গহন রাতে শ্রাবণধারা পর্ব ১

প্রায় বছরখানেক পরে প্রাক্তনের সাথে দেখা মিলে রাহা’র। চোখ দুটো ভিজে উঠে দু’জনেরই। সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে মাঝের সময়টাতে। রাহা চলে আসতে চাইলেও হাত ধরে ফেলে রায়হান। পিছু ফিরে হাতের দিকে তাকায় রাহা। রায়হান কিছু বলতে চেয়েও পারেনি। রাহা হাত ছাড়িয়ে চলে আসার সময়ে পিছু ফিরে তাকায় রায়হানের দিকে। রায়হান কিছু না বলে তাকিয়ে আছে, অসহায় সে চাহনি।

এদিকে রাস্তা দিয়েই আসছিল রোহান। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’জনের কান্ড দেখছিল। রাগে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায় তাঁর। চোখমুখ শক্ত করে ঘরে ফিরে যায় সে।

রাহা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। তবুও রোহান ডেকেছিল, রাহা ওর শাশুড়ির দিকে ভীত ভাবে তাকিয়ে রোহানের রুমে যায়৷ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাহা’র দিকে রোহান। মুখমণ্ডল ঘামে ভিজে আছে, গরমের যে উত্তাপ এর জন্য ঘামে ভেজা স্বাভাবিক ব্যাপার।
রাহা গম্ভীরভাবে বললো,
—–কিছু বলবা?
রোহান কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
——- রাস্তায় গিয়েছিলে কেন?
“রাহা ধীর কণ্ঠে বললো,”
——-তিশা নিয়ে গিয়েছিলো।
রোহান কিছু না বলে বিছানায় বসে পরলো। রাহা পাশে এসে দাঁড়ালো। রোহান শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
—–রান্না ঘরে যাও। মা রেগে যাবে।

রাহা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রোহানের দিকে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। বিদ্যুৎ লাইনে সমস্যা, বেশিক্ষণ থাকেনা। রাহা হাত পাখা নিলো, রোহান অভিমানের সুরে বললো;
“লাগবেনা”
রাহা কিছু না বলে রোহানের পাশে বসলো। রোহান চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটির থেকে চাইলেও কোথাও যেতে পারেনা রাহা। হাত-পা বাঁধা তাঁর। এটা ভালবাসা না-কি মোহ জানা নেই রাহার। তবুও এই মানুষটিকে ফেলে কোথাও যেতে পারবেনা।
চোখমুখ দেখে বেশ বুঝা যায়, সে রেগে আছে। অভিমান করে আছে। কিন্তু প্রকাশ করেনা। ভালবাসাও প্রকাশ করেনা কখনো। রাহা বুঝতে পারে, কিন্তু আজকের রাগ, অভিমান সবকিছু রাহা বুঝতে পারে। যেভাবে ভালবাসা বুঝে।
রোহানের গাল ধরে ওর দিকে ফিরায় রাহা। রোহান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
রাহা মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বললো,
মন খারাপ?
জবাবে রোহান কিছু বলে না। রাহা কোনো উত্তর না পেয়ে রোহানের মুখের দিকে তাকায়। চোখমুখ লাল হয়ে আছে রোহানের। রাগ করেছে? না-কি অভিমান?
“রাহা” কিছু না বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে রোহানের মুখমন্ডলের ঘাম মুছে দেয়। অতঃপর রোহানের কাঁধে মাথা রাখে।
রোহান কিছু বললো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে রোহান বললো,
রান্না ঘরে যাও। মা কিন্তু রেগে যাবে।
রাহা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজা অবধি যেয়ে আবারো রোহানের দিকে তাকায় রাহা।
রোহান শক্ত চাহনিতে তাকিয়ে ছিল রাহা’র দিকে। রাহা চুপচাপ চলে যায় রান্না ঘরে। হয়তো রোহানের এমন ব্যবহারের কারণটা বুঝতে পেরেছে রাহা।
কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলার সাহস নেই। এই মানুষটির কেয়ারের জন্য! না-কি দায়িত্ব পালনের জন্য অজানা রাহার।

রোহান চুপচাপ বসে থাকে। জানালা দিয়ে দক্ষিণের হাওয়া বইছে। তবুও গায়ের ঘাম যাওয়ার নয়। এগুলো বেহায়ার মতো থাকবেই, হয়তো কিছুক্ষণ পরে শরীরের সাথে মিশে যাবে। তারপরেই বাঁধবে অসুখ। শরীরের শার্টও খুলেনি রোহান। রোহান গ্রামে যতদিন থাকবে প্রতিদিন বাহির থেকে আসলে রাহা’ই শার্টের বোতাম খুলে দিতো। আর রোহানের বুকের লোমের সাথে লুকোচুরি করতো। যদিও এই অভ্যাসটি কিছুদিন থেকে শুরু করছে। তার আগে একাএকাই থাকতে হতো রোহানকে। রাহাকে নিজের ভালবাসার যুদ্ধে ফিরে পেয়েছে। তবে এতটা কাছেও পায়নি৷ হয়তো জোর করে রাহা’কে কাছে পেতো, তাতে রাহার ভালবাসা কখনোই পেতো না।
তাই রোহান অপেক্ষা করে, নিজের ভালবাসার যুদ্ধে নামে। সে রাহাকে জয় করেই এই যুদ্ধ থেকে ফিরবে।
বিবাহের এই মূল্যবান বন্ধন থেকে চাইলেও কেউ দূরে যেতে পারেনা। বাঁধা পরবেই এই বন্ধনে। স্বামীর ভালোবাসায়, সংসারের ভালবাসায়, সংসারের প্রতিটি মানুষের ভালবাসায়।

বিয়ের প্রথমদিন থেকেই রাহা দূরে দূরে থাকতো। রোহান কখনো জোর করেনি রাহাকে। ওর ধারণা ছিল মাত্র এসএসসি পরিক্ষা দেয়া মেয়েটি এত বড় হয়নি৷ ছেলেদের কাছে আসাটা সে মানতে পারবেনা এত তাড়াতাড়ি’ই। হয়তো ভয় পেয়ে আছে, তাই সময় দেয় রোহান। যত সময় লাগুক, রাহার মনে এই ভয়কে জয় করে নিবেই সে। বিয়ের বয়স ছয় মাস এখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। শুধুমাত্র বন্ধুত্বসুলভ আচরণ হইছে। এটাই বা কম কিসের!! যে মেয়ে প্রথম প্রথম দেখলেই ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকতো, অথচ সেই মেয়ে এখন অনেকটা গা ঘেঁষে থাকে। সবকিছু তো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দিয়ে বিবেচনা করা যায়না। ভালোবাসা থাকতে হয়। রোহান অনেকটা জয় করতে পেরেছে ভালবাসা দিয়ে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবকিছু ভুল ছিল। রায়হান রাস্তায় রাহার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এটা এতটা সহজ ভাবারও বিষয় বলে মনে হয় না রোহানের কাছে।

আজকে ভাবাচ্ছে রোহানকে। এতদিন রাহার দূরে থাকার কারণের জন্য। হয়তো পশ্চিমের খান বাড়ির রায়হানের কারণেই এতদিন দূরে দূরে ছিল। একজন ছেলে কোনো কারণ ছাড়াই অন্য মেয়ের হাত ধরবে কেন! তাছাড়া সে কোনো বাড়ির বউ, যেটা এলাকার কম-বেশি সবাই জানে। রাহা’র মিথ্যা বলার কারণটাও বুঝতে পারেনা রোহান।
কি সুন্দরভাবে গুছিয়ে মিথ্যা বললো রোহানকে। নিজ চোখে দেখে আসলো রায়হানের হাত ধরা, কিন্তু রোহান জিজ্ঞেস করায় বললো তিশা নিয়ে গেছে। আদৌও এর সঠিক উত্তর জানা নেই রোহানের। জানা নেই রাহা’র এমন আচরণের উত্তর । দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে শার্টের বোতামে হাত লাগায় রায়হান।

রান্নাঘরে পা ফেলা মাত্রই রাহা’র শাশুড়ি তাসলিমা বেগম চেঁচিয়ে উঠেন। তাঁর ছেলেকে পুরোপুরি তাবিজ করে ফেলেছে রাহা।
তাসলিমা বেগমের কথা শুনে চোখ দুটো ভিজে উঠার উপক্রম রাহার। নিজেকে সংযত রেখে কাজে মন দেয়। তাসলিমা বেগম এখনো একেরপর এক কথা শুনিয়েই যাচ্ছে রাহাকে। এতবড় বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে বাপের বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে আসেনি। বাপ-বেটারে (বাবা-ছেলে) একসাথেই তাবিজ করে রাখছে। সবাই চোখে অন্ধকার দেখে, কেউ কিছু জানেই না। এতবড় বাড়ির বউ হতে হলে যে কতকিছু আনতে হয় বাপের বাড়ি দিয়া সবকিছু জানার কথা সবার। কিন্তু এই মাইয়া আর ওর বাপ-মায় তাবিজ কইরা রাখছে সবাইরে। ভালমন্দ কেউ দেখেনা তারজন্য।

#গহন রাতে শ্রাবণধারা
লেখাঃ সুমাইয়া আক্তার মনি
সূচনা পর্ব

(বানান ভুল হলে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন, ঠিক করে নিবো। সাড়া পেলে পরেরপর্ব বড় করে দেয়ার চেষ্টা করবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here