চন্দ্ররঙা_প্রেম_২ পর্ব ১৯

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৯
#আর্শিয়া_সেহের

সকাল‌ থেকেই রান্নাঘরে পড়ে আছে রুমঝুম আর বিথী। তিহানের সমস্ত পছন্দের খাবার বানাচ্ছে দুজন মিলে। শান আর সাঁঝ গেছে এয়ার পোর্টে তিহানদের আনতে। বেলা দশটার মধ্যেই চলে আসবে ওরা।

রুশান আর শান্ত সোফায় বসে বসে টিভি দেখছিলো । তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তনিম। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। রুশান তনিমের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে বললো,
-“কি হয়েছে তোমার ? এমন বেহাল দশা কেমন করে হলো?”
শান্তর হঠাৎই মনে পড়লো গতকালকের সেই ইশারার কথা। খারাপ কিছু হয়েছে ভেবে যখনই মুখ খুলতে যাবে তখনি তনিম দুঃগ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো,
-“আমি একটু ঘুমাতে চাই স্যার।”

রুশান আর শান্ত দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো এমন কথা শুনে। না ঘুমানোর ফলেই তনিমের চোখ মুখের এমন অবস্থা তা বেশ টের পেলো রুশান। তনিমের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাক করে বললো,
-“ঘুমাবে পরে আগে কারন বলো। এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে? আর রাতে ঘুমাওনি কেন?”

তনিম ধপ করে সোফায় শান্তর পাশে বসে পড়লো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“আমার কর্মফল স্যার। বউকে সারপ্রাইজ দিতে গেলে যা হয় তাই হয়েছে। আপনার আর পুনমের এনগেজমেন্টের ছবিগুলো সারপ্রাইজ হিসেবে দেখাতে গিয়েছিলাম। ছবিগুলো দেখে প্রথমে কি খুশি হলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। তারপর হুট করে মুখ ফুলিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। সারারাত কত ডাকলাম কিন্তু শুনলোই না। তাই সকালে চলে এলাম আপনার এখানে একটু ঘুমাতে।”

রুশান আর শান্ত হা হা করে হেসে উঠলো। রুশান হাসতে হাসতে বললো,
-“কালই বলেছিলাম পিহুকে আগে থেকে জানাতে। এমনিতেই সে ডিপ্রেশনে ছিলো। তার উপর এমন মজা সে মেনে নিতে পারে নি।”
তনিম মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। এর মধ্যেই টেবিলে রাখা রুশানের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে পুন্যি নামটা জ্বলজ্বল করছে। রুশান‌ রিমোট রেখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যাস্ত কন্ঠে পুনম বললো,
-“তনিম ভাই কই? জানো তুমি? তোমার ওখানে আছে?”

রুশান আড়চোখে তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“না তো। তনিম এখানে এতো সকালে আসবে কেন? কি হয়েছে বলো তো? এতো উদ্বিগ্ন হয়ে আছো‌ কেন?”
পুনম এবার আরো উত্তেজিত হয়ে বললো,
-“আপু কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে উঠেছে। বারবার বলছে তার উপর রাগ করে ভাইয়া চলে গেছে। সে নাকি কি একটা শাস্তি দিয়েছিলো ভাইয়াকে।‌ সারারাত ঘরে ঢুকতে দেয়নি। কয়েকবার দরজার নিচে থেকে তাকিয়ে দেখেছে ভাইয়া আছে কি না। কিন্তু ভোরের দিকে নাকি ভাইয়াকে আর দেখেনি। তারপর থেকেই কান্নাকাটি শুরু করেছে।কেউ থামাতে পারছে না। ভাইয়ার ফোনটাও নাকি বাড়িতে।”

রুশান ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখলো খানিকক্ষণ হাঁসি থামানোর জন্য। নিজেকে সামলিয়ে তনিমের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে সোফায় হেলে থাকা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। রুশান টিভির সাউন্ড একটু কমিয়ে দিয়ে আস্তে করে পুনমকে বললো,
-“পিহু কখন গেছে তোমাদের বাড়িতে?”
পুনম অধৈর্য গলায় বললো,
-“এইতো একটু আগেই এসেছে হন্তদন্ত হয়ে। একদম পাগলপ্রায় অবস্থা। প্রিয়া আপু তো পিহুকে দেখেই দরজা আটকে দিয়েছে। পিহুর অবস্থা দেখে সেও ভয় পাচ্ছে।”

রুশান দুই আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। পেট ফেটে হাসি আসছে তার। কিন্তু এখন হাসা ঠিক হবে না। মানে এরা নিজেরাই শাস্তি দিবে আবার নিজেরাই কষ্ট পাবে। কি আজব মেয়ে জাতি। শান্ত ভ্রু কুঁচকে রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো এভাবে ঠোঁট চেপে রাখার কারন খুজতেছে।
শান্তর দিকে চোখ পড়তেই রুশান ঠোঁট ছাড়লো। পুনমকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“তুমি পিহুকে দেখো। আমি তনিমকে খুঁজে দেখছি। চিন্তা করো না। রাখছি।”
-“আচ্ছা একটু তাড়াতাড়ি খুঁজো।”

পুনম ফোন রাখতেই রুশান দমফাটা হাসিতে ফেটে পরলো।‌ তার হাসির তোড়ে তনিম ধড়পড়িয়ে উঠে বসলো। রুমঝুমও দৌড়ে এলো রান্নাঘর থেকে। বিয়ের খুশিতে ভাই পাগল‌ হয়ে যাচ্ছে কিনা এমনটাই আশঙ্কা রুমঝুমের।
রুশান খুব কষ্টে হাঁসি থামালো। একটু একটু করে পুনমের বলা সবটাই খুলে বললো। রুমঝুম মুচকি হেসে চলে যেতে যেতে বললো,
-“এটাই ভালোবাসা, ছাগল।‌ তোর কপালেও এমন থাকলে বুঝবি।”
শান্ত দাঁত বের করে হেঁসে বললো,
-“আমি তো আগেই বলেছি রুশান ভাই পুনম আপুর কাছে উদুম ক্যালানি খাবে।”

তনিম মুচকি হেসে মাথা চুলকাচ্ছে সোফায় বসে। পিহু যে এখন তাকে ভালোবাসে এটা সে বোঝে। ভালো না বাসলে এভাবে কাঁদতো‌ না।
তনিম যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই উঠে বেরিয়ে গেলো। রুশান পিছু ডাকলে বললো,
-“স্যার আমি ওখানে গিয়ে ফোন দিবো। আগে ঘর সামলাই।”
রুশান হালকা হাসলো তনিমের কথায়। শান্ত এগিয়ে এসে রুশানের পাশে বসলো।‌ নিচু কন্ঠে বললো,
-“তোমাকে কিছু বলার আছে রুশান ভাইয়া।”

রুশান আপেলে কামড় বসিয়ে বললো,
-“কি বলবি বল।”
শান্ত সতর্ক ভাবে বললো,
-“ওইযে কালকের যে ছোট শয়তানটা ছিলো না?”
রুশান কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
-“ছোট শয়তান? পুনমকে যে বিয়ে করতে এসেছিলো সে?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই। ওই লোকটাকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময় সে পেছনে আরেকটা ছেলের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ইশারা করেছিলো। ছেলেটা সম্ভবত উনার চাচার ছেলে।”
রুশান সতর্ক চোখে তাকিয়ে বললো,
-“নিজে দেখেছিস ইশারা করতে?”
-“হুম নিজেই দেখেছি।”
রুশান কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“কিছু হবে নাহ। তুই এসব নিয়ে ভাবিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”

শানদের বাড়িতে আজ জমজমাট অবস্থা। সিন্থিয়া,প্রান্ত, শিরীন ,তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে এসেছে। তিহান আর অ্যামিলিয়াও চলে এসেছে বেশ খানিকটা সময় আগেই। তিহান আসার শব্দ পেয়েই বিথী উপরে চলে গিয়েছিলো। সবাই আসলে তারপর সে দেখা দেবে। বিথী হলো আজকের সারপ্রাইজ। সোফায় একদম পাশাপাশি বসে আছে সিন্থিয়া,প্রান্ত আর তিহান।‌ অ্যামিলিয়া রুমঝুমের সাথে হাতে হাতে এটা ওটা সাহায্য করছে। এতো দিন পর বন্ধুরা এক হয়েছে তাই ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দিয়েছে।

-“তিহানের বউটা তো বেশ মিষ্টি রে। এই মিষ্টি মেয়ে দেখেই দেশ ভুলে গেছিস তাই না?”
শাফিয়া আক্তারের কথা শুনে সবাই হেঁসে ফেললো।‌ তিহান উঠে এসে শাফিয়া আক্তারকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“না আন্টি,ভুলিনি। তবে এই দেশ থেকে দূরে থাকলেই ভালো থাকি।”
কথাটা জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললো তিহান। কেউ খেয়াল না করলেও প্রান্ত সেটা খেয়াল করলো। সুন্দরীদের তালিকা করলে অ্যামিলিয়ার নাম সেখানে থাকবেই। এতো রুপবতী একটা মেয়েকে পেয়েও তিহান জেরিনকে ভুলতে পারেনি। এটাই বোধহয় ভালোবাসার জোর যা না চাইলেও মনের গহীনে নিজ ইচ্ছায় থেকে যায়।

রুমঝুম ট্রে তে করে পায়েস এনে সবাইকে খেতে দিলো। আজ বহু বছর পরে চার বন্ধু একসাথে হয়েছে। একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। সিন্থিয়া তো থেকে থেকে কেঁদে উঠছে বিথীর কথা ভেবে। একবার তো অভিমানী কন্ঠে‌ বলেই ফেললো,
-“বিথীটা বড্ড স্বার্থপর। কি হতো আজ আমাদের সাথে এখানে থাকলে?”
রুমঝুমের খারাপ লাগলো বিথীকে স্বার্থপর বলায়। তাই সে মুখ খুলতে গেলেই শান থামিয়ে দিলো।‌ চোখের ইশারায় বোঝালো,
-“এখন ওদের বলতে দাও।”

রুমঝুম মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিলো তখনই কানে এলো প্রান্তর অবাক কন্ঠস্বর। সে যেন বিষ্ময়ের সপ্তম আকাশ ছুঁয়ে বললো,
-“এটা বিথীর হাতে বানানো পায়েস। আমি বাজি ধরে বলতে পারি।”
তিহান আড়চোখে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বিথীকে কোথায় পাচ্ছিস তুই? তোর মনের ভুল হবে।”
প্রান্ত নিভলো।‌ আসলেই তো।‌ বিথী‌ কোথা থেকে আসবে? সিন্থিয়া পায়েস একবার মুখে নিয়ে আর নিচ্ছে না। বিথীর হাতের পায়েস ওরা বহুবার খেয়েছে। সেই স্বাদ চিনতে এতোটা ভুল হওয়ার কথা না।
সিন্থিয়া রুমঝুমকে ডাকলো।‌ নরম স্বরে বললো,
-“এটা কে বানিয়েছে ,ঝুম? সত্যি করে বলো।”

রুমঝুম আড়চোখে শানের দিকে তাকালো।‌ শান মুচকি হেঁসে বললো,
-“তোর কি মনে হয়? কে বানিয়েছে বল তো?”
সিন্থিয়া উত্তর দিতে পারছে না। যদি বিথীর হদিস একটাবারের জন্য হলেও ও পেতো তাহলে জোর গলায় বলতো এটা বিথী বানিয়েছে। তবে এখন সেটা পারছে না।

-“আম্মু আমরাও পায়েস খাবো।”
মাহিমের কন্ঠ পেয়ে সিন্থিয়া পেছনে তাকালো। মাহিম,সিনিম,সাঁঝ আর অন্য আরেকটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়ানো। এই বাচ্চাটাকে সিন্থিয়া চিনে না। শুধু সিন্থিয়া কেন শিরীন,প্রান্ত,তিহান কেউই চিনে না। তিহান সব বাচ্চাদেরই ভিডিও কলে দেখেছে কিন্তু এই মেয়েটা কে? প্রান্ত একধ্যানে বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। বাম চোখের নিচে একটা তিল যেটা বিথীরও আছে। সবকিছু এমন কাকতালীয় কিভাবে হচ্ছে?
সিন্থিয়া বিন্দুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে রুমঝুমকে বললো,
-“ওই বাচ্চাটা কে? আগে তো দেখিনি।”
রুমঝুম আস্তে করে শুধু বললো,
-“ও বিন্দু।”

প্রান্ত শানের দিকে তাকালো। শান একমনে পায়েস খাচ্ছে। প্রান্ত সটান দাড়িয়ে শানের সামনে গিয়ে বললো,
-“এই বাচ্চা মেয়েটা কার শান? দেখ সিরিয়াস হ প্লিজ।‌ হেয়ালি না করে বল এই মেয়েটা কার?”

-“ও আমার মেয়ে, প্রান্ত।”
বহুপ্রতীক্ষিত একটি কন্ঠ হঠাৎ ধাক্কা মারলো সকলের কানে। সিন্থিয়া তাকাতে পারছে না। যদি কানের শোনাটা মিথ্যে হয়? যদি তাকালে আর দেখতে না পায় মানুষটিকে?
তিহান বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে‌। এ কোন বিথীকে দেখছে সে? বয়স যেন উপচে পড়েছে মেয়েটার। কি মলিন চেহারা। গায়ের রং আগের তুলনায় ময়লা হয়ে গেছে। চোখ ধাঁধানো লম্বা চুল গুলো আজ রুক্ষ শুষ্ক হয়ে গেছে। প্রান্তও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এটা বিথী। হাত পায়ের বল ফুরিয়ে এসেছে মেয়েটাকে দেখে। প্রান্ত ধপ করে বসে পড়লো শানের পাশে। তিহান এখনো একধ্যানে বিথীর দিকেই চেয়ে আছে।

বিথী তাকালো না তিহানের দিকে। সে চায়না তিহানের বউয়ের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু করে ফেলতে। গুটি গুটি পা ফেলে সিন্থিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালো বিথী। ক্ষীণ কন্ঠে ডেকে উঠলো,
-“সিন্থু।”
সিন্থিয়া তড়িৎ বেগে ঘুরেই জড়িয়ে ধরলো বিথীকে। চোখ মেলে তাকায়নি। আগে মেয়েটাকে অনুভব করলো। দুটো মেয়ের কান্নার শব্দে আজ সবাই চুপ হয়ে গেলো। সিন্থিয়া গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো পরিচিত ছোঁয়া পেয়ে। যে মেয়েটাকে ছাড়া ওর একটা দিন যেতো‌না সেই মেয়েটাকে ছাড়া সাতটা বছর কেটে গেছে।
সিনিম মায়ের কান্না দেখে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো।

বিথী সিন্থিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কান্নার বেগ কমে এলে বিথী সিন্থিয়াকে ছাড়ালো নিজের থেকে। এবার সিন্থিয়া বিথীর মুখশ্রী দেখলো। সাথে সাথেই আঁতকে উঠলো সে। এ কি অবস্থা মেয়েটার? মনে হচ্ছে বয়সটা যেন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। ততক্ষণে শান বিথীর সাথে কি কি হয়েছে সবটাই বলতে শুরু করে দিয়েছে।
সিন্থিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে বিথীর মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে আর শ্রবণ করছে প্রান প্রিয় বান্ধবীর ফেলে আসা গত সাত বছরের কুৎসিত,কালো আর জঘন্য এক অধ্যায়।

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here