গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব -১৩

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ১৩
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। সবাই রেডি হয়ে নিলো প্রিতির বন্ধু শাম্মীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মুহুর ইচ্ছে নেই বলে সে বাহানা বানালো সে যাবে না। সে স্মান গলায় মাকে বলে,

‘মা আমার পেটে ব্যথা তাই আমি যাবো না। তোমরা যাও আমি রেস্ট নেবো বাড়িতে।’

‘সেকি রেএ! হঠাৎ পেট ব্যথা করছে কেনো?’

‘জানি না বুবু আমি যাবো না। তোমরা যাও।’

‘আচ্ছা তুই না গেলে কি আমার ভালো লাগবে?’

‘তুমি যাও না বুবু। মা বাবা তো আছে।’

‘আহা কুহু ও যখন চাইছে থাকুক না বাসায়। শিউলি তো আছেই।’

‘হ্যাঁ চলো কুহুর মা। আমরা তারাতাড়ি ফিরবো।মুহু মা যাহ তুই রেস্ট নে।’

মুহু ঘরে ঢুকেই রোমান্টিক নোভেল বুক টা নিয়ে পরতে বসে গেলো।আর ভাবতে লাগলো তার ফুলবাবুর কথা। নোভেল বুকের প্রতিটি পাতায় যেনো সে একজন কেই খুজে পাচ্ছে। ‘ফুলবাবু, ফুলবাবু, ফুলবাবু!’

প্রিতিদের দেখতে পেয়েই শাম্মী এগিয়ে এলেন। তিনি অতিব আপ্যায়নের সহিত বলে,

‘আরে এসো এসো।তা তোমার ছোট মেয়ে এলো না?’

‘ওর আসলে শরীরটা ভালো নেই তো তাই আর জোর করলাম না।’

‘ওহ আচ্ছা। আসো ভেতরে আসো।’

প্রিতি হেসে হেসে কথা বললো শাম্মীর সঙ্গে।সবাই মিলে শাম্মীর ঘরের ড্রইংরুমে বসলো। শাম্মী কুহুর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আর মনে মনে ভাবলেন, ‘ছেলের জন্য পছন্দ টা আমি ভালোই করেছি।’

প্রিতি চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো বাড়ির।আলিশান বাড়ি। বাড়িটা ভীষণ সুন্দর।সারা বাড়িতে কোনো ময়লার ছিটেফোটা নেই।বেশ পরিপাটি সব কিছুই। তিনি শাম্মীকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তা তোমার ছেলেটা কে দেখছি না কোথায় সে।’

শাম্মী হেসে বললেন, ‘আমি এক্ষুনি ডাকছি।নিশ্চয়ই সিনেমার মধ্যে ডুবে বসে আছে। আসলে একটা মাত্র ছুটির দিন পাই তো ও।তাই সারাদিন এমন ভাবেই কাটাই। কিন্তু আর বেশি দিন নয়। ওঁকে বাধার জন্যই তো**।’

কথা মাঝ পথে আটকেই তিনি আবার তাকালেন কুহুর দিকে।মুচকি হাসলেন তিনি খুশিতে!

সালমান হোসেন বলেন, ‘সে একটু আধটু ছুটির দিনে বাড়ি থাকলে হয়েই থাকে। ব্যাপার না। আপনি ডাকুন আপনার ছেলেকে। দেখি তাকে।’

এর মধ্যে শাম্মী উনার ছেলে সুপ্রিয় কে ডাকলেন আলাপ করাবেন বলে। সবাই সুপ্রিয়র প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেলো। কথা বার্তায় সব কিছুতেই মুগ্ধ হলেন প্রিতি আর সালমান হোসেন।

কিন্তু সুপ্রিয়র এসেই নজর পরেছিলো কুহুর দিকে। ছবির থেকেও মেয়েটি বেশি সুন্দর! মায়ের কথা ভুল নয়। মার্বেল কালারের কুর্তির সাথে সাদা লেগিন্স পরা কুহুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুপ্রিয়। এসে থেকেই ওর নজর আটকে আছে কুহুর দিকে। নজর সরানো যেনো দায়!

একটু আগে বলা শাম্মীর অর্ধসমাপ্ত কথায় কুহুর মনে আতংক সৃষ্টি কর। কুহুর হঠাৎ করে দম বন্ধ লাগছে। সবাই যখন আলাপ চারিতা করতে ব্যস্ত কুহু তখন অনুভব করলো ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ওর একটু খোলা জায়গায় গিয়ে ঠান্ডা বাতাসের দরকার। কুহু মাথা নত করে বসে আছে। সে সময় সুপ্রিয় ওর কিছু টা কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আমি এসে থেকে দেখছি আপনি একভাবে বসে আছেন।আমাদের সাথে আলাপ ও তো করলেন না?’

তারপর নিজে থেকেই পরিচিত হওয়ার জন্য বলে, ‘আমি সুপ্রিয় হুশেইন। আর আপনি?’

কুহু খেয়াল করলো সুপ্রিয় একদম ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ রাগ হলো ওর। অত্যন্ত ক্ষোভে ভেতর টা জ্বলে যাচ্ছে। যাকে বলে ছাড় খার হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। বিরক্ত আর অস্বস্তি চেপে ও ম্লান গলায় বলে,

‘আমি ইকরা কুহুলতা। বাড়িতে সবাই কুহু বলে ডাকে। আসলে অসুস্থ বোন টাকে একা বাড়িতে রেখে এসেছি তো তাই মন টা বাড়িতেই পরে আছে। চিন্তা হচ্ছে ছোট বোনের জন্য!’

কুহুর কন্ঠ সুপ্রিয়ের কর্নকুহরে পৌছতেই আরও বিস্মিত হলো সে। কি অসাধারণ, অমায়িক কণ্ঠের অধিকারীনি মেয়েটি। সে কোনো এক জায়গায় পড়েছিলো, ‘বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ নারীর কণ্ঠের প্রেমে পরেছে।’ তাহলে কি তার ক্ষেত্রেও সেটা হবে নাকি পাশা উল্টে যাবে নতুন কোনো দাণে ?সে নিজেকে সামলে শান্ত ভাবে বলে,

‘বাহ! আপনি কি সবার জন্যই এতোটাই ভাবেন?’

কুহু মিথ্যা হাসার চেষ্টা করলো।তারপর বলে,

‘আজ্ঞে সবার জন্য না। শুধু নিজের লোকের কথা ভাবি।’

সুপ্রিয় কুহুর এমন চাহনী আর কথার ধা’রে কি বলবে ভেবে পেলো না।শুধু আড়ষ্ট গলায় বলে, ‘আচ্ছা আপনারা কথা বলুন আমি ভেতরে যায়।’

কুহুর যেনো এতক্ষণে গলা থেকে কা’টা নেমে গেলো। শাম্মী ইতি মধ্যেই সবার জন্য স্নেকস আর চা নিয়ে চলে এসেছে। এক সাথে খেতে খেতে শাম্মী সরাসরি কুহু কে প্রশ্ন করলেন,

‘আমার ছেলেটাকে পছন্দ হয় তোমার?’

আচমকা এরকম একটা প্রশ্নে ও থতমত খেয়ে গেলো কুহু। ভীষণ বিরক্ত লাগছে এখন ওর।তবুও যথা সাধ্য নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে ও চুপ করে বসে রইলো। আর ওর এই চুপ করে থাকাটাই প্রিতি আর শাম্মীর মনে আশার আলো দেখা দিলো। দুজনেই ভাবলো, ‘চুপ করে আছে যখন তাহলে ঠিকই পছন্দ হয়েছে সুপ্রিয় কে!’

রাত আট টাই কুহুদের কে গাড়িতে তুলে দেওয়ার উছিলায় সুপ্রিয় ওঁদের সামনে এলো। কুহুরা যাওয়ার আগে সুপ্রিয় ওর কিছু টা
কাছে ঘেসে এসে কানের কাছে মুখ এনে বলে,

‘আপনি ভাবুন বা না ভাবুন। আমি কিন্তু আপনার কথায় ভাববো। ধরে নিন না অনেক দিনের হিসেব নিকেশ মেটানোর আছে। কিংবা আমাদের চলার পথ টা হইতো এক সুতোই বাধা রয়েছে!’

কুহু কটমট করে তাকালো সুপ্রিয় এর দিকে।সুপ্রিয় তখন ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। ভাব এমন ‘তুমি যতই রাগ দেখাও সুন্দরী আমার কাছে তোমাকে ধরা দিতেই হবে!’

কুহুর মনের ভেতর টা হুহু করে উঠলো তৌহিদের কথা ভেবেই। তৌহিদ তাকে ভাবুক আর না ভাবুক সে চাই না ওর কথা আর কেউই কল্পনায় আনুক। সে শুধুই তার আর কারোর নয়। মনের ভেতর টা মুচড়ে উঠছে ওর। বড় কষ্টে চোখের জল লুকিয়ে রাস্তায় দিকে চেয়ে বসে রইলো ও। সে গাড়িতে বসে বসে বিরবির করে বলে,

‘ওই লোকটার সাহস তো কম নয়? আমার কানের কাছে মুখ এনে রোমান্টিক কথা বলছে? মৌ’মা’ছির মতো ভো ভো করছিলো একবারে। এতো কিসের কাছে আসা ওই লোকের।’

রীতিমতো ফুসছে সে। এদিকে প্রিতি আর সালমান হোসেন ঠিকই বুঝেছেন মেয়ের মুখে রাগের আভাস। হাওয়া গরম দেখে দুজনেই চুপ করে রইলেন।

সারাফের সারারাত ঘুম হয়নি। মুহুর প্রতি টা কথা, ওর ফুলবাবু ডাকা, ওর চাহনি, হাসি, মেয়েটির প্রতিটি পদক্ষেপ ওর মনের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে। তোলপাড় করেছে বক্ষে।হৃদয়ে অসংখ্য বার ঝড়ের আভাস মিলেছে।সেই ঝড় থেমেছে একজনের কাছে গিয়েই।রাত টা যেনো কাটতেই চাইছিলো না ওর। সাহিরা সারাফ কে বলেছে কাল একটা জায়গায় যাবে তারা। আর সেই জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে হবে। সারাফ কিছুতেই না করতে পারে না সাহিরা মা কে। যত যায় হোক না কেন পালিত মাতা ওর। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি। সে তো নিজের মা বাবা কে চোখেও দেখেনি। কোথায়, কিভাবে আছে তারা কিছুই তার জানা নেই। এটা ভেবে কত না সে কেদেছে ছোট বেলাই। কেন তাকে তার মা বাবা এভাবে অবহেলায় ফেলে দিয়েছে। চোখের কার্ণিশে পানি এলেও তা পরতে দিলো না সারাফ।

সাহিরা ভোর বেলায় দশটার দিকে ডেকে তুললেন সারাফ কে। সারাফ নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়েই রেডি হচ্ছে। মন বসছে না কোনো কাজে। নিচে থেকে সাহিরার ডাক,

‘সারাফ বাবা তুমি রেডি তো?’

সারা রাত জাগার ফলে এখনো ঘুম লেগে আছে ওর চোখে। সে ঘুম ঘুম গলায় রবরাতে রবরাতে বলে, ‘আসছি মা আপনি অপেক্ষা করুন।’

‘আসো বারোটা বেজে গেলো যে।’

সে নিচে নামতে নামতে বলে, ‘চলুন এবার।’

সাহিরা সারাফের দিকে তাকিয়ে বলেন, বাহ! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে বাবা! নজর না লাগে কারোর!’

সারাফ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকালো। আস্তে আস্তে বলে, ‘চলুন।’

আজকে শুক্রবার। বন্ধের দিন।তাই সবাই বাড়িতেই আছেন। প্রিতি গেছেন হসপিটাল।সাধারণত ডক্টর দের বন্ধ মানায় না। তাদের ছুটি টা খুবই কম কাটে পরিবারের সঙ্গে। আজ কুহু আছে। সে নিজ দায়িত্বে পড়াচ্ছে বসে বসে মুহুকে। কুহুর কথায় বাধ্য বোন হয়ে সেও পড়ছে। নতুবা মন টা তো একেবারেই নেই নিজের কাছে। পরে আছে তার ফুলবাবুর কাছে। সকাল নয় টা থেকে পড়ছে সে। কিন্তু বুবুর দোয়া মায়া নেই। তিন ঘন্টা থেকে টানা পড়িয়েই যাচ্ছে। ভয়ের চোটে একবার ও মুখ থেকে এই কথা বের করে নি, ‘বুবু এবার ক্ষান্ত হোও! রেহাই দাও আমাকে এবার পড়া থেকে।’
কিন্তু বিধিবাম! মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে।জিবের ডগায় ঝুলে আবার সেটা ভেতরেও চলে গেছে। কিছুক্ষন পর কুহু বলে,

‘এই মুহু পা গুলো টিপে দে তো!’

‘কিহ বুবু আমি?’

‘হ্যাঁ তুই ছাড়া কি আর কেউ আছে এখানে? আয় পা টেপ। ব্যথায় নাড়াতে পারছি না।’

এদিকে যে তার লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। তিন ঘন্টায় জরুরি কাজে যাওয়া ছাড়া উঠতে দেইনি তাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় বুবু খুব নিষ্ঠুর! নইলে কি এভাবে কেউ কাউকে পড়াই। তবুও ক্ষীন আশার আলো দেখলো ও।ভাবলো এই উছিলায় যদি বুবুর কড়া শাসন থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই লক্ষী মেয়ে হয়ে বুবুর পা টিপতে লাগলো। কুহু বালিশে হেলান দিয়ে মুহুর অসহায় মুখ খানা দেখে মুখে হাত দিয়ে হাসছে। মেয়েটা বড্ড ফাঁকি বাজ হয়েছে। সুযোগ পেলেই ভার্সিটি বাংক করবে মেয়েটা। মাঝে মধ্যে এরকম শাসনের প্রয়োজন আছে। ওকে সরাসরি তো পড়া থেকে উঠতে বলতে পারতো না তাই এই বাহানা টা করলো। নইলে যে বুঝে যাবে যে ওর কষ্ট হয় ওঁকে এভাবে শাসন করলে। পাঁচ মিনিটের মাথায় কুহু বললো,

‘ওই তুই পা টিপছিস নাকি খা’ম’চি দিচ্ছিস। যাহ এখান থেকে লাগবে না তোর পা টিপা। বই খাতা নিয়ে বেরো এখান থেকে!’

মুহু তো মহা খুশি তে এক লাফ দিলো।বই খাতা হাতে নিয়ে সাহস করে বুবুর কাছে গিয়ে টুপ করে চু’মু দিলো বুবুর গালে। দিয়েই ভো দৌড়। মুহুর কান্ডে হেসে কুপোকাত কুহু। শব্দ করে হেসে বলে, ‘ কবে আরও বড় হবি তুই? এখনো সেই ছোট টাই রয়ে গেলি! পা’গ’লি মেয়ে একটা।

#চলবে

রিচেক হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here