গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -২৬+২৭+২৮

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছাব্বিশ

গাড়ির কাচ গুলো ভেঙে’ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। ফারদিন ফাইজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ফাইজা’ চেষ্টা করে ও ফারদিন’কে আটকা’তে পারলো না। ফারদিন ওদের সামনে এগিয়ে যেতে’ই একটা লোক ওর হাতে ছু’ড়ি দিয়ে সামান্য আঁচড় দিয়ে উঠলো। তা দেখে ফাইজা ভেতর থেকে আতৎনাদ করে উঠলো। আঁচড়ের জায়গা থেকে সামান্য রক্ত বের হতে লাগলো। ফারদিন এক হাতে ক্ষত স্থান চেপে ধরে প্রশ্ন করে উঠলো….

–কি চাই?

ফারদিনের প্রশ্ন শুনে লোক’গুলো বলে উঠলো……

–একদম চালাকি করতে আসবিনা। বেশি ঝামেলা আমার পছন্দ নয়। তাই ঝামেলা না করে চুপচাপ সাথে যা আছে দিয়ে দে…….

এত ক্ষনে ফারদিন বুঝতে পারলো। এইগুলো আসলে ডাকা’ত। কি আশ্চর্য এরা দিনে দুপুরে ডাকা’তি করতে নেমে গেছে। এই রাস্তা’টার দুই দিকে সাড়ি সাড়ি গাছ। আর দুই পাশে বিশাল বিশাল মাঠ। পাঁকা ধানে সম্পূর্ণ মাঠ হলুদ হয়ে আছে। দিনের বেলায় ও এদিকে খুব একটা গাড়ি চলাফেরা করেনা। ওরা যেহেতু লং ড্রাইভে বেড়িয়েছে তাই ফারদিন এই রাস্তা বেছে নিয়েছে। এই রাস্তা’টা দিয়ে কিছু দূর যেতেই সব’টা গ্রামাঞ্চল।
কিন্তু এমন একটা বিপদে পড়বে বুঝতে পারে’নি। ফারদিন কোনো শব্দ না করে ওর সাথে যা টাকা পয়সা ছিলো তা সহ ওর ফোন’টাও দিয়ে দিলো। লোক গুলো ও কোনো শব্দ না করে চলে গেলো।
লোক গুলো চলে যেতে’ই ওরা দুজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফারদিন একবার হতাশ চোখে নিজের প গাড়ি’টার দিকে তাঁকালো। মনে মনে ভাবছে” কি দরকার ছিলো গাড়ি’র কাচ’টা ভাঙা’র? আমাকে সুস্থ মাথায় বললেই দিয়ে দিতাম সব” ভাবতে ভাবতে গাড়ি’র জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ফাইজা’কে নামার জন্য বলতে’ই ফাইজা গাড়ি থেকে নেমে ফারদিনের হাত’টা খামচে ধরলো। ওর মনে এখনো ভয় জমে আছে। ফারদিন ওর ভয়ার্ত মুখ’টা দেখে শান্ত কন্ঠে বললো…..

–ভয় পেও না। ওরা চলে গেছে।

ফাইজা চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।ফারদিনের হাতের দিকে নজর দিতেই দেখলো রক্ত বের হচ্ছে। ফাইজা মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়লো। অস্থির কন্ঠে বললো….

–আপনার হাত দিয়ে কত রক্ত বের হচ্ছে? কি করবেন এখন? খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা। কি করব এখন? কি করে রক্ত পড়া বন্ধ করব? আপনি কেনো নামতে গেলেন?

ফাইজা’কে অস্থির হতে দেখে ফারদিন ও’কে থামিয়ে গাড়ি খুলে টিস্যু বক্স এনে ফাইজার হাতে দিতেই ফাইজা টিস্যু নিয়ে রক্ত পরিস্কার করতে লাগলো। ওর চোখ দুটো অস্থির হয়ে আছে। ফারদিনের মনে হচ্ছে আঁচড়’টা ওর নিজের না ফাইজার লাগছে। কিছুক্ষন পর রক্ত পড়া বন্ধ হতে ফাইজা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাঙা গাড়ি’টার দিকে একবার অসহায় চোখে তাঁকিয়ে ফারদিন’কে বলে উঠলো…..

–ইস গাড়ি’টার কি অবস্থা হয়েছে? এখন কি হবে? আমরা কি করে ফিরবো? এদিকে তো কাউকেই দেখছি না। জায়গা’টা খুব নিরিবিলি। ভয় করছে আবার যদি কোনো বিপদ হয়…….

ফাইজার চিন্তিত স্বর শুনে ফারদিন পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ফোন’টা রিসিভ করতে’ই ফারদিন ও’কে সব’টা বলে ফোন রেখে দিয়ে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে বললো….

–রাফি আসচ্ছে…..

ফাইজা মুখে একটু হাসির রেখা টানলো। ফারদিন চারদিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো…..

–জায়গা’টা কিন্তু খুব সুন্দর। চলো রাফি আসতে আসতে আমরা একটু ঘুরে আসি…..

ফাইজা ও ফারদিনের হাত’টা ধরে সামনে পা বাড়ালো। দমকা হাওয়ায় খোলা চুল গুলো উড়ছে আপন মনে। প্রকৃতি সুন্দর। এমন মনোরম পরিবেশে একবার আসলে বার বার ছুটে আসতে মন চাইবে প্রকৃতির টানে। দুই পাশে সাড়ি সাড়ি গাছ। আর তার পাশে ধান ক্ষেত। পরিবেশ’টা চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। আকাশে কালো মেঘের দাপটে সূর্যের আলো ক্ষীনপ্রভ। কালো মেঘের আধারের ফাঁকে ফাঁকে সূর্য’টা মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে। পরিবেশের বর্ননা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না ও? এত সুন্দর একটা পরিবেশ গাড়ি’তে করে গেলে মিস করে যেতো। মনে মনে ডাকাত’গুলো’কে একটা ধন্যবাদ দিয়ে উঠলো ফাইজা। আকাশের দিকে তাঁকিয়ে মনে মনে খুব করে চাইছে। এক্ষুনি এই কালো মেঘের বুক চিড়ে বৃষ্টি রাশি নামুক। জলধারায় সব’টা স্রোতময় হয়ে যাক। এসব ভাবতে ভাবতে’ই ফাইজা আনমনে ফারদিনের থেকে হাত’টা ছাড়িয়ে নিলে হিজাব’টা ওড়নার মতো নিয়ে দুই হাত মেলে সামনে দৌড়ে গিয়ে রাস্তার মাঝে ঘুরতে লাগলো। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ফাইজা ঘুরছে। খোলা চুল গুলো উড়ে মুখ পড়ছে। চোখ বুঝে ঘুরছে। মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। এত’টা স্নিগ্ধ লাগছে মেয়ে’টাকে? মায়া ভরা মুখ’টায় হাসি’টা বেশ মানিয়েছে। ফারদিন সামনে এগুলো না। একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে মুগ্ধ নয়নে তাঁকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে। ফাইজা কিছুক্ষন ঘুরে দুই হাতে মেলেই দাড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আপনমনে। আর এই মুহূর্ত’টাকে আরো সৌন্দর্যে ভরপুর করে তুলতে সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ করতে নেমে এলো শ্রাবন ধারা। এটা শ্রাবন মাস চলছে। তাই তো প্রতিদিন একবার না একবার বৃষ্টির দেখা মিলছে শহর জুড়ে। বৃষ্টির জল ফাইজার মুখমন্ডলে পড়তেই খুশিয়ে লাফিয়ে উঠলো ফাইজা। পড়নের সাদা পায়জামা’টা খানিক’টা উপরে তুলে বৃষ্টির জলে পা ভিজাতে লাগলো। ঝুমঝুম করে বৃষ্টির শব্দে চারদিক’টা ভরে উঠছে। ছোট ছোট ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা দেখে মনে হচ্ছে মুক্ত বিছিয়ে রাখা হয়েছে। চঞ্চল মনে আনমনে নেচে বেড়াচ্ছে ফাইজা। আর ফারদিন ঘোর লাগা চাহনী নিক্ষেপ করে আছে ওর দিকে। এত সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এর আগে কখনো দেখা হয়নি ওর। শ্যামবর্নের গোল স্নিগ্ধ মুখ’টা বৃষ্টির জলে সিক্ত হয়ে উঠেছে৷ হাওয়ার তোড়ে ভেজা ভেজা চুল গুলো এসে গালে লেপ্টে রয়েছে। দীর্ঘ কালো রেশমি চুলগুলো দিয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে। শ্রাবন ধারার সিক্ত হাওয়ার আর সিক্ত জলে ভেজা সাধারন মুখ’টা দেখতে অসাধারণ লাগছে এই মুহূতে। এত বছর জীবনে এই প্রথম এই অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা শ্রাবন ধারা’র পরিবেশ অতুলনীয় সুন্দর করে তুলেছে সামনে থাকা মানুষ’টা। ফারদিনের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আনমনে সামনের চঞ্চল মেয়ে’টার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো””

–“আমার শ্রাবনধারিনী” আমার জলধারার রানী” আমার মনোহরিনী” আমার শ্রাবন রানী…….

এই মুহুর্তে ফাইজার সাথে এই নাম গুলোই মিলে রয়েছে। অনেক ক্ষন যাবৎ ঝুম বৃষ্টি’তে ভিজচ্ছে ওরা দুজন। একজন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত আরেক জন শ্রাবন রানী’কে দেখতে ব্যস্ত। অনেকক্ষন ভেজার ফলে ফাইজা জোরে হাচি দিয়ে উঠতে’ই ফারদিনের ধ্যান ফিরে আসে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো ফাইজার দিকে। বৃষ্টি থামার নাম গন্ধ ও নেই। ফাইজা’কে হাচি দিতে দেখেই ফারদিন ব্যস্ত কন্ঠে বললো…..

–আর বৃষ্টিতে ভেজার দরকার নেই। চলো আমরা গাড়ি’তে বসে অপেক্ষা করি।

বলেই ফাইজা’র হাত ধরে পা বাড়ালো। ফাইজা হাচি দিতে দিতে বলে উঠলো….

–আমি যাব না। এত সুন্দর একটা মুহূর্ত এই ভাবে নষ্ট করে দিচ্ছেন? আমি আরো কিছুক্ষন ভিজব প্লিজ। আমাকে ছাড়ুন না…

কে শুনে কার কথা? গাড়ির সামনে এনে ফাইজা’কে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লো গাড়ি’তে। সাদা ড্রেস’টা ভিজে একদম শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। তা দেখে ফারদিনের একটু অস্বস্তি বোধ হলো। হুট করে গাড়ির পেছনের কিছু খোঁজা শুরু করলো। ফাইজা’র যেনো হাচি কিছু’তেই থামছে না। আবার বাতাসে শরীরে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডার প্রভাবে ঠোঁট জোড়া কাঁপছে খানিক’টা। আগের বারের মতো একটা শার্ট বের করে ফাইজা’কে পড়ে নিতে বললো। নিজেও একটা টি-শার্ট বের করে পড়ে নিলো। ফাইজার শরীর ভিজে একাকার অবস্থা। ঠান্ডা শরীর জমে যাবে মনে হচ্ছে। গাড়ির সামনের কাচ’টা ভাঙা তাই বৃষ্টি এসে বার বার ছুঁয়ে দিচ্ছে ওদের? ফাইজা শীতে কেঁপে উঠছে তাই ফারদিন ফাইজা’কে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কিছুক্ষন এভাবেই কেটে যায়। ফাইজা বার বার নাক টেনে যাচ্ছে। ফারদিনের ও মাথা ভার হয়ে আসচ্ছে। আজ দুই’টার অবস্থা খারাপ হবে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানিকের মাথায় আরেক’টা নীল রঙের কার এসে থামলো ওদের পাশে। জানালা খুলে রাফি ওদের ইশারা করতে’ই ফারদিন আর ফাইজা দুজনে’ই ওর গাড়ি’তে গিয়ে উঠে পড়লো। রাফি কে ফারদিন ওর গাড়ি নিয়ে ঠিক করে দেওয়ার জন্য পাঠালো।
____________________________________________
রাতে একটা ভারী কম্বল গায়ে জড়ানো তাও জ্বরে কাপছে ফাইজা। আসার পর থেকে হাড় কাপুঁনি দিয়ে জ্বর উঠেছে। আর হাচি ঠান্ডায়। ওর পাশেই চিন্তিত মুখে বসে বসে জলপট্টি দিচ্ছে নাদিয়া বেগম। কিছু’তেই জ্বর নামছে না। জ্বরের চোটে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
____________________________________________
ফারদিনের ছোট থেকেই ঠান্ডার অতিরিক্ত সমস্যা। ঠান্ডায় এলার্জি রয়েছে ওর। একটু বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে ওর ঠান্ডায় শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। গায়ে যেমন জ্বর আর কিছুক্ষন পর পর শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে খুব। সায়মা খানম চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। একা একা কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। ফারদিনের অবস্থা ও ভালো হচ্ছেনা। নাকের মাথা’ টকটকে লাল হয়ে আছে। মুখ’টা একদম লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রক্ত জমেছে।
____________________________________________
রাতে একটা গুদাম ঘরের মেঝেতে চার-পাঁচটা ছেলে র’ক্তা’ক্ত হয়ে পড়ে আছে। ওদের সামনেই হিংস্র চেহারায় বসে আছে তিথী। মুখে লেগে আছে বাঁকা হাসি। তিথী’র পাশে দুইজন ২৬/২৭ বয়সী ছেলে দাড়িয়ে। তিথী’ওদের দিকে ইশারা করতেই ওরা পড়ে থাকা ছেলেগুলো’কে টেনে রুম থেকে বের করতে লাগলো। তা দেখে তিথী একটু মুচকি হেসে বলতে লাগলো…..

–আমার ফারদিনের গায়ের রক্ত বের করেছিস। তোদের তো বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই……

#চলবে#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সাতাশ

সামনে দুটো র’ক্তা’ক্ত লা’শ তাতেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তিথী। সে নিজ খেলায় মত্ত। যে ফারদিনের গাঁয়ে আঘাত করেছিলো। তাকে একেরপর ছু’ড়ি দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে ও। বেশ কয়েকবার আঘাতের ফলে ছেলে’টার হাতের মাংস থেতলে উঠে গেছে তা ও থামছে না। ওর পাশে থাকা গার্ড দুটো দুজন দুজনের দিকে চেয়ে আছে। একটা মেয়ে এতটা ভয়ংকর’ কি হয়? বেশ কয়েকবার আঘাত করে নিজের ক্ষোভ মেটানো শেষে তিথী র’ক্ত মাখা ছু’ড়িটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো…..

–এটা’কে সরানোর ব্যবস্থা করো……

বলেই বেড়িয়ে গেলো। তিথী চলে যেতে’ই গার্ডদের মধ্যে প্রথম একজন বলে উঠলো……

–ম্যাডাম বোধহয় ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেছে……

তার কথা শুনে দ্বিতীয় গার্ড’টা বলে উঠলো…..

–আমার মনে হয় ম্যাডাম মানসিক ভাবে অসুস্থ….

বলে দুজনেই হাফছেড়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
____________________________________________
হসপিটালের এক কেবিনে পাশাপাশি দু’টি বেডে রয়েছে ফারদিন আর ফাইজা। ফারদিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর ফাইজা’র জ্বর কিছু’টা কমায় শরীর বেশ সুস্থ লাগছে তাই ও বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে এক দৃষ্টি’তে ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ছেলে’টার কাল রাতে খুব বেশি শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছিলো তাই বাধ্য হয়ে হসপিটালে নিয়ে আসতে হয়েছে। ফারদিনের খবর কানে যেতে’ই সবার হাতে পায়ে ধরে জ্বর নিয়েই হসপিটালে চলে এসেছিলো। রাতে তুলনামূলক ভাবে বেশি জ্বর থাকায় ও’কেও ফারদিনের সাথে একি কেবিনে রাখা হয়েছে। এই বুদ্ধি’টা অবশ্য জেহেরে’র। ফারদিনে’র মুখে অক্সিজেন লাগানো। সারা মুখ’টা লাল হয়ে আছে রক্ত জবার মতো। দেখে খুব মায়া হচ্ছে ফাইজা। আবার রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। কেনো ভিজতে গেলো? যদি কাল না ভিজতো তাহলে ছেলে’টা আজ এত বেশি কষ্ট পেতো না। এখন ওদের সম্পর্কে’র সবাই জানে। সবাই মিলে কাল রাতে’ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব শিঘ্রই ওদের চার হাত এক করে দিবে। ভাবতেই ফাইজা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মাথা’টা ঝিম ধরে আছে। চিন চিন করে ব্যাথা করছে সাথে পুরো দুনিয়া মিলে ঘুরছে। ফাইজা নিজেকে সামলে বেড থেকে নেমে ফারদিনের মাথার কাছে এসে বসলো। এই মুহূর্তে এই কেবিনে ওরা ছাড়া কেউ নেই। হসপিটালে শুধু জেহের আছে তাও জরুরী কাজে বাইরে গেছে একটু। বাড়ির সবাই সারা রাত ছিলো সকালেই বাড়ি গেছে। এই সুযোগে ফাইজা ফারদিনের মাথার কাছে বসে ফারদিনের ঘন চুলে হাত ডুবালো।আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মনের অদম্য ইচ্ছা’টাকে দমিয়ে না রেখে ঠোঁট ছোঁয়ালো ফারদিনের কপালে। আর ভাবনায় ডুব দিলো নিজের অজান্তে বিয়ে হওয়ার সময়’টা…..
____________________________________________
রাতে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলো ফাইজা। এই সময় বাবা-মা’কে একসাথে রুমে ঢুকতে দেখে ফাইজা একটু অবাক হয় খানিক’টা। তারা কখনোই কোনো দরকার ছাড়া একসাথে এই রুমে প্রবেশ করে না। তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হলো যে দুজন এক সাথে? ফাইজা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে হাসি মুখে প্রশ্ন করলো…..

–তোমরা এই সময় একসাথে?

ফাইজার কথা শুনে নাদিয়া বেগম ওর হাত ধরে ও’কে বিছানায় বসিয়ে নিজেও ফাইজার পাশে বসে ওর দুই গালে হাত রেখে বলে উঠলো….

–আমার মেয়ে’টা তো বড় হচ্ছে। তাই বাবা-মা হিসেবে আমার অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। আজ তোর জীবনে’র সব থেকে বড় ডিসিশন’টা তোকে না জানিয়ে নিয়েছি মা। এতে কি তোর আপত্তি রয়েছে?

নাদিয়া বেগমের কথা ফাইজা ঠিক বুঝতে পারলো না। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো তার দিকে। তারপর মা’কে জড়িয়ে ধরে খুশি মনে বললো…..

–তোমরা আমার বাবা-মা। তোমরা আমার কখনো খারাপ চাইবে না। তাই তোমাদের ডিসিশনে আমার কোনো আপত্তি নেই মা। এখন বলো কি ডিসিশন নিয়েছো?

নাদিয়া বেগম কিছু না বলে হাসনাত সাহেবের দিকে ইশারা করতে সে বললো……

—এখনো তুই বেশ ছোট। তাই যেদিন সময় আসবে সেদিন তোকে আমরা সব’টা বলব। আজ কোনো প্রশ্ন না মা।

বলেই ফাইজা’র দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো…..

–শুধু একটা সিঙ্গেন্যাচার করে দে এখানে। আর ভেবে নে বাবা যেটা করছে আমার ভালোর জন্য।

ফাইজা কিছু বুঝতে পারলো না কিছুই। মনে হাজার প্রশ্ন থাকা স্বত্তেও মুখে কোনো প্রশ্ন না করে। সাথে সাথে সিঙ্গন্যাচার করে দিলো। একবার পড়ার সুযোগ’টা অব্দি পায়’নি৷ সেদিন যে নিজের অজান্তে’ই ফাইজা অন্য একজনের অধাঙ্গিনী হয়ে গিয়েছিলো ও নিজেও জানেনা। তারপর থেকে বড় হয়েছে সময়ের সাথে সাথে এইসব কিছু ভুলে’ই গিয়েছিলো ও? তাই ফারদিন যখন ও’কে বিয়ের কথা বলছিলো তখন অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলো। আসলে নাদিয়া বেগম আর হাসনাত হাসেব চেয়েছিলো। ফাইজা প্রর্যাপ্ত বয়স হওয়ার পর বিয়ে’টা হবে। আর ফাইজার থেকে ফারদিন প্রায় ৮-৯ বছরের বড় ছিলো তাই একটু অমত করেছিলো। এখন যখন জানতে পেরেছে ফাইজা ও ফারদিন’কে সমান ভাবে ভালোবাসে। তাই এখন যত দ্রুত সম্ভব ওদেফ বিয়ে’টা জমজমাট ভাবে দিতে চায়।
____________________________________________
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফাইজা অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলো। ফারদিন নড়ে উঠতে’ই ওর ধ্যান ভাঙে। ফারদিনের দিকে তাঁকাতেই দেখে ফারদিন ওর দিকেই চেয়ে আছে। তাই ফাইজা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো…..

–আপনার আবার কষ্ট হচ্ছে?

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন মুখের থেকে অক্সিজেন মাস্ক’টা খুলে চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললো…..

–আ’ম অলরাইট জান।

ফারদিনের মুখে জান শব্দ’টা শুনে ফাইজা একটু হাসলো। পরক্ষনে’ই গম্ভীর মুখ করে বললো….

–আপনি কেনো ভিজেছেন? আগে বলবেন তো বৃষ্টি’তে ভিজলে আপনার এত সমস্যা হয়?

ফাইজা’র কথায় ফারদিন হেসেই জবাব দিলো…..

–এক বৃষ্টি কন্যার বৃষ্টি’ উপভোগ করার মনোরম দৃশ্য দেখছিলাম।

বলে ফাইজা’র হাত’টা টেনে এনে উল্টো পিসে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফাইজা ও লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেললো।

____________________________________________
বেশ কয়েকদিন কে’টে গেছে। কলেজের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পরিক্ষা চলছে। যার দরুন ফারদিন’কে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে৷ ফাস্ট ইয়ারের ক্লাস বন্ধ থাকায় ফাইজা’কে ও সারাদিন বাসায় থাকতে হচ্ছে। তাই আজ সময় পার করতে বাবা-মায়ের সাথে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকাল সকাল উঠে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় গুঁছিয়ে নিলো। সামনের মাসে ওদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তাই খুশি’তে মন’টা ফুরফুরে লাগছে খুব। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আচড়াচ্ছে ফাইজা। ড্রয়িং রুমের থেকে ডাক পড়তেই। হাতে ঘড়ি’টা পড়তে পড়তে বেরিয়ে গেলো। তারপর সবাই মিলে রওনা হলো। বাসার সামনে থেকে দুইটা রিকশা ডেকে নিলো। যেহেতু ওরা তিনজন তাই কে একা যাবে সেটা নিয়ে বাধলো বিপত্তি। বাবা-মা দুজন’জে থামাতে ফাইজা বলে উঠলো……

–আমি একা যাব। আর তোমরা এই রিকশায়। আমরা তো একসাথেই যাব তাই সমস্যা কি বাবা?
আমার রিকশা’টা না হয় আগে যাবে আর তোমাদের’টা পেছনে। তাই আর কোনো সমস্যা হওয়া’র কথা না। চলো এইবার উঠে পড়ো…..

মেয়ের আবদারে ওরা দুজন ও না করলো না। ফাইজার কথা মতো রিকশা চলা শুরু করলো।
____________________________________________
নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেব’দের রিকশা কিছু দূর পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার রিকশা’য় ধাক্কা দিতে’ই তারা দুজনেই রিকশা থেকে উল্টে রাস্তায় পড়তে’ই ব্যস্ত রাস্তার মাঝে একটা বড় ট্রাক এসে ওদের পিশিয়ে রেখে গেলো। চোখের পলকে দুজনের প্রান পাখি উড়ে গেলো।

ফাইজার রিকশা কিছু টা দূরে ছিলো। পেছন থেকে হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসতেই ফাইজা’র বুক ধক করে উঠলো। রিকশা থেকে নেমে পেছনে তাঁকাতে’ই মানুষের ভীড় চোখে পড়লো। বাবা-মায়ের রিকশা’টা দেখতে না পেয়ে ভয়ে বুক ধুকপুক করতে লাগলো। ভীড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই ওর ফোন স্কীনে একটা মেসেজ ভেসে উঠলো। মেসেজের শব্দে ফোন স্কীনে তাঁকাতে’ই আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ। কৌতুহল বশত মেসেজ ওপেন করতে’ই ওর হাত থেকে ফোন’টা পড়ে গেলো। দৌড়ে ছুটে গেলো ভীড়ের মধ্যে। ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দুইটা রক্তাক্ত দেহ দেখে। জোরে চিৎকার জ্ঞান হারালো। তখনের মেসেজ’টা ছিলো…

“আজ বাবা-মা হারিয়েছো কাল ভালোবাসা’কে হারাবে। কেমন লাগবে বলো তো””””””
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আটাশ

চোখের সামনে বাবা-মায়ের সাদা কাপড় জড়ানো লা’শ কোনো সন্তানের পক্ষে’ই সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ফাইজা’র গগন কাঁপানো চিৎকারে সবার হৃদয় কেঁপে উঠছে বার বার। ফাইজার সামনেই ফারদিন এক কোনে চুপিসারে দাড়িয়ে আছে। ওর বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছেনা ফাইজার চোখের পানি। এই আহাজারি’র শব্দে ফারদিন নিস্তব্দ, নিশ্চুপ হয়ে আছে। কি করে স্বান্তনা দিব সদ্য বাবা-মা হারা মেয়ে’টাকে? কোনো ভাষা কি আছে? তনুজা ফাইজা’কে বুকে আগলে রেখে চোখের পানি ফেলছে। সায়মা খানম একটু দূরে বসে আছে। মেয়ে’টাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন সে? ফাইজা’র গলা ভেঙে গেছে চেঁচিয়ে কান্নার ফলে। কিছুক্ষন পরেই দাফন করা হবে হাসনাত সাহেব আর নাদিয়া বেগম’কে।

–সবাই চিরকাল বেঁচে থাকেনা মা। এত’টা ভেঙে পড়িস না। আমি আছি তো। আমি তোর মা না বল? আমি তোকে আগলে রাখব। তুই আর কান্না করিস না মা। তুই অসুস্থ হয়ে যাবি….

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে উঠলো। ফারদিন টলমল চোখে তাঁকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে এক নজরে। তনুজার কথা শুনে ফাইজা চিৎকার করে বললো…….

–এইসব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি আমার বাবা-মা’কে মে’রে ফেলেছি। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার ও ম’রে যাওয়া উচিত…..

বলেই তনুজার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একেক’টা জিনিস সব ফেলে দিলো। পা’গলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো” আমার ম’রে যাওয়া উচিত”। ফাইজা’কে থামানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে তনুজা আর আরজা। আরজা খবর শুনে’ই ছুটে এসেছে। জেহের বাইরে খাটিয়ার সামনে বসে আছে। ফাইজা’র পাগলামি গুলো নিশ্চুপ হয়ে টলমল চোখে দেখছে ফারদিন।
টেবিলে থাকা একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাজ নিয়ে নিজের মাথায় আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হতে’ই ফারদিন গিয়ে ধরে ফেললো। ফাইজা ফারদিনের দিকে অশ্রভর্তি চোখে অসহায় চাহনী’তে দিতে’ই ফারদিন ফাইজা’কে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো। ফারদিনের স্পর্শে ফাইজা আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়লো। আরজা ও দাড়িয়ে মুখ চেপে কান্না করতে করতে বাইরে চলে এলো। তনুজা ফারদিন’কে ইশারা করতে’ই ফারদিন বুঝতে পারলো। তাই, চোখের ইশারায় যেতে বলে নিজে ফাইজা’কে শান্ত করতে বলে উঠলো…..

—আমি আছি তো। কেনো এত’টা ভেঙে পড়ছো। আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনেই এতিম। আমরা দুজনেই সমান। আল্লাহ কি সবাই’কে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। একদিন আগে পরে সবাই’কে তার কাছে যেতে হবে। এখন তুমি এত’টা ভেঙে পড়ছে তোমার বাবা-মা দুজনে কষ্ট পাবে। তারা তো দেখছে তোমাকে?

ফারদিনের স্বান্তবা বানী শুনে ফাইজা ফারদিন’কে আরো বেশি আকড়ে ধরে বললো…..

–আমি পারব না। বিশ্বাস করুন আমার দম আটকে যাচ্ছে। আমি ম’রে যাব। আমি থাকতে পারব না….

ফারদিন আর উওর না দিয়ে চুপ করে রইলো। সাথে সাথে ওর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ফোটা গড়িয়ে পড়লো।
____________________________________________
ছেলেরা তো সবার মতো শব্দ করে কাঁদতে পারেনা। চাইলেও কাঁদতে পারেনা। জেহের ড্রয়িং রুমে বসে বসে বোনের আহাজারির শব্দ শুনছিলো। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা। কি বলে বোন’কে স্বান্তনা দিবে সে? ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিঃ শব্দে চোখের পানি ফেলছিলো। আরজা ড্রয়িং রুমে পা দিয়ে জেহের’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো জেহেরের দিকে। জেহেরের পাশে বসে ওর কাঁধে সাহস করে হাত রেখে বললো…..

–আপনি এত’টা ভেঙে পড়লে ফাইজুর কি হবে ভাইয়া? প্লিজ নিজেকে শক্ত করুন। এখন আপনি ছাড়া আর কে আছে ওর?

স্বান্তনা বানী পেয়ে জেহের নিজেকে সামলাতে পারলো না। হুট করে আরজা’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আরজা খানিকক্ষণ চমকে গেলেও নিজেকে সামলে জেহের পিঠে রাখলো।
____________________________________________
নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেব’কে জানাযার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। তাই ফাইজা’কে শেষ বারের মতো তাদের সামনে নিয়ে আসলো ফারদিন। সাদা কাফনের থেকে নাদিয়া বেগমের মুখ’টা খুলে দিতে’ই ফাইজা চিৎকার করে খাটিয়ার সামনে লুটিয়ে পড়লো। খাটিয়া ধরে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

–মা ও মা একবার উঠো না মা। আমি থাকতে পারব না তোমাকে ছাড়া। আমাকেও নিয়ে যাও তোমার সাথে…..

বলেই পাশে রাখা হাসনাত সাহেবের খাটিয়া ধরে বললো….

–বাবা তুমি না বলে ছিলে তুমি আমাকে ছেড়ে কোনো দিন যাবে না। তাহলে এইভাবে এখন নিশ্চুপে সুয়ে আছো কেনো? উঠো না বাবা।

বলেই পাগলের মতো কাদতে লাগলো। জেহের ফারদিনের পাশে দাড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। উপস্থিত স্কবার চোখ অশ্রুসিক্ত। জেহের বোনের পাগলের মতো অবস্থা দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বোন’কে জড়িয়ে ধরলো। ভাইয়ের ভরসা পেয়ে ফাইজা গগন বিদায়ক চিৎকার করে উঠলো।

–ভাই আমি আর তুই একা হয়ে গেলাম। আমরা কি নিয়ে বাঁঁচব ভাইয়া। আমাকেও মে’রে ফেল তুই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া। বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা ছিড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে মে’রে ফেল প্লিজ। আমি থাকতে পারব না….

জেহের সহ্য করতে না পেরে নিজেও শব্দ করে এইবার কেঁদে দিলো। দুই পাশে দুইটা খাটিয়া রাখা তার মাঝে বসে দুই ভাই বোন বিলাপ করে যাচ্ছে। দৃশ্য’টা সহ্য করার মতো না।
____________________________________________
দাফন শেষ হতে’ই ফারদিন আর জেহের এক সাথে রুমে প্রবেশ করলো। ফাইজা সেন্সলেস হয়ে আছে। ওর দুই পাশে বসে আছে আরজা আর তনুজা আর সায়মা খানম। ফাইজা’কে এই অবস্থায় দেখে ফারদিন আর জেহের দুজনেই দৌড়ে গেলো ওর সামনে। দুজনেই এক সাথে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে বসলো…

–ওর কি হয়েছে? কি হয়েছে?

তনুজা ঠান্ডা মাথায় উওর দিলো…..

–খাটিয়া নিয়ে যাওয়ার পর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হয়ে গেছে। শরীর ভীষন দূর্বল তাই স্যালাইন দিতে হবে। তোমরা ব্যবস্থা করো তাড়াতাড়ি…..

ফারদিনের জান বেড়িয়ে যাচ্ছে ফাইজার মুখের দিকে তাঁকিয়ে। মেয়ে’টা আর কত কষ্ট সহ্য করবে? ফারদিন এখনো জানেনা ফাইজার বাবা-মাকে পরিকল্পনা করে হ’ত্যা করা হয়েছে। ফাইজা’কে কিছুক্ষনের মধ্যে স্যালাইন দেওয়া হলো। সারাদিন সবার উপরে ধকল গিয়েছে বিধায় ফারদিন’কে ফাইজার কাছে রেখে সবাই একটু অন্য রুমে গিয়েছে। জেহের’ বোনের অবস্থা দেখে পাগল পাগল হয়ে গেছে। সদ্য বাবা-মাকে হারিয়ে এভাবেই ভেঙে পড়েছে৷ বোনের মুখ চেয়ে নিজেকে শান্ত রেখেছিলো এতক্ষন৷ এখন সেই বোনের এই অবস্থা মেনে নিতে পারছেনা। জেহের কে জোর করেই তনুজা অন্য রুমে নিয়ে গেছে।
____________________________________________
মধ্য রাত ফাইজা’র সেন্স আসতে’ই চোখ খুলে তাঁকা’তেই দেখলো ফারদিন নিচে বসে ওর এক হাতে আকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। ফারদিন’কে দেখে’ই কেনো যেনো ওর শরীর রাগে জ্বলে উঠলো। হাত’টা জোর করে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারদিন জেগে উঠলো। ফাইজা’কে সজাগ দেখে লাফিয়ে দাড়িয়ে পড়ে অস্থির কন্ঠে বললো….

–তোমার কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? পানি খাবে? কি হয়েছে?

ফাইজা ফারদিনের অস্থির কন্ঠ শুনে লাফিয়ে উঠলো। এক টানে স্যালাইন’টাকে খুলে ফেললো। এতে অবশ্য ওর হাত দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলো। ফাইজার কান্ডে ফারদিন অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। রক্ত বের হতে দেখে ভয় পেয়ে ফাইজার হাত’টা ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

–কি করছো কি? রক্ত বের হচ্ছে তো? পাগল হয়ে গেছো তুমি?

ফারদিনের কথায় ফাইজা এইবার ও’কে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো….

–আমার কাছে আসবেন না একদকম। আপনার জন্য আজ আমি বাবা-মা হারা। তাদের মৃ’ত্যুর জন্য শুধু মাত্র আপনি দায়ী। চলে যান আপনি চোখের সামনে থেকে। নয়তো আমি কি করব নিজেও জানিনা। চলে যান বলছি…..

কথাগুলো শুনেই ফারদিন যেনো আকাশ থেকে পড়লো। ওর মাথা ঘুরে গেলো মুহূর্তে’ই। কি বলছে মেয়ে’টা এইসব? ফারদিন অবাক স্বরে বলে উঠলো….

–কিসব বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? দেখো এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর এক্সিডেন্টের উপর আমাদের কারোর হাত থাকেনা। প্লিজ নিজেকে সামলে নাও……

ফাইজা এইবার দ্বিগুন রাগ নিয়ে চারদিকে কিছু খুঁজতে লাগলো। টেবিলের উপর ফোন’টা দেখে ছুটে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ’টা বের করে ফারদিনের হাতে ফোন ধরিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–দেখুন। আমার বাবা-মা’কে খুন করা হয়েছে। কে করেছে আশা করি আপনাকে বুঝাতে হবেনা। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। আমার ভুলের জন্য আমার বাবা-মা’কে জীবন দিতে হলো। চলে যান আপনি…….

ওদের চেচামেচি’তে সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। তনুজা এসেই ফাইজা’কে ধরে প্রশ্ন করলো…..

–চেঁচাচ্ছিস কেনো? শরীর খারাপ করবে? একি হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে কেনো? কি করেছিস তুই…..

ফাইজা উওর না দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আর ফারদিনের দিকে রাগী চাহনী দিয়ে আছে। ফারদিন ফোন’হাতে নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ফাইজা পুর্নরায় চেঁচিয়ে উঠার আগেই ফারদিন বড় পা ফেলে রুমের বাইরে চলে গেলো। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখানে কি হচ্ছে তারা কিছুই বুঝছেনা। ফারদিন চলে যেতে’ই ফাইজা তনুজা’কে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। আর সবাই প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলো।
____________________________________________
ফারদিন নিচে নেমে এসে’ই ফোন’টা আছাড় মে’রে ভেঙে ফেললো। রাগে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো…..

–আমি এত’টা বোকা কি করে হতে পারলাম? তিথী ভয়ংকর জেনেও কেনো চুপ করে বসে রইলাম সময়ের অপেক্ষায়। আজ আমার জন্য’ই ফাইজা’র এই অবস্থা? সত্যি তো আমি দায়ী এইসবের জন্য। এখন কি করব আমি….

বলেই চুল খামচে ধরলো দুই হাতে। রাগে দাতে দাত চেপে বলে উঠলো…..

–যার জন্য আজ তুমি এতিম হলে? যার জন্য আজ তোমার এই অবস্থা। তাকে এত’টা ভয়ংকর মৃ’ত্যু দিব যে কেউ কল্পনা ও করতে পারছেনা। ইটস মাই প্রমিস………

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here