গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -১৮+১৯

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আঠারো

পার্কে ঘুরতে এসে থা’প্প’ড় খেয়ে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে গালে হাত দিয়ে স্টীলের বেঞ্চের উপর বসে আছে ফাইজা। ওর থেকে সামনেই ভীড়ের মধ্যে থেকে ফারদিন দুই’টা আইস্ক্রিম হাতে বের হলো। ফাইজার সামনে আসতেই অভিমানে ফাইজা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তা দেখে ফারদিন একটু মুচকি হেসে ফাইজার পাশ ঘেষে বসলো। ফারদিন’কে পাশে ঘেষতে দেখে ফাইজা আরেক’টু সরে গেলো। ফারদিন ও দুষ্টুমি ভঙ্গি’তে ওর দিকে আরো চে’পে বসলো। ফাইজা আবার সরে যেতেই ধুম করে নিচে পড়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ফারদিন একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আর ফাইজা অসহায় ফেস করে ফারদিনের দিকে হা করে তাঁকাতে’ই ফারদিন ব্যাপার টা বুঝে উঠতে’ই হাহা করে হেসে দিলো। ফারদিনের হাসি দেখে ফাইজার মুখ’টা আরো চুপসে গেলো। ফারদিন আইস্ক্রিম দুইটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে এক প্রকার গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফাইজা রেগে উঠে ফারদিনের কলার চেপে ধরলো। তাও ফারদিনের হাসি থামছে না। ফারদিন একনাগাড়ে হেসে’ই যাচ্ছে। ফাইজা ফারদিনের হাসি থামাতে’ই সবার দিকে একবার তাঁকালো। বেশি মানুষ নেই কয়েকজন নিজেদের মতো ব্যস্ত। এই সুযোগ’টাই কাজে লাগিয়ে ফাইজা হুট করে ফারদিনের দিকে অনেক’টা ঝুঁকে পড়লো। আর এক ইঞ্চি হলে ওদের নাকে নাক ঘষা পড়বে। ঠোটে ঠোঁট মিলিত হবে। ফাইজা’র অন্যরকম চাহনীতে ফারদিন একটু নড়ে বসলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে এতক্ষনে। ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলাতে লাগলো। ফাইজা ফারদিনের দিকে ঝুঁকেই ওর চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বললো…..

–খুব হাসি পাচ্ছে তাইনা….

ফারদিন কোনো উওর দিলো না। ফাইজা’র মতলব বুঝতে পারছেনা। এই প্রথম ফাইজা নিজ ইচ্ছায় ওর এর কাছে এসেছে৷ ফারদিন এক নজর চারদিকে দেখলো। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত ওদের দিকে কেউ চেয়ে নেই। ফাইজা এমন করে ঝুঁকে থাকলে ফারদিন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেনা। ফাইজার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে যা ফারদিন’কে আরো কাছে টানছে। প্রশ্নে ফারদিন আমতা আমতা করে বললো….

–ব্যাথা পেয়েছো? পড়ে গেলে কি করে?

ফারদিনের চেহারা দেখে ফাইজার ভীষন হাসি পাচ্ছে। তাও হাসি কন্ট্রোল করে ফারদিনের চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো…..

–তোমার এই চোখে আমি ডুবে থাকতে চাই জান…

ফাইজার এমন কথায় ফারদিন কেশে উঠলো। এ মেয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? যেই ছেলে প্রতিদিন ফাইজা’কে লজ্জা দিয়ে মা/রে। আজ সেই ছেলে’টাকে ভড়কে দিতে ফাইজার ভীষন মজা লাগছে। ফারদিন কাশতে কাশতে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে। ফিসফিসিয়ে বললো…..

–কি করছো? এটা পার্ক আমার বা তোমার রুম না। সরে বসো….

ফারদিনের কথায় ফাইজা এইবার নিজের হাত দুটো ফারদিনের কলার ছেড়ে ওর দুইপাশ দিয়ে বেঞ্চের হাতলের উপর রাখলো। তা দেখে ফারদিন আরেক’টু নড়েচড়ে বসলো। ওর চেহারা’টা দেখতে অসহায় লাগছে খুব। ফাইজা এইবার ফারদিনের নাকে নাক ঘষে উঠতেই ফারদিন আরেকবার নড়ে উঠলো। ওর দম বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। ফাইজা’কে এতটা কাছে কিছুতেই আশা করে’নি। এইবার ফারদিন’কে চরম অবাক করে দিয়ে ফাইজা ফারদিনের গালে জোরে কামড় দিয়ে বসলো। আকস্মিক ব্যাথায় ফারদিন “আউচ” শব্দ করে উঠলো। ফাইজা ফারদিন’কে ছেড়ে জোরে শব্দ করে হেসে দিলো। পেটে হাত দিয়ে হেসে যাচ্ছে। আর ফারদিন অবাক হয়ে দেখছে। এমন কিছু মোটেও আশা করেনি ফাইজার কাছ থেকে। ফাইজা হেসে’ই যাচ্ছে আর ফারদিন ব্যাথায় গাল ডলতে লাগলো। গালে ঠান্ডা অনুভব করতেই মনে পড়লো হাত আইস্ক্রিম ছিলো সেই আইস্ক্রিম দিয়েই ফারদিন গাল ডলে যাচ্ছে। এতে করে আইস্ক্রিম দিয়ে ওর সাড়া মুখ মেখে ভূত হয়ে গেছে। ফাইজা হাসতে হাসতে ওর পেট ব্যাথা হয়ে গেছে। তাও হাসি থামছে না। ফারদিন অসহায় ফেস করে বসে আছে। কোনো রকম হাসি থামিয়ে ফাইজা বললো….

–শুধু মাত্র একটা ছেলে’কে ক্রাশ বলেছি বলে আমাকে থা’প্প’ড় দিয়েছেন মিস্টার অভদ্র। আবার আমি পড়ে গেছি আমাকে না উঠিয়ে হাসতেছিলেন। এইগুলা তার শাস্তি। আপনাকে দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগছে…..

বলেই আবারো মুখ চেপে হেসে দিলো। ফারদিন ফাইজার কান্ডে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। এই তো কিছুক্ষন যখন এক সাথে বের হলো তখন হাসি ছিলোনা মুখে। এখন কি সুন্দর হেসে যাচ্ছে। দেখতে বেশ মায়াবী লাগছে। বরং ভালোই লাগছে ফারদিনের। ফাইজা হাসতে হাসতে ফারদিনের অন্য হাত থেকে আইস্ক্রিম’টা ছু মে/রে নিয়ে অন্যদিকে পা বাড়ালো। যাওয়ার আগে ফারদিন’কে চোখ টিপ মে/রে গেলো। ফারদিন ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো……

–বাচ্চা’টা এই ভয়ংকর কাজ করবে ভাবতে পারছিনা….

বলেই নিজে নিজে একটু হেসে আবারো বললো…

–তুমি একদম মাখনের মতো জান। তোমাকে তো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে এইজন্যই।

মুখ না পরিস্কার করে ফাইজার পেছনে ছুটলো। ফাইজা আইস্ক্রিম খেতে খেতে সামনের বাচ্চাদের পার্কের দিকে হাটছে আর বাতাসে ওর চুল উড়ছে। কালকের কথাগুলো কিছু’তেই ওর মাথা থেকে বের হচ্ছেনা। আইস্ক্রিম’টা মুখে দিয়েই কালকের ভাবনায় ডুব দিলো….
____________________________________________
–ও কোনো দিন মা হতে পারবেনা এই কথা’টা যদি ও শুনে তাহলে কত’টা ভেঙে পড়বে ভাবতে পারছো তুমি?

হাসনাত সাহেবের কথায় নাদিয়া বেগম খানিক চিন্তা করে বললো….

–কিন্ত মেয়ে’টা যদি ভবিষ্যতে জানে তাহলে নিজেকে সামলাতে পারবেনা। তুমি বুঝতে পারছো না…..

নাদিয়া বেগমের কথা শুনে বেশ চিন্তিত ভঙ্গীতে হাসনাত সাহেব বললো….

–এই একটা কারনেই ফারদিনের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি রাজি হতে চাই’নি। শুধু ফারদিন না যেকোনো ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসলে আমি বারন করেছি সব সময়। কিন্তু ফারদিন ছেলে’টা এত পাগল যে রাজি না হয়ে উপায় রইলো না…….

তার কথা শেষ হতেই সাথে সাথে নাদিয়া বেগম বলে উঠলো….

—এই ছেলেটাকে ও আমরা ঠকাচ্ছি। ও’কে সত্যি’টা জানানো দরকার ছিলো…..

ফাইজা আর শুনতে পারেনি। সাথে সাথে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলো। ফাইজা’কে অশ্রুসিক্ত চোখে ভেতরে ঢুকতে দেখেই উনারা দুজন হকচকিয়ে ভয় পেয়ে গেলো। এই মুহূর্তে যে এই ব্যাক্তিকে এখানে আশা করেনি তা বেশ বুঝা যাচ্ছে ওদের মুখ দেখে। ফাইজা’ ভেতরে ঢুকেই ধীর পায়ে ওর মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে কান্না চে’পে বলে উঠলো…..

–আমি কোনো দিন মা হতে পারব না কেনো মা?

কথা’টা বলতেই ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। এই একটা শব্দ যে কতটা ভয়ংকর একটা মেয়ের জন্য তা বোধহয় সবাই জানে। ফাইজার প্রশ্নে তারা দুজন চোখচোখি করলো। নাদিয়া বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বেশ শান্ত কন্ঠে বললো…..

–তুই মা হতে পারবিনা। কে বললো…

মায়ের এমন প্রশ্নে ফাইজা প্রশ্নসূচক চোখে অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাঁকালো। কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো…..

–আমি নিজের কানে শুনেছি মা তোমরা বলেছো? প্লিজ আমাকে সত্যি’টা খুলে বলো। লুঁকিয়ে রেখো না মা প্লিজ……

মেয়ের কথায় তারা দুজনেই ভড়কে গেলো। তাও নিজেদের সামলে নাদিয়া বেগম ধমকের শুরু বললো….

–টেনে মা/রব এক থা’প্প’ড়। তুই ভুল শুনেছিস আমরা তো ফাইয়াজের বউয়ের কথা বলেছি। নাম’টা শুনতে এক রকম তাই তুই ভুল শুনেছিস। কে বলেছে তুই কোনোদিন মা হতে পারবিনা। আমার কত শখ জানিস আমার এই ছোট্ট মেয়ে’টা মা হবে। তার কোল জুড়ে একটা রাজপুত্র আসবে। আমি নিজের হাতে ওদের বড় করব…..

কথাগুলো বলতে নাদিয়া বেগমের বুক ফেটে যাচ্ছিলো তাও সে মেয়ে’কে সামলানোর জন্য বলে গেলো। মায়ের কথা শুনে ফাইজার মনে হলো সত্যিই ও ভুল শুনেছে। কিন্তু তাও ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা। উনাদের চোখ বলে দিচ্ছে উনারা মিথ্যা বলছে। নাদিয়া বেগম আরো কিছু কথা বলে বুঝিয়ে দিলো ফাইজা যা শুনেছে সব ভুল শুনেছে। ফাইয়াজ ফাইজার মামাতো ভাই। ওদের নাম’টা অনেক’টা এক রকম লাগে শুনতে। এই ভেবে ফাইজা ও নিজেকে বুঝ দিলো ও ভুল শুনেছে। তাও খটকা রয়েই গেছে নিজের মনে। কোন এক সত্যি লুকিয়েছে ওর আড়ালে?
____________________________________________
হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে চেনা স্পর্শ পেতেই ফাইজার ধ্যান ভাঙ্গলো। পাশ ফিরে ফারদিনের আইস্ক্রিম মাখানো মুখ’টা দেখে না চাইতেও আবারো হেসে দিলো। ফাইজার হাসি দেখে ফারদিন মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলো….

–খুব হাসি পাচ্ছে জান। একবার নিজের কাছে পাই তখন বুঝাব মজা। নাকি তুমি চাচ্ছো এই পাবলিক প্লেসেই তোমাকে..

বলে ওর দিকে একটু ঝুঁকলো। ফারদিনে এহেতুক কথায় ফাইজার হাসি থেমে গেলো। এই ছেলে’টাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যা খুশি করে দিতে পারে। তাই ফাইজা থেমে কপট রাগী ফেস করে নিজের ওড়না দিয়ে ফারদিনের মুখ পরিস্কার করে দিতে দিতে বললো…..

–এইভাবেই সুন্দর লাগছিলো আইস্ফার ভূত…

আইস্ফা এমন অদ্ভুত নামের অর্থ ফারদিন বুঝতে না পেরে কপাল কুচকে প্রশ্ন করে বসলো…

–আইস্ফার ভূত এর মানে কি.??

ফাইজা হেসে উওর দিলো….

–আইক্রিমের আইস আর ফারদিনের ফার এর সাথে ভূত। সব মিলিয়ে আইস্ফার ভূত। সুন্দর না নাম’টা মিস্টার…..

বলেই হেসে সামনে এগিয়ে গেলো। আর ফারদিন ভ্যাবলাকান্তের মতো বড় বড় চোখে তাঁকিয়ে আছে ফাইজার যাওয়ার দিকে। কি আজব নাম? ভাবতে পারছেনা। এই মেয়ে’টার মাথায় কখন কি চলে আর বুঝে উঠতে পারেনা ও? বলেই ফোস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ফাইজার পাশে গিয়ে হাটতে হাটতে ওর হাত আকড়ে ধরলো। আজকে সারাদিন দুজন এক সাথে কাটাবে? যতই ফাইজা হাসি খুশি থাকুক একটা প্রশ্ন ওকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ফারদিনের পাশাপাশি হাটতে হাটতে নিজের পেটের উপর হাত রেখে মনে মনে বলতে লাগলো……

–এইখানে আমার দেহের ভেতর কোনো অস্তিত্ব কি কোনোদিন বেড়ে উঠবেনা। আমি কি সত্যি’ই কোনো দিন মা হতে পারব না। নাকি আমি ভুল শুনেছি?
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনিশ

নিজের বাবার আর খালা’কে উল্টো করে ফুটন্ত পানির উপর ঝুলিয়ে রেখেছে ফারদিন। ফাইজা পাশের চেয়ারে এখনো হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ে চেয়ে সব’টা দেখছে। কাল পার্কে ঘুরে রাতে বাসায় কাছে নামিয়ে ফারদিন চলে যেতেই এক দল লোক ও’কে তুলে নিয়ে আসে এখানে। তারপর থেকে ওর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুললো তখন এই দুজন’কে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে ওর আত্মা কেঁপে উঠলো। তার পাশেই ফারদিন চেয়ারে হেলান দিয়ে গান’টা কপালের সাথে ঠেঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সব পরিবেশ কিছু বুঝতে না পেরে ফাইজা চুপ করে বসে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছে। রেজওয়ান আর কাকনের হাত পা বাঁধা আর মুখে টেপ লাগানো বলে ওরা কোনো শব্দ করতে পারছেনা। ফারদিনের দুই পাশেই দুইজন গার্ড দাড়িয়ে আছে। ফারদিন কিছুক্ষন থম মে/রে বসে থেকে শান্ত হয়ে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফাইজার সামনে এগিয়ে এসে ওর দুই গালে হাত রাখলো। ওর হাতে গান’ থাকায় ফাইজা কিছু’টা ভয় পেলো। ফারদিন বুঝতে পেরে অভয় বানী দিয়ে বললো…..

–আর ইউ ও’কে জান? কোথায় লেগেছে? কোথায় কষ্ট দিয়েছে ওরা? বলো আমাকে?

ফারদিনের চিন্তিত স্বর শুনে ফাইজা একটা ঢোক গিয়ে ফারদিনের কপালে নিজের কপাল ঠেঁকিয়ে বলে উঠলো….

–আমি জানতাম আপনি থাকতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। দেখুন আমি একদম সুস্থ আছি। ঠিক আছি।

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন একটু হেসে ওর কপালে আদুরে স্বরে ঠোঁট ছোঁয়ালো। কাল যখন শুনেছিলো ফাইজা কিডন্যাপ হয়েছে তখন ওর মনে হচ্ছিলো কেউ ও’র গলা চে’পে ধরেছিলো। দম নিতে পারছিলোনা। এইসব কে করেছে সব জেনেও ফাইজা’কে খুঁজে পেতে পেতে সারা রাত কেটে গেলো। সকালে যখন এখানে এসেছিলো তখন ফাইজা সেন্সলেস অবস্থায় ছিলো। আর ফারদিনের লোকেরা কাকন আর রেজওয়ান’কে ফারদিনের কথামতো এইভাবে রেখে দিয়েছে৷ সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে যে রেজওয়ান আর কাকন কিছু বুঝেই উঠতে পারেনি। ফাইজা’র হাত পা দুটোর বাঁধন খুলে দিয়ে ও’কে একটু জড়িয়ে ধরে ঠিক ভাবে ওড়না’টা গায়ে প্যাঁচিয়ে দিলো। তারপর ওর লোক’দের ইশারা করতেই ওরা রেজওয়ান আর কাকন’কে নামিয়ে আনলো। ওদের দুজন’কে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাত পা বেধে দিলো। ফারদিন একটা চেয়ার টেনে ওদের মুখোমুখি বসে সামনের একটা টেবিলের উপর পা তুলে বসলো। গান’টা টেবিলের সাথে লাগিয়ে ধরে আছে। রেজওয়ান আর কাকন ওর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাঁকিয়ে আছে। ফারদিন ওদের দিকে তাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠলো….

–কি ভেবেছিলেন? আমার প্রথম ভালোবাসা আমার মায়ের মতো আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা’টা ও কেড়ে নিবেন। আমাকে নিঃস্ব করে দিবেন। হাউ ফানি ম্যান…..

বলেই হাহা করে হেসে দিলো। ফাইজা প্রশ্নওর চোখে তাঁকিয়ে সব’টা দেখছে। ফারদিন একটু থেমে শান্ত স্বরে ফাইজার দিকে না তাঁকিয়েই বলতে লাগলো….

–আমি যখন সাত বছরের একটা বাচ্চা। তখন চোখের সামনে প্রতিদিন বাবা-মা’কে ঝগড়া করতে দেখতাম। প্রতিদিন রাতে ড্রিংকস করে বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে ঝগড়া করে মা’কে মা/রধর করা ছিলো বাবার নিত্যদিনের রুটিন। আমি দরজার আড়াল থেকে লুঁকিয়ে দেখতাম। আর চাপা আতৎনাদ করতাম। কি, বা বুঝতাম? শুধু মায়ের কান্না দেখে বুঝতাম মা খুব কষ্টে আছে। আমার মা সব’টা মেনেও কোনো শব্দ করতো না। বাবার অফিসের যত সুন্দরী মেয়ে ছিলো তাদের সবাই’কে টাকার লোভ দেখিয়ে বাবা বাড়ি নিয়ে এসে ভোগ করতো। তাও আমার মায়ের চোখের সামনে। মা’কে রুমের এক কোনে বেঁধে রেখে মায়ের সামনেই অন্য মেয়ে’র সাথে দিনের পর দিন রাত কাটিয়েছে এই লোক’টা। পাঁচ বছর থেকেই আমাকে একা অন্য রুমে কা’টাতে হতো। কত রাত কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি হিসেব নেই। টাকা পয়সার অভাব ছিলোনা। বিশাল বাড়ি সম্পত্তি কিছুর অভাব ছিলোনা। অভাব ছিলো ভালোবাসা আর শান্তির। আর এইযে এই মহিলা’টা(কাকনের দিকে ইশারা করে) ইনি আমার আপন খালা। আমার মায়ের আপন রক্তের বোন। আমি শুনেছিলাম খালা হলো দ্বিতীয় মা। কিন্তু এই মহিলা’টার থেকে জঘন্য মহিলা আমি কোনোদিন দেখি’নি। যে নিজের আপন বোনের স্বামীর সাথে পরকিয়া করে গেছে দিনের পর দিন। অন্য মেয়ের সঙ্গ পেয়ে আমার বাবা আমার মা’কে যেই নির্যাতন করতো। সেগুলো দেখে ওই সাত বছরের বাচ্চা’টা আমি’র মনে আস্তে আস্তে মেয়েদের নিয়ে ক্ষোভ ঘৃনা জমতে শুরু করেছিলো। আমি প্রতিদিন আড়ালে লুঁকিয়ে মায়ের কান্না দেখতাম। মায়ের শরীরে আঘাতের ক্ষত গুলো আমার থেকে লুঁকিয়ে রাখার জন্য মা বড় বড় পোষাক পড়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক রাত মা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতো। আমি চেয়ে চেয়ে বোবার মতো মায়ের কান্না দেখতাম। বাবা নামক মানুষ’টার থেকে কোনো দিন আমি আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কিছু পাই’নি। বরং পেয়েছি অবহেলা। যেদিন মা জানলো তার বোন তার সংসার ভাঙ্গছে সেদিন মা বড় হয়েও ছোট বোনের পা জড়িয়ে নিজের স্বামী আর সংসার ভিক্ষা চেয়েছিলো। কিন্তু ওরা আমার মা’কে ভিক্ষা দেয়’নি। বাবার সাথে তর্ক করার সময় বাবা মা’কে বেল্ট দিয়ে আ’ঘাত করে র’ক্তা’ক্ত করেছিলো। মা তারপরের দুইদিন তীব্র জ্বর আর ব্যাথায় ছটফট করেছিলো কিন্তু জঘন্য লোক’টা ফিরেও তাঁকায়’নি।
বাড়ির কাজের আন্টি মা’কে ওষুধ দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যেতো। ওই কাজের আন্টি’টাকেও আমার বাবা ভোগ করেছে বহুবার। লোক লজ্জার ভয়ে সে কোনোদিন মুখ খুলতে পারে’নি। তার চোখে আমি অসহায়ত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম৷ নভেম্বরের ১২ তারিখ আমার জীবনে কাল রাত্রী হয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি’নি। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আর এই মহিলা’টা ড্রিংকস করে একসাথে আমাদের বাড়ি ফিরেছিলো। রুমে যেতেই মা ওদের দেখে প্রতিবাদ করা শুরু করে। রেগে গিয়ে এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। আমি তখন ওই রুমের বেলকনি’তে বসে বসে খেলছিলাম। চেঁচামেচি শুনে দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি ওরা তিনজন কিছু নিয়ে চেঁচামেচি করছিলো। ওই টুকু আমি বুঝিনি এতসব কিছু। এই মহিলা’টাকে থা’প্প’ড় মা/রায় বাবা রেগে মায়ের চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে জোরে বারি মা/রতেই মায়ের মাটা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। মা চিৎকার করে নিচে পড়ে যেতে’ই এই মহিলা’টা গিয়ে মা’কে একাধারে হিল জুতো দিয়ে লা/থি মা/রা শুরু করে। মা যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। দৃশ্য’টা সহ্য করতে না পেরে জোরে চেঁচিয়ে গিয়ে মাকে ঝাপটে ধরেছিলাম। কিন্তু ওরা আমার মায়ের থেকে আমাকে টেনে ছাড়িয়ে নিলো। বার বার কান্না করতে করতে বলছিলাম” বাবা মায়ের কষ্ট হচ্ছে। মা’কে মে/রো না। মা ম/রে যাবে। বাবা মা/কে খালামনি মা/রছে কেনো? তুমি একটু থামাও? “কিন্তু না এই নির্দয় মানুষ দুটো আমার কথা শুনলো না। বাবা আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে নিয়ে আসার সময় মা আহত অবস্থায় বাবার পা জড়িয়ে ধরেছিলো। বাবা মা’কে সেই অবস্থায় লা/থি মে/রে দূরে সরিয়ে দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে অব্দি দেখলাম যে এই মহিলা মায়ের তল পেটে এমন ভাবে লা/থি মে/রেছে যে মা একটা চিৎকার করে শান্ত হয়ে গেলো। আর শব্দ পাইনি মায়ের। ছটফটানি থেমে গিয়েছিলো মায়ের। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছিলো “তোর মা আর বেঁচে নেই ফারদিন। চলে গেছে দূর আকাশের তারা হয়ে” বাবা আমার হাত ধরে টেনে পাশেফ রুমে এনে আমার হাত পা এমন’কি মুখ বেঁধে দরজা আটকে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সেদিন বদ্ধ ঘরে এক অসহায় মা আর তার ছেলের চিৎকার কেউ শুনে’নি। চলে গিয়েছিলো তখনি আমার মা আমাকে ছেড়ে বহু দূরে। আমার থেকে খুব জঘন্য ভাবে আমার মা’কে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মায়ের শেষ চিৎকার আমি এখনো শুনতে পাই……

বলেই ফারদিন হাটু ভেঙে ফাইজার সামনে বসে পড়লো। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা বইছে। কথা গুলো বলতে বলতেই ফারদিন ফাইজার সামনে এসেছিলো। এইটুকু বলেই আর বলতে পারলো না। হাটু ভেঙে ফাইজার বুকে মাথা রেখে জোরে কান্না করে উঠলো। ছেলেরা এমন করে কাঁদতে পারে বুঝি?

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here