গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ২

#গহন_রাতে_শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
পর্ব_২

শাশুড়ির কথা শুনে বারবার চোখ ভিজে যায় রাহা’র। তবুও নিরুপায় রাহা সবকিছু সহ্য করে রান্নার কাজে মনযোগ দিল। তাসলিমা বেগম বিড়বিড় করে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
অনেকটা দেরী হয়ে গেছে, তাড়াহুড়ো করে একেএকে সবকিছু সামলাতে হবে। না’হলে আবারো কথা শুনতে হবে রাহা’র। কড়াইয়ে তেল দিয়ে পিয়াজ কুঁচি করছে রাহা। আপনমনে ভাবছে কতদিন পরে দেখা মিললো রায়হানের সাথে। অথচ মাঝের সময়টাতে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেল। চাইলেও কেউ কারো কাছে ঘেঁষতে পারবেনা। কেউ কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারবেনা, হাসতে পারবেনা। গভীর চিন্তায় মগ্ন রাহা। এদিকে কড়াইয়ের তেল অতিমাত্রায় গরম হয়ে আগুন উঠে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই রাহার। তাসলিমা বেগম এদিকেই আসছিলেন, রান্না ঘরের এই অবস্থা দেখে চিল্লাপাল্লা শুরু করেন। তাঁর এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে একপ্রকার দৌঁড়ে আসে রোহান। কোনোরকমে রাহাকে টান দিয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে কড়াইয়ে পানি ঢেলে দেয় রোহান। রাহার এতক্ষণে সবকিছু খেয়ালে আসলো। ভয়েভয়ে তাসলিমা বেগম ও রোহানের দিকে তাকাচ্ছে। তাসলিমা বেগমের খই ভাজার মতো তাঁর মুখ দিয়ে বুলি ফুটছে। তাঁর উচ্চস্বরে ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে রীতিমতো কাঁপতে লাগলো রাহা। এখন পরিবার নিয়ে আবারো কথা শোনাবেন তাসলিমা বেগম। নিজের দোষেই আজকে নিজের পরিবারকে কথা শোনাচ্ছে রাহা।
রোহান চোখমুখ শক্ত করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ওর মায়ের কথায় আজকে আর প্রতিবাদ করছে না। এটা রাহার প্রাপ্য ছিল আজ।
দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করে রোহান। রাহা এখনো নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাসলিমা বেগম একপর্যায়ে বললেন,
—- এমন অলক্ষুণে মাইয়ারেও আমার একমাত্র পোলার লইজ্ঞা আনতে হইছে! বাপের বাড়ির কথা কইছি তাই তেজে সবকিছু জ্বালাইয়া- পোড়াইয়া মারতে চাইছো! এমন হইলে স্বামীর সংসারে আইছো ক্যান!! বাপের বাড়ির মানুষ তেজ সহ্য করবে, পরের বাড়ির কেউ না।
রাহাকে ক্রমাগত কথা শুনিয়ে বিড়বিড় করতে করতে রান্না ঘরে পা ফেললেন। আর উচ্চস্বরে রাহাকে বললেন,
” এখনি যেন স্থান ত্যাগ করে। না’হলে বিশ্বাস নাই তাসলিমা বেগমকেই যেন কখন পুড়িয়ে মারে।”

তাসলিমা বেগমের কথা শুনে লজ্জায় তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে রাহা।
“রুমে এসে দেখতে পায়, হাত মুঠো করে বসে আছে রোহান। ”
“রাহা বিছানার এক পাশে বসে ঠোঁট চেপে কান্না করে দেয়। নিশ্চয়ই রোহানও রেগে আছে ওর উপরে। এক বারের জন্যও রোহান রাহার দিকে ফিরে তাকায়না। বরং রুম থেকেই বের হয়ে যায়। রোহানের এমন ব্যবহার দেখে অভিমানে কান্না করে দেয় রাহা। রোহানের থেকে এমন কিছু আশা করেনি কখনো।

প্রায় দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রোহান এখনো বাড়িতে ফেরেনি। তাসলিমা বেগম কয়েকবার রাহাকে কথা শুনিয়ে গেছে, ওর অশান্তির জন্যই না-কি রোহান বাড়ি থেকে চলে গেছে। কত বেলা হয়ে গেল এখনো না খেয়ে আছে ছেলেটা। একটা দিনেও এই মেয়ের জন্য শান্তিতে থাকতে পারেনা কেউ।
তাঁর কথাগুলো শুনে বালিশে মুখ গুঁজে কান্নার গতি তীব্র বাড়িয়ে দেয় রাহা।

এই মানুষটা কখনোই রাগ করেনা, অথচ আজকে কিরকম অদ্ভুত আচরণ করছে। কারণ খুঁজে পায়নি এখনো রাহা। যে মানুষটা না খেয়ে থাকতে পারেনা, অথচ সে এখনো বাড়িতেই ফেরেনি। সবকিছু ওর ভুলের জন্যই হয়েছে। রান্না ঘরে ওই কাহিনী না করলে হয়তো রোহান এখন পাশেই থাকতো।
তিন-চার দিন আগে চাকরির ছুটিতে ঢাকা থেকে গ্রামে আসে রোহান। অথচ তার মধ্যেই ঝামেলা শুরু হল। সারাদিন খাটাখাটুনি করতে করতে দিন যায়, একটু শান্তির জন্য গ্রামে আসছে। এখানেও শান্ত নেই। দুপুরে না খাওয়ায়, ক্লান্ত রাহা কান্না করতে করতেই এক সময়ে ঘুমিয়ে পরে।

এদিকে তাসলিমা বেগম একেরপরে এক কথা শুনিয়েই যাচ্ছে। ছেলেটাকে অশান্তিতে রেখে, বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষকে অশান্তিতে রেখে এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো হচ্ছে!! কাহাকে টেনে হিঁচড়ে ঘুম থেকে তুললে তাঁর শান্তি মেলে। কিন্তু এসব করলে তো গ্রামে ছড়িয়ে যাবে শাশুড়ি বউয়ের গায়ে হাত তুলছে। রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তাসলিমা বেগমের। ছেলেটাও আছে, কোনো কথাই শোনার নয়। পইপই করে বারণ করছিল, এমন ঘরের মেয়েরে বিয়া করন লাগবেনা। মা নাই সৎ মায়ের ঘরে বড় হইছে বাপের ইচ্ছা মেললে খোঁজ খবর নেয়। এমন মাইয়া ঘরে তোলার থেকে না তোলাই ভাল। কিন্তু কেউ শোনেনি কথা। রূপের জাদুতে তাবিজ করছে, রূপ দেইখাই ভুলে গেছে সবকিছু। শেষ পর্যন্ত নিজেকে শান্ত রাখতে না পেরে রাহার কাছে এসেই উচ্চস্বরে কথা বলা শুরু করলো।
—- রাহা আড়মোড়া দিয়ে উঠলো, শাশুড়ির ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে৷ বিয়ের প্রথম থেকেই এমনটা প্রতিনিয়তই শুনতে হইছে রাহার। তখন মনে রোহানকে না ধরলেও কোথাও যাওয়ার ছিলনা রাহার। বাবা-মা তো বিদায় দিয়ে মুক্ত হয়ে গেছে। এখন ও বাড়িতে স্থান নেই, সৎ মা বলে দিছে স্বামী বাড়িতে ঝগড়াঝাটি করে যেন ওই বাড়িতে না উঠে। তাদেরও সংসার আছে, তাই বাড়তি কোনো ঝামেলা বহন করতে চায়না আর।
সেদিন রাহা বাড়ি থেকে আসার সাথে সাথে শপথ করে কোনো কারন ছাড়া যাবেনা। কখনোই না। তাই তাসলিমা বেগমের এমন কড়া কথা শুনেও এখানেই পরে থাকতো, এক মুহুর্তের জন্যও কোথাও যাওয়ার ছিল না রাহার।
কিন্তু এখন তো রোহান আত্নার সাথে মিশে আছে। চাইলেও কোথাও যেতে পারবেনা। স্বামী সংসার যে কি জিনিস এখন বুঝে গেছে রাহা। নিজের জীবনের থেকেও এরা প্রিয় হয়।
প্রথম থেকে এই প্রিয় জিনিসের যত্ন করেনি তাই আফসোসে ভুগছে৷ হয়তো সেই অবহেলার কারন গুলোই এখন কাদাচ্ছে রাহাকে।

গ্রামের বাড়িতে রাত ৯টার পরেই সবাই ঘুমে ঢলুমলু হয়ে যায়। এখন ১১টা বাজে এখন তো কারো সাড়াশব্দই পাওয়া যাবেনা তেমন। অথচ রোহান এখনো বাড়িতে আসেনি। তাসলিমা বেগম রাহাকে অনেক কথা শুনিয়ে নিজের ঘরে গেলেন। রোহানের বাবা মাহতাব খন্দকার কিছু বললেন না। রান্নাঘরের ঘটে যাওয়া সবকিছু বিড়বিড় করে বলে দিলেন। মাহতাব খন্দকার উল্টো ধমক দিলেন তাসলিমা বেগমকে। রাহা ছোট মানুষ রান্না ঘরের সবকিছু কিভাবে সামলাবে। ভুল করতেই পারে। তারজন্য এত রাগারাগির কি আছে?
মাহতাব খন্দকারের কথা তাসলিমা বেগমের পছন্দ হল না। সে উল্টো রাহাকে রেখে মাহতাব খন্দকারের সাথে ঝগড়া শুরু করলেন। জবাবে মাহতাব খন্দকার কিছু না বলে চুপচাপ না খেয়েই শুয়ে পরলেন।

রাত ১১.৩০ এর দিকে দরজায় ঠকঠক শব্দ হল। দৌঁড়ে ছুটে গেল রাহা, এই শব্দের জন্যই হয়তো অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। সবকিছু মুহুর্তেই থমকে গেল রাহার কাছে। রোহানকে ধরে ওর এক বন্ধু নিয়ে আসছে। রাহাকে দরজার কাছে রেখেই রোহানকে নিয়ে ওর রুমে প্রবেশ করলো ওর বন্ধু। কোনোভাবে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। আর বলে গেল, দুপুর থেকেই না-কি জ্বরে ভুগছে রোহান। প্রায় বেহুশ অবস্থা। তাই আজকে এই অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেনি। রাস্তার যে অবস্থা তাতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আরও সমস্যা হতে পারে। কিন্তু রোহান যখন একটু হুশে ফিরলো তখন বাড়ি আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। ভাগ্যিস বাড়িতে জমিল চাচার ভ্যান ছিল, তাই ভ্যান গাড়িতেই আস্তে আস্তে নিয়ে আসছে। না’হলে এত রাতে হেঁটে আসবে কিভাবে!!

রোহানকে এই অবস্থায় দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তাসলিমা বেগম। আজকে রাহাকে কথা দিয়েই মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে। মাহতাম খন্দকার ধমকের সুরে তাসলিমা বেগমকে বললেন,
—- এখান থেইকা যাবা এখন? অনেক রাইত হইছে এহন রাইতে অন্তত মুখটারে শান্তি দাও।
মাহতাম খন্দকারের কথা শুনে রাগে খমখম করতে করতে তাসলিমা বেগম চলে গেলেন। মাহতাম সাহেব রাহার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—- মা’রে!! মাফ কইরা দে আমায়। ভুল আমারই হইছে এই বাড়িতে তোরে নিয়া আইছি৷ আগে সবকিছু জানা উচিত ছিল আমার৷ বাড়ির আসল কর্তী কেমন!
জবাবে রাহা কিছু বললোনা। মাহতাব খন্দকার নিজের ঘরের দিকে পা ফেললেন।

রাহা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছ এখনো। মাহতাব খন্দকারের দোষ কিসের!! সব দোষ নিজের কপালের। দরজা বন্ধ করে রোহানের পাশ ঘেঁষে বসলো রাহা। রোহানের মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে রোহান। রাহাকে এমন মর্মাহত অবস্থায় দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে রোহানের। কিন্তু এই জ্বরের ঘোরে উঠে বসার শক্তি টুকু নেই। নেই কথা বলার ইচ্ছা।
কাঁপাকাঁপা হাতে রাহার হাত স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে রোহান। রাহার চোখের পানিতে প্রায় গোসল করার অবস্থা এই জ্বরের মধ্যে। রাহা কেঁদেই যাচ্ছে এখনো। সবকিছু ওর জন্যই হয়েছে।

মাঝরাতে রোহানের জ্বর কিছুটা কমলো। শুরু হল পাগলামি তাঁরমধ্যে। আজকে বাঁধা দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই রাহা’র। বাঁধা দিলেও শোনার মতো অবস্থায় রোহান নেই। শুরু হলো রাহা’র জীবনের নতুন অধ্যায়।

________
উঠোনের আমড়া গাছের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে একেরপর এক সিগারেট টানছে রায়হান। রাত ১২টার কাছাকাছি এখনো চোখের দু’পাতা এক করতে পারেনি রায়হান। রাহা’কে জীবনে না পেলেও ওর থেকে ভাল কাউকে জীবনসঙ্গী করা যাবে। তবে রোহান!!! যার সাথে সাপ-বেজির সম্পর্ক ছোট থেকেই। সে-ই রাহা’কে নিয়ে গেল!! সুখী জীবন-যাপন করছে? এত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ করে দেয়া যাবে? কখনোই না। ঠোঁট পুড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে, আর এসব ভাবছে রায়হান। অবশেষে রায়হানের মুখে শান্তির হাসির দেখা মিললো। এই হাসির কারন হয়তো কারো জানা নেই।
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে রায়হান। কম-বেশি স্মৃতি এখানেই লুকিয়ে আছে ওর। ভাল কিংবা খারাপ সবকিছুই লুকানো আছে।

_______________________

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here