গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ৩

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_৩

ভোরের মিষ্টি আলোয় ঘুম ভাঙে রাহার। কিন্তু ওঠার শক্তি নেই, রোহান আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে শুয়ে আছে।
অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। তবুও রাহা অনেক কষ্টে নিজেকে মুক্ত করলো, যাতে রোহানের ঘুমের কিছু না হয়। নিজেকে পরিপাটি করে রান্নাঘরের দিকে পা ফেললো রাহা। এতক্ষণে হয়তো ওর শাশুড়ীর চিল্লাপাল্লা শুরু হয়ে গেছে।
যা ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘরে পা ফেলতে না ফেলতেই কথা শুরু হয়ে গেল। তাসলিমা বেগমের থেকে তিশা কথা বেশি বলে যাচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসছে রান্নাঘরে। মেজাজ তো খারাপ হওয়ারই কথা।
—- “এতো বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায় ভাবি? সমস্ত কাজকর্ম পরে আছে সকালের। বাড়ির বউ হয়ে এমন আলসেমি করা উচিত সবকিছুতে?”
একটানা কথাগুলো বললো তিশা।

“তাসলিমা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন। চুপ কর তিশা। পোলা আর ওর বাপে বুঝুক। পোলাডারে তো মাইরা ফালাইছিল কাইল। এহন অসুস্থ পোলা সকালে উঠে কি খাইবে না খাইবে ওসব নিয়া ‘ও’ কি কিছু ভাববে? ”

তিশা একটু জোরে বললো,
— ভাবি!! এখনো দাঁড়িয়ে আছো? রুটি গুলো ভেজে দাও। আমি যাচ্ছি, এত সকালে কেউ ঘুম থেকে উঠায়!! মাথা ব্যাথা করছে এখন (চোখ-মুখ এক করে)

রাহা চুপচাপ এসে উনুনের সামনে বসলো। তিশা চলে যাওয়ার পরে আবারো রান্নাঘরে আসলো।

—-“ ভাবি এত সকালে গোসল করছো যে?” কাজকর্ম করার পরে তো আবারো গোসল করা লাগবে। তখন কি অসুখ বাঁধিয়ে আমাদের ঝামেলায় রাখবা আবারো? তোমার দেখাশোনা করার জন্য না আছে বাপের বাড়িতে কেউ, না এখানে আছে।
কথাগুলো বলে শব্দ করে হেঁটে গেল তিশা। এই রাগের কারণ জানা নেই এখনো রাহার।

“রাহা লজ্জা ঘৃনায় মাথানিচু করে আছে। তিশা এতটা অবুঝ তো নয়। বয়সে রাহার থেকে মাস দেড়েক বড় হবে। তাছাড়া এক ক্লাসেই পড়তো। তারমধ্যে সবকিছু জেনেও এমন না জানার ভান করে এমন অপমান করা উচিত ছিল ওর? তাও তাসলিমা বেগমের সামনে। ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা করে রাহার।”

___________

খাবার নিয়ে রুমে আসলো রাহা। রোহান আধশোয়া হয়ে বসে আছে। রাহাকে দেখা মাত্রই গম্ভীরমুখ করে ফেললো রোহান। রোহানের মুখ বাংলার পাঁচের মতো দেখে চিন্তিত হয়ে পরলো রাহা। চুপচাপ যেয়ে রোহানের পাশে বসে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কি-না এখনো। রোহান পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। রাহা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে যেতে চাইলেই রোহান হাত ধরে পাশে বসায়।
—- স্যরি রাহা।
রোহানের হঠাৎ স্যরি বলার কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা রাহা। শান্তভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপরে বললো,
— স্যরি কেন?
রোহান আমতা-আমতা করে বললো গতকালের জন্য।
রাহা কিছু না বলে রোহানের বক্ষে মাথা রাখলো। রোহানকে কিছু বলতে না দিয়ে রাহা বললো,
—- নিজের বউয়ের কাছে আসলে স্যরি বলতে হয়? জানা ছিল না তো আগে।

রাহা’র কথা শুনে রোহান ঠোঁটে হাসির রেখা তুলে রাহার মাথা শক্ত করে চেপে ধরলো। রাহা কিছু বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে মাথা তুলতে চাইলো। কিন্তু নাছোড়বান্দা রোহান সে দুষ্টু বুদ্ধিতে মেতে উঠলো।
রাহা কঠিনভাবে বললো,
—- ঔষধ খেতে হবে। তাড়াতাড়ি খাবার খাও। আমার কাজে যেতে হবে, কত কাজ পরে আছে।
রাহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রোহান বললো,
—- আমার থেকেও বড় কাজ?
রাহা মাথা উঁচু করে রোহানের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে খাবার সামনে ধরলো।
রোহান কিছু বললো না। ও জানে মিসেস তাসলিমা বেগম চিল্লাপাল্লা করবে রাহার উপরে।
—- রাহা!
—- কি?
—- খাইয়ে দাও৷ আমার ভীষণ অসুখ তো।তাহলে
নিজ হাতে খাওয়া যায়?
রোহানের কথা শুনে রাহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রোহানের মুখের অবস্থা দেখে হেসে ফেললো। তারপরে বললো,
—- ভীষণ অসুখ কখন হল?
—- অসুখ বুঝো না?
রাহা মাথা নাড়ালো। রোহান বললো,
—- তোমাকে পাওয়ার অসুখ হইছে। এ অসুখ যে ভীষণ ভয়ংকর অসুখ।
রোহানের কথা শুনে রাহার মুখখানা নিমিষেই লাল নীল হতে লাগলো। রোহান হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
‘রাহা কিছু না বলে রোহানের মুখের সামনে খাবার ধরলো।
—- তুমি খেয়েছো রাহা?
রোহানের কথা শুনে রাহা শান্তভাবে বললো,
—- তুমি খাওনি, আমি আগে খাবো?
—- আমিতো ঘুমিয়েছিলাম। কত দেরী করে উঠলাম। এতক্ষণ না খেয়ে ছিলা? চল একসাথে খাবো।
কথাগুলো বলেই রোহান খাইয়ে দিল রাহাকে। রাহার চোখ থেকে পানি ঝড়তে লাগলো। রোহান কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, ব্যস্ত হয়ে পরলো।
—- রাহা! শরীর খারাপ লাগছে তোমার? কান্না করছো কেন? আমায় বল, কি হয়েছে?
রাহা কেঁদেই চলেছে।
—- রাহা! কি হয়েছে তোমার?
“রাহা ফুফিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো,”
—- আমার জন্য কত চিন্তা করো তুমি। অথচ আমি সবসময় কষ্ট দেই, দূরে সরিয়ে রাখি। সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয় আমার জন্য।
সবাইকে ঝামেলায় ডুবিয়ে রাখি আমি।
—- এই কান্নার কারণ তোমার? ঘর-সংসার করো অথচ ছেলেমানুষী গেল না এখনো। যত আজগুবি কথাবার্তা মনে পরে আর কান্না করে।

রাহা খুব ধীর কণ্ঠে বললো,
—- গতকাল আমার উপরে রেগে ছিলে তুমি?
রাহার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো রোহান। রাহা আবারো বলতে শুরু করলো,
—- সত্যি বলছি আমি। এই তোমায় ছুঁয়ে বললাম, তিশা নিয়ে গিয়েছিল আমায়।
রোহান গম্ভীরমুখে বললো,
—- রায়হান ছিল? কেন ছিল? আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার বউয়ের হাত ধরবে কেন?
“রোহানের কথা শুনে আত্না কেঁপে উঠে রাহার। তারমানে গতকাল রোহান দেখছে যে রায়হান হাত ধরেছিল! ”
রোহান আবারো বলতে শুরু করলো,
—- রাহা! আমি যেমন ভালমানুষ তেমনি খারাপ। প্রয়োজনে ভালবাসতে পারি, তেমন শাসনও করতে পারি। রায়হানের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক সেসব জানিনা আমি। জানতেও চাইনা। তবে এরপর থেকে যেন এমন কিছু না দেখি যার জন্য আমাদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়। আর কে বা কার সাথে গিয়েছিলে আমি জানতে চাইনি। আগেও বলছি তিশার সাথে এত ঘনিষ্ঠ না হতে।

রোহানের কথায় মাথা নাড়ালো রাহা। রোহান মুখে হাসির রেখা টেনে আলতোভাবে রাহার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করলো।
—- রাহা!
—-‘হু’
—- আমি রেগে কথা বলি তাইনা? বাড়িতে তো সারাক্ষণ থাকবো না৷ কাজও করতে হবে। তাই সবকিছু ভেবেচিন্তে করবে। এটা ভেবো না তুমি একা। আমি আছি, থাকবো। তাই বিশ্বাস রেখো আমার কথার। এমন কিছু করবে না আমি জানি, যার জন্য আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়। তাছাড়া এখন অবুঝ নও তুমি। ভালমন্দ সবকিছুই বুঝতে পারো। আর একটু শাসন করি আমি, কারণ আমার রাহা’কে আমি হারাতে চাইনা। সবসময়ের জন্য কাছে চাই, নাহলে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।
রাহা! কথা বলবে না?
—- হু
—- কি?
—- তিশা ছোট। তাই একটু আধটু অবুঝের মতো রেগে রেগে কথা বলে। তার জন্য ওর সাথে মিশতে পারবো না কেন?
—- রাহা! তুমি খুব বড় হয়ে গেছো? তিশা তোমার থেকে দুই এক মাসের বড় হবে। তাহলে ও ছোট আর তুমি খুব বড় হয়ে গেছো?

—- তিশা বোন হয় তোমার।
—- এমন ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো, খালাতো অনেক বোন হয়৷ তারজন্য সবাইকে মাথায় তুলে নাচাতে হবে?
—– মানে?
—–কিছুনা। দেখো মায়ের কিছু দরকার কিনা। আবার চেঁচামেচি শুরু করবে।
রোহানের দেখে কোনো উত্তর না পেয়ে রাহা চুপচাপ চলে গেল।
রোহান জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। এই তিশা নামক ভাইরাস জীবন থেকে সরে না। সবসময় পিছু লেগে থাকবে। বয়সে অনেকটা ছোট রোহানের থেকে তবুও জীবন ত্যানাত্যানা করে ফেলে। এখন রাহার পিছু লাগছে। কিন্তু বারবার বোঝানোর পরেও রাহা মানতে নারাজ।

রান্নাঘরে বসে সবকিছু জোগাড় করছে রাহা। পাশে টিনের ফাঁকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাগানে দাঁড়িয়ে ফোনে হেসে হেসে কথা বলছে তিশা। আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, ছোট গাছের পাতা নাড়ছে। এত মনযোগ সহকারে কার সাথে কথা বলে!! রাহাও বেশ মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। এরমধ্যেই তাসলিমা বেগম চলে আসেন। এসে রাহাকে এমন বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও তাকায়।
—- তিশার দিকে নজরদারি করা হচ্ছে?
তাসলিমা বেগমের কথায় চমকে উঠে রাহা। তুতলিয়ে বলে,
—- ন না আম্মা।সেরকম কিছু না। আসলে,,,
রাহাকে সম্পুর্ন কথা বলতে না দিয়েই তাসলিমা বেগম বলতে শুরু করেন,
—- নিজের চরকায় তেল দে। তিশার পিছনে লাগতে আবিনা। আর তোর মতো মাইয়ায় তিশার দোষগুণ খুঁইজা পাবি? তোর মতোন তো তিশা হারাদিন আকাম করে না।
তাসলিমা বেগমের কথাটি রাহার গায়ে লাগে। তবুও চুপচাপ হয়ে কাজে মনযোগ দেয় রাহা আর চোখের পানি ফেলে।
এদিকে তিশা এসে তাদের কথোপকথন শুনে রাহার দিকে আঁড়চোখে তাকালো। তাসলিমা বেগম হেসে তিশাকে বললেন,
—- লাবনীর সাথে কথা কইছো?
তিশা হেসে জবাব দিল,
—- হ্যাঁ আম্মা। এক্সাম সামনে তাই সেই ব্যাপারেই বললো।
তাসলিমা বেগম বললেন,
—- আমি জানি তো আমার তিশা মা কেমন। অন্যসবার কথায় সবকিছু কওন লাগবেনা।
তাসলিমা বেগমের কথা শুনে তিশা হাসলো। তাসলিমা বেগমও হেসে চলে গেলেন। ততক্ষণে তিশা রাহার পাশে বসে বললো,
—- সবাইকে তোমার মতো ভাবো? নিজে তো সারাক্ষণ অন্য ছেলের সাথে ঢনঢন করে ঘুরে বেড়াইছো। এখন নিজের মতো অন্যকে ভাববা না। তাছাড়া এমন কান পরামর্শ দিলেও আমার কিছু আসবে যাবেনা।

রাহা তিশার এমন আচরণ দেখে অনেকটা অবাক হয়ে বললো,
—- এসব কি বলছো তিশা? আগের তিশা আর এখনের তিশা কি একজন?
তিশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—- সবকিছু জানা লাগবে তোমার? তাহলে শোনো,
আমি একদম বলতে ইচ্ছুক নই এখন। সময় হলে বলে দেবো খুব পরিষ্কার ভাবে।
কথাটি বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে তিশা চলে গেল।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here