চন্দ্ররঙা_প্রেম_২ পর্ব ২৫

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ২৫
#আর্শিয়া_সেহের

পেরিয়ে গেছে তিন‌ বসন্ত। তনিম আর পিহুর কোল আলো করে এসেছে এক ফুটফুটে রাজপুত্র। পুনম তো বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলেই ফেললো,
-“আমার মেয়ে হলে তোর ছেলের সাথে বিয়ে দিবো আপু।”
পিহু হসপিটালের বেডে শুয়ে মুচকি হাসলো বোনের কথায়। আধ ঘন্টার মধ্যেই কেবিনে ঢুকলো শান্ত। সে এখন মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। স্বপ্ন পূরণের পথে সে অবিচল। শান্ত আসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এলো উর্বিন্তা। শান্ত উর্বিন্তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাচ্চাটার দিকে তাকালো। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বললো,
-“বাবার মতো সুপার হিরো হ বেটা।”

উর্বিন্তা হেঁটে এলো শান্তর কাছে। শান্ত বাচ্চাটাকে পুনমের কোলে দিয়ে উর্বিন্তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। উর্বিন্তা মলিন মুখে তাকিয়ে শান্তর চলে যাওয়া দেখলো। শান্ত বের হয়ে গেলে পুনম হেঁসে উঠলো। উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার পিচ্চি ভাইটারে কত বছর ঘুরাইছো নাকে দড়ি দিয়ে। এবার নিজেও একটু ঘুরো ।”
উর্বিন্তা মলিন একটা হাঁসি দিলো। এগিয়ে এসে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো বাচ্চাটাকে। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে।

পুনম বাচ্চাটাকে পিহুর পাশে শুইয়ে দিলো আলগোছে। পিহু তখনও তাকিয়ে ছিলো দরজার দিকে। তনিমের কাছে শান্তর বাচ্চামি, পাগলামি মাখা ভালোবাসার গল্প অনেক শুনেছে সে। আজই ওদের দুজনকে প্রথম দেখলো। কিন্তু বুঝতে পারলো তাদের মধ্যে মান অভিমানের পালা চলছে। পিহু পুনমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ওদের মধ্যে কি কোনো সমস্যা হইছে? দেখে তো মনে হচ্ছে ওরা কেউ কাউকে চিনেই না।”

পুনম পিহুর মাথার কাছে চেয়ারে বসলো। একটু হেঁসে বললো,
-“ওই দুইটা পাগলই একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে আপু। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। তবে উর্বিন্তা ভালোবাসলেও কখনো শান্তকে প্রশ্রয় দেয় নি। ও চেয়েছে শান্তর সুন্দর একটা ক্যারিয়ার হোক আগে। তাই শান্তকে এড়িয়ে চলতো মেয়েটা। আর শান্ত? সে তো সারাক্ষণ তার উর্বিন্তাকে নিয়েই ভাবতো।
বছর তিনেক আগে উর্বিন্তা ইচ্ছে করেই অন্য কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। সেটা গার্লস কলেজ ছিলো। শান্ত অনেক বার চেষ্টা করেছিলো উর্বিন্তাকে বোঝাতে যেন সে তার সাথে একই কলেজে ভর্তি হয় কিন্তু উর্বিন্তা শোনে নি। শান্ত মেনে নেয়েছিলো সেটা। তবে সমস্যা হয় এরপর গিয়ে। শান্ত প্রতিদিন ক্লাস বাদ দিয়ে উর্বিন্তার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। উর্বিন্তাকে একনজর দেখার জন্য, তার সাথে কথা বলার জন্য পাগলামি করতো। এজন্য উর্বিন্তা নিজেকে ওর থেকে পুরোপুরি আড়াল করে চলতে শুরু করে। কিছু দিন পর শান্তর হাতে উর্বিন্তার একটা চিঠি আসে। সেখানে উর্বিন্তা স্পষ্ট ভাবে লিখে দিয়েছিলো ‘কিছু করে তারপর সামনে এসো। আগে যোগ্য হয়ে দেখাও।’
এটুকু পড়ার পর শান্ত সেখান থেকে বাড়িতে চলে আসে। পুরো দু’টো দিন নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে। আর তারপর এক অন্য শান্ত হয়ে বেরিয়ে আসে।

আগের সেই চঞ্চলতা,সেই পাগলামি, সেই ছেলেমানুষী কিছুই নেই এই শান্তর মধ্যে। একদম নতুন এক শান্তকে দেখছি সেদিন থেকে। এখন সে গম্ভীর , বদমেজাজি, একরোখা একটা ছেলে হয়ে গেছে। উর্বিন্তা সেদিনের পর থেকে শান্তকে খুব বেশি মিস করতে শুরু করে। শান্তকে আশেপাশে আর কোথাও না পেয়ে নিজেকে পাগল পাগল লাগতো তার‌। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আর শান্তর সাথে কথা বলতে পারেনি সে। শান্ত সবরকম ভাবে এড়িয়ে চলা শুরু করলো উর্বিন্তা কে। আস্তে আস্তে ক্যারিয়ারে ফোকাস করা শুরু করলো। ওকে সব ব্যাপারে সহায়তা করতো রুশান।

শেষ পর্যন্ত উর্বিন্তা সিদ্ধান্ত নিলো মেডিক্যালে পড়বে শান্তর সাথে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সেও পুরো দমে পড়া শুরু করলো আর দু’জনই ভর্তি হলো মেডিক্যাল এ। কিন্তু এতো দিনেও দুই একটা যেমন তেমন কথা ছাড়া শান্ত উর্বিন্তার সাথে কোনো কথা বলেনি।”

-“কিশোর মনে লাগা আঘাতটা হয়তো গভীর ছিলো।”
পিহুর কথা শুনে হেঁসে উঠলো পুনম। কোনো উত্তর দিলো না কথার। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তুই থাক। আমি পরে আসবো আবার। নিজের খেয়াল রাখিস।”

সময় কাটছে সময়ের মতো। উর্বিন্তা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে শান্তর থেকে। তার মনে হচ্ছে শান্ত আর তাকে ভালোবাসে না। সবটাই হয়তো তার বয়সের দোষ ছিলো। আবেগে ভেসেই হয়তো তার প্রতি এতো ভালোবাসা দেখাতো ছেলেটা । আর সেই কি না বোকার মতো সত্যিকারের ভালোবাসা ভেবেছিলো সেটাকে। উর্বিন্তা চুপচাপ বসে থাকে ক্লাসে। লেকচারে মনোযোগ দিতে পারে না, পড়াশোনাতেও মন বসাতে পারে না। সারাক্ষণ উদাস হয়ে বসে থাকে। শান্তর এতে কিছুই যায় আসে না। সে নিজের মতো ক্লাস করতে ব্যাস্ত। তার ক্যারিয়ার গড়তে হবে। কাউকে দেখানোর জন্য হলেও একটা ক্যারিয়ার গড়তে হবে।

দু’দিন ধরেই উর্বিন্তার খোঁজ নেই। কলেজে আসছে না সে। হোস্টেলেও নেই। সুন্দরী মেয়ে হওয়ায় অনেকেই খোঁজ রাখে তার। বাতাসে ভেসে এই খবরটা শান্তর কানেও পৌঁছালো। উর্বিন্তা নেই এটা শুনেও কোনো ভাবান্তর হলো না তার। ইচ্ছে মতো চলে গেছে , আবার ইচ্ছে মতোই ফেরত আসবে ভেবে নিজের কাজে মন দিলো শান্ত। পরীক্ষা কাছাকাছি থাকায় রুশানের সাথেও যোগাযোগ করার সময় হচ্ছে না শান্তর। উর্বিন্তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে শান্তর।‌ সেই সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ আর কঠিন সময় ছিলো। সেই কঠিন সময়ে শান্তকে সাহায্য করেছিলো রুশান। নিজের ভাইকে যে কথাগুলো মন খুলে বলতে পারেনি সেই কথাগুলো রুশানকে বলেছিলো শান্ত।‌ রুশান তখন পুরোদমে সাপোর্ট দিয়েছিলো শান্তকে। দিনের বেশিরভাগ সময়টা শান্তর সাথেই কানেক্টেড থাকতো সে। বিভিন্ন বুঝ দিতো। ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পেরেছিলো সে।

বিকেলের দিকে মেডিক্যাল থেকে বের হলো‌ শান্ত। হেমন্তের বিকেল হওয়ায় চারিদিকে হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। শান্ত হেলেদুলে হেঁটে চলেছে। রাস্তার এক পাশে চিল্লাচিল্লি শুনে শান্ত সেদিকে তাকালো। দশ বা এগারো বছর বয়সের একটা ছেলে আর উনিশ বা বিশ বছর বয়সের দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে খুনসুটি ঝগড়া করছে। হয়তো তারা ভাই ভাই। শান্তর মনে পড়ে গেলো নয় দশ বছর আগের কথা। শানের কাছে ম্যাথ করা, শিরীনের কাছে বকুনি খাওয়া, তার একমাত্র ভাবির ভক্ত হওয়া, ভাই ভাবির একান্ত সময়ে তাদের মাঝে ঢুকে পড়া। শেষ কথাটা মনে পড়তেই শান্তর রুশান আর পুনমের ঘরে ঢুকে পড়ার সেই দিনটার কথা মনে পড়লো। একা একাই হেঁসে উঠলো শান্ত। সেদিন ইচ্ছে করেই রুশানের ঘরে ঢুকেছিলো শান্ত। ইচ্ছে করেই হয়রান করেছিলো। তখন ছেলেমানুষী করতে ভীষণ মজা লাগতো তার। হঠাৎ করেই কেমন গম্ভীর হয়ে উঠলো সে। আজ হাসতে গেলে গালটাও ব্যাথা করে তার।

সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরলো শান্ত। রুমঝুম কিচেনে ছিলো। ডোরবেল বাজতেই এসে দরজা খুলে দিলো। ক্লান্ত মুখে শান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হাসলো। মিষ্টি গলায় বললো,
-“সোফায় বস। আমি ঠান্ডা পানি দিচ্ছি।”
শান্ত ভেতরে ঢুকে বললো,
-“লাগবে না ভাবি। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই আগে। তুমি রান্না শেষ করো।”

রুমঝুম শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো‌ ক্ষণকাল। মাঝে মাঝে বুক ফেটে কান্না আসে রুমঝুমের। এই ছেলেটার পরিবর্তন মেনে নেওয়া এখনও একদমই অসম্ভব মনে হয় তার কাছে। রুমঝুম এখনো চায়, শান্ত আগের মত ছুটে আসুক,এটা সেটা বাহানা করুক,বাড়িটা মাতিয়ে রাখুক। কিন্তু শান্ত আজ এর কোনোটাই করে না। শান্ত আজ নামের মতোই শান্ত হয়ে গেছে। ভালোবাসা তাকে শান্ত করে দিলো একেবারেই।

শান্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠেই প্রথমে গেলো সাঁঝের রুমে। বাড়িতে এসে সাঁঝের ঘরেই প্রথম যায় সে। সাঁঝ বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ড্রয়িং করছিলো। শান্তকে দেখে বিছানায় উঠে বসলো। বাচ্চাসুলভ হেঁসে বললো,
-“আসো চাচ্চু।”
শান্ত ভেতরে এসে সাঁঝের হাতে দু’টো কিটক্যাট দিলো প্রতিদিনের মতো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“খবরদার সাঁঝ মনি, আর যাই করিস এই ছোট্ট বয়সে কাউকে মন থেকে ভালোবাসিস না। শেষ হয়ে যাবি।”
এটুকু বলে শান্ত বেরিয়ে গেলো। এই কথাটা শান্ত প্রতিদিনই বলে সাঁঝকে। সাঁঝ এখন ভালো মতোই বোঝে সবকিছু। শান্ত সবার কাছে কঠোর হলেও সাঁঝের কাছে নরমই থেকে গেছে। বাচ্চা মেয়েটার উপর কোনো প্রভাব পড়ুক তা চায়না সে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাও বোঝে সবকিছু। তার চাচার কষ্ট স্পষ্ট ভেসে ওঠে তার সামনে।

অন্ধকার ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে উর্বিন্তা। জানালার এক ফাঁকা দিয়ে আসছে এক ফালি চাঁদের আলো। সেই আলোতে ঘরটা কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। গত দু’দিন ধরেই নিজেকে একা করে রেখেছে উর্বিন্তা। একাকীত্বটাকে বেশ উপভোগ করছে সে। হুট করেই দরজা খোলার শব্দ হলো। উর্বিন্তা জানে কে এসেছে তাই নড়াচড়া করলো‌ না আর। পূর্বের মতোই বসে রইলো দেয়াল ঘেঁষে।

উর্বিন্তার বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,
-“তোমার এই অবস্থা দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। কাল পরশুই তারা আসবে। নিজেকে প্রস্তুত রেখো।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আর উর্বিন্তা অন্ধকারের আড়ালে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চলবে……

(আগামী পর্বে শেষ করে দিবো। রি-চেক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here