ঘাসফুল পর্ব ৫

ঘাস ফড়িং (৫ম পর্ব)
——–
কনুইও খানিক থেঁতলে গেছে। আঙুল আর কনুই বাঁধা দরকার। কি দিয়ে বাঁধবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ মনে হলো তার পরনের সাদা সেন্টু গেঞ্জি টেনে ছিঁড়তে পারলেই হয়ে যেত। কিন্তু কীভাবে ছিঁড়বে?
টেনে-টুনে কোনোভাবেই ছিঁড়তে পারছে না৷ দাত দিয়েও না। হঠাৎ মাথায় আইডিয়া আসে একটা পাথরের উপর গেঞ্জি রেখে অন্য পাথর দিয়ে আঘাত করলে ছিদ্র হয়ে যাবে৷ তখন আঙুল ঢুকিয়ে টেনে ছেঁড়া সম্ভব৷ বুদ্ধিতে কাজ হলো বটে। নীলাভ গেঞ্জির এক অংশ ছোট করে ছিঁড়ে আঙুলে শক্ত করে বাঁধে। যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরে মিনু।
তারপর আরেকটা অংশ দিয়ে শক্ত করে কনুই বেঁধে দেয়। কিন্তু বাঁধার পর সমস্যাটা হলো মিনু আর হাত ভাজ করতে পারছিল না। এতোক্ষণে অন্যরাও চলে এসেছে। সবাই তাকে টেনে-টুনে দাঁড় করায়।
দাঁড়াতে গিয়ে মিনু বুঝতে পারে কেবল কনুই আর পায়ে আঘাত পায়নি।
পাথরে পড়ে পেছন এবং পিঠেও প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। সবাই তাকে ধরাধরি করে নিয়ে নৌকায় বসায়। নৌকা তাদেরকে রাস্তায় দিয়ে আসে। বৃষ্টি মিনুকে ধরে গাড়িতে নিয়ে যাবার সময় ফিসফিস করে বলল,
— ‘বাহ, ছেলেটাকে পটিয়ে ফেললি রে মিনু। সিনেমার নায়কের মতো কেমন গেঞ্জি ছিঁড়ে বেঁধে দিল দেখলি?’
মিনুর প্রচন্ড রাগ হলেও কোনো কথা বলল না। অভিমানে কিংবা রাগে বৃষ্টিকে পাশে বসার কথাও বলল না। বৃষ্টি তাকে বাসে তুলে দিয়ে কাপড় চেঞ্জ করতে চলে গেল। মিনু সীট ধরে ধরে এগুচ্ছে। তার সীট পেছন দিকে। তাকিয়ে দেখে গাড়িতে কেবল ওই ছেলেটিই বসা। বাকি সবাই ভেজা কাপড় চেঞ্জ করতে চলে গেছে৷ তার জন্য ছেলেটির পানিতে নামা হলো না। মিনু পাশে বসার আগেই দেখল ছেলেটি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে।
মিনু খানিক ইতস্তত করে। ছেলেটি এবার বলেই ফেলল,
— ‘সে কি আপনি চেঞ্জ করলেন না? আপনার পেছন তো ভেজা। এভাবেই বসবেন না-কি?’
মিনুর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। হ্যান্ডসাম ছেলেদের তার এমনিতেই বেশি লজ্জা লাগে। আমতা আমতা করে বলল,
— ‘আসলে আমি এক্সট্রা কোনো কাপড় আনিনি। পানিতেও নামতে চাইনি। পা একটু ভেজাতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেলাম।’
— ‘ঠিকাছে ঠিকাছে। ড্রেসের পেছন দিক একটু চিপা দিয়ে ঝেরেঝুড়ে বসুন।’
মিনু হাত ভাজ করতে পারছিল না। এদিকে সীট না ধরে যেন দাঁড়াতেই পাড়ছে না। শরীর ব্যথা করছে৷ লজ্জা ব্যথা একসাথে মিলেমিশে শরীর কাঁপছে।
কালো ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন অহংকারী চেহারার ছেলেটি কিছু একটা বলল। মিনু যেন বুঝতেই পারল না। ছেলেটি আবার বলল,
— ‘আমি কি চিপে দেব?’
— ‘আ-আ আপনি চিপে দিবেন?’
— ‘হ্যাঁ, লজ্জার কি আছে? অসুস্থ হলে এসব মানিয়ে নিতে হয়। মনে করেন আমি এখন ডাক্তার।’
মিনু কিছু বলার আগেই দেখল ছেলেটি পেছনের ড্রেস চিপে ঝেড়েঝুড়ে বলল,
— ‘এবার বসুন।’
মিনু চুপচাপ বসে গেল। শরীর দূর্বল লাগছে। বিছানা পেলেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে গুটিশুটি খেয়ে ঘুমিয়ে যেতো। যতটুকু সম্ভব ছেলেটি থেকে সরে বসতে চাচ্ছে৷ হাত-পা কি অবস হয়ে আসছে? শরীরে যেন কোনো শক্তি নেই৷ শুধু চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে৷ সবাই ধীরে বাসে এসে উঠলো। গান ছেড়ে দিয়েছে৷ মৃদু আলোয় বাতি জ্বলছে। তাদের সীট আবছা অন্ধকারে। মিনুর মনে হলো কেউ কিছু বলছে। হ্যাঁ ছেলেটি। মিনু দূর্বল গলায় বলল,
— ‘আমাকে কিছু বলছেন?’
— ‘হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।’
— ‘কি?’
— ‘চাইলে আমার দিকে আরেকটু সরে আসতে পারেন। অথবা জানালার পাশে বসুন। ঘুম আসলেও পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না।’
মিনু কাঁপা গলায় বলল,
— ‘আপনার সমস্যা না থাকলে আমাকে জানালার পাশে দিন৷ অসুস্থ লাগছে আমার।’
মিনু দেখতে পেল ছেলেটি ‘আচ্ছা ঠিকাছে’ বলে দাঁড়িয়ে গেছে৷ সে চেষ্টা করেও যেন দাঁড়াতে পারছে না। শরীর গরম হয়ে গেছে। জ্বর আসছে কি-না কে জানে। ছেলেটি এক হাত ধরে৷ মিনু ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠে।
— ‘দাঁড়ান, আমি ধরছি।’
মিনু কোনোভাবে দাঁড়াল। ছেলেটি তাকে ধরে ধরে জানালার পাশে বসায়। তারপর কপালে হাত দিয়ে বলে,
— ‘হাত গরম হয়ে আছে। এখন দেখি কপালও। আপনার তো জ্বর আসছে।’
মিনুর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও তার মন খুবই সজাগ। অস্ফুটে বলল,
— ‘তাই মনে হচ্ছে।’
— ‘বৃষ্টি আপনার কাজিন না?’
— ‘হ্যাঁ।’
— ‘ও হচ্ছে একটা ছেলে পাগল মেয়ে৷ আপনাকে এই অবস্থায় রেখে বসে আছে তামিমের কাছে। চম্বুকের মতো ছেলেদের সাথে লেগে থাকতে পারলেই সে খুশি। আপনি যদি মরেও যান সে আজ তামিমকে ছাড়বে না। বেড়াতে আসার কারণও তামিমের পাশাপাশি বসে হাতাহাতি করা।’
মিনু কিছু বলল না। ছেলেটি আবার বলল,
— ‘আমি নীলাভ৷ আপনার নামটা যেন কী?’
— ‘মিনু।’
তারপর দু’জন নীরব। নীলাভ কানে হেডফোন গুঁজে।
খানিক বাদেই দেখে ঘুমে মিনু সামনের দিকে ঢলে পড়ছে। কপাল আলতো করে ঢেলে সীটে এনে দেয় নীলাভ। ঘুম ভেঙে যায় মিনুর। চোখ বড় বড় করে তাকায়।
— ‘সরি সরি আমি বুঝতেই পারিনি কীভাবে আপনার উপরে মাথা চলে গেল।’
— ‘আমার উপরে নয়। আপনি সামনের দিকে ঢলে পড়ছিলেন। তাই সীটে এনে দিচ্ছিলাম।’
— ‘ওহ।’
মিনু যেন খুশিই হলো। ছেলেটির উপরে মাথা না গিয়ে নরকে যাক তাও ভালো। এবার অসুস্থ শরীর নিয়ে সীটে হেলান না দিয়ে বসল। কোনোভাবেই ঘুম আসতে দেয়া যাবে না। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ বসা গেল না। পিঠ ব্যথা শুরু হলো। আবার সীটে হেলান দেয়। খানিক পর ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। বুঝতে পেরে ঝাঁকুনি দেয় মাথা। আবার হেলান ছেড়ে বসে। হঠাৎ মিনু লক্ষ্য করে ছেলেটিও ঘুমোচ্ছে। মাথা ধীরে ধীরে তার পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছে। এখন কি করবে? ডেকে দিবে? শত হলেও ছেলেটি তাকে অনেক হেল্প করেছে। মিনু ধীরে ধীরে ছেলেটির মাথা নিজের কাঁধে জায়গা করে দেয়। কান থেকে হেডফোন বের করে সীটের এক পাশে রাখে। খানিক পর রাজ্যের ঘুমে মিনুরও চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। আচমকা ঘুমের মধ্যে নীলাভের মনে হলো সে উপর থেকে কোথাও পড়ে যাচ্ছে। তখনই কেঁপে উঠে ঘুম থেকে। দেখে সে মিনুর কোলে শুয়ে আছে। আর মিনু তার পিঠে। কখন ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেই বুঝতে পারেনি৷ এখন কি করবে? উঠতে গেলেই মিনুর ঘুম ভেঙে যাবে। সে বুদ্ধি করে ধীরে ধীরে সীট থেকে নেমে গেল। আর মিনুর মাথাও ধীরে ধীরে সীটে পড়ে গেছে। সে এবার বাসের পরিবেশটা দেখে। তাদের সীট পেছনে। আবছা অন্ধকার। কেউ হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে, কেউ মোবাইল টিপছে, আবার কেউ ঘুমোচ্ছে। নীলাভ এবার মিনুর দিকে তাকায়। কেমন মায়া লাগে তার। অসুস্থ মেয়েটা আরাম করে ঘুমোতেও পারছে না। আবার বাসের সবার দিকে সতর্কভাবে তাকাল। তারপর আলগোছে মিনুর মাথা তুলে কাঁধে রাখে। তারপর এক হাত মিনুর পিঠের দিকে নিয়ে সাপের মতোন পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরে। বাসের ঝাঁকুনিতে মিনুর মাথা বারংবার কাঁধ থেকে পড়ে যাচ্ছিল। এবার বুদ্ধি করে আলগোছে মিনুর মাথা বুকের উপর আনে। বাসের ঝাঁকুনিতে মাথা যেন না নড়ে তাই মিনুর তুলতুলে গালটা আলতো করে বুকে চেপে রাখে। মিনুর শরীরে প্রচন্ড জ্বর। উষ্ণ শরীর। গরম শ্বাস-নিশ্বাস। অদ্ভুত এক রহস্যময় ভালো লাগায় নীলাভের মন যেন কানায় কানায় ভরে গেল। ধীরে ধীরে গত দিনের ক্ষ্যাত মেয়েটিকে তার মনে হলো দেখতে তো বেশ মেয়েটা। তুলতুলে গাল। গালের মাঝখানে একটা তিল। বাচ্চা বাচ্চা চেহারা। ঘুমালে বাচ্চাদের মতো নিচের ঠোঁট খানিক ভেতরের দিকে থাকে৷ এই মেয়েটাই কি তার ডায়েরিতে লেখা মায়াবতী? এই মুহূর্তে তার এই মেয়েটিকে এতো মায়া লাগছে কেন? আরেকটু শক্ত করে মেয়েটিকে কাছে টেনে আনে। গালে হাত রেখে তীব্র মায়ায় বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের নিচ ঘষে। ভেতরের অলিগলিতে কি যে ঘটে যাচ্ছে বুঝতে পারে না৷ মন কেমন করা একটা তীব্র অনুভূতি। তার ইচ্ছে করছে এই মায়াবতীর কপালে আলতো করে পবিত্র গ্রন্থের মতোন চুমু খেতে। কিন্তু ওর অজান্তে কি ঠিক হবে? ঘুমানোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে চুমু দেবার মতো অপরাধ সে করতে পারল না। চেপে রাখল তীব্র ইচ্ছেটা। কিন্তু গালে রাখা তার হাতটি পরম আদরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুখময়। কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আবার কখনও গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের নীচ আলতো করে ঘষছে। ফুলের পাপড়ির মতোন গোলাপি ঠোঁটে কি আঙুল ছোঁয়াবে? ঠোঁটেও আঙুল ছুঁয়ে দেবার ইচ্ছেটা সামলে নেয় নীলাভ। তার হঠাৎ মনে হলে মেয়েটির পা সীটে তুলে মাথা তার কোলে রাখলে আরও শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। এ যেন জগতের সমস্ত সুখ-শান্তি প্রিয় মানুষের পায়ের কাছে এনে দেবার ইচ্ছে। সে আলগোছে মিনুর মাথাটা কোলের উপর আনে৷
— চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here