের মাথা ভীষণ ভাবে নাড়া দিতে শুরু করলো। এমনকি তিশাকে কিছু বলার আগেই রায়হানকে আশেপাশে দেখলে তিশা অন্যরকম করতো। যার কারণে না চাইতেও তিশাকে নিজের দিকে নিতে পারে রায়হান।
রায়হানকে চুপচাপ দেখে তিশা বলতে শুরু করলো,
—- রাহা’র ব্যাপারে বললাম তাই মুখ বন্ধ হয়ে গেল? আগের প্রেমিকা বলে কথা, তাই কষ্ট লাগতেই পারে।

রাহা’র কথা শুনে রায়হান নিজেকে সংযত করে বললো,
—- ধুরো। ওইসব বাদ দাও। তিশা অন্যের বউ, ওর ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া করবো কেন? এখন বলো, কি করছো?

“তিশা শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
—-বারান্দায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। বাগানে বসেও কথা বলা যায়না, তাহলেও খবরদারি শুরু করে দেয় তোমার রাহা। ”

“রায়হান রেগে বললো,
—- আমার রাহা, আমার রাহা বলছো কেন? ও কি আমার বউ? ”

“তিশাও ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
—- মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত ধরার সময়ে মনে ছিল না? ”

“তিশার কথা শুনে রায়হান কোনো কথা বলছেনা। তিশা খানিকটা রেগে বললো,
—- গায়ে লাগছে? রাহা’র কথা বললেই গায়ে লাগে সবার? রাহা কি সবাইকে কালো জাদু করে রাখছে? না-কি ‘ও’ মানুষ নিজের আয়ত্ত্বে নেয়ার জাদু জানে। ওর কথা কাউকে বলাই যায়না, সবাই তেড়ে উঠে। ”

“রায়হান ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
—- রাহা রাহা রাহা করছো কেন? ওর আচরণ জাদু করার মতোই। যে কেউ বাঁধা পরে যাবে। তাই অন্যের সম্পর্কে কিছু বলার আগে নিজেকে ঠিক রাখো। তাছাড়া রাহা অতীতে ছিল, বর্তমানে নেই। তাই বারবার ওর কথা আমাদের মধ্যে আনবেনা।
সবাই সবাই করে যাচ্ছো কেন? সবাই কি বলে না বলে সেসব কথা আমার টাকা শেষ করে ফোনে বলতে হবে?”

—- ‘রাহা’র গুন তো ভালোই গাইছো। তাহলে এটা জানা উচিত ছিল না তোমার? মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্য বাড়ির বউয়ের হাত ধরলে, যদি তাঁর স্বামীর চোখেই পরে তাহলে কেমন হতে পারে?
তাছাড়া, আমি এতটা অবুঝ নই। তুমি যে রোহান ভাইয়াকে দেখেই রাহা’র হাত ধরেছিলে ভালভাবেই বুঝতে পারছি।

—- মানে?

—- মানে বুঝোনা? রাস্তায় তো কতক্ষণ যাবৎ অন্যের বউয়ের উপরে নজরদারি করলে, তখন হাত তো দূরের কথা পাশ ঘেঁষেও দাঁড়ালে না। যখনি তাঁর স্বামী রাস্তা দিয়ে আসছিল, তখনি তোমার হাত ধরে ইমোশনাল হতে হবে? বুঝিনা কিছু আমি? বোকা পাইছো আমায়?

তিশার কথায় খানিকটা থতমত খেল রায়হান। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- তিশা! বেশি বেড়ে গেছো তুমি।

তিশা আজকে বাঁধ মানছে না। সে একেরপর কথা শুনিয়েই যাচ্ছে রায়হানকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
—- সত্যি কথা বললে তাকে অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াই বলে রায়হান। গ্রামে বড় হইছি তাই বলে বোকা ভাবছো আমায়? পুরো গ্রামের মানুষ নাচাতে পারি আমি।

রায়হান আবারও দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—- বলা শেষ?

তিশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
—- এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে? মাত্র তো শুরু হল সবকিছু। অন্য কারো জন্য আমাদের মধ্যে ঝামেলা করবো কেন? তাইনা রায়হান?

রায়হান খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
—- ওহ! হুম।
—- হুম কি?
—- ওই যে বললা না! অন্য কারো জন্য আমাদের মধ্যে ঝামেলা হবে কেন, তাই হুম বললাম।
“রায়হানের কথায় তিশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো”,
—- রায়হান! তাহলে আমাদের দুজনের চাওয়া-পাওয়া ঠিক থাকুক। তাইনা?
রায়হান অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
—- ম ম মানে?
তিশা পুনরায় হেসে বললো,
—- বুঝোনা তুমি? যে জন্য আমার সাথে নতুনভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছো। সেই চাওয়া-পাওয়ার কথা বলছি আমি। তোমার ইচ্ছাও ঠিক থাকুক আর আমার ইচ্ছাও। ঠিকাছে?
“মুখে মুখে তিশার কথার সম্মতি প্রকাশ করলো রায়হান। তবে তিশাকে চারআনাও বিশ্বাস করেনা। এই মেয়েটি প্যাঁচ দিতে এক সেকেন্ডও সময় নিবেনা। বলা তো যায়না, কখন আবার রায়হানকে প্যাঁচে ফেলে। তাই মুখে মুখে তিশার কথায় সম্মতি জানালো।
তিশাও অমায়িকভাবে হেসে ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দিল। এদিকে রায়হান রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে গাছের শিকড়ে বসে আছে। এতক্ষণ এখানে বসে বসেই কথা বলছিল তিশার সাথে। কি ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা! রায়হানকে কথা দিয়ে পুরো পেঁচিয়ে ধরছিল। এখন রায়হানের মনে হচ্ছে, সাপের লেজে পা দিয়ে বলছে – ছোবল দে, ছোবল দে। নিজের দোষেই নিজের দুর্গতিকে ডেকে এনেছে রায়হান। এই সত্য-মিথ্যার সম্পর্কে তিশার সাথেই কেন জড়াতে গেল! রাগে পা দিয়ে সামনে থাকা মাটির স্তুপটিকে সামনের ডোবার মধ্যে ফেলে দিল।”

________

সূর্যের সোনালী আলোয় চারিদিকে আলোকিত হয়ে আছে। তেমনি গরমের উত্তাপও বেড়েই চলেছে। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক, যার জন্য অন্যরকমের মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষিনের জানালা দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এই প্রকৃতির দিকে কোনো খেয়াল’ই নাই, সে ব্যস্ত হয়ে আছে অন্য একটা অস্ত্বিত্বের উপরে নজরদারি করতে। বিদ্যুৎ নাই ঘণ্টাখানেক সময় হল, এখনো আসছে না। প্রকৃতির ভালোবাসা থাকলেও, গরমে যেন সেই অস্তিত্বের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছে একজন।
হাত পাখা নাড়ছে আর পুতুল বউকে নজরদারি করে যাচ্ছে রোহান। এদিকে রাহা’র কোনো হুশ নেই। সে গভীর ঘুমে বিভোর। রাহা’র কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলোকে ঠিক করে দিল রোহান। এই পুতুল বউয়ের থেকে নিজেকে কখনোই দূরে রাখতে পারেনা । না পারে কোনোভাবে রেগে থাকতে। মনে মনে প্রার্থনা করছে রোহান, এমনভাবেই যেন নিঃশ্বাস অবধি পাশে থাকতে পারে। মুখে হাসির রেখা টেনে ঘুমন্ত রাহা’র মুখের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর মনযোগ দিয়ে। একপর্যায়ে ওষ্ঠ এক করে নেয় রোহান। এরমধ্যেই তড়িঘড়ি করে উঠে পরে রাহা। রোহান অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘ আমার অসুখ তাই ঘুমানো দরকার কিন্তু ঘুম আসছিল না। তাহলে ঔষধ দরকার না বলো! কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। তাহলে নিজের ঔষধ নিজের তৈরি করতে হবে । তাই তো নিজের মতো ওষুধ আবিস্কার করলাম। রাহা ঔষধ! আবিস্কারক রোহান খন্দকার। ’
রোহানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাহা। রোহান বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছে। রোহান দাঁত বের করেই বললো,
—- শুভ অপরাহ্ন ঔষধ।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here